মানুষ সেই কবেই চাঁদে পা রেখেছে, মঙ্গলগ্রহ ও বৃহস্পতিতে পাঠাচ্ছে মহাকাশযান। আবার সেই আদিমকালের ডাইনোসরের কঙ্কাল থেকে উদ্ধার করছে বিস্ময়কর সব তথ্য। কিন্তু এখন মানুষের অগ্রযাত্রার প্রধান অন্তরায় তার বিশাল জনসংখ্যা। আগামী ৩০ বছরের মাঝে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়ে প্রায় ৯৭০ কোটি মানুষ হবে। তাদের খাদ্যের চাহিদা কীভাবে পূরণ হবে, সেই চিন্তায় এখন অনেকেই আতঙ্কিত। তার ওপর তো জলবায়ু পরিবর্তনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, খরা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ত পানিতে খাদ্যশস্যের উত্পাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। আবার বেশি বেশি কীটনাশক ব্যবহারে ফসল নষ্টকারী পোকামাকড়, ছত্রাক ইত্যাদি কীটনাশক-সহনশীল হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো যে করেই হোক খাদ্যের উত্পাদন বাড়ানো। এরই সমাধানে নতুন অভিনব প্রযুক্তি ক্রিসপার (CRISPR) হতে পারে দারুণ এক হাতিয়ার, যাকে টার্গেট করে পৃথিবীর সব অণুজীববিজ্ঞানী, জীবপ্রযুক্তিবিদেরা খাদ্যশস্যের উত্পাদন বৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং লবণ-সহনশীল, খরা-তাপমাত্রা-সহনশীল, রোগ-সহনশীল শস্য (যেমন: ধান, আলু, টমেটো, শসা, সয়াবিন, ক্যানোলা, যব, জোয়ার, বাজরা ইত্যাদি) উত্পাদন করার জন্য ক্রিসপার প্রযুক্তির ব্যবহার করে যাচ্ছেন।
ডিএনএ (DNA) সম্পর্কে কমবেশি আমরা সবাই জানি। ডিএনএ হচ্ছে সব জীবের গঠন ও কাজের একক। আর জীবদেহের সমস্ত ডিএনএ মিলে তৈরি করে জিনোম। জিনোমের মধ্যে বিভিন্ন অংশে থাকে হাজারো জিন। এসব জিনের ডিএনএ থেকে আরএনএ আর আরএনএ থেকে প্রোটিন তৈরি হয়। জীবদেহের (হোক সে মানুষ, গাছ, শৈবাল, ছত্রাক কিংবা ব্যাকটেরিয়া) সব কাজ এসব প্রোটিনই নিয়ন্ত্রণ করে। ধানের কথাই ধরা যাক, ধানের হাজারো প্রোটিন আছে, যেগুলোর নানা কাজ করে। আবার বিভিন্ন জাতের ধানের প্রোটিন তৈরি করার ক্ষমতা ভিন্ন হতে পারে। কখনো দেখা যায় কিছু প্রোটিনের উপস্থিতির জন্য ধানের উত্পাদন কমে যাচ্ছে অথবা ধান আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন পোকামাকড় বা রোগ দ্বারা। তখন দরকার হয় এসব প্রোটিন যাতে কম তৈরি হয় অথবা প্রোটিন তৈরিকারী জিনটি একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় সেই ব্যবস্থা করা। আবার দেখা গেল, হয়তো ধানের কোনো একটি জাতে এমন প্রোটিন আছে, যেটির জন্য প্রচণ্ড খরায় গাছটি বেঁচে আছে, কিন্তু এর ফলন কম। অথচ বেশি ফলনের অন্য একটি জাত আবার খরায় টিকতে পারছে না। তখন আমরা যদি প্রথম জাতের ধান থেকে খরায় বাঁচতে সাহায্য করে এমন প্রোটিন তৈরিকারী জিনটিকে পরের জাতের ধানে এনে প্রকাশ করতে পারি, তবে একটি অসাধারণ কাজ হবে। তাতে খরা বা পানিশূন্যতা সহনশীল ধানের জাত আমরা পাব, যা কি না উচ্চফলন দেবে। একইভাবে আমরা লবণাক্ত পানি সহনশীল ধানের জাতও পেতে পারি। আবার শুধু ধানের ফলন বাড়াতে ও কোনো জিনকে নিষ্ক্রিয় করা বা অন্য জিনের প্রকাশ ঘটানো যায় এই ক্রিসপার-এর মাধ্যমেই।
ক্রিসপার-ক্যাস৯ হলো ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়ার আত্মরক্ষার কৌশল। ব্যাকটেরিয়ার জিনোমে এমন কিছু অংশ আছে, যা কোনো প্রোটিন তৈরি করতে পারে না। কিন্তু এর সঙ্গে ভাইরাসের জিনোমের মিল আছে। যখন ব্যাকটেরিয়াকে ভাইরাস আক্রমণ করবে, তখন ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএর বা ক্রিসপার নামের অংশ থেকে আরএনএ তৈরি হবে, যা ভাইরাসের আরএনএ বা ডিএনএর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। তখন ক্যাস৯ প্রোটিন এসে কাঁচির কাজ করবে! এটি ভাইরাস এর আরএনএ বা ডিএনএকে চিনে ফেলে একে কেটে ফেলবে কয়েক টুকরোয়। এভাবেই ব্যাকটেরিয়া শতাব্দী ধরে আত্মরক্ষাকৌশল অবলম্বন করছে। ক্রিসপারের এই বিভিন্ন ডিএনএর অংশকে চিনে ফেলার দারুণ ক্ষমতাকে ব্যবহার করে আজ বিভিন্ন অভূতপূর্ব কাজের পরিকল্পনা সম্ভব হচ্ছে।
এই ক্রিসপার-ক্যাস৯ দ্বারা আমরা কোনো শস্যে, যখন কোনো পরিবর্তন ঘটাতে চাই, তখন আমাদের দুইটি জিনিস লাগে—ক্যাস৯ প্রোটিন, যা আমাদের কাঁচি! আর আরেকটি গাইড আরএনএ, যা ক্যাস৯-কে গাইডের মতোই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে ডিএনএর যে জায়গায় পরিবর্তন আনতে চাই সে জায়গায়। যখন গাইড আরএনএ-ক্যাস৯-কে গাছের কোষে ঢুকানো হয়, সে পথ চিনে ঠিক চলে যাবে তার গন্তব্যে, সেখানে ক্যাস৯ প্রোটিনের কাটা অংশে আমাদের সরবরাহকৃত নতুন কোনো ডিএনএর অংশ, কোষ নিজে ঢুকাতে পারে। ফলে নতুন কোনো প্রোটিন পাওয়া যাবে, অথবা ডিএনএর কোনো অংশকে কেটে ফেলে সেই জিনের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেবে। ২০১২-১৩ সালে এই ক্রিসপার আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই রোগ-কীট-কঠিন জলবায়ু সহনশীল খাদ্যশস্য উত্পাদনের কথা ভেবে আসছেন বিজ্ঞানীরা। আর এ নিয়ে কাজও হয়েছে বেশ।
Magnaporthe নামের এক ছত্রাকের জন্য ধানের ব্লাস্ট রোগ হয়ে থাকে। আর এ সময় ERF922 নামের প্রোটিনের কাজ বেড়ে যায়। আবার লবণাক্ত পানি, খরা বা প্রচুর ঠান্ডায়ও এই প্রোটিনের কাজ বাড়ে। চীনের বিজ্ঞানীরা ক্রিসপার-ক্যাস৯ দিয়ে এই প্রোটিনের কিছু অংশ বাদ দিয়ে দেখলেন, যে নতুন ধানের যে জাতটি পাওয়া গেল, তা আসল ধান জাতের চেয়ে অনেকগুণ বেশি ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধ করতে পারছে। অন্যদিকে, ধানের ফলনও আগের মতোই পাওয়া গেল, যা প্রমাণ করে, ক্রিসপার দ্বারা পরিবর্তিত ধানের উন্নত বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে, কিন্তু ফলন কমবে না।
আবার, IPA1 নামের জিনটি ধানের অধিক বীজ আর বেশি ফলনের জন্য দায়ী। কিন্তু সরজ১৫৬ নামক ম্যাক্রো-আরএনএ এই জিনের কাজে বাধা দান করে। যখন IPA1 এ ক্রিসপার-ক্যাস৯ দ্বারা একটি ছোট্ট পরিবর্তনের জন্য সরজ১৫৬ যুক্ত হতে পারে না। দেখা গেল, ধানের ফলন, বীজের সংখ্যা ও মান বহুগুণে বেড়ে গেছে। ক্রিসপার-ক্যাস৯ পদ্ধতি দ্বারা এভাবে আদর্শ খাদ্যশস্যের জাত তৈরি সম্ভব, যা উচ্চতায়, ফলনে, মানে অনন্য। ক্রিসপার-ক্যাস৯ দ্বারা যে শুধু ধানের গুণাগুণ বাড়ানো হয়েছে তা কিন্তু নয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের DuPont Pioneer নামক একটি কোম্পানি ভুট্টার ARGOS8 নামক প্রোটিনের উত্পাদন বাড়িয়ে খরা-সহনশীল করতে সক্ষম হয়েছে।
এভাবেই লবণাক্ততা-সহনশীল, উচ্চতাপমাত্রা-খরা-বন্যাসহনশীল, ভালো মানের অধিক ফলন দেয় এমন ধান, গম, আলু ইত্যাদি উত্পাদন সম্ভব, যা আমাদের নিকট ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ খাদ্যসংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারে। তা ছাড়া পোকামাকড় প্রতিরোধী ধান ও গম যেমন কীটনাশক ব্যবহার কমাবে, তেমনি পরিবেশের ওপর এসব রাসায়নিক কৃত্রিম পদার্থের প্রকোপও কমবে।
লেখক: গবেষক, প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলজি ল্যাব, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: PLOS ONE, Plant Biotechnology Journal
*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত