রহস্যময় রোগ মিস্ক!
সম্প্রতি করোনাভাইরাস কেড়ে নিয়েছে নটরডেম কলেজের সতেরো বছরের এক তরতাজা যুবকের প্রাণ। রোগের নাম মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমটরি সিনড্রোম ইন চিলড্রেন, ইংরেজিতে যাকে সংক্ষেপে বলা হয় 'এমআইএস-সি' বা 'মিস্ক'। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে এ রোগে সম্ভবত এটাই প্রথম মৃত্যু। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই মিস্ক রোগের প্রাদুর্ভাব ও তা থেকে মৃত্যুর রিপোর্ট পাওয়া গেছে। মিস্ক এক ধরনের গুরুতর রোগ, যার ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি, মস্তিস্ক , ত্বক , চক্ষু ও খাদ্যপ্রণালী জুড়ে প্রদাহ দেখা দেয়। এরোগের সঠিক কারণ এখনো জানা না থাকলেও, সার্স-কোভি-২ করোনাভাইরাস সংক্রমণের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে । যদিও শিশু-কিশোর ও অল্প বয়সীদের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের তীব্রতা অনেক কম। এদের মধ্যে কিছু রোগি মিস্কের মতো গুরুতর রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
মিস্ক রোগের লক্ষণের সাথে মিল রয়েছে কাওয়াসাকি নামে এক পরিচিত এক রোগের। কাওয়াসাকি রোগে শরীর জুড়ে রক্তনালীতে প্রদাহ হয়, সঙ্গে জ্বর ও ফুসকুড়ি। কিন্তু কাওয়াসাকি রোগ সাধারণত পাঁচ বছর বা তার চেয়ে কম বয়সী শিশুদের সংক্রমিত করে। অন্যদিকে মিস্ক রোগের সাথে ‘টক্সিক শক সিন্ড্রোম’ নামে ব্যাকটেরিয়াঘটিত এক মারাত্মক রোগেরও সামঞ্জস্য রয়েছে। আবার করোনাভাইরাসজনিত সব গুরুতর রোগই কিন্তু মিস্ক নয়। কাজেই এসব রোগ থেকে মিস্ক রোগকে আলাদা করে শনাক্ত করা করা জরুরি। এ জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ছয়টি বৈশিষ্ট নির্ধারণ করে দিয়েছে—১. রোগীর বয়স বিশ বা তার কম হতে হবে; ২. তিন দিন বা তার থেকে বেশি সময় ধরে জ্বর থাকবে; ৩. শরীরের দুই বা ততোধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রভাবিত হবে। (এসব লক্ষণের মাধ্যমে চিহ্নিত করা যাবে : ফুসকুড়ি , কঞ্জাঙ্কটিভাইটিস, হাত পা ফুলে যাওয়া, নিম্ন রক্তচাপ ও শক, রক্ত জমাট বাধা, খাদ্য নালিতে সংক্রমণ যেমন ডায়রিয়া, পেটে ব্যাথা ও বমি হওয়া); ৪. শরীরে প্রদাহের সাথে সম্পর্কিত ল্যাব টেস্ট যেমন সিআরপির অস্বাভাবিক মাত্রা শনাক্ত হওয়া, ৫. সম্প্রতি করোনাভাইরাস আক্রান্ত হবার বা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া এবং ৬. প্রদাহের অন্য কোনো কারণ খুঁজে না পাওয়া ।
মিস্ক রোগ করোনাভাইরাস নয় বরং ভাইরাসের বিপরীতে রোগীর শরীরের তৈরি অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার ফল। করোনাভাইরাস সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই মিস্ক রোগ হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। সংক্রমণের কয়েক সপ্তাহ পরেও এ রোগের আবির্ভাব হতে পারে। এমনকি করোনাভাইরাস সংক্রমণে লক্ষণহীন থাকা রোগীদের ক্ষেত্রেও এ রোগ দেখা দিতে পারে। আবার নিজের অজান্তে কোনো করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে, আসার কারণেও এক পর্যায়ে এরোগ দেখা দিতে পারে। মিস্ক রোগীদের আরটি-পিসিআর এর মাধ্যমে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করলেও, সবসময় তা পজিটিভ আসবে তার নিশ্চয়তা নেই। সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি টেস্ট করলে তা পজিটিভ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও সম্পূর্ণ সুস্থ বাচ্চাদের মধ্যেও মিস্ক রোগের সম্ভাবনা রয়েছে। স্থূলকায় ও এজমা রোগীদের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অনুযায়ী তাদের অন্য নাগরিকদের চেয়ে এশিয়ানদের মধ্যে এরোগের প্রাদুর্ভাব কম। কিন্তু এশিয়াতে যথেষ্ট তথ্য প্রমানের অভাবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
মিস্ক একটি বিরল রোগ কিন্তু গুরুতর ও জীবন সংহারী। আক্রান্ত হওয়ার পর দ্রুত রোগীর অবস্থার অবনতি হতে থাকে। একের পর এক শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিশেষ করে হৃদপিণ্ড ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে। বেশিরভাগ রোগীকে আইসিঊতে চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন ঘন ঘন বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেমন এক্স রে, আল্ট্রাসোনোগ্রাফি, ইকোকার্ডিওগ্রাম ও ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে রোগীর সার্বিক অবস্থার পর্যালোচনা ও সে অনুযায়ী সহায়ক চিকিৎসা দেওয়া। সহায়ক চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে ফ্লুইড দেওয়ার মাধ্যমে রোগীর রক্তচাপ ঠিক করা, প্রদাহ বন্ধ করতে স্টেরয়েড দেওয়া, অক্সিজেন দেওয়া, ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করা, অন্যান্য জীবাণুর সংক্রমণ রোধে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া, আর ইন্ট্রাভেনাস ইমিউনোগ্লোবিউলিন (আইভিআইজি ) দিয়ে রোগীর ইমিউন সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।
বাংলাদেশে মিস্ক রোগ নিয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। রোগ শনাক্ত করতে না পারলে, তার চিকিৎসা দেওয়া কঠিন। কাজেই এ বিষয়ে চিকিৎসকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা। স্থূলকায় ও এজমা রোগাক্রান্ত শিশুদের জন্য প্রয়োজন বিশেষ সাবধানতা। আর রোগ প্রতিরোধে একটাই মন্ত্র—করোনাভাইরাসকে দূরে রাখা।
লেখক: ক্লিনিকাল মলিকুলার মাইক্রোবায়োলোজিস্ট, সিদরা মেডিসিন ও সহকারী অধ্যাপক, ওয়েল কর্নেল মেডিকেল কলেজ, দোহা, কাতার