গ্রহের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার কেন?

গ্রহের গতি নিয়ে কেপলার তিনটি সূত্র দিয়েছিলেন ১৬ শতকের প্রথম দিকে। কেপলার জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহের সহকারী। বহু বছর ধরে সময়ের সঙ্গে মঙ্গলের স্থান পরিবর্তন, দুরবিন ছাড়াই খুব সূক্ষ্মভাবে রেকর্ড করেছিলেন টাইকো। কেপলার তাঁর সূত্রগুলো টাইকোর মঙ্গল গ্রহের রেকর্ড বিশ্লেষণ করে পেয়েছিলেন। কেপলারের প্রথম সূত্র বলে, সূর্যের চারদিকে যেকোনো গ্রহের কক্ষপথ হলো একটি উপবৃত্ত এবং সূর্য এই উপবৃত্তের একটি ফোকাসে অবস্থান করে। কেপলার অবশ্য বলতে পারেননি কেন গ্রহের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার হবে। এর অনেক বছর পরে ১৬৮৪ সালে জ্যোতির্বিদ এডমান্ড হ্যালি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আইজ্যাক নিউটনকে প্রশ্ন করেছিলেন, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যদি দূরত্বের ব্যস্তানুপাতিক বর্গ হিসেবে কাজ করে, তবে গ্রহের গতিপথ কেমন দেখতে হবে। নিউটন নাকি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন—উপবৃত্তাকার। তবে হ্যালির প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দিতে নিউটনের মাস তিনেক সময় লেগেছিল, আরও তিন বছর লেগেছিল সবকিছু গুছিয়ে শুধু ব্যস্তানুপাতিক বর্গ নীতি থেকে কেপলারের সূত্রগুলোর প্রমাণ ও বলবিদ্যার ভিত্তিভূমির সূত্রগুলোকে একসঙ্গে করে প্রিন্সিপিয়া অব ম্যাথমেটিকা বইটি বের করতে।

চিত্র ১: একটি উপবৃত্ত, কিন্তু উৎকেন্দ্রিকতার (e) মান শূন্য হলে এটিই বৃত্তে রুপান্তরিত হবে

একটি গ্রহ যখন সূর্যের কেন্দ্রীয় বলক্ষেত্রে বিচরণ করে, তখন নিউটনের বলবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে অবলম্বন করে গ্রহটির গতিপথকে (r) একটি উপবৃত্তের মূল অক্ষ a, উেকন্দ্রিকতা (Eccentricitye) ও মূল অক্ষের সঙ্গে গ্রহটি যে কোণ সৃষ্টি (q) করে, তিনটি জিনিসের অপেক্ষক (Function) হিসেবে প্রকাশ করা যায় (চিত্র ১)। কিন্তু এই সমীকরণ একটি সাধারণ সমীকরণ। অর্থাৎ এটি ব্যবহার করে বৃত্ত, উপবৃত্ত, পরাবৃত্ত (Parabola) বা অধিবৃত্ত (Hyperbola) যেকোনো কনিক প্রস্থচ্ছেদকে বর্ণনা করা যাবে (চিত্র ২)। একটি শঙ্কুকে (cone) একটি সমতল দিয়ে ছেদ করলে যে আকারটি পাওয়া যায়, তাই হলো কনিক প্রস্থচ্ছেদ। এই সমীকরণে উেকন্দ্রিকতা যদি শূন্য হয়, তবে গ্রহের গতিপথটি হবে বৃত্তাকার, উেকন্দ্রিকতা ০ থেকে ১-এর মধ্যে হয়, তবে সেটি হবে উপবৃত্তাকার, ১-এর সমান হলে হবে পরাবৃত্ত এবং ১-এর বেশি হলে হবে অধিবৃত্ত।

অর্থাৎ সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ বলের ব্যস্তানুপাতিক বর্গ নীতির ক্ষেত্রে একটি গ্রহ যেকোনো কক্ষপথ (বৃত্ত, উপবৃত্ত, পরাবৃত্ত বা অধিবৃত্ত) গ্রহণ করতে পারে। যদি গ্রহটির গতিশক্তি বেশি হয়, তবে সেটি পরাবৃত্ত বা অধিবৃত্ত পথে চলবে এবং সূর্যের কাছে আর ফিরে আসবে না। আর গ্রহগুলো যদি সূর্যের কক্ষপথে থাকে, তবে তাদের উেকন্দ্রিকতা শূন্য হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই মূলত তারা উপবৃত্তাকার কক্ষপথ নেবে। আসলে একটি গ্রহের চক্রাকার পথে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। গ্রহটির গতি যদি বেশি হয়, তবে সেটি সূর্য থেকে যত দূরে যাবে, সূর্যের আকর্ষণে শ্লথ হতে হতে আবার সূর্যের দিকে ফিরবে। আবার সূর্যের কাছাকাছি আসতে আসতে তার গতি বেড়ে যাবে এবং সূর্যের চারদিকে বাঁক খেয়ে দূরে চলে যেতে থাকবে।

চিত্র ২: কনিক প্রস্থচ্ছেদ। বাঁয়ে উপবৃত্ত, মধ্যে বৃত্ত ও অধিবৃত্ত, ডানে পরাবৃত্ত

এভাবে গ্রহটির গতির অসমতা তাকে উপবৃত্তাকার কক্ষপথ দেবে। বৃত্তাকার পথ কেপলারের প্রথম সূত্র অনুযায়ী অসম্ভব নয়, কারণ বৃত্ত উপবৃত্তেরই একটি অংশ, কিন্তু বাস্তবে বৃত্তাকার কক্ষপথ হওয়া প্রায় অসম্ভব, তার জন্য বিশেষ আদি অবস্থার প্রয়োজন। তবে বহিঃসৌরমণ্ডলে আবিষ্কৃত অনেক গ্রহ, যেগুলো তাদের তারাদের খুব কাছে সেখানে জোয়ার-ভাটার কারণে গ্রহগুলোর উপবৃত্তাকার পথ ধীরে ধীরে বৃত্তের কাছাকাছি হচ্ছে।

লেখক: জ্যোতিঃপদার্থবিদ ও অধ্যাপক, রিভারসাইড কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত