ওপেনএআই বনাম স্যাম অল্টম্যান: নাটকের তৃতীয় প্রহর

হঠাৎ ওপেনএআই থেকে বহিষ্কৃত হলেন স্যাম অল্টম্যান। আরও অনেক কর্মী পদত্যাগ করার ঘোষণা দিলেন এর ফলে। রুদ্ধশ্বাস এক নাটক প্রযুক্তিজগতে...

ওপেন এআই-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্যাম অল্টম্যান

চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে গোটা বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় এআই কোম্পানি হয়ে উঠেছে ওপেনএআই। চ্যাটজিপিটি, ডাল.ই ও হুইস্পারের মতো এআই মডেলের ব্যাপক সফলতায় কোম্পানির সঙ্গে সঙ্গে এই মডেলগুলোর কাজে জড়িত গবেষণা-প্রকৌশলী দল এবং এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্যাম অল্টম্যানও অনেক প্রশংসা কুড়ান। এ জন্য গত নভেম্বরে যখন ওপেনএআইয়ের পরিচালনা পর্ষদ হঠাৎ স্যাম অল্টম্যানকে চাকরি থেকে কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়া বরখাস্ত করে, তখন চমকে ওঠে সবাই।

প্রথম দিকে অনেক গুজব-গুঞ্জন শোনা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিশ্ববাসীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া কোম্পানির সিইও নিজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে চাকরি হারিয়েছেন—এই মর্মে অনেক খবর ও অসংখ্য মিম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে আগুনের মতো। তবে শিগগিরই পরিষ্কার হয়ে যায়, স্যাম অল্টম্যানের বদলে কোনো এআই নিয়োগ দেওয়া হবে বলে কোম্পানি থেকে তাঁকে ছাঁটাই করা হয়নি। বরং এটা কোম্পানির পরিচালনা বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছিল।

তবে শিগগিরই পরিষ্কার হয়ে যায়, স্যাম অল্টম্যানের বদলে কোনো এআই নিয়োগ দেওয়া হবে বলে কোম্পানি থেকে তাঁকে ছাঁটাই করা হয়নি। বরং এটা কোম্পানির পরিচালনা বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছিল

এমন সফল একটি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কোনো আগাম ঘোষণা ছাড়া বহিষ্কৃত হওয়ার বিষয়টি কোম্পানির বোর্ডকে সবার সামনে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরে। এরপর যখন মাইক্রোসফট স্যাম অল্টম্যানকে তাদের কোম্পানির এআই গবেষণা বিভাগের সিইওর ভূমিকায় নিয়োগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন ওপেনএআই কোম্পানির প্রায় ৯৫ শতাংশ কর্মী সেই বোর্ডকে খোলাচিঠি পাঠান। চিঠিতে তাঁরা স্পষ্ট করে জানান, স্যামকে যদি সেই কোম্পানিতে সিইও পদে পুনর্বহাল করা না হয় এবং এই পরিচালনা পর্ষদ যদি নিজে থেকে কোম্পানি থেকে সরে না যায়, তাহলে তাঁরা সবাই স্যামের সঙ্গে মাইক্রোসফটে যোগ দেবেন।

গত ১৭ নভেম্বর স্যামকে কোম্পানি থেকে বহিষ্কার করা হয়। পাঁচ দিনের মাথায় সেই বোর্ড বাধ্য হয়ে স্যামকে আবার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদে নিয়োগ দেয়। শর্তমতে, সেই ছয় সদস্যের বোর্ডও ভেঙে ফেলা হয়। গঠন করা হয় নতুন পরিচালনা বোর্ড, যা ওপেনএআই পরিচালনায় ভূমিকা রাখবে। আপাতদৃষ্টে বোর্ডকে পুরো ঘটনায় খলনায়ক বলে মনে হচ্ছে। তবে মূল ঘটনা এবং এর চরিত্রগুলোর ভূমিকা একটু ভিন্ন।

চলুন, পাঁচ দিনের এই নাটকীয়তা বিশ্লেষণ করে স্যাম অল্টম্যানকে কোম্পানি থেকে বের করে দেওয়ার পেছনের মূল উদ্দেশ্য জেনে আসি।

ওপেনএআই মূলত অলাভজনক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করা। কিন্তু গবেষণার জন্য প্রয়োজন ফান্ডিং। আর ফান্ডিংয়ের জন্য দরকার বিনিয়োগকারী। তাই ওপেনএআই বাইরের কিছু বিনিয়োগকারীর খোঁজ করে গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। খুঁজতেই মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ পেয়ে যায় খুব সহজে, তা–ও আবার মাইক্রোসফটের মতো টেক জায়ান্টের কাছ থেকে।

এই বিনিয়োগকারীদের অর্থ পরিশোধের জন্য ওপেনএআইকে ব্যবসা নিয়েও ভাবতে হয়। কীভাবে নিজেদের গবেষণালব্ধ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে লাভ বা মুনাফা অর্জন করা যায়, সে বিষয়ে জোর দিতে শুরু করে কোম্পানিটি।

এভাবে নন-প্রফিটের পাশাপাশি ওপেনএআই একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চলতে থাকে। তবে কোম্পানির বাণিজ্যিক অংশ যেন নন-প্রফিট অংশ থেকে বেশি গুরুত্ব না পায়, তার জন্য কোম্পানির বোর্ড কিছু নীতিমালা বেঁধে দেয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো এর লভ্যাংশের বণ্টন।

বোর্ডের দেওয়া সীমাবদ্ধতা অনুযায়ী কোম্পানির প্রথম দিকে করা বিনিয়োগকারীদের মূল বিনিয়োগের ১০০ গুণ লাভ হিসেবে ফেরত দেওয়া হবে। সেই ১০০ গুণ লাভ সব বিনিয়োগকারীকে পরিশোধ করা হলে ওপেনএআই আগের মতো সম্পূর্ণ নন-প্রফিট প্রতিষ্ঠান হিসেবে এআইয়ের গবেষণাকাজে যোগ দেবে।

অন্যদিকে বোর্ডের কাজ ছিল কোম্পানি যেন বেশি লাভের আশায় সূচনাকাল থেকে তাদের নন-প্রফিট উদ্দেশ্য, তথা মানবজাতির কল্যাণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ থেকে সরে না আসে। এসবের রেশ ধরেই বোর্ড স্যাম অল্টম্যানকে ওপেনএআই থেকে চাকরিচ্যুতি করতে বাধ্য হয়

ওপেনএআইয়ের তৎকালীন বোর্ডটি মূলত গবেষক ও এআই-বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত ছিল। বোর্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঠিক, উচিত প্রয়োগ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা। তারা চাইছিল, কোনোভাবে যেন বেশি লাভের আশায় ওপেনএআই এমন কিছু তৈরি না করে, যা মানুষের উপকারের চেয়ে ক্ষতিসাধনে বেশি ব্যবহৃত হবে।

লভ্যাংশের ওপর যে সীমাবদ্ধতা টেনে দেওয়া হয়েছিল, অনেকের তা উপযুক্ত মনে হয়নি। ফলে বোর্ডের সঙ্গে কোম্পানির বাণিজ্যিক অংশে কাজ করা অনেক কর্মীর, বিশেষ করে স্যাম অল্টম্যানের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দেয়।

স্যামসহ কোম্পানির অনেকে চাইছিলেন, ওপেনএআই ধীরে ধীরে মাইক্রোসফট বা গুগলের মতো বড় কোম্পানি হয়ে উঠুক। অন্যদিকে বোর্ডের কাজ ছিল কোম্পানি যেন বেশি লাভের আশায় সূচনাকাল থেকে তাদের নন-প্রফিট উদ্দেশ্য, তথা মানবজাতির কল্যাণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ থেকে সরে না আসে। এসবের রেশ ধরেই বোর্ড স্যাম অল্টম্যানকে ওপেনএআই থেকে চাকরিচ্যুতি করতে বাধ্য হয়।

তাদের ভাষ্যমতে, স্যাম কোম্পানির পুরোটা বাণিজ্যিকীকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন। বোর্ডের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও স্পষ্ট ছিল না। বোর্ডের সঙ্গে এই মতবিরোধ এবং কোম্পানির ব্যাপারে বোর্ডের সঙ্গে স্বচ্ছতার অভাবে স্যামকে কোনো আগাম বার্তা ছাড়া বরখাস্ত করা হয়। এমনকি কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের এবং মাইক্রোসফটকেও আগে থেকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।

ছয় সদস্যের বোর্ডের চারজনের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সিইও বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্যাম অল্টম্যানের সঙ্গে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট এবং চেয়ারম্যান গ্রেগ ব্রোকম্যানকেও তাঁর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়।

আরও পড়ুন
ওপেন এআই বোর্ডের সদস্য অ্যাডাম ডি’এঞ্জেলো, হেলেন টোনার, তাশা ম্যাককলিই ও সাটস্কেভার

বোর্ডের সদস্য অ্যাডাম ডি’এঞ্জেলো, হেলেন টোনার, তাশা ম্যাককলিই ও সাটস্কেভারের মতে, স্যাম অল্টম্যান কোম্পানির মূল উদ্দেশ্য ‘নিরাপদে ও সতর্কতার সঙ্গে শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ’ ভুলে গিয়ে চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ানো, বেশি মুনাফা এবং মাইক্রোসফটের মতো বিনিয়োগকারীদের খুশি করতে বেশি সচেষ্ট ছিলেন। বোর্ডের মতে, কোম্পানির উদ্দেশ্য এবং স্যামের উদ্দেশ্য ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছিল। এ জন্য তারা স্যাম অল্টম্যানকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। এর ফলে কোম্পানির ভেতর ও বাইরে থেকে যে বিপরীত প্রতিক্রিয়া আসবে, তা বোর্ড আন্দাজ করতে পারেনি।

স্যামকে পদচ্যুত করার তিন দিন পর ওপেনএআই কোম্পানির ৭৭০ কর্মীর ৯৫ শতাংশ—যাঁরা ওপেনএআইয়ের বাণিজ্যিক অংশে মূলত কাজ করতেন—কোম্পানি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে একটি খোলাচিঠি প্রকাশ করেন। এদিকে বহিষ্কারের পরপরই মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলা নতুন অ্যাডভান্সড এআই টিমের সিইও হিসেবে নিতে চান স্যামকে। গ্রেগ ব্রোকম্যানও মাইক্রোসফটের সেই টিমে যোগ দেন। স্যাম ও গ্রেগের সঙ্গে ওপেনএআই থেকে যেসব কর্মী এই এআই দলে যোগ দেবেন, মাইক্রোসফট তাঁদের ওপেনএআইয়ে থাকাকালের বেতন, সুযোগ-সুবিধা ও পদমর্যাদা দেবে বলে আশ্বস্ত করে।

এ কারণে ওপেনএআইয়ের বেশির ভাগ কর্মী স্যামকে নিজের পদে পুনর্বহাল না করলে কোম্পানি ছেড়ে মাইক্রোসফটে যোগ দেবেন বলে উল্লেখ করেন সেই চিঠিতে। এর সঙ্গে এই শর্তও জুড়ে দেন, স্যামকে তাঁর পদে বহাল রাখার পাশাপাশি সেই বোর্ডকেও পদত্যাগ করতে হবে। কেননা সেই বোর্ড কোম্পানির কর্মীদের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ।

কোনো এক কারণে বোর্ডের এক সদস্য সাটস্কেভার মত পরিবর্তন করে সেই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এটাও জানান যে স্যাম অল্টম্যানকে পদচ্যুত করা তাঁর তরফ থেকে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। যদিও তাঁর এই মত পরিবর্তনের পেছনের কারণ এখনো জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ওপেনএআইয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মী ও বিভিন্ন বিনিয়োগকারীর চাপে সাটস্কেভার মত পরিবর্তন করেছেন।

ওপেন এআই-এর লোগো
আরও পড়ুন

প্রথম দিকে বোর্ড এ চিঠিকে গুরুত্ব না দিলেও এত কর্মীর একসঙ্গে চলে যাওয়া কোম্পানির কী পরিমাণ ক্ষতি করবে, তা উপলব্ধি করতে পেরে বোর্ড স্যাম অল্টম্যান ও গ্রেগকে তাঁদের পদে পুনর্বহাল করতে বাধ্য হয়। কর্মীদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী দুজন বোর্ড মেম্বারকে পদত্যাগ করিয়ে নতুনভাবে বোর্ড গঠন করা হয়, যেখানে আগের বোর্ডের ডি’এঞ্জেলো এবং সেলসফোর্সের সাবেক সিইও ব্রেট টায়লর, সাবেক ট্রেজারি সচিব লরেন্স সামারস বোর্ড মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া মাইক্রোসফটের প্রতিনিধিসহ আরও কয়েকজন এই বোর্ডে যুক্ত হয়ে কোম্পানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন।

ওপেনএআইয়ের বোর্ড বনাম স্যাম অল্টম্যান ও তাঁর দলের লড়াইয়ে স্যাম অল্টম্যানই জিতলেন। তবে এর মাধ্যমে ওপেনএআই হারাল এমন এক বোর্ডকে, যা কোম্পানির উদ্দেশ্য এবং এআইয়ের সঠিক ব্যবহারের প্রতি ছিল যত্নশীল। এর ফলে ভবিষ্যতে হয়তো এমন আরও অনেক এআই মডেল ওপেনএআই তৈরি করবে, যা মানবজাতির ভালো-মন্দের পরিবর্তে লাভ-লোকশানের দিকটা বেশি দেখবে। বাড়বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপপ্রয়োগের ঝুঁকি।

লেখক: ব্যবস্থাপক, ডেফ্টাইল্ড

সূত্র: ওয়্যার্ড এবং ব্লুমবার্গ

* লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত