আমাদের শরীরে যদি কোনো অনুপ্রবেশকারী, যেমন ভাইরাসের আগমন হয়, শরীরের সহজাত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সেই অনুপ্রবেশকারীর বিভিন্ন টুকরাংশ বা পেপটাইট মেলে ধরে নমনীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সামনে, যাদের বিরুদ্ধে বিশেষ অ্যান্টিবডি গড়ে তুলতে নমনীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সময় লাগে এক–দুই সপ্তাহ। এই এক–দুই সপ্তাহ সময়কাল অনেক ভাইরাসের পক্ষেই যথেষ্ট আমাদের শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করার জন্য। এর পরিণতি হতে পারে মৃত্যু বা দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা। টিকার লক্ষ্য হলো নির্দিষ্ট কিছু অ্যান্টিবডি গড়ে তুলতে শরীরকে আক্রমণের পূর্বেই সাহায্য করা, যাতে প্রয়োজনের সময় সেই অ্যান্টিবডির জন্য আমাদের এক–দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে না হয়। যেহেতু আমাদের শরীর বিশেষ অ্যান্টিবডি গড়ে তুলতে সক্ষম (যার বর্ণনা আমরা পেয়েছি আগের লেখাতে), তাই সফল টিকার লক্ষ্য হলো শরীরের ক্ষতি না করে অনুপ্রবেশকারী রোগ জীবাণুর পূর্ণ বা সঠিক অংশবিশেষ শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সামনে উপস্থাপন করা। অর্থাৎ কিছু দুর্বল বাপুরাম সাপুড়ে শত্রুকে ধরে শত্রুপক্ষ সম্পর্কে আগে থেকে জেনে নেওয়ার ব্যবস্থা করা। সেই হিসাবে টিকা তৈরি করা গুপ্তচরবৃত্তির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা তৈরির প্রচেষ্টাকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়:
১. নিষ্ক্রিয় ভাইরাস
এটা টিকা তৈরির আদি প্রক্রিয়া। কোনো ভাইরাসের সবচেয়ে মারাত্মক অংশ হলো তার আরএনএ বা বংশ সূত্রের ধারক। এই আরএনএ আমাদের শরীরের কোষের ভেতরে ঠিকঠাক জায়গায় ঢুকতে পারলে কোষের বিভিন্ন বাসিন্দাকে ব্যবহার করে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি করে। তাপ, রেডিয়েশন বা কেমিক্যালের সাহায্যে এই আরএনএকে খণ্ডবিখণ্ড করতে পারলে ভাইরাস নিষ্ক্রিয়। কারণ ভাইরাস তখন তার প্রোটিনগুলোর সাহায্যে কোষের ভেতর ঢুকতে পারবে ঠিকই, কিন্তু বংশবৃদ্ধি আর করতে পারবে না। সেই নিষ্ক্রিয় ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করালে ভাইরাসের বিভিন্ন প্রোটিনের বিরুদ্ধে করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে যেমন S বা Spike বা শজারু প্রোটিনের বিরুদ্ধে নমনীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সুযোগ পাবে অ্যান্টিবডি গড়ে তুলে B বা T কোষের স্মৃতির ভান্ডারে রেখে দেওয়ার। এর ফলে যখন সত্যিকারের ভাইরাসের আগমন ঘটবে, তখন এই অ্যান্টিবডির কারণে তারা হয়তো কোষেই ঢুকতে পারবে না।
নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের টিকা বহুল ব্যবহৃত, যেমন MMR, চিকেন পক্স, স্মল পক্স ইত্যাদি। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি নতুন ভাইরাসেকে কী করে টিকার জন্য নিষ্ক্রিয় করা যাবে, তা বুঝতে অনেক পরীক্ষা–নিরীক্ষার দরকার পড়ে। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললেও বছর দশেক লেগে যায় এই প্রক্রিয়ায় মানব শরীরের জন্য নিরাপদ টিকা আবিষ্কার করতে। মহামারি চলাকালে অত সময় কোথায়? আর টিকা যদি আগে থেকে আবিষ্কারও করা থাকে, তাহলেও পৃথিবীজুড়ে মহামারি এই প্রক্রিয়ায় টিকা তৈরি করে সামলানো সম্ভব নয়। কোষের থেকে ভাইরাসকে আলাদা করে বের করে নিষ্ক্রিয় করার প্রক্রিয়াটা একেক ভাইরাসের জন্য একেক রকম। তাই এই ধরনের টিকার আবিষ্কারের পরও সেই টিকা শিল্পজাত করার জন্য বহুল পরিমাণে কী করে বানানো যায়, তা–ও নতুন করে বের করতে হয়। অন্যান্য টিকার প্রযুক্তির তুলনায় এই প্রযুক্তি খুবই ধীরগতির। তারপরও এই বহুল পরীক্ষিত পথে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা আবিষ্কারের প্রয়োজনীয় চেষ্টা অনেকেই করছে, নতুন প্রযুক্তি যে সব সময় কার্যকরী হবে, তার কোনো মানে নেই। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে চীনের সিনোফার্ম, সিনোভ্যাক। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ে আছে ওদের টিকা (ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ে ভালো ফল দেখা দিলে একটা টিকাকে বাজারে ছাড়া হয়, পরের লেখাতে এ ব্যাপারে আরও আলোচনা করব)। ভারতবর্ষের ভারত বায়োটেকও এ ধরনের টিকা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের দ্বিতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা করে দেখছে।
২. ভাইরাসের অংশবিশেষ
নিষ্ক্রিয় ভাইরাস যে সব সময় ঠিকঠাক অ্যান্টিবডি গড়ে তুলতে সাহায্য করে, তা নয়। অনেক সময়ই ভাইরাসের গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিনের অংশ থাকে লুকানো, যেমন করোনাভাইরাসের S2 বা শজারু২ লুকানো থাকে S1 বা শজারু১ প্রোটিনের আড়ালে। এ ছাড়া আমাদের শরীরে গ্লাইক্যান নামের শর্করা অণু আছে প্রচুর। বিবর্তন ও পরিবর্তনের মাধ্যমে ভাইরাসের প্রোটিনের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো থাকে গ্লাইক্যান দিয়ে ঢাকা। করোনাভাইরাসের S1 বা শজারু১ প্রোটিনের পুরোটাই প্রায় এক গ্লাইক্যানের তৈরি বর্ম দিয়ে ঢাকা। এ রকম গুপ্ত প্রোটিন নিষ্ক্রিয় ভাইরাসে উন্মুক্ত না–ও হতে পারে। তাই একটা পূর্ণ ভাইরাসের জন্য যে অ্যান্টিবডিটা সবচেয়ে কার্যকরী, তা নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের জন্য তৈরি অ্যান্টিবডিগুলোর মধ্যে না–ও থাকতে পারে। তবে এ ধরনের অসুবিধাগুলো বেশি দেখা যায় ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে, যাদের জীবনযাত্রা ভাইরাসের থেকে অনেক বেশি জটিল। এ রকম ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় পুরো ভাইরাসকে শরীরে না পাঠিয়ে পাঠানো হয় ভাইরাসের কোনো একটা প্রোটিনকে, যাতে বিশেষভাবে ওই প্রোটিনের বিরুদ্ধে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। ভাইরাসের অংশবিশেষ নিয়ে টিকা তৈরি করার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো প্রয়োজনীয় প্রোটিন বা প্রোটিনের গুপ্ত অংশ, এমনভাবে পরিবর্তন করে তৈরি করা যাতে ভাইরাসের অন্যান্য অংশের অনুপস্থিতিতেও প্রোটিন স্থিতিশীল থাকে।
প্রোটিনসহ প্রতিটি জৈব অণুই দেহের তাপমাত্রায় ক্রমাগতভাবে স্পন্দিত হয়। এই স্পন্দনের মাঝেই একে অন্যের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আর খুলে এক গতিশীল স্থিতি অবস্থায় থাকে। এ রকম গতিশীল এক পারিপার্শ্বিক থেকে কোনো প্রোটিনকে যদি আলাদা করা হয়, তাহলে প্রায়ই তা আর নিজের স্বরূপ ধরে রাখতে পারে না, রূপ বদলে অন্য কোনো অকাজের, কখনোবা ক্ষতিকারক প্রোটিনে পরিণত হয়। তবে এ ব্যাপারে গবেষণা অনেকটা পরিণত। অনেক ক্ষেত্রেই সহজে, বিশেষ করে কম্পিউটারের সাহায্য এবং তার সঙ্গে গবেষণার অভিজ্ঞতা মিশিয়ে, কিছু পরমাণুর পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন করে (প্রোটিন ইঞ্জিনিয়ারিং) স্থিতিশীল ও কাজের প্রোটিন বানানো যায়। একবার স্থিতিশীল হলে সেই প্রোটিনকে শরীরে সরাসরি ঢোকানো হয় অথবা ঢোকানো হয় অন্য কোনো ভাইরাসের বাইরের খোলসের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে (আরএনএ বা ডিএনএ ব্যতীত ভাইরাসের খোলস বাপুরাম সাপুড়ের সাপের মতোই নির্বিষ)। যেহেতু প্রতি প্রোটিনের স্থিতিশীল করার প্রক্রিয়া আলাদা, তাই শিল্পজাত করে দ্রুত উৎপাদনের প্রক্রিয়াও প্রতিক্ষেত্রে আলাদা করে বের করতে হয়। মহামারির সময় প্রচুর পরিমাণের টিকা দ্রুত উৎপাদনের জন্য তাই প্রযুক্তিও খুব উপযুক্ত নয়। এই পথে টিকা আবিষ্কারের প্রয়োজনীয় চেষ্টার মধ্যে অন্যতম চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সস, সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া, কিউবার ইন্সটিটিউট অব ফিনলে দ্য ভাকুনাস, ফুজি ফিল্ম ডায়োসিন্থ বায়োটেকনোলজি ইত্যাদি। এদের সবার টিকাই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে।
৩. কৃত্রিম সমন্বিত টিকা
বিজ্ঞান কৃত্রিম সমন্বয়ে টিকা তৈরির এবং তা দ্রুত শিল্পজাত করার টিকার নকশা, তৈরি ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যাওয়ার সময় খুব কমিয়ে এনেছে। এই প্রযুক্তির মূলে হলো কম খরচে দ্রুত পৃথিবীর কোনো প্রান্তের নতুন এক জীবাণুর, যেমন ভাইরাসের, জিন (ডিএনএ বা আরএনএ) সংক্রান্ত খবর নির্ণয় করে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে পৃথিবীর বাকি সবাইকে তা জানিয়ে দেওয়া।
প্রোটিনের মতো ডিএনএ এবং আরএনএ কোষের অন্যতম প্রয়োজনীয় বাসিন্দা। আগে এদের বর্ণনা যথাযথভাবে দিতে পারিনি, তাই এদের সংক্ষেপ বিবরণী এখানে দিচ্ছি। আগে উল্লেখ করেছি, প্রোটিন ২০ রকম অ্যামিনো অ্যাসিড দিয়ে তৈরি। অ্যামিনো অ্যাসিড হলো বিশেষ কিছু পরমাণুর দ্বারা গঠিত দল, যা কোষ বারবার ব্যবহার করে বিভিন্ন রকম প্রোটিন তৈরি করে। প্রোটিনের ২০ রকমের অ্যামিনো অ্যাসিড যদি হয় বিরিয়ানির ২০ রকমের মসলা, তাহলে ডিএনএ বা আরএনএ হলো রোগীর পথ্য; থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়। ডিএনএ বা আরএনএ চার রকমের নিউক্লিক অ্যাসিড দিয়ে তৈরি। চার রকমের মধ্যে তিনটি ডিএনএ ও আরএনএর দুটোতেই পাওয়া যায়, একটি কেবল ডিএনএ না আরএনএর তার ওপর ভিত্তি করে ভিন্ন রূপ নেয়। নিউক্লিক অ্যাসিড অ্যামিনো অ্যাসিডের মতোই বিশেষ কিছু পরমাণু দ্বারা গঠিত দল, তবে এদের পরমাণুর দল অ্যামিনো অ্যাসিডের দলের থেকে অনেক আলাদা। একটি কোষে এরা প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান এবং এরাই ধরে রাখে কোন কোষ কী ধরনের প্রোটিন তৈরি করবে তার সংকেত। পরপর উপস্থিত তিনটি নিউক্লিক অ্যাসিড ঠিক করে কোষ তার থেকে কোন অ্যামিনো অ্যাসিড উৎপাদন করবে। তার ফলে কোনো ডিএনএ বা আরএনএতে কোন নিউক্লিক অ্যাসিড কোনটার পরে, এই ক্রমান্বয় জানলে, তা থেকে কোষ কী অ্যামিনো অ্যাসিডের ক্রমান্বয়ে গঠিত প্রোটিন তৈরি করে, তা জানা যায়। প্রোটিনের মতো হরেক বাহারের অণু বাদ দিয়ে এত সাদামাটা এক অণু যে জীবনের বংশবৃদ্ধির সংকেত ধরে রাখবে, এটা মানতে অনেক বিজ্ঞানীর শুরুর দিকে অসুবিধা হয়েছিল।
নিউক্লিক অ্যাসিড ক্রমান্বয়ে জুড়ে তৈরি হয় লম্বা শৃঙ্খল, যা আরএনএর ক্ষেত্রে সাধারণত একক এক শৃঙ্খল এবং ডিএনএর ক্ষেত্রে একজোড়া একে অন্যের পরিপূরক শৃঙ্খল (বিখ্যাত ডাবল হেলিক্স)। এবার গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে যদি আমরা জানি কোনো এক বিশেষ প্রোটিন টিকার জন্য উপকারী হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাহলে ওই লম্বা নিউক্লিক অ্যাসিডের ক্রমান্বয় থেকে যে অংশ ওই প্রোটিন তৈরি করার সূত্র ধরে রাখে, তার তথ্য সহজেই জোগাড় করতে পারি। এই তথ্য থেকে নতুন করে ডিএনএ বা আরএনএর একইর কম অংশ তৈরি করার প্রযুক্তি শিল্পজাত, দ্রুত ও সুলভ। একবার তৈরি হলে এ রকম কৃত্রিম নিউক্লিক অ্যাসিডের ক্রমান্বয় ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ঢুকিয়ে, ব্যাকটেরিয়ার কোষের বাসিন্দাদের সাহায্যে গবেষণাগারে আরও সস্তায় সংখ্যায় বাড়িয়ে নেওয়া যায় (যেমন ভাইরাস আমাদের কোষের বাসিন্দাদের সাহায্যে তার নিজস্ব ডিএনএ বা আরএনএ প্রচুর সংখ্যায় বাড়িয়ে বংশবৃদ্ধি করে)। একবার জিনসংক্রান্ত সব খবর হাতে পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় নিউক্লিক অ্যাসিডের ক্রমান্বয় বহুল পরিমাণে কয়েক দিনের মধ্যেই তৈরি করা সম্ভব।
ডিএনএ বা আরএনএ অংশবিশেষ কোষের ভেতর ঢোকাতে পারলে কোষ নিজেই তার যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে সেই নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরি করে নেয়। তার ফলে শরীরের নমনীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সুযোগ পেয়ে যায় সেই প্রোটিনের জন্য নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি গড়ে তোলার। কিন্তু মেমব্রেনের দুর্গ, সহজাত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এই সব পার করে একটা বহিরাগত প্রোটিনকে কোষের ভেতর ঢোকানো সহজ নয়। কোনো কোনো বিরল ক্ষেত্রে ডিএনএ বা আরএনএ অংশবিশেষ থেকে স্থিতিশীল প্রোটিন পরীক্ষাগারে তৈরি করে সরাসরি মাংসপেশির কোষে ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব, তবে করোনাভাইরাসের S বা শজারু প্রোটিনের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি।
কোষে প্রবেশের জন্য বিভিন্ন গবেষকের দল বিভিন্ন রকম কৃত্রিম মাধ্যমের সাহায্য নেয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অ্যাডেনোভাইরাসের ব্যবহার। এই ভাইরসের বংশবৃদ্ধির ধারক হলো ডিএনএ। এর ডিএনএকে কাটাছেঁড়া করে বেশ কিছু গবেষক নিরীহ অ্যাডেনোভাইরাস তৈরির কয়েক রকম উপায় বের করেছেন। যেমন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা উদ্ভাবন করেছেন চ্যাডক্স ১ নামে শিম্পাঞ্জির অ্যাডেনোভাইরাসের ওপর ভিত্তি করে এক মাধ্যম, যাকে সহজেই কোষের মধ্যে প্রবেশ করানো যায়, শরীরের কোনো ক্ষতি না করে। নিরীহ মাধ্যম মানে ভাইরসের সব অংশই সেখানে আছে, কেবল ডিএনএর কিছু অংশ বাদ দিয়ে। এর ফলে কোষের ভেতর ভাইরাস তার প্রয়োজনীয় সব প্রোটিন তৈরি করতে পারে না, তার ফলে পারে না বংশবৃদ্ধি করতে অথবা বংশবৃদ্ধি করলেও পারে না সেই কোষের কোনো ক্ষতি করতে। এবার এই কৃত্রিম মাধ্যমের ডিএনএর মধ্যে টিকার জন্য প্রয়োজনীয় ডিএনএর টুকরা জুড়ে দিলে সম্পূর্ণ হয় টিকা তৈরি। চ্যাডক্স ১ এই মুহূর্তে আছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়েলের তৃতীয় পর্যায়ে। রাশিয়ার গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও একই রকম পদ্ধতিতে ভিন্ন ধরনের অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করে তৈরি করেছে গাম-কোভিড-ভ্যাক। এই টিকা এই মুহূর্তে ক্লিনিক্যাল ট্রায়েলের দ্বিতীয় পর্যায়ে থাকা সত্ত্বেও বিতরণ করা হচ্ছে সে দেশের জনসাধারণের মধ্যে। এই পদক্ষেপ খুবই বিপজ্জনক, এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকস, যারা ব্যবহার করছে আরেক ধরনের অ্যাডেনোভাইরাস, তাদের টিকা আছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়েলের তৃতীয় পর্যায়ে। তৃতীয় পর্যায়ের ফল আসার আগেই চীন এই টিকা বিতরণ করেছে তাদের সামরিক বাহিনীর মধ্যে। চীন আর রাশিয়ার বিপদের সঙ্গে লটারি খেলা কতটা যুক্তিযুক্ত তা হয়তো আমরা জানতে পারব ঠিক সময়েই।
টিকার গল্প শেষ করতে চাই সবচেয়ে নতুন এম-আরএনএ প্রযুক্তির কথা বলে। এই প্রযুক্তিতে ডিএনএর অংশের পরিবর্তে এম-আরএনএ নামে এক বিশেষ আরএনএ ব্যবহার করা হয়। ডিএনএ ঘরের তাপমাত্রায় আরএনএ থেকে অনেক বেশি টেকসই আর স্থিতিশীল, কিন্তু নতুন প্রযুক্তি এম-আরএনএকেও করে তুলেছে অনেক টেকসই। এ ছাড়া এম-আরএনএ টিকা নমনীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে অনেক বেশি উজ্জীবিত করতে পারে। এই ধরনের টিকার মাধ্যম হলো লিপিড অণুর সাহায্যে কৃত্রিমভাবে তৈরি খুব ছোট একটা থলি বা লিপিড ন্যানো পার্টিকেল।
একবার কৃত্রিম মাধ্যম কোনো এক টিকার জন্য তৈরি হলে তার ভেতর প্রয়োজনীয় ডিএনএ বা আরএনএর অংশবিশেষ বদলে তাকে বদলে দেওয়া যায় অন্য কোনো একটা টিকায়। যেমন চ্যাডক্স ১–এর ওপর ভিত্তি করে MERS করোনাভাইরাসের (বর্তমানের SARS করোনাভাইরাস নয়, তবে তার কাছাকাছি) টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছিল। তাকে দ্রুত বদলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বর্তমান করোনাভাইরাসের টিকায় পরিণত করেছেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ (NIH) তো এ বছরের জানুয়ারিতে নিপাহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে এম-আরএনএ টিকা বানাচ্ছিল। করোনাভাইরাসের জিনসংক্রান্ত সব খবর হাতে পাওয়ার বিশ্বরেকর্ড মাত্র ৬ সপ্তাহের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসের টিকাকে করোনাভাইরাসের টিকাতে পরিণত করে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করে।
কৃত্রিম সমন্বিত ডিএনএ টিকা, যে প্রযুক্তির প্রথম গবেষণা শুরু হয়েছিল ২০ বছর আগে এবং এম-আরএনএ টিকা, যা মাত্র কয়েক বছরের পুরোনো, যে ভবিষ্যতের সংক্রমণের বিরুদ্ধে আমাদের প্রধান হাতিয়ার সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। তবে রাশিয়ার জনগণ ও চীনের সামরিক বাহিনী বাদ দিয়ে এই প্রযুক্তির কোনো টিকা এখনো সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহার করা হয়নি। (ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও পরীক্ষামূলক টিকা ঝুঁকি নিয়েই অনেক সময় যাদের নমনীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দুর্বল, তাদের ওপর প্রয়োগ করা হয় ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার শেষ হাতিয়ার হিসেবে। যেমন যুক্তরাজ্যে অনেক বয়স্কদের চ্যাডক্স ১ টিকা দেওয়া হয়েছে)। পশুপাখি ও মাছের ওপর এই প্রযুক্তির টিকা সফল হয়েছে এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের এখন অবধি ফলাফল আশাব্যঞ্জক। এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময়ই হয়তো দেখা মিলবে সব ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পার হওয়া এই প্রযুক্তির প্রথম মানবদেহের টিকার। নতুন প্রযুক্তি যেমন খুলে দেয় সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত, তেমনি নিয়ে আসে অনেক অজানা সম্ভাবনাকে। তাই নতুন প্রযুক্তি টিকার সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বহুল পরীক্ষিত পুরোনো প্রযুক্তির টিকাদেরও। এখন সময়ের অপেক্ষা, কোন সফল টিকা সার্থকভাবে সারা পৃথিবীর জনগণের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেওয়া যায়।
লেখক: পদার্থবিদ ও কম্পিউট্যাশনাল বায়োলজিস্ট, হ্যামিলটন, যুক্তরাষ্ট্র
১. করোনা কাহিনি ১ : অনুপ্রবেশের দরজা
২. করোনা কাহিনি ২ : সজারুর কাঁটা
৩. করোনা কাহিনি ৩ : কোষের শুল্ক গোয়েন্দা ও জহ্লাদ
৪. করোনা কাহিনি ৪ : টিকার পূর্বকথা ও নমনীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা