জিনোমের অন্তরালে
ডিএনএ, আরএনএ এবং প্রোটিনবিষয়ক অনুসন্ধান চিকিৎসাবিদ্যাকে এগিয়ে নিচ্ছে ক্যানসারের রহস্য সমাধানের পথে। যদিও এ পথে যাত্রার মাত্র শুরু, কিন্তু বিশ্বের নানা প্রান্তে গবেষকেরা কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর। তাঁদের সামগ্রিক চেষ্টাতেই সফলতা আসবে একদিন। ক্যানসারের বিরুদ্ধে এ লড়াইয়ে বাংলাদেশি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক সজীব চক্রবর্তী কাজ করছেন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। বিশ্বদরবারে করছেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব। সম্প্রতি নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে চক্রবর্তীসহ বিশ্বসেরা ক্যানসার গবেষকদের বক্তব্য। সেটারই চুম্বক অংশ রূপান্তর করা হলো বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য।
বর্তমান ক্যানসার গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব এসেছে জিনোমিকসের হাত ধরে। আক্রান্ত টিস্যু বা অঙ্গের ওপর নির্ভর করে ক্যানসারকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। আবার রোগটির জন্য দায়ী বিশেষ জিনগত পরিবর্তন বা মিউটেশনের ওপর ভিত্তি করে অনেকগুলো উপশ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যদিও ক্যানসার নিরাময়ে এর প্রভাব আশানুরূপ ফল দিয়েছে কি না, তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিস্টেম বায়োলজিস্ট আন্দ্রেয়া ক্যালিফানো বলেন, ‘মাত্র ৫-১০ শতাংশ ক্যানসার রোগী জেনেটিক্যাল চিকিৎসাপদ্ধতি ব্যবহার করে সুফল পেয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগেরই পরে ক্যানসারের লক্ষণগুলো ফিরে এসেছে। এ পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা খুবই কম।’
একটি বিশেষ জিনগত বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার এবং বাস্তবায়ন করা সহজ কাজ নয়। ক্যানসারের ক্ষেত্রে কোন জিনগত পরিবর্তন ক্যানসারের জন্য দায়ী আর দায়ী নয়, তা শনাক্ত করা কঠিন। যদিও গবেষকেরা বিশেষ চিকিৎসাপদ্ধতি তৈরির জন্য বিভিন্ন অনকোজিনের (ক্যানসারের জন্য দায়ী জিন) ড্রাইভার মিউটেশনের ওপর গুরুত্ব দেন। কিন্তু তা ছাড়া আরও অনেক জিন রয়েছে, যেগুলো ক্যানসারের বিস্তারে ভূমিকা রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানসার গবেষক বার্ট ভোগেলস্টেইন বলেন, ‘ক্যানসারের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ জিনগত পরিবর্তন অনকোজিনে নয় বরং টিউমার তৈরিতে বাধাদানকারী টিউমার সাপ্রেসর জিনে ঘটে।’
জিনগত এসব পরিবর্তন টিউমার সাপ্রেসর জিনকে অকার্যকর করে। অথচ এই জিনগুলো আমাদের ক্যানসারের হাত থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। যেমন যেসব জিন ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ সংশোধন করে অথবা যেসব জিন কোষের মৃত্যু (অ্যাপোটোসিস) নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক ক্ষেত্রে ক্যানসার কোষে এসব ত্রুটিপূর্ণ জিন থেকে তৈরি প্রোটিন পাওয়া যায় না, তাই এগুলো নিয়ে গবেষণা করা কঠিন। ভোগেলস্টেইন আরও বলেন, ‘যদি কোষে প্রোটিন না থাকে, তবে এর বিরুদ্ধে কোনো ওষুধ ব্যবহার করা সম্ভব নয়।’
টিউমারের বিভিন্ন কোষে বিভিন্ন রকমের মিউটেশন হয়। এ কারণে অনেক সময় চিকিৎসার পরও ক্যানসার আবার ফিরে আসে। ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়নবিদ টামার গেইগার বলেন, ‘কোনো ক্যানসারের একটি টিউমার একাধিক ক্লোন দিয়ে তৈরি।’ ক্লোন হচ্ছে, একই ধরনের মিউটেশন বহনকারী একগুচ্ছ কোষ। গেইগার আরও বলেন, ‘এসব কোষের অল্প কিছুর বিপক্ষেও যদি চিকিৎসাপদ্ধতি কাজ না করে, তবে এগুলো সম্পূর্ণ টিউমার দখল করে নেয়, ফলে ক্যানসারের পুনরাবৃত্তি ঘটে।’
এসব সীমাবদ্ধতার জন্য ক্যানসার জিনোমিক প্রতিলিপির বাইরেও চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছেন গবেষকেরা। তাই জিনের এপিজেনেটিক মেকানিজম নিয়েও চলছে গবেষণা। এপিজেনেটিক মেকানিজম হলো পরিবেশ ও অভিযোজন দ্বারা প্রভাবিত একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতি জেনেটিক কোড পরিবর্তন না করেই জিনের প্রকৃতি পরিবর্তন করতে পারে। এটা টিউমার তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। সিকোয়েন্সিং টেকনোলজি এখন অনেক উন্নত। আরএনএ সিকোয়েন্সিং ব্যবহার করে গবেষকেরা জিন থেকে তৈরি করা আরএনএ পরিমাপ করেন। তারপর এর সাহায্যে জিনের চলমান এপিজেনেটিক অবস্থা বুঝতে পারেন। এ ছাড়া সাম্প্রতিক অগ্রগতি গবেষকদের জিন থেকে তৈরি প্রোটিন নিয়ে গবেষণা সহজ করে দিয়েছে। তাই সহজেই ক্যানসার কোষের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের একটি চিত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
২০০৬ সালে ইউএস ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট (এনসিআই) এবং ন্যাশনাল হিউম্যান জিনোম রিসার্চ ইনস্টিটিউট দ্য ক্যানসার জিনোম অ্যাটলাস (টিসিজিএ) নামে একটি প্রোগ্রাম শুরু করে। এর মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৩৩ রকম ক্যানসারের ২০ হাজারেরও বেশি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সেসব নমুনার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা হয়েছে, যেমন, এপিজিনোম, আরএনএ ও প্রোটিন। এগুলো প্রতিটিই বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা ‘অমিকস’-এর অংশ। অমিকসের এসব শাখার তথ্য ব্যবহার করে গবেষকেরা ক্যানসার শনাক্ত এবং চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণা পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেমন, টিউমার সাপ্রেসর জিনের মিউটেশনগুলোকে সরাসরি প্রতিহত করা কঠিন। তবে এসব মিউটেশনের ফলে কোষে যে কার্যক্রমগুলো শুরু হয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ভোগেলস্টেইন বলেন, ‘যদি আমরা কোনো টিউমার সাপ্রেসর জিনের গতিবিধি সম্পর্কে জানতে পারি, তবেই আমরা এর পরবর্তী ধাপগুলো সম্পর্কে জানতে পারব।’
বিভিন্ন জৈবিক উপাদানের মধ্যকার সম্পৃক্ততা বিশ্লেষণ করে শারীরিক কার্যক্রম পরিচালনায় এগুলোর ভূমিকার কথা জানা সম্ভব। সম্ভব এর সাহায্যে বিভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতি তৈরি উদ্ভাবন করা। এসব পদ্ধতি হয়তো একাধিক মিউটেশনের বিরুদ্ধে একই সময়ে একই সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম। প্রোটিনের বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, কেন কিছু চিকিৎসাপদ্ধতি সব মানুষের জন্য কার্যকর নয়? তবে সবচেয়ে কার্যকর গবেষণা হচ্ছে অমিক্সের বিভিন্ন শাখাকে একত্র করে ক্যানসার কোষের একটি সম্পূর্ণ চিত্র তৈরি করা। আশা করা যায়, এর সাহায্যে ক্যানসারের বৈচিত্র্য এবং গতিশীলতা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।
একই সূত্রে গাঁথা
আরএনএর তথ্য এবং কম্পিউটেশনাল মডেলিং পদ্ধতি ব্যবহার করে কীভাবে জিনগত বৈশিষ্ট্য প্রোটিনকে প্রভাবিত করা যায়। এর সাহায্যে একটি সাধারণ কোষকে ক্যানসার কোষে রূপান্তরিত করে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছেন ক্যালিফানো। তিনি বলেন, ‘ডিএনএ হলো আমাদের জিনগত ফলাফলের পূর্বাভাস, আরএনএ হলো তার প্রতিচ্ছবি। এটা আমাদের কোষের কার্যক্রমের একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলে।’
তিনি এ ধারণাটিকে ‘টিউমার চেকপয়েন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এমনকি একই ধরনের ক্যানসারের মধ্যেই অনেক বৈচিত্র্য আছে। অনেক সময় দেখা যায়, একই ক্যানসারের দুটি উপশ্রেণির মধ্যে মাত্র একটি মিউটেশনের মিল রয়েছে। একাধিক মিউটেশন একই ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে পারে। তার মানে, এগুলো একই ধরনের প্রোটিনকে প্রভাবিত করছে। এ ধারণা থেকে ক্যালিফানো তৈরি করেছেন একটি গাণিতিক অ্যালগরিদম। এই অ্যালগরিদমের মাধ্যমে অসংখ্য আরএনএর তথ্য থেকে জিনের কার্যক্রম সম্পর্কে অনুমান করা যায়। এ থেকে একাধিক মিউটেশনের প্রভাব বিস্তারকারী প্রোটিন শনাক্ত করা সম্ভব। এ প্রোটিনগুলো হতে পারে এনজাইম। এগুলো এপিজেনেটিক পদ্ধতির মাধ্যমে আরএনএকে প্রভাবিত করতে পারে। অথবা সরাসরি আরএনএ থেকে প্রোটিন তৈরি করতে সক্ষম ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরও হতে পারে। ক্যালিফানো বলেন, ‘এই প্রোটিনগুলো ক্যানসার কোষের মূল কার্যক্রম পরিচালনা করে। এগুলোকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় মাস্টার রেগুলেটর।’
ক্যালিফানো ও তাঁর সহকর্মীরা ১০ হাজার ক্যানসার নমুনা অনুসন্ধান করে ৪০৭টি মাস্টার রেগুলেটর শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। এগুলোর সাহায্যে ক্যানসার নমুনায় থাকা সব মিউটেশনের প্রভাব সম্পর্কে ধারণা করা যায়। তাঁদের গবেষণাটি পিপ্রিন্টের একটি সার্ভার বায়োরিভ-এ প্রকাশিত হয়েছে। এই মাস্টার রেগুলেটরগুলো অন্য জিনের মিউটেশনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিন্তু নিজেরা মিউটেশনের শিকার হয়, এমন ঘটনা খুব কম। সে কারণে এদের শনাক্তকরণ পদ্ধতি জিনোমিকসের ওপর নির্ভরশীল।
মাত্র একটি মাস্টার রেগুলেটরকে বাধা দিয়ে একাধিক মিউটেশনের ফলে পরিবর্তিত কোষের কার্যক্রম বন্ধ করা যায়। ক্যালিফানো বলেন, ‘শুধু মূল দুর্বলতাকে শনাক্তকরণের মাধ্যমেই কোনো “টিউমার চেকপয়েন্টের” সম্পূর্ণ কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব।’ এ পদ্ধতিটি ইতিমধ্যেই ফলপ্রসূ হয়েছে। ২০১৫ সালে ক্যালিফানো এবং তাঁর সহকর্মীরা স্তন ক্যানসারের রোগীদের নিয়ে গবেষণা করেন। সেই রোগীদের যাঁদের HER2 জিনে মিউটেশন রয়েছে। কিন্তু এই রোগীদের একটি বড় অংশকে অ্যান্টিবডিভিত্তিক ওষুধ ট্র্যাসটুজুম্যাব (হারসেপটিন) প্রয়োগ করা হয়। এই ওষুধ মিউটশনভিত্তিক পদ্ধতিতে তৈরি। কিন্তু রোগীদের শরীরে এই ওষুধ তেমন কাজ করেনি।
HER2 পজিটিভ কোষ থেকে উচ্চমাত্রায় IL-6 নামে একধরনের সাইটোকিন প্রোটিন নিঃসৃত। ফলে সক্রিয় হয় STAT3 নামে এক ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর। এর ফলে ক্যালপ্রোটেকটিন নামে একধরনের প্রোটিনগুচ্ছ তৈরি হয়, যা কোষের বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এ কারণে ধারণা করা হয়, STAT3 একটি মাস্টার রেগুলেটর। এটা স্তন ক্যানসারের অ্যান্টিবডি ওষুধ ট্র্যাসটুজুম্যাবের কাজ করতে বাধা দেয়। এই বাধা দূর করার জন্য রুক্সলিটিনিব নামের একটি ওষুধ তৈরি হয়েছে। এই ওষুধ ট্রায়ালের দ্বিতীয় পর্যায়ে পরীক্ষাধীন আছে। রুক্সলিটিনিব ওষুধটি ইতিমধ্যে ব্লাড ক্যানসার এবং বোন ম্যারো ক্যানসারের জন্য অনুমোদন পেয়েছে। মাস্টার রেগুলেটর শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যালিফানো আর তাঁর সহকর্মীরা বিভিন্ন গাণিতিক অ্যালগরিদম তৈরি করেছেন। এর সাহায্যে তাঁরা কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে পারেন। বেশি সক্রিয় মাস্টার রেগুলেটর বন্ধ করতে এবং কম সক্রিয় মাস্টার রেগুলেটরের সক্রিয়তা বৃদ্ধি করতে সক্ষম এই অ্যালগরিদম। আগামী তিন বছরে তিন হাজারেরও বেশি রোগীকে সুস্থ করার লক্ষ্য নিয়ে এই পদ্ধতিটা কলম্বিয়ায় চালু করা হয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে। জিনোমিক অনুসন্ধানের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকেরা ক্যালিফানোর গাণিতিক অ্যালগরিদমের ফলাফলকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন।
জৈব রাসায়নিক প্রভাবক
আরএনএ হলো জীববিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ডিএনএ এবং প্রোটিনের একটি মধ্যবর্তী অবস্থা। গেইগার বলেন, ‘কোনো কোষের কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা পেতে চাইলে আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রোটিনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।’
প্রোটিন পরিমাপক যেসব প্রযুক্তি আছে, সেগুলো ব্যবহার করে কোনো কোষের সব প্রোটিন পর্যালোচনা করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু মাস স্পেকট্রোমেট্রি পদ্ধতির অগ্রগতির এ ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে উঠেছে।
গেইগার আগে জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব বায়োকেমিস্ট্রিতে কাজ করেছেন, প্রোটিন গবেষণার অগ্রদূত মাথিয়াস মানের সঙ্গে। ২০১৬ তাঁরা একটা যৌথভাবে একটা প্রবন্ধ লেখেন। তাতে দেখান, ১৯টি প্রোটিনের মাধ্যমে HER2-পজিটিভ, এস্ট্রোজেন-রিসেপ্টর-পজিটিভ এবং ট্রিপল নেগেটিভ (এস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর এবং HER2 অনুপস্থিত) স্তন ক্যানসারের শাখাগুলো আলাদা করা সম্ভব। ২০১৮ সালে গেইগার এস্ট্রোজেন-রিসেপ্টর-পজিটিভ স্তন ক্যানসারের একটি নতুন উপশাখা চিহ্নিত করেন। সেটার অস্তিত্ব ডিএনএ কিংবা আরএনএর সাহায্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এ রকম প্রোটিনভিত্তিক শ্রেণিগুলো অনেক সময় বিভিন্ন ক্যানসারের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে জড়িত। গেইগার বলেন, ‘আমরা প্রোটিনের সঙ্গে রোগীর আয়ুষ্কালের সম্পর্ক খুঁজে পাই। এটা আরএনএর মাধ্যমে পাওয়া যায় না। তাই বলা যায়, প্রোটিন আমাদের কোষের গভীরে জানতে সাহায্য করে।’
প্রোটিন গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ হচ্ছে ইমিউনোথেরাপি। ইমিউনোথেরাপির ফলাফল পর্যলোচনা করে এর গুণমাণ বৃদ্ধি করা যায় এ পদ্ধতিতে। ইমিউনোথেরাপি আমাদের শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্যানসার কোষ ধ্বংস করে। এ পদ্ধতিটি ক্যানসার চিকিৎসায় বিপ্লব এনেছে। ওয়াশিংটনের প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট ন্যাশনাল ল্যাবরেটোরিতে গবেষণা করেন জীববিজ্ঞানী ক্যারিন রোডল্যান্ড। তিনি বলেন, ‘খুব কম ক্যানসারের জন্যই ইমিউনোথেরাপি কাজ করে। তবে যাঁদের শরীরে কাজ করে, তাঁদের জন্য এটা নিঃসন্দেহে একটি কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি। কিন্তু বড় প্রশ্ন হচ্ছে, যাঁদের শরীরে এটা কাজ করে না, তাঁদের জন্য এ পদ্ধতির উন্নতি করা যেতে পারে।’
ত্বক আর ফুসফুসের ক্যানসারে ইমিউনোথেরাপি বেশ ভালো কাজ করে। অন্য ক্যানসারে বেশি জেনেটিক মিউটেশন পাওয়া যায়। সুতরাং গবেষকেরা বলছেন, মিউটেশনের পরিমাণের ওপর ইমিউনোথেরাপির কার্যকারিতা নির্ভর করে। রোডল্যান্ড বলেন, ‘আমাদের জিনে যদি প্রচুর মিউটেশন থাকে, তবে আমাদের শরীরে প্রচুর বহিরাগত অ্যান্টিজেন পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিন্তু এ ব্যাখ্যাটিও খুব বেশি নির্ভরযোগ্য নয়।’ এ কারণে গবেষকেরা তাই ইমিউনোথেরাপির প্রতি সংবেদনশীলতা দেখানো প্রোটিনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
রোডল্যান্ড আর বলেন, ‘ইমিউনোথেরাপির কার্যক্ষমতা সম্পর্কে পূর্বধারণা পেতে প্রোটিন বিশ্লেষণ যে জেনেটিক মিউটেশনের বেশি কার্যকর, এ কথা জোর দিয়ে বলার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু বেশ কিছু গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে।’
২০১৯ সালে গেইগারের নেতৃত্বে চালানো গবেষণায় ত্বকের ক্যানসারের আক্রান্ত রোগীদের ওপর দুই ধরনের ইমিউনোথেরাপির প্রতিক্রিয়া দেখা হয়েছে। তাঁরা ক্যানসার কোষ বিপাকক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত প্রোটিনগুলোর মধ্যে কিছু পার্থক্য খুঁজে পান। এর মাধ্যমে ইমিউনোথেরাপির কার্যক্ষমতা সম্পর্কে পূর্বধারণা পাওয়া যায়। গেইগার বলেন, ‘আমরা গবেষণা শুরু করেছিলাম ইমিউনোথেরাপির প্রতি অসংবেদনশীলতার জন্য দায়ী মূল কারণ খুঁজে বের করার জন্য। উদ্দেশ্য ছিল অকার্যকর চিকিৎসা থেকে রোগীদের বিরত রাখা। কিন্তু ইমিউনোথেরাপির প্রতি বেশি সংবেদনশীলতা দেখায়, এমন একটি পদ্ধতি খুঁজে পেয়েছি।’
সমন্বিত প্রয়াস
ডিএনএ, আরএনএ ও প্রোটিন ক্যানসার সম্পর্কে আলাদাভাবে ধারণা দেয়। তবে এগুলোর সমন্বয়ে ক্যানসারের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তৈরি করা সম্ভব। ডিএনএ ও প্রোটিন অনুসন্ধান করে ক্যানসারে সংঘটিত মিউটেশন এবং তার ফলে উৎপন্ন প্রোটিনের সংযোগ তৈরি করা যায়। কলোরেক্টাল ক্যানসারের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো জিনের সংখ্যার পরিবর্তন, সেই জিন থেকে তৈরি হওয়া প্রোটিনের পরিমাণের ওপর প্রভাব রাখে।
২০১৮ সালে আরএনএ ও প্রোটিনের সমন্বয়ে করা একটি অনুসন্ধানী গবেষণা চালানো হয়। স্তন ক্যানসারের রোগীদের ওপর। তাতে দেখা গেছে, সুস্থ টিস্যুর তুলনায় টিউমার টিস্যুতে আরএনএর আর প্রোটিনের অনুপাতের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং আরএনএ ও প্রোটিনের পরিবর্তনের হার ক্যানসার গবেষণায় নতুন পথ দেখাবে।
কোনো কোনো রোগের ক্ষেত্রে আরএনএ ও প্রোটিনের নিবিড় সম্পর্ক দেখা যায়। রোগের তীব্রতা এবং রোগীর আয়ুষ্কাল হ্রাসের এর মধ্যে সম্পর্ক। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও কম্পিউটেশনাল বায়োলজিস্ট সজীব চক্রবর্তী বলেন, ‘ক্যানসার কোষগুলোর গুরুত্বপূর্ণ কার্যপদ্ধতিগুলোতে দেখা যায়, আরএনএ ও প্রোটিনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।’ কখনো কখনো ক্যানসার কোষের কোনো বিপাকজনিত কার্যপদ্ধতি পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন পড়ে। তখন ওই কার্যপদ্ধতির সম্পর্ক রয়েছে এমন আরএনএ ও প্রোটিন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়। সুতরাং আরএনএ ও প্রোটিনের পারস্পরিক সম্পর্ক ক্যানসারের একটি নির্দিষ্ট কার্যপদ্ধতির ওপর নির্ভরতা প্রমাণ করে। ড. চক্রবর্তী আরও বলেন, ‘এভাবে আমরা ক্যানসার কোষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্যপদ্ধতি শনাক্ত করতে পারি।’
এ বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন সজীব চক্রবর্তী। এ জন্য তিনি জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব ফ্রাইবুর্গে কর্মরত সহকর্মীদের সহায়তা নিয়েছেন। সেই সহকর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া রোগীদের তথ্যের ওপর অনুসন্ধান চালাচ্ছেন তিনি। ক্যানসারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যপদ্ধতি শনাক্তের সম্পর্কে তিনি যেমন জানতে চান, তেমনি ক্যানসারের বিস্তার রোধ ও চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কেও জানতে চান। ক্যানসারের বিভিন্ন ওষুধ এবং এর সঙ্গে জড়িত জিনগুলোর নানা তথ্য ব্যবহার করছেন তিনি। এর সাহায্যে আরএনএ ও প্রোটিনের পারস্পরিক সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে ওষুধের কার্যকারিতা বদলে দেয়, তা–ও অনুসন্ধান করছেন ড. চক্রবর্তী। যেমন কলোরেক্টাল ক্যানসার রোগীদের জন্য ৫-ফ্লুরোইউরাসিল নামের ওষুধটি একটি নির্দিষ্ট সময় পর অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে ড. চক্রবর্তী বলেন, ‘রোগীর শরীরে ওষুধটি যে জিনগুলো নিষ্ক্রিয় করার জন্য প্রয়োগ করা হয়েছিল, সেগুলোর আরএনএ ও প্রোটিনের সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হয়। তিনি আরও বলেন, ‘৫ - ফ্লুরোইউরাসিলের সক্রিয়তার সঙ্গে যেসব আরএনএ এবং প্রোটিনের নিবিড় সম্পর্ক সেগুলো প্রথম দিকে খুব সক্রিয় থাকে। কিন্তু পরে এই সম্পর্কের অবনতি ঘটে।’ এ ব্যাপার থেকে একটা বিষয় বোঝা যায়, একটি কার্যকর ওষুধের কার্যকারিতা সময়ের সঙ্গে কমে যাওয়ার মূল কারণ কী।
অমিক্সের বিভিন্ন শাখার মধ্যে প্রোটিনই শেষ উপাদান নয়। তৈরি হওয়ার পরও প্রোটিন নিজেরা বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। এসব পরিবর্তনের মধ্যে ফসফরাইলেশনকে সবচেয়ে বেশি অনুসন্ধান করা হয়েছে। এটা প্রোটিনের অন-অফ সুইচ হিসেবে কাজ করে। ২০১৯ সালে কলোরেক্টাল ক্যানসার অনুসন্ধানের রেশ ধরে সিপিট্যাক প্রথম ফসফোরাইলেশনের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করে। এর ফলে বেশ কিছু তাৎক্ষণিক ফলাফল জানা যাচ্ছে। এগুলো অজানা অনেক বিষয় ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করবে।
সাধারণত ক্যানসার কোষে RB1 জিন অকার্যকর থাকে। কারণ, এটা ক্যানসারপ্রতিরোধী জিন। কিন্তু কলোরেক্টাল ক্যানসারের ডিএনএ ও প্রোটিন অনুসন্ধান করে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এসব ক্যানসারে RB1 প্রোটিনের পরিমাণ অনেক বেশি। RB1 জিন থেকে তৈরি হওয়া প্রোটিন, RB, কোষের বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে। কিন্তু RB প্রোটিনের ফসফোরাইলেশন তার এই বাধা দেওয়ার ক্ষমতাটাকে নষ্ট করে দেয়। রোডল্যান্ড বলেন, ‘প্রোটিনের ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে শুধু প্রোটিনের পরিমাণ সম্পর্কে জানাই যথেষ্ট নয়, প্রোটিনের পরিবর্তন সম্পর্কেও জানাও জরুরি।’
প্রোটিন অনুসন্ধানের মূল সীমাবদ্ধতা হলো এর জটিলতা। টিস্যুর নমুনা থেকে পাওয়া হাজারো কোষের প্রয়োজন হয় মাস স্পেকট্রোমেট্রি পদ্ধতিতে ব্যবহারের জন্য। আরএনএ সিকোয়েন্সিংয়ের মতো প্রযুক্তিটি কোষভিত্তিক পার্থক্য করতে উপযোগী নয়। কোনো ক্যানসারের বৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা পেতে এই সীমাবদ্ধতা দূর করা দরকার। গেইগার বলেন, ‘এ জটিলতা রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করার জন্য কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি তৈরিতে বাধা দিচ্ছে।’
গেইগার আশাবাদী, ‘এই প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাকে আমরা সামনের কয়েক বছরে কাটিয়ে উঠতে পারব। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা ক্যানসার অমিক্সের বিভিন্ন শাখাকে আরও উন্নত করেছেন। যেমন, মেটাবলমিকস (বিপাকক্রিয়া–সম্পর্কিত অনুসন্ধান) শাখাটির কথাই ধরা যাক। এ পদ্ধতিতে তরল বায়োপসি ব্যবহার করে ক্যানসারকে তার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু এসব প্রযুক্তি বাস্তবায়নে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং লোকবলের প্রয়োজন হয়। এ জন্য এসব প্রযুক্তি তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারছে না। এ জন্য প্রযুক্তিগুলো আরও নিখুঁত এবং সুলভ করা জরুরি। সজীব চক্রবর্তী বলেন, ‘আমি আশাবাদী, অদূর ভবিষ্যতে এমন ভালো ভালো সফটওয়্যার তৈরি হবে। সেগুলো ব্যবহার করে খুব সহজেই রোগীর শরীরের ভেতরকার কার্যক্রম সহজেই জানা যাবে। এ জন্য আমাদের কম্পিউটেশনাল বায়োলজিস্টদের ওপর আস্থা রাখতেই হবে।’
অনুবাদকদ্বয়: এমএস শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: নেচার আউটলুক: প্রিসিশন অনকোলজি; doi: 10.1038/d41586-020-02676-9
মূল: সাইমন ম্যাকিন
রূপান্তর: তন্ময় দাস ও মায়িশা আদিবা