ক্যাকটাসের নাম শুনলে মাত্র একটা প্রজাতির কথাই মনে আসে। সেটা ফণীমনসা। এই শব্দটার সঙ্গেও সম্ভবত বেশির ভাগ মানুষ পরিচিত নজরুলের কাব্যগ্রন্থ ফণীমনসা থেকে। আমেরিকান ব্যান্ড পিক্সিস তাদের অ্যালবাম সার্ফার রোজাতে তো ক্যাকটাস নিয়ে পুরো একটা গানই বানিয়ে ফেলেছে! ক্যাকটাস শব্দের উত্পত্তি গ্রিক ক্যাকটা থেকে, যার অর্থ শিরদাঁড়াযুক্ত কাঁটাওয়ালা গাছ। এর গণের (Genus) সংখ্যা প্রায় ১০০-এর ওপর। আর আড়াই হাজারের বেশি প্রজাতি রয়েছে। এদের আবার ভাগ করা হয়েছে চারটি উপগোত্রে (Subfamily)। সেগুলো হলো Cactoideae, Maihuenioideae, Opuntioideae এবং Pereskioideae। এদের ভেতর Cactoidea গোত্রেই ২০০ প্রজাতির ক্যাকটাস।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রাচীন অ্যাজটেক সভ্যতায় ক্যাকটাসের নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রায় ৮০০ বছর আগে এক ঝড়ের রাতে প্রবল প্রতাপশালী অ্যাজটেক সম্রাট স্বপ্ন দেখলেন—বিশাল এক ক্যাকটাসের মাথায় বসে এক বিষধর সাপকে চঞ্চু আর নখর দিয়ে ফালি ফালি করে ছিঁড়ে খাচ্ছে পাখির রাজা ইগল। রাজা একে ঐশী বাণী বলেই ভেবে নিলেন। তারপর থেকে অ্যাজটেক সভ্যতায় অন্য রকম গুরুত্ব পায় ক্যাকটাস। এর আদি বাসভূমি আমেরিকার পূর্বাঞ্চলে। ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রথম ইউরোপে ক্যাকটাস নিয়ে আসেন। Prickly pears (যার বাংলা করলে দাঁড়ায় কণ্টকিত নাশপাতি) উনিশ শতকে অস্ট্রেলিয়ার প্রাকৃতিক শোভা বৃদ্ধিতে এবং রঞ্জক কারখানায় ব্যবহূত হতো। বিশ শতকে এর চাহিদা বিপুল পরিমাণে বাড়তে থাকে। এ-জাতীয় গাছকে আমেরিকার নিজস্ব উদ্ভিদ বলে ধরা হয়। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া, মেক্সিকো, অ্যারিজোনা ও টেক্সাসের বিস্তৃত মরু অঞ্চলে এ উদ্ভিদের বন গড়ে উঠেছে।
এ উদ্ভিদের রয়েছে পানি সংরক্ষণের অসাধারণ ক্ষমতা। মরুভূমির প্রচুর উত্তপ্ত আবহাওয়াতেও ক্যাকটাস পানি সংরক্ষণ করতে পারে বলে এটি প্রায় দুই শ বছরের মতো দীর্ঘ সময় বাঁচতে পারে। বাংলাদেশে যে কয়েকটি প্রজাতির ক্যাকটাস রয়েছে তাদের মধ্যে একাইনো ক্যাকটাস, এপিফাইলাম, নিপল ক্যাকটাস, সেরেয়াস, গোল্ডেন ব্যারেল, ওল্ড লেডি, মাদার-ইন-ল চেয়ার, ফণীমনসা প্রধান। এশিয়ার বৃহত্ ক্যাকটাস নার্সারি পাইন ভিউ নার্সারি। এটি দার্জিলিংয়ের কালিম্পংয়ে অবস্থিত। এখানে কয়েক হাজার বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ক্যাকটাস রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একাই ৫০টি দেশ থেকে বার্ষিকভাবে প্রায় ৭ মিলিয়নের ওপর ক্যাকটাস আমদানি করে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এই উদ্ভিদের ব্যাপক চাহিদা এবং এর অনিয়ন্ত্রিত বাজারজাতকরণ এর প্রজাতিগুলোকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
অলংকরণ, সাজসজ্জা, ওষুধ ও খাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হয় ক্যাকটাস। তাই এর চাহিদা আকাশছোঁয়া। এ কারণে ক্যাকটাসের ৩১ শতাংশ প্রজাতি এখন বিলুপ্তির মুখে। IUCN পরিচালিত এক সমীক্ষার তথ্য যেটি ২০১৫ সালের অক্টোবরে নেচার প্ল্যান্টস নামের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে উঠে এসেছে এ রকম হতাশাজনক আরও কিছু তথ্য। একে IUCN-এর Most Threatened Taxonomic Group অর্থাত্ রেড লিস্টের পঞ্চম স্থানে রাখা হয়েছে। এর নিচে রয়েছে যথাক্রমে স্তন্যপায়ী ও পাখির কিছু প্রজাতি।
পুরো পৃথিবীতে ক্যাকটাসের প্রায় দুই হাজার প্রজাতির ব্যবহূত হয়। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ ক্যাকটাসের বিভিন্ন প্রজাতি বিভিন্ন কারণে ব্যবহার করে থাকে। এই অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে দিনের পর দিন ক্যাকটাসের বিভিন্ন প্রজাতির ওপর হুমকি বেড়েই চলেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে বেআইনিভাবে গাছ এবং এর বীজ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহার করা, ব্যক্তিগতভাবে সংরক্ষণ করা এবং অপরিকল্পিত ও অস্থিতিশীল চাষাবাদ ক্যাকটাসের বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা প্রজাতিগুলোর মধ্যে ৪৭ শতাংশের জন্য দায়ী। ৩১ শতাংশ হুমকির সম্মুখীন প্রজাতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সংরক্ষণ নীতির কারণে হুমকিতে রয়েছে। বাকি ২২ শতাংশের দায় বার্ষিক চাষাবাদ নীতির। আবাসন এবং বাণিজ্যিক উন্নয়নে এর ব্যবহার, আকরিকের জন্য খনন এবং জলজ লালনপালনের কারণে এগুলো টিকতে পারছে না। বিশেষ করে চিংড়ি চাষ এজন্য দায়ী। এরা পানিতে ক্যাকটাস জন্মানোর জায়গা ধ্বংস করছে।
ক্যাকটাস নতুন বিশ্বে অনুর্বর বাস্তুসংস্থানের চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। এরা বিভিন্ন প্রাণীর সংকটাপন্ন অবস্থায় বিশেষভাবে অবদান রাখে। হরিণ, কাঠবিড়ালি, খরগোশ, এক প্রজাতির নেকড়ে, টার্কি, টিকটিকি, কচ্ছপ প্রভৃতি প্রাণীর খাদ্য ও জলের প্রধান উত্স বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস। ক্যাকটাসের ফল এবং রসাল পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ কাণ্ড বিভিন্ন দেশের গ্রামাঞ্চলে খাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হয়। Opuntia ficus-indica নামের একধরনের Prickly Pear বা কণ্টকিত নাশপাতি মেক্সিকোতে খাবার হিসেবে বিখ্যাত। নোপাল নামের সুস্বাদু এই খাবারকে বিফ স্টেকের সঙ্গে তুলনা করা হয়। আর Ariocarpus kotschoubeyanus প্রদাহের ওষুধ হিসেবে বিশেষভাবে ব্যবহূত হয়। কিন্তু এই প্রজাতিও এখন বিলুপ্তপ্রায়।
হুমকির সম্মুখীন প্রজাতির মধ্যে ৮৬ শতাংশ, যেগুলো চাষাবাদের জন্য ব্যবহূত হয় সেগুলো বন্য পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়। মূলত ইউরোপ এবং এশিয়ার কিছু অসাধু লোক ক্যাকটাসের অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। বন থেকে সংগৃহীত হওয়ায় এবং বিরল হওয়ায় এ সম্পর্কে তেমন একটা খোঁজখবর রাখা হয় না বলেই অবাধে এমন বাণিজ্য চলতে পারছে।
এ রকম তথ্য একরকম ধাক্কার মতো বলেই মনে করেন IUCN-এর সহসভাপতি এবং ক্যাকটাস ও সাকুলেন্ট প্ল্যাট গ্রুপের প্রধান গবেষক বারবারা গোশ। তিনি বলেন, ‘আমরা ক্যাকটাসের প্রজাতির প্রতি এ রকম ভয়ংকর হুমকি কখনো আশা করিনি। এদের বিলুপ্তি অনুর্বর অঞ্চলে খাদ্য, প্রাণীবৈচিত্র্য এবং বাস্তুসংস্থানের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।’
বারবারা গোশের কথার সূত্র ধরে উদাহরণ হিসেবে Echinopsis pampana-এর কথা টানা যায়। এটি পেরুর পুনা মরুভূমির এন্ডেমিক উদ্ভিদ (যে উদ্ভিদ কেবল ওই এলাকাতেই জন্মে), যেটা অবৈধভাবে আলংকারিক উদ্ভিদ বাণিজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে এই প্রজাতির ৫০ শতাংশ উদ্ভিদের বিলুপ্তি ঘটেছে গত ১৫ বছরে। তাতে ওই এলাকার ভূমির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে এই প্রজাতিকে বিপন্ন ঘোষণা করা হয়েছে।
ক্যাকটাস মূলত তাদের বৈচিত্র্য ও অসাধারণ ফুলগুলোর জন্য পরিচিত। এদের কিছু প্রজাতি এন্ডেমিক এবং সেসব অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান এগুলো ছাড়া কল্পনা করা অসম্ভব। যদিও এরা সেসব অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের অংশ, তবু এগুলোকে অনেক সময়ই অগুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, যেটার ফলাফল খুবই ভয়ংকর হতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এর ব্যবহার তেমন নেই বলে মনে হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য জীববৈচিত্র্য প্রধান ভূমিকা পালন করে। তাই পরিবেশ ও নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়ার জন্য এর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আবশ্যক।
লেখক: শিক্ষার্থী, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: সাইম অ্যান্ড শুস্টার্স গাইড টু ক্যাকটি অ্যান্ড সাকুলেন্টস/ ম্যারিয়েল্লা পিজ্জেটি ও স্ট্যানলি শুলার, আইইউসিএন ডট ওআরজি, উইকিপিডিয়া, বাংলাদেশ ক্যাকটাস সোসাইটি
*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত