হুমায়ুন আজাদ একবার লিখেছিলেন, প্রেমে পড়া মানে একধরনের পতন। কারণ হিসেবে তাঁর মত, মানুষ প্রেমে পড়ে, কখনো ওঠে না। বিষয়টি ঠিক না বেঠিক সেটি নিয়ে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিস্তর বিতর্ক চলতেই পারে। কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিতে শুধু প্রেমই নয়, পৃথিবীতে সবকিছুই আসলে নিচেই পড়ে। এর পেছনের কারণটি নিয়ে শত শত বছর রহস্যের ধোঁয়াজালে আটকে ছিল মানুষ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেই রহস্যের কিছু জট খোলা সম্ভব হয়েছে। তারপরও মহাকর্ষ নামের এই বলটি এখনো রয়েছে অনেক বড় ধাঁধা হয়ে
মহাবিশ্ব চারটি মৌলিক বল দিয়ে নিয়ন্ত্রিত: শক্তিশালী নিউক্লিয় বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল, বিদ্যুত্চুম্বকীয় বল এবং মহাকর্ষ বল। এদের মধ্যে সাধারণত মহাকর্ষ বলটিই দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় অনুভব করি আমরা। অথচ রহস্যময় এ বলটির মোটামুটি সঠিক ব্যাখ্যা পেতে মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়েছে কয়েক হাজার বছর।
এ নিয়ে ভাবনার শুরু প্রাচীন গ্রিসে। তখন মহাকর্ষকে ভাবা হতো বস্তুর নিজস্ব প্রকৃতি হিসেবে। সে যুগের প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন প্লেটোর ছাত্র ও বীর আলেকজান্ডারের শিক্ষক অ্যারিস্টোটল। পৃথিবী ও পানির মহাকর্ষ কীভাবে কাজ করে, সেটি ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। পৃথিবীতে সবকিছুই নিচের দিকে পড়ে। কোনো কিছু ওপরে ছুড়লে সেটিও একসময় নিচেই নেমে আসে। এসব দেখে তাঁর মনে হয়েছিল: সবকিছুই মহাবিশ্বের কেন্দ্রের (তাঁর মতে পৃথিবী) দিকে যেতে চায়। তাই পৃথিবীকেই মহাবিশ্বের কেন্দ্র ভেবেছিলেন অ্যারিস্টোটল। অবশ্য সেকালে গ্রিসের অ্যারিস্টার্কাস সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের কথা বলেছিলেন। কিন্তু অ্যারিস্টোটলের প্রভাবশালী মতবাদের কাছে সেটি নস্যির মতো উড়ে গিয়েছিল। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে ভারতের গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্ত ধারণা করলেন, মহাকর্ষ সম্ভবত চুম্বকের মতো কাজ করে। ৩০০ বছর পর ব্রহ্মগুপ্তের কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া গিয়েছিল আরবের পণ্ডিত আলবেরুনির লেখায়ও। তবে অ্যারিস্টোটলের মতবাদ বাতিল করে তাদের ধারণাটি মানার মতো কোনো যুক্তি খুঁজে পায়নি কেউ। এভাবে হাজার বছর তাঁর মতবাদই মহাপ্রতাপে রাজত্ব করেছিল।
সেই ভুল ধারণায় প্রথম ফাটল ধরিয়ে সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের কথা বলেছিলেন কোপার্নিকাস আর গ্যালিলিও। তাঁদের কথা সত্যি হলে সৌরজগতের কেন্দ্র হওয়ার কথা সূর্য। তাতে অ্যারিস্টোটলের মহাকর্ষ মডেল বাতিল হয়ে যায়। আসলে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই শুধু সহজাত কাণ্ডজ্ঞানের ওপর ভর করে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে পৃথিবীকে বসিয়েছিলেন অ্যারিস্টোটল। তাঁর যুক্তি, পৃথিবীর বদলে সূর্য মহাবিশ্বের কেন্দ্র হলে সব বস্তু বিশেষ করে ভারী বস্তু নিচে না পড়ে মহাকাশে ভেসে যেত। এমনকি ভারী বস্তু দ্রুত আর হালকা বস্তু তুলনামূলক ধীরগতিতে নিচে পড়বে বলে ভাবতেন অ্যারিস্টোটল। সেটিও বিনা বিতর্কে সবাই মেনে নিয়েছিল। তবে অ্যারিস্টোটলের এ ধারণায় প্রথম আঘাত হানেন গ্যালিলিও। তাঁর হাত ধরেই প্রথম পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের সূচনা হয়। কোনো মতবাদ সত্যি না মিথ্যা প্রমাণ করতে এর আগে কেউ পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা ভাবেনি। এ ক্ষেত্রেও সেই প্রতাপশালী অ্যারিস্টোটলীয় চিন্তার প্রভাব। অ্যারিস্টোটল ভাবতেন, কোনো কিছু জানতে বিশুদ্ধ চিন্তা আর যুক্তিই যথেষ্ট। সে জন্য কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন নেই বলেই মত ছিল তাঁর। কিন্তু অ্যারিস্টোটলকে অগ্রাহ্য করলেন গ্যালিলিও। তিনি ভাবলেন, যদি ভিন্ন ওজনের দুটি বস্তুকে (ভারী ও হালকা) একসঙ্গে বেঁধে ওপর থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে কী ঘটবে? অ্যারিস্টোটলের মত মানলে, ভারী বস্তুটি দ্রুত বেগে নিচে পড়তে চাইবে, তাতে তার গতি বাড়বে। অন্যদিকে ভারী বস্তুর তুলনায় হালকা বস্তু ধীরে পড়তে চাইবে। তাই দুই গতির মিলনে মাঝামাঝি একটা গতিতে একত্র বস্তু দুটি নিচে পড়তে চাইবে। কিন্তু দুটি বস্তুকে একত্র করায় বস্তুর মোট ওজন তো বেড়ে গেছে। তাহলে? এখন তো বস্তু দুটি আগের তুলনায় বেশি গতিতে পড়ার কথা! সে ক্ষেত্রে পুরো বিষয়টিই তো পরস্পরবিরোধী!
অ্যারিস্টোটলের কথা ঠিক নাকি বেঠিক—সেটি প্রমাণ করতে হাতে-কলমে পরীক্ষা চালালেন গ্যালিলিও। এ ব্যাপারে এক কিংবদন্তি চালু আছে। বলা হয়, তিনি নাকি ইতালির পিসার হেলানো মিনার থেকে দুটি আলাদা ওজনের বস্তু নিচে ফেলে দেখতে পেয়েছিলেন, বাতাসের বাধা উপেক্ষা করলে দুটি বস্তুই একই সময়ে নিচে পড়ে। এ ঘটনার ঐতিহাসিক ভিত্তি না থাকলেও, গ্যালিলিও সত্যিই কিছু পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল পেন্ডুলাম নিয়ে। কর্ক আর সিসা নির্মিত কিছু পেন্ডুলাম দুলিয়ে তিনি দেখলেন, তারা একই হারে দুলছে। সিসার পেন্ডুলাম কর্কের চেয়ে ১০০ গুণ ভারী ছিল। আবার একটি ঢালের ওপর বেশ কিছু বল গড়িয়েও তিনি মহাকর্ষের প্রভাব পরিমাপ করেছিলেন। পরীক্ষায় তিনি দেখলেন, কোনো বস্তুই ধ্রুব গতিতে নিচে নামে না অথচ এটিই এতকাল ভাবা হতো। বরং নিচে পতনের সময় বস্তুর গতি ক্রমেই বাড়তে থাকে। গতি বাড়ার এ হারকে পদার্থবিদ্যার পরিভাষায় বলে ত্বরণ। গ্যালিলিও দেখলেন বস্তুর পতনের গতি ধ্রুব নয়, বরং তার ত্বরণ ধ্রুব রাশি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সব পড়ন্ত বস্তুর জন্যই তিনি একই ত্বরণ পেয়েছিলেন। সেই মানটি ছিল প্রায় ৯.৮ মিটার/সেকেন্ড২। অর্থাত্ সেকেন্ডে সব ধরনের পড়ন্ত বস্তুর গতি ৯.৮ মিটার/সেকেন্ড হারে বাড়ে।
তবে মহাকর্ষের গাণিতিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি গ্যালিলিও। মানবজাতিকে সে জন্য আইজ্যাক নিউটন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তিনিই প্রথম মহাকর্ষ ব্যাখ্যায় বিজ্ঞান আর গণিতের সমন্বয় ঘটাতে পেরেছিলেন। সে জন্য অবশ্য গ্যালিলিও আর কেপলারের কাছে তিনি ঋণী। নিউটনের ভাষ্যমতে, গাছ থেকে একটি আপেল মাটিতে পড়তে (আপেলটি তাঁর মাথায় পড়েনি) দেখে তাঁর মাথায় মহাকর্ষবিষয়ক চিন্তা শুরু হয়েছিল। ১৭২৬ সালের এপ্রিলে নিউটনের বন্ধু ও তাঁর প্রথম জীবনীকার উইলিয়াম স্টুকেলির সঙ্গে দীর্ঘ আলাপে নিউটন এটি জানিয়েছিলেন। পড়ন্ত আপেল দেখে কীভাবে মহাকর্ষ চিন্তায় জড়ালেন—মৃত্যুর এক বছর আগের সেই আলাপে বর্ণনা করেছিলেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ ৮৩ বছরের নিউটন। নিউটনের ভাষ্য, পড়ন্ত আপেল তাঁর মনে প্রশ্ন জাগিয়েছিল, আপেল সব সময় খাড়াভাবে নিচের দিকেই পড়ে কেন?
এর কারণ তিনি ল্যাটিনে লিখিত তাঁর বিখ্যাত বই প্রিন্সিপিয়াতে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তবে সেখানে আপেলের বদলে তিনি ‘লিটল মুন’ বা ‘ছোট চাঁদ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি লিখেছেন, কল্পনা করা যাক, বৃহস্পতির মতো পৃথিবীরও অনেকগুলো চাঁদ আছে। অর্থাত্ বাস্তবের বড় চাঁদটি ছাড়াও অনেকগুলো ছোট চাঁদ। ধরা যাক, একটি ছোট চাঁদ পৃথিবী থেকে সর্বনিম্ন দূরত্বে (পাহাড়চূড়া থেকে একটু ওপরে) পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। তাহলে এই চাঁদটির গতিবেগ কত হবে? এ বিষয়ে কেপলার একটি সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। সেটি ব্যবহার করে দেখা যায়, পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘুরে আসতে ছোট চাঁদটির সময় লাগবে প্রায় দেড় ঘণ্টা। এখন কোনো বস্তুর গতিপথ যদি সরলরেখা না হয় এবং যদি বারবার তার দিক পাল্টে যায়—তাহলে তার ত্বরণ ঘটছে। ছোট চাঁদটি পৃথিবীর কেন্দ্র বরাবর ত্বরণপ্রাপ্ত হচ্ছে। এই ত্বরণের হার নির্ণয় করতে নিউটন অঙ্ক কষে পেয়েছিলেন ৯.৮ মিটার/সেকেন্ড২। মনে আছে নিশ্চয়ই, পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রেও গ্যালিলিও ত্বরণের ঠিক একই মান পেয়েছিলেন।
বিষয়টি কি কাকতালীয়? মোটেও না, বরং এর পেছনে কারণ খুঁজে পেয়েছিলেন নিউটন। যদি এই দুটি পরিণতি একই হয়—অর্থাত্ নিচে নামার ত্বরণ যদি ৯.৮ মিটার/সেকেন্ড২ হয়, তাহলে এ পরিণতির পেছনের কারণও নিশ্চয়ই এক। কাজেই যে বলটি ছোট চাঁদকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে বাধ্য করছে, সেটিই নিঃসন্দেহে পড়ন্ত বস্তুকেও ভূপৃষ্ঠের দিকে টানছে। যে বল বস্তুকে ভূপৃষ্ঠের দিকে টানে তাকে বলা হয় মহাকর্ষ। নিউটন বুঝতে পারলেন, ওই একই বল ছোট চাঁদকেও পৃথিবীর চারপাশে ঘোরাচ্ছে। এই বল না থাকলে ছোট চাঁদটি সরলপথে চলত। কাজেই বাস্তবে আমাদের একমাত্র চাঁদকেও ওই মহাকর্ষ বলই পৃথিবীর চারপাশে ঘোরাচ্ছে বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন নিউটন। একইভাবে বৃহস্পতির চারপাশে ঘূর্ণমান চাঁদগুলোকেও বৃহস্পতি আকর্ষণ করছে। সূর্যও তার আকর্ষণবলে গ্রহগুলোকে তার চারপাশে ঘুরতে বাধ্য করছে।
এরপর নিউটন আরও এক ধাপ এগিয়ে সর্বজনীন মহাকর্ষের প্রস্তাব করলেন। তাঁর মতে, এই আকর্ষণ বল ছাড়া প্রতিটি মহাজাগতিক বস্তু সরলপথে চলত। কাজেই মহাবিশ্বের সবকিছুই আসলে পরস্পরকে এই বলে আকর্ষণ করছে। নিঃসন্দেহে সর্বজনীন একটি বল বা মহাকর্ষও আছে, যার কারণে প্রতিটি বস্তু অন্য সব বস্তুকে আকর্ষণ করছে। নিউটনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মহাকর্ষ বল বস্তুগুলোর ভর ও তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের ওপর নির্ভরশীল। তাঁর মহাকর্ষ সূত্র অনুযায়ী, দুটি বস্তুর ভরের গুণফলকে তাদের দূরত্বের বর্গ দিয়ে ভাগ করে মহাকর্ষীয় ধ্রুবক বা G (৬.৬৭×১০−১১ মিটার৩. কিলোগ্রাম—১. সেকেন্ড—২) দিয়ে গুণ করলেই পাওয়া যাবে ওই দুটি বস্তুর আকর্ষণ বল। মহাকর্ষ সূত্র ও গতির তিনটি সূত্র গ্রহ ও চাঁদের গতি এবং বস্তু কেন নিচে পড়ে তার ব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সমস্যাটি হলো, মহাকর্ষের প্রভাব ও বলটি দিয়ে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা সম্ভব হলেও নিউটন নিজেই জানতেন না, এই অদ্ভুত বলটি দূর থেকে কীভাবে কাজ করে। দ্বিধান্বিত নিউটন বুঝতে পেরেছিলেন, এই আকর্ষণ বলের পেছনে কিছু একটা আছে। কিন্তু সেটা কী—সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না তাঁর। তাই তিনি প্রিন্সিপিয়াতে লিখেছিলেন, ‘...এটি বস্তুগত বা অবস্তুগত কোনো সংঘটক হতে পারে, তবে বিষয়টি পাঠকের বিবেচনার ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি আমি।’
এভাবেই মহাকর্ষ সম্পর্কে অ্যারিস্টোটলের মতবাদের কফিনে শেষ পেরেকটি গুঁজে দিয়েছিলেন নিউটন। নিউটনের আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই আবিষ্কার প্রায় তিন শতক বিশ্ব শাসন করেছিল। কিন্তু জিনিয়াসদের বৈশিষ্ট্যটাই এমন যে তাঁরা নিজেদের আবিষ্কারের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সবার আগে সচেতন হন। সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতেও দ্বিধা করেন না। তবে নিউটনের প্রশ্নটির উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও প্রায় আড়াই শ বছর। উত্তরটি দিয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। ১৯০৫ সালে এই ভদ্রলোক তিনটি গবেষণাপত্র (আসলে পেপার প্রকাশ হয়েছিল পাঁচটি, এর মধ্যে তিনটি আপেক্ষিকতা নিয়ে। এই তিনটি পেপারকে একত্রে অনেকে একটি হিসেবে বিবেচনা করেন) প্রকাশ করেছিলেন সেকালের বিখ্যাত এক জার্নালে। এই তিনটি গবেষণাপত্রের একটি পরমাণুর অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল, দ্বিতীয়টি আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত্তি (এ কারণেই তিনি ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন) আর তৃতীয়টি ছিল বিশেষ আপেক্ষিকতা নামের সম্পূর্ণ নতুন এক ধারণার অবতারণা। আপেক্ষিকতা তত্ত্বে আইনস্টাইন দেখালেন, আপাতদৃষ্টিতে স্থির রাশি বলে পরিচিত ভর, দৈর্ঘ্য আর সময় কীভাবে পর্যবেক্ষক সাপেক্ষে পাল্টে যায়। এর দুই বছর পর বার্নে নিজের অফিসে বসে ছিলেন আইনস্টাইন। ঠিক তখন তাঁর মাথায় এক চিন্তা খেলে যায়। একে পরবর্তী সময়ে তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুখী চিন্তা বলে বর্ণনা করেছেন তিনি। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘হঠাত্ একটা চিন্তা আমার মাথায় এল: কেউ যদি মুক্তভাবে পড়তে থাকে তাহলে সে আর নিজের ওজন অনুভব করবে না। এটি চিন্তা করে আমি চমকে উঠলাম। এই সরল চিন্তাটি আমার ওপর গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। এটিই আমাকে মহাকর্ষের সূত্রের দিকে নিয়ে গিয়েছিল।’
এই চিন্তা থেকে আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন, মহাকর্ষ আর ত্বরণ আসলে সমতুল্য ও অবিচ্ছেদ্য। ধরা যাক, কেউ যদি জানালাহীন কোনো নভোযানে বসে থাকে আর সে যদি আকর্ষণ বল ১ম অনুভব করে তাহলে তার সম্ভাব্য দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে। এক, ওই ব্যক্তি পৃথিবীপৃষ্ঠের কোথাও বসে আছে। অথবা লোকটি হয়তো মহাকাশে কোনো নভোযানে আছে, যার ত্বরণ ৯.৮১ মিটার/সেকেন্ড২। পৃথিবীর অভিকর্ষ বল বা মধ্যাকর্ষণ বলের কারণে পড়ন্ত বস্তু এই একই ত্বরণপ্রাপ্ত হয়। নভোযানের কোনো যন্ত্র তাই এ দুটি ঘটনার মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারবে না। এ থেকে আইনস্টাইন বুঝেছিলেন, মহাকর্ষ নিয়ে চিন্তা করা আর ত্বরণ নিয়ে চিন্তা করা পরস্পর সম্পূরক। ত্বরণ তো সহজেই বোঝা যায়। তাই তিনি ত্বরণ নিয়েই চিন্তা করতে লাগলেন। এভাবে তিনি বোঝেন, মহাকর্ষ স্থানকে বাঁকিয়ে দেয়, বিশাল আয়তনের ভারী কোনো বস্তু তার চারপাশের স্থানকে দুমড়েমুচড়ে দেয়। কাজেই সরলপথে চলমান যে কোনো কিছুই ওই ভারী বস্তুর চারপাশে বক্রপথে ঘুরতে বাধ্য হয়। গ্রহগুলোর কক্ষপথের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। আবার আলোকরশ্মিও যেকোনো মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে বেঁকে যাবে।
আইনস্টাইনের এই আবিষ্কার এখনো বিস্ময় জাগায়। তবে গ্রহগুলোর কক্ষপথে চলার পথতত্ত্বটি ব্যাখ্যা করতে পারলেও গাছ থেকে কেন আপেল পড়ে তা বলতে পারে না। সহজাতভাবে কোনো কিছুই আসলে গতিশীল হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু স্থান-কাল (বিশেষ আপেক্ষিকতা থেকে উদ্ভূত স্থান ও সময়ের মিশ্রণ) নিজেই বিশাল ভারী বস্তুর কারণে দুমড়ে যায়। এ কারণেই আসলে গতির সূচনা হয়। যে গাণিতিক কাঠামোর ওপর পুরো তত্ত্বটি দাঁড়িয়ে, সেটি অনেকের জন্যই বেশ জটিল। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ তত্ত্বের মূলনীতিটা কিন্তু যথেষ্ট সরল। এভাবেই নিউটনের তত্ত্বটিকে একটি কাঠামো দিতে পেরেছিলেন আইনস্টাইন। অর্থাত্ মহাকর্ষ নামক কার্যের জন্য একটি যুক্তিযুক্ত কারণ দিতে পেরেছিলেন তিনি। সাধারণ আপেক্ষিকতার মাধ্যমে এমন কিছু আগাম অনুমান করা হয়েছিল, যেগুলো নিউটনের চেনা পরিচিত মহাবিশ্ব থেকে কিছুটা আলাদা (যেমন ভারী বস্তুর প্রভাবে আলোর বক্রপথ)। তাই সেগুলোর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। তবে একাধিক পরীক্ষা ভালোভাবে উতরে গিয়ে তত্ত্বটি সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছিল। তাতে রাতারাতি সুপারস্টারে পরিণত হয়েছিলেন আইনস্টাইন।
এসব সাফল্যের কারণে একদা মনে হয়েছিল, আইনস্টাইনের এ তত্ত্বের পর মহাকর্ষ সম্পর্কে সবটা জানা হয়ে গেছে। কারণ তত্ত্বটি ব্যবহার করে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব থেকে শুরু করে সময়ের সঙ্গে মহাবিশ্বের বিবর্তন পর্যন্ত সবই অনুমান করা যাচ্ছিল। কিন্তু আমাদের জানায় কোথাও বিশাল এক শূন্যতা আছে। প্রকৃতির অন্য তিনটি বল কোয়ান্টায়িত। অর্থাত্ এ বলগুলো অবিচ্ছিন্ন নয়, বরং শস্যদানার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুচ্ছের মতো, যাদের বলা হয় কোয়ান্টা। তাই অনেক দিন ধরেই ধারণা করা হচ্ছে, মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্ব নামের একটি তত্ত্ব অবশ্যই থাকা উচিত। কিন্তু শত বছরের শত সংগ্রামের পরও এখনো তেমন কোনো তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। একসময় মনে হয়েছিল, স্ট্রিং তত্ত্ব হয়তো সেই সমাধান দিতে পারবে। কিন্তু ইদানীং অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, গাণিতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এই তত্ত্বটি কখনোই কার্যকর বা দরকারি কোনো অনুমান করতে পারবে না। বরং একসময়ের আলোড়ন তোলা লুপ কোয়ান্টাম মহাকর্ষ নামের বিকল্প তত্ত্বের মতোই সবার মনে প্রত্যাশার পারদ চূড়ায় তুলে স্ট্রিং তত্ত্বও বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে।
এখন আমরা বুঝি, অতীতে মহাকর্ষ সম্পর্কে যেমনটি ভাবা হতো বলটি আসলে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। সবাই জানে, মহাকর্ষ পৃথিবীর সবকিছুকে নির্দিষ্ট স্থানে ধরে রাখে। শুধু তা-ই নয়, এর কারণেই ধুলা ও গ্যাসের ঘূর্ণমান মেঘ একত্র হয়ে একদা সৌরজগত্ সৃষ্টি হয়েছিল। মহাকাশ গবেষণায় দেখা গেছে, জীবের জন্যও মহাকর্ষ গুরুত্বপূর্ণ। মহাকর্ষহীন স্থানে গাছকে বেড়ে উঠতে বেশ সংগ্রাম করতে হয়। পাখির ডিম পাড়া থেকে শুরু করে ডিমের পরস্ফুিটনের জন্যও মহাকর্ষ দরকার। আর নিম্ন মহাকর্ষ পরিবেশে মানুষের জন্য বেশ সমস্যাজনক। এতে তার হাড়ের ঘনত্ব কমে যায় এবং মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে অতি প্রয়োজনীয় এই মহাকর্ষের অনেক কিছুই এখনো আমাদের অজানা। যেমন অন্যান্য সব বলের চেয়ে মহাকর্ষ দুর্বল বল। কিন্তু এখনো কারণটা অজানা। আবার অনেক চেষ্টায়ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গেও এ বলটিকে কোনোভাবেই গাঁটছড়া বাঁধা যায়নি। তবে কিছুটা আশার কথা যে এই মৌলিক বলটি এখন আর অতীতকালের মতো রহস্যময় নয়। অবশ্য এই রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য নিউটন আর আইনস্টাইনের মতো কয়েকজন পথিকৃেক কৃতজ্ঞতা জানাতেই হবে।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: দ্য নেচার অব গ্র্যাভিটি/ ব্রায়ান ক্লেগ
রিয়েলিটি ইজ নট হোয়াট ইট সিমস/কার্লো রোভেল্লি
*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত