সাক্ষাৎকার

আনন্দের সঙ্গে কাজ করতে পারাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি

এহসান হক বর্তমানে সৌদি আরবের ডেটা অ্যান্ড এআই অথরিটির প্রধান গবেষক। এর আগে ১১ বছর যুক্তরাষ্ট্রের রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটারবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব মেডিসিন তাঁকে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ বিষয়ে উদীয়মান পথপ্রদর্শক হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৪, ১৬ ও ১৯ সালে পেয়েছেন গুগল ফ্যাকাল্টি অ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়াও সায়েন্স নিউজ তাঁকে ‘টেন সায়েন্টিস্ট টু ওয়াচ’ হিসেবে চিহ্নিত করে ২০১৭ সালে। এর আগের বছর এমআইটি টেক রিভিউ ৩৫ বছরের কম বয়সী বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন হিসেবে ভূষিত করে তাঁকে।

সম্প্রতি তিনি এসেছিলেন বিজ্ঞানচিন্তা কার্যালয়ে, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এতে উঠে এসেছে তাঁর গবেষণা, পড়ালেখা, অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞানভাবনা, শৈশবের নানা স্মৃতিসহ অনেক কিছু। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ম্যাগাজিনটির নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার ও সম্পাদনা দলের সদস্য কাজী আকাশ। ছবি তুলেছেন আশরাফুল আলম

বিজ্ঞানচিন্তা:

কেমন আছেন?

এহসান হক: ভালো আছি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

দীর্ঘদিন পর দেশে এসে কেমন লাগছে?

এহসান হক: দেশে ফিরে ভালোই লাগছে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

সম্প্রতি সৌদি আরবের জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণাকেন্দ্রে কাজ শুরু করেছেন। সেখানে কী ধরনের কাজ করছেন?

এহসান হক: আমি ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টারের কম্পিউটার সায়েন্সের প্রফেসর। একজন একাডেমিকের কাজ হলো পেপার পাবলিশ করা কিংবা গ্র্যান্ট লেখা বা শিক্ষার্থীদের পড়ানো। কিন্তু আমার এখনকার কাজটা এগুলো থেকে ভিন্ন। প্রযুক্তি প্রয়োগ করে নতুন অনেক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি সৌদি আরবের জন্য। পাশাপাশি ধর্ম, চিকিৎসা, প্রযুক্তি কিংবা হজ মন্ত্রণালয়ে কীভাবে প্রযুক্তি কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে কাজ করছি। কারণ, যেকোনো সরকারই নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে একই প্যাটার্নে কাজ করে। বেশি পরিবর্তন পছন্দ করে না। সে ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনতে হলে ঠিক করতে হবে কোন ভাষা প্রয়োগ করব, কীভাবে প্রযুক্তিকে অন্য মোড়কে সাজাব, যাতে প্রযুক্তিজ্ঞান না থাকা মানুষও সেটা বোঝে এবং গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়। এ ধরনের কাজগুলো আমরা একাডেমিতে করতে পারি না। সে ক্ষেত্রে বলব, এ কাজ আমার জন্য খুব আনন্দদায়ক ও শিক্ষণীয়। আমরা যেখানে কাজ করি, সেখানকার বেশির ভাগ মানুষ সৌদি আরবের নাগরিক। তারা সবাই উচ্চশিক্ষিত। ভালো ইংরেজি বলতে পারে। ৫০ শতাংশের বেশি নারী। তাদের সঙ্গে যখন কাজ করছি, তখন আরও নতুনভাবে অনেক কিছু শিখছি। সৌদি সরকারের কাজ করার ধরন সম্পর্কে জানতে পারছি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি অনেক দিন ধরে এআই নিয়ে কাজ করছেন। আপনার নামে এমএস ওয়ার্ডের একটা পেটেন্টও আছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যেভাবে এআই প্রসারিত হচ্ছে, একে আপনি কীভাবে দেখছেন?

এহসান হক: ইতিবাচকভাবেই দেখছি। তবে এখন অনেকেই চিন্তিত যে বর্তমানের শিক্ষার্থীরা কী নিয়ে পড়াশোনা করবে। যদি এআই দিয়েই সব করা যায়, তাহলে আমাদের নতুন কৌশল কী হবে? এর উত্তর আসলে কেউ জানে না। কিছু দিন আগে মানুষ ভাবত, সৃজনশীলতা এমন একটি বিষয়, যেটা এআই রিপ্লেস করতে পারবে না। কিন্তু এখন এআই এমনভাবে ছবি আঁকতে পারে, বোঝাই যায় না এটা মানুষ এঁকেছে নাকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ইংরেজিতে একটি বাক্য লিখলেই এআই সেই বাক্যের অর্থ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝতে পারছে, তার ওপর ভিত্তি করে ৫ থেকে ১০ সেকেন্ডের স্বয়ংক্রিয় ভিডিও তৈরি করছে। ভিডিওগুলো বেশ মানসম্মতও। বোঝার উপায় নেই যে এটি মানুষ তৈরি করেছে নাকি এআই। সে ক্ষেত্রে হয়তো অনেক টাকা ব্যয় করে একটা ক্যামেরা বা ভিডিওগ্রাফার না–ও লাগতে পারে। এআইকে কমান্ড দিলে ভিডিও বানিয়ে দেবে। খরচও কমবে। ফলে এআইবিহীন অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এআই আমাদের চাকরি নেবে না, বরং আরও চাকরির নতুন ক্ষেত্র তৈরি করবে। সে ক্ষেত্রে কোন ধরনের চাকরি তৈরি হবে, তা আন্দাজ করা একটু কঠিন। যেমন দুই থেকে তিন বছর আগেও কেউ জানত না ‘প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং’ বলে একটি চাকরি থাকতে পারে। আমি চ্যাটজিপিটি বা লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলে কোন ধরনের প্রশ্ন করব বা কী প্রশ্ন করব? আসলে ওসব মডেল থেকে যেসব উত্তর আসে, তা নির্ভর করে ‘প্রম্পট’-এর মানের ওপর। যে যত সুন্দর করে প্রম্পট লিখতে পারে, তার আউটপুট হয় তত ভালো। যেমন গুগলে সার্চ দিলে কোন লেখাগুলো সামনে আসবে, সেটা ওই প্রম্পটের ওপর নির্ভর করে। এ ধরনের চাকরির এখন অনেক দাম। কিছু বছর আগেও এগুলো ছিল না। এখন তৈরি হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের চোখ-কান খোলা রাখতে হবে—প্রযুক্তি কোন দিকে যাচ্ছে, কোন ধরনের চাকরি তৈরি হচ্ছে এবং সে ক্ষেত্রে নতুন কৌশলগুলো শেখার উপায় কী? এখন তো ইউটিউবে অনেক কৌশল শেখা যায় বিনা মূল্যে। ফলে নতুন কোনো কৌশল আয়ত্তে আনা কঠিন কিছু নয়।

অর্থাৎ আমরা যদি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি, নতুন সব কৌশল জানি, তাহলে এআই আমাকে কখনো রিপ্লেস করবে না। কিন্তু যারা এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবে না, তাদের সমস্যা হতে পারে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

মধ্যপ্রাচ্যে প্রযুক্তির উন্নতি নিয়ে কেউ আগে এতটা ভাবেননি। সৌদি আরব এ ক্ষেত্রে সবার আগে এগিয়ে এসেছে। বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?

এহসান হক: সৌদি আরবের বর্তমান সরকার এআইয়ের পাশাপাশি সব ব্যাপারেই বেশ অগ্রসর। তবে এআইয়ের ক্ষেত্রে তারা সুদূরপ্রসারী চিন্তা করছে। সরকার এখন এআইকে পরবর্তী তেল হিসেবে ভাবছে। যে দেশ এআইয়ে এগিয়ে যাবে, তারা বেশি ক্ষমতাবান হবে। সৌদি আরব সেই ক্ষমতা অর্জন করতে চাইছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে জনগণের জীবনযাত্রার সূচক পরিবর্তন করতে চাচ্ছে তারা। রাষ্ট্রের কাজ হলো জনগণের সেবা করা। যেমন পড়ালেখা, নিরাপত্তা, যোগাযোগ, হজ—এসব ক্ষেত্রে কীভাবে এআই ব্যবহার করা যায়, সেই প্রচেষ্টা চলছে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

সৌদি আরব ‘নিওম’ নামের একটি অঞ্চল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এ রকম আরও কিছু শহর তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে এআইয়ের ভূমিকা কতটুকু?

এহসান হক: নিওম এখন সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট। প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারের কাজ হচ্ছে। ‘নিওম’ নতুনভাবে একটি শহর নির্মাণের চেষ্টা করছে, যেখানে লোকালয়ের ধারেকাছে কোনো যানবাহন থাকবে না। দ্রুততম ট্রেন থাকবে মাটির নিচে, যাতে শহরের যেকোনো জায়গায় কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছানো সম্ভব। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ থাকবে না। এনার্জির দিক থেকে শহরটি হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগেই মানুষ বুঝতে পারবে যে তার এই এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই আগে থেকেই প্রতিহত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কারও হাসপাতালে যেতে হবে না। কারণ, সবাই বাসায় থেকেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা নিতে পারবে। কিন্তু কীভাবে এ ধরনের সায়েন্স ফিকশনের শহরটি তৈরি হবে, তা এখনো কেউ জানে না—এ রকম একটি অজানা মিশন নিয়ে তারা এগোচ্ছে। ফলে এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ একটি প্রকল্প। কিন্তু যদি তারা সফল হয়, তাহলে পুরো বিশ্বের জন্য একটি নিদর্শন তৈরি হবে। আর পুরো শহর তৈরি হবে এআই দিয়ে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বাংলাদেশে এআইয়ের ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?

এহসান হক: বাংলাদেশে এখন অনেক স্টার্টআপ তৈরি হচ্ছে। বিদেশ থেকেও বাংলাদেশে কাজ আসছে। যারা প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত, তাদের উপলব্ধি করাতে হবে যে এআই একটি বিনিয়োগযোগ্য ক্ষেত্র। বাংলাদেশ সরকার যদি এআই খাতে আরও বিনিয়োগ করে, তাহলে আরও দ্রুত উন্নতি করা সম্ভব। আমি কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এথিক্যাল এআইয়ের ব্যাপারে একটি গাইডলাইন বা খসড়া অনলাইনে পড়েছি। এটি একটি ভালো লক্ষণ।

বিজ্ঞানচিন্তার দপ্তরে এহসান হক
ছবি: বিজ্ঞানচিন্তা
বিজ্ঞানচিন্তা:

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যেতে চাইলে কী করা উচিত বলে মনে করেন?

এহসান হক: আমাদের তরুণ প্রজন্মের ওপর বিনিয়োগ করা উচিত। দেশে প্রাইভেট বা পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে পর্যাপ্ত রিসোর্স নেই। শুধু কয়েকটি ইউনিভার্সিটিতে ‘জিপিইউ’ আছে। ফলে বিনিয়োগ করে শিক্ষার্থীদের যথাযথ পরিবেশ দেওয়া উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা এখনকার নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন কিছু শিখতে পারে। পুরোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা এগোতে পারব না। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাব।

বিজ্ঞানচিন্তা:

প্রযুক্তি-দুনিয়ার সেরা আবিষ্কার বা উদ্ভাবন কোনটাকে মনে করেন?

এহসান হক: এ প্রশ্নের উত্তর ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কারণ, নতুন যা আসে, মানুষ তাকেই সবচেয়ে ভালো মনে করে। তবে গত ১৫ বছরে মানুষের জীবনযাত্রার মান সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে মুঠোফোন। দেখুন, আমাদের সবার হাতে হাতে মুঠোফোন। মুঠোফোনও অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে। আগে সব মুঠোফোনে কি-বোর্ড থাকত। কিন্তু স্টিভ জবস পরে কি-বোর্ডের পরিবর্তে সম্পূর্ণ স্ক্রিন বানালেন। আমরা সবাই এখন ইন্টারনেটের মধ্যে থাকি, পকেটে একটা করে কম্পিউটার নিয়ে ঘুরে বেড়াই।

মার্ক উইজার নামের একজন গবেষক আছেন। তিনি বলেছিলেন, একটা প্রযুক্তি একপর্যায়ে অদৃশ্য হয়ে গেলে পরিণত হয়। যেমন ধরুন, বিদ্যুৎ। আমরা সবাই জানি, বিদ্যুৎ আছে বলেই লাইট জ্বলছে, পাখা ঘুরছে, কিন্তু বিদ্যুৎ আমরা কেউ দেখতে পাচ্ছি না। আবার ধরুন, ইন্টারনেট। সব জায়গায় থাকলেও আমরা তা দেখতে পাচ্ছি না। মুঠোফোনটাও আমার কাছে তেমনই লাগে। সবখানে আছে এবং এত বেশি আছে যে আমরা যেন দেখতেই পাই না। এটাই আমার কাছে সমসাময়িক কালের এক বড় উদ্ভাবন মনে হয়।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার শৈশব সম্পর্কে একটু জানতে চাই। আপনার জন্ম, পড়ালেখা—এই যাত্রার গল্পটা বলুন।

এহসান হক: আমার জন্ম ঢাকায়। নার্সারি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি উদয়ন স্কুলে। এরপর ইন্টারমিডিয়েট (এইচএসসি) পর্যন্ত পড়েছি ঢাকা কলেজে। স্কুল নিয়ে আমার একটা ঘটনা আছে। স্কুলে পড়ার সময় আমি প্রথম সারির শিক্ষার্থী ছিলাম না। আসলে আমি হতে চাইতামও না। ভাবতাম, অল্প পড়ে কাজ হলে বেশি পড়ার দরকার কী? ফলে আমি এমনভাবে পড়তাম যে কোনোরকমে সম্মানজনক পাস করতাম। এ রকম করতে করতে অষ্টম শ্রেণিতে ইংরেজিতে ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করলাম। বিষয়টি আমার খুব খারাপ লাগল। বুঝতেই পারিনি কী হলো। ফেল করার পর বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম। যাত্রাবাড়ীর একটি মসজিদে এক রাত কাটিয়েছিলাম। কিন্তু এক বিষয়ে ফেল করলেও আমাদের ‘গ্রেস’ দিয়ে পরের ক্লাসে ওঠাল। নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ছিল ৬৩ জন। আমার রোল ছিল ৬৩। ফলে তখন দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গেল। এরপর আমি ওই দুই বছর, মানে নবম ও দশম শ্রেণিতে অনেক পড়াশোনা করি। রেজাল্টও ভালো করি। সে জন্য আমার মনে হয়, মানুষের জীবনে ব্যর্থতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ব্যর্থতার মাধ্যমেই আপনি সামনে এগোবেন। ক্লাস এইটে ফেল না করলে এই উপলব্ধি আমার আসত না। ওই ট্রেনের মতো ধীরে ধীরে জীবন এগিয়ে যেত। ব্যর্থতা থেকে অনেক কিছু শেখা যায়।

যাঁরা সারা জীবন সফল হয়ে এসেছেন, আমি নিশ্চিত, তাঁরা অনেক বেশি ব্যর্থও হয়েছেন।

বিজ্ঞানচিন্তা:

পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে গেলেন কখন?

এহসান হক: ঢাকা কলেজ থেকে পাস করার পর বাইরে গিয়েছি। ঢাকা কলেজে থাকতে আমার বেশি পড়াশোনা করতে হয়নি। নিজে যেটুকু করেছি, সেটুকুই। আমরা সারা দিন মজা করে বেড়াতাম। অধ্যাপকেরা ক্লাসে বেশি পড়াতেন না। তাঁদের বাসায় গিয়ে পড়তে হতো। সবাই পড়াশোনা করত ভালো ফলাফল করে যাতে বুয়েট বা মেডিকেলে পড়তে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় না অধিকাংশ শিক্ষার্থী আনন্দের জন্য পড়ত। তাই তখন ভেবেছি, একটা পরিবর্তন দরকার। সে জন্য বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। তখন আমেরিকান সেন্টারে গিয়ে খোঁজ করতে শুরু করলাম, কী নিয়ে পড়া যায়। তারা আমাকে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে জানাল। কীভাবে পড়াশোনা করে যাওয়া যায়, তা বলে দিল। পরে আমি সেভাবে পড়াশোনা করে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই।

সেখানে গিয়ে পড়া শুরু করি কম্পিউটার সায়েন্সে। পড়াশোনা ইংলিশ মিডিয়াম হওয়ায় খুব বিপদে পড়েছিলাম। কারণ, আমি পড়েছি বাংলায়। ওখানে গিয়ে দেখি, ইংরেজি বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। তার ওপর একদম হাতে-কলমে শিক্ষা, তখন আমি অনেক কষ্ট করেছি খাপ খাওয়াতে। প্রথম সেমিস্টারে খুব খারাপ করার পর ‘প্রবেশনে’ চলে যাই। কারণ, আমার জিপিএ অনেক কম ছিল। ওখানেও ব্যর্থ না হয়ে কোনোরকমে পাস করে গেলে আর ভালো করতে পারতাম না। ওভাবেই খারাপ করতে করতে এগোতাম। দ্বিতীয় সেমিস্টারে গিয়ে সামান্য ভালো করলেও তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় বদলে ফেলি, অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আবার নতুন করে শুরু করি। সেই নতুন যাত্রা ও উদ্যম খুব প্রয়োজনীয় ছিল।

বিজ্ঞানচিন্তা:

এরপর গবেষণা শুরু করলেন কীভাবে?

এহসান হক: প্রথম থেকেই আমি চেয়েছিলাম প্রফেসরদের সঙ্গে কাজ করতে। সে জন্যই দেশ ছেড়ে বিদেশে পড়তে যাই। প্রফেসরদের সঙ্গে হাতে-কলমে কাজ করে তাঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছিলাম, যাতে তাঁদের কাছ থেকে শিখতে পারি। অনেক প্রফেসরের কাছে গিয়ে ঘুর ঘুর করেছি। বেশির ভাগ প্রফেসর বলতেন, ‘তোমাকে দিয়ে হবে না, তুমি অনেক পিছিয়ে আছো। অনেক কিছু জানো না। তোমাকে ট্রেনিং দিয়ে আমার কোনো লাভ হবে না।’

এরপর আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস থেকে একটা ছোট ক্যাম্পাসে যাই। ভেবেছিলাম, ছোট ক্যাম্পাসে প্রফেসররা আমাকে কাজ দিতে পারেন। কারণ, হাতে-কলমে কাজটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দরকার ছিল সঠিক মেন্টরশিপ। সেখানে যাওয়ার পর র‍্যালফ ফোর্ড নামের একজন প্রফেসরের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি মানুষ হিসেবে ছিলেন চমৎকার। তিনি তখন ডিপার্টমেন্ট চেয়ার ছিলেন। আমার জিপিএ ভালো না থাকা সত্ত্বেও কেন যেন তিনি আমাকে একটি সুযোগ দিলেন। দুই বছর তাঁর সঙ্গে কাজ করলাম। তিনি মানুষের প্রতিভা খুঁজে বের করতে পারতেন। আমার প্রতিভা বুঝতে পেরেছিলেন এবং সাহায্য করেছিলেন। আমি তাঁর প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ। এটা ২০০৪ সালের ঘটনা।

এরপর একটা মজার ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালে র‍্যালফ ফোর্ড আমাকে আউটস্ট্যান্ডিং অ্যালামনাইয়ের জন্য নমিনেট করেন। ফলে আমি পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে একটি পুরস্কার পাই। র‍্যালফ ফোর্ড সেখানে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমার ২৫ বছরের শিক্ষকজীবনে এমন কৌতূহলী শিক্ষার্থী পাইনি।’ এটা ছিল আমার জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণা। তিনি যে আমাকে ১২ বছর মনে রেখেছিলেন, এটা অবাক করার মতো ব্যাপার। সেখান থেকে আমি বুঝলাম, শুধু ভালো কাজ করলে হবে না, ভালো মেন্টর হতে হবে। আমি এখন চিন্তা করি, কীভাবে আমি র‍্যালফ ফোর্ডের মতো হতে পারি। অন্যের প্রতিভাকে চিহ্নিত করে তাকে আরও প্রস্ফুটিত করতে পারি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

কম্পিউটার সায়েন্স কেন বেছে নিয়েছিলেন?

এহসান হক: ১৯৯৯ সালে ঢাকা শহরে কম্পিউটারের একটা বুম চলছিল। আমার তখন কোনো প্যাশন ছিল না। তবে শুরুতে ক্লাসগুলো নিয়ে আমি বেশ স্ট্রাগল করি। কোনো কিছু নিয়ে স্ট্রাগল করলে আমি সেটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিই। পরে দেখা যায়, ওই জিনিস ধীরে ধীরে সহজে পরিণত হয়েছে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

এমন কোনো বইয়ের নাম বলবেন, যেটা সবার পড়া উচিত?

এহসান হক: দ্য পাওয়ার অব পজিটিভ নো নামের একটি বই পড়েছিলাম। সেটির কথাই বলব। অনেক সময় আমরা ‘না’ বলতে পারি না, ‘হ্যাঁ’ বলতে হয় অনিচ্ছা সত্ত্বেও। ইতিবাচকভাবে কীভাবে ‘না’ বলব, তা বলা হয়েছে বইটিতে। কাউকে মনমরা না করে ‘না’ শব্দটি সুন্দরভাবে বলতে পারা একটি বড় গুণ।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি তো আগে অনেক বই পড়েছেন। এখন কি মনে হয়, সেই পড়া আপনার জীবনে কোনো কাজে লেগেছে?

এহসান হক: অনেক বই পড়লে শব্দভান্ডার ও তার প্রয়োগ তীক্ষ্ণ হয়। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ।

বিজ্ঞানচিন্তা:

শৈশবে কী হতে চেয়েছিলেন?

এহসান হক: ক্রিকেটার। কখনো ভাবিনি বিজ্ঞানী হব। অবশ্য এখনো নিজেকে বিজ্ঞানী ভাবি না। শুধু জানি, লেগে থাকতে হবে। লেগে থাকলে কাজ হবে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চূড়ান্ত গন্তব্য কী?

এহসান হক: মানুষের সঙ্গে মানুষের সুসম্পর্ক, ভালোবাসা ও হৃদ্যতা বাড়ানোই হওয়া উচিত বিজ্ঞানের চূড়ান্ত গন্তব্য। প্রযুক্তির কাছে প্রত্যাশা কমিয়ে পরস্পরের কাছে প্রত্যাশা বাড়াতে হবে। একা হয়ে গেলে চলবে না। একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে তাকে পরিচর্যা করতে হবে। একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

একনজরে

জন্ম: ২৩ অক্টোবর, ১৯৮১; নারিন্দা, ঢাকা

বাবা: এনামুল হক

মা: সৈয়দা লুৎফে সাবা

পরিবার: স্ত্রী নাফিসা আলম ও ২ ছেলে

প্রিয় গায়ক: মাইলস

মুভি: জীবন থেকে নেওয়া

অবসর: সাইকেল চালানো, পড়া, ছবি তোলা

বিজ্ঞানচিন্তা:

গবেষণা বা উচ্চশিক্ষার জন্য কেউ দেশের বাইরে যেতে চাইলে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন?

এহসান হক: ইন্টারমিডিয়েট (এইচএসসি) শেষ করে যেতে চাইলে ফলাফলের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখতে চায়, অন্যান্য অ্যাকটিভিটি কেমন আছে। কোনো ক্লাব করা, স্বেচ্ছাসেবীর কাজ, খেলাধুলা, অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ অনেক ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। এগুলো থাকলে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর অনার্সের পর যেতে চাইলে সুপারিশপত্র (রিকমেন্ডেশন লেটার) খুব গুরুত্বপূর্ণ। গতানুগতিক কাজের পাশাপাশি নতুন কী করেছেন, সবাই তা দেখে। কারণ, সবাই সৃজনশীল ও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ পছন্দ করেন। যেমন যাঁরা পড়াশোনার পাশাপাশি অন্য কিছুও করেছেন, হয়তো গ্রামে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন, হয়তো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে স্বেচ্ছায় নগরকে সুন্দর করার কাজে সময় দিয়েছেন।

বিজ্ঞানচিন্তা:

কেউ বিজ্ঞানী হতে কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?

এহসান হক: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে কৌতূহল। সবকিছু সম্পর্কে জানার ইচ্ছা থাকতে হবে। এআইয়ের জনক মার্ভেন মিনস্কি এমআইটির প্রফেসর ছিলেন। মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। তাঁর সঙ্গে একবার কথা বলেছিলাম। পুরো সময়টা আমার দিকে না তাকিয়ে অন্য কিছু দেখছিলেন। একটি শিশুর মতো কৌতূহল নিয়ে। আবার আমার প্রশ্নের সব উত্তর যথাযথভাবে দিচ্ছিলেন। কিন্তু চোখ দুটি চারদিকে সব দেখছে। কী নিদারুণ তাঁর কৌতূহল। আপনি জোর করে এটা নিজের মধ্যে নিতে পারবেন না। তবে জানার আগ্রহ থাকলে গুণটি আপনার ব্যক্তিত্বের মধ্যে চলে আসবে। গুণটি থাকলে অন্য গুণগুলো এমনি এমনি আপনার রপ্ত হয়ে যাবে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানচিন্তার বেশির ভাগ পাঠক কিশোর ও তরুণ। তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন।

এহসান হক: জীবনে ব্যর্থতা আসবেই। কিন্তু তুমি যদি এমন কোনো কাজ করো, যা তুমি ভালোবাসো এবং তাতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করো, তাহলে ব্যর্থতা তোমাকে কখনো কাবু করতে পারবে না। ব্যর্থ হলেও অন্ততপক্ষে কাজটা তো ছিল আনন্দের এবং পরিতৃপ্তমূলক। এই কাজ করতে পারাই হচ্ছে আসল পুরস্কার। আনন্দের সঙ্গে কাজ করতে পারাই জীবনের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি। বাকি সব হচ্ছে বোনাস।

অনুলিখন: অনিক রায়, শিক্ষার্থী, তিতুমীর কলেজ, ঢাকা