উইকিপিডিয়া কি তথ্যসূত্র হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য

উইকিপিডিয়ার তথ্য কি সরাসরি বিশ্বাস করা উচিত? জবাব: না! আমাদের কি উইকিপিডিয়া ব্যবহার করা উচিত? উত্তর: হ্যাঁ! কেন সরাসরি বিশ্বাস না করলেও ব্যবহার করা উচিত? উত্তরটা লুকিয়ে আছে কীভাবে ব্যবহার করা উচিত, তার ভেতরে।

প্রথমে একটা মজার কথা বলি। উইকিপিডিয়া নিজেই বলে, ‘উইকিপিডিয়া: উইকিপিডিয়া ইজ নট আ রিলায়েবল সোর্স’। অর্থাৎ উইকিপিডিয়া নির্ভরযোগ্য উৎস নয়। তাই একটি উইকিপিডিয়া নিবন্ধে আরেকটি উইকিপিডিয়া নিবন্ধকে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। বরং একই তথ্য দুটি উইকিপিডিয়া নিবন্ধে ব্যবহার করা হলে প্রথম উইকিপিডিয়া নিবন্ধটিকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার না করে, সেই নিবন্ধের সূত্রগুলো ব্যবহার করা হয়। তাহলে প্রশ্ন আসে, কীভাবে উইকিপিডিয়া ব্যবহার করব? তা নিয়েই এ লেখায় আলোচনা করব।

ছবি: ইংরেজি উইকিপিডিয়া সম্প্রদায়, সিসি বাই এসএ ৪.০

মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরেকটা কথা বলে নিই। ‘রিডিং উইকিপিডিয়া ইন দ্য ক্লাসরুম’ নামে একটি টিচার্স ট্রেনিং প্রোগ্রাম আছে। সারা পৃথিবীতে এই প্রশিক্ষণের জন্য ৭৩ জন সার্টিফায়েড ট্রেইনার রয়েছেন। উইকিপিডিয়া ব্যবহার করে কীভাবে শিক্ষার্থীদের ‘মিডিয়া অ্যান্ড ইনফরমেশন লিটারেসি’ বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে হাইস্কুল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেন তাঁরা। গত এক বছরে নাইজেরিয়া, ইউক্রেন, কলম্বিয়া, মরক্কো, ইয়েমেন, বলিভিয়া, জর্দানসহ অনেকগুলো দেশে হাইস্কুল শিক্ষকদের এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। এসব কার্যক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইউনেস্কো, সংশ্লিষ্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসহ শিক্ষাখাতের অন্যান্য স্টেকহোল্ডাররা পার্টনার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকেন। এই প্রশিক্ষণ কারিকুলাম ইউনেস্কোর ‘মিডিয়া অ্যান্ড ইনফরমেশন লিটারেসি ফ্রেমওয়ার্কের’ ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। 

রিডিং উইকিপিডিয়া ইন দ্য ক্লাসরুম প্রোগ্রামের সার্টিফায়েড ট্রেইনারদের ব্যবহৃত ব্যাজ
ছবি: BerlinRosen, সিসি বাই এসএ ৪.০

ইউনেস্কোর মিডিয়া অ্যান্ড ইনফরমেশন লিটারেসি (এমআইএল) ফ্রেমওয়ার্কের তিনটি মূল কম্পোনেন্ট বা উপাদান রয়েছে। প্রথমটি হলো একজন মানুষের কী তথ্য দরকার এবং কোথা থেকে সেই তথ্য খুঁজে পেতে হবে, তা জানা। দ্বিতীয় দক্ষতা হলো, তথ্য খুঁজে পাওয়ার পর ঠিকভাবে বুঝতে পারা এবং তার সত্যতা যাচাই করা। আর তৃতীয়টি হলো নিজে জ্ঞান তৈরি করতে পারা এবং সেটি যথাযথ উপায়ে ব্যবহার ও সবার সঙ্গে শেয়ার করার দক্ষতা। ‘রিডিং উইকিপিডিয়া ইন দ্য ক্লাসরুম’ প্রোগ্রাম মূলত এই তিনটি মূল উপাদানের ওপর ভিত্তি করে উইকিপিডিয়ার কর্মপ্রণালী ব্যবহার করে একজন শিক্ষকের মিডিয়া অ্যান্ড ইনফরমেশন লিটারেসি বাড়াতে কাজ করে। এ লেখায় উইকিপিডিয়া বিশ্বাসযোগ্য কি না বা কতটা বিশ্বাস করা উচিত, তা আলোচনা করতে গিয়ে রিডিং উইকিপিডিয়া ইন দ্য ক্লাসরুম প্রোগ্রামে এমআইএলের দ্বিতীয় দক্ষতা, অর্থাৎ তথ্য যাচাই করার দক্ষতা নিয়ে যে কারিকুলাম রয়েছে, তা অনুসরণ করা হয়েছে। গোটা এমআইএল, বিশেষত দ্বিতীয় উপাদানটি—অর্থাৎ তথ্য যাচাই করার দক্ষতা বাংলাদেশের মতো দেশে গুজব প্রতিরোধে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। সময়ের সঙ্গে গুজব বা ভুয়া তথ্য শনাক্ত করা অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সত্য থেকে অর্ধ সত্য বা মিথ্যা আলাদা করা আরও বেশি কঠিন। এখানেই এমআইএল ফ্রেমওয়ার্কের মতো পরীক্ষিত পদ্ধতি আমাদের পথ দেখাতে পারে। 

আরও পড়ুন
নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি বা এনপিওভি বলে, উইকিপিডিয়া নিবন্ধের ভাষা হবে যথাসম্ভব নিরপেক্ষ। ভাষার ব্যবহার বা তথ্যের উপস্থাপন কোনো একটি নির্দিষ্ট মতের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারবে না।

এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরি। আগের একটি লেখায় বলেছিলাম, পৃথিবীতে ৩২০টির বেশি ভাষায় উইকিপিডিয়ার সংস্করণ রয়েছে। এর মধ্যে ইংরেজি উইকিপিডিয়া সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। সেখান থেকেই প্রায় সব উইকিপিডিয়ার ভাষা সংস্করণের নীতিমালা ও পদ্ধতি আত্তীকরণ করা হয়। তাই ইংরেজি উইকিপিডিয়ার কাঠামো এবং তথ্য যাচাই করার পদ্ধতি জানলে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি উইকিপিডিয়ার ভাষা সংস্করণে একই কাজ প্রায় একইভাবে করা সম্ভব। এই লেখায়ও ইংরেজি উইকিপিডিয়ার ওপর ভিত্তি করে তথ্য যাচাইয়ের উপায় দেখানো হয়েছে। 

উইকিপিডিয়ার তিনটি মূল কন্টেন্ট পলিসি হলো—এক, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি (ইংরেজিতে এনপিওভি বা নিউট্রাল পয়েন্ট অব ভিউ), দুই, ভেরিফায়েবিলিটি বা যাচাইযোগ্যতা এবং তিন, মৌলিক গবেষণা না হওয়া (ইংরেজিতে এনওআর বা নো অরিজিনাল রিসার্চ)। এর বাইরে উইকিপিডিয়ার ফাইভ পিলার্স বা পঞ্চস্তম্ভ, বিহেভিওরাল গাইডলাইনস বা আচরণগত নির্দেশিকার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ডকুমেন্ট রয়েছে। তবে আমরা এ লেখায় শুধু কন্টেন্ট নিয়ে আলোচনা করছি বলে মূল কন্টেন্ট পলিসির বাইরে অন্য বিষয়ে যাব না। 

নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি বা এনপিওভি বলে, উইকিপিডিয়া নিবন্ধের ভাষা হবে যথাসম্ভব নিরপেক্ষ। ভাষার ব্যবহার বা তথ্যের উপস্থাপন কোনো একটি নির্দিষ্ট মতের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারবে না। যদি একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে একাধিক মতবাদ থাকে, তাহলে সবগুলোই যথাযথ নীতিমালা মেনে নিরপেক্ষ ভাষা ব্যবহার করে তুলে ধরতে হবে। কোনো নিবন্ধের ভাষা যদি একপেশে হয়ে যায়, তা নিম্নমানের বলে বিবেচিত হবে। 

ভেরিফায়েবিলিটি বা যাচাইযোগ্যতা বলে, উইকিপিডিয়ায় থাকা প্রতিটি তথ্য নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে যাচাই করতে পারা উচিত। এ কারণেই যেকোনো ভাষার উইকিপিডিয়ায় প্রতিটি তথ্যের পর সংখ্যা দিয়ে তথ্যসূত্র বা রেফারেন্স দেওয়া থাকে, যেন পাঠক সেই সূত্র ব্যবহার করে তথ্য যাচাই করে নিতে পারেন। যেকোনো উৎসকে আবার নির্ভরযোগ্য হিসেবে উইকিপিডিয়ায় গ্রহণ করা হয় না। তৃতীয় পক্ষের স্বাধীন উৎস উইকিপিডিয়ায় ব্যবহৃত হয়। বই, সংবাদপত্র, বিজ্ঞান জার্নাল হলো বহুল ব্যবহৃত কিছু তথ্যসূত্রের উদাহরণ। কোনো উৎস নিয়ে সন্দেহ দেখা গেলে সেই প্রকল্পে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা সবাই মিলে আলোচনা করে উৎসের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে সিদ্ধান্তে আসেন। ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় ‘পেরেনিয়াল সোর্স’ নামে আলাদা একটি পাতা রয়েছে, যেখানে এর আগে যেসব উৎস নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেগুলোর তালিকা আর কতটা নির্ভরযোগ্য, তা নথিবদ্ধ করা আছে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাসোশিয়েটেড প্রেসকে (এপি) নির্ভরযোগ্য, আর ক্যালিফোর্নিয়া গ্লোবকে যথাযথ সম্পাদকীয় প্রক্রিয়ার অভাবে অনির্ভরযোগ্য বলে তালিকাভুক্ত করা আছে। 

আরও পড়ুন
একজন চীনা গৃহিনী বাড়িতে কাটানো অলস সময় কাজে লাগানোর জন্য ২০১৯ সাল থেকে মধ্যযুগীয় রাশিয়ান ইতিহাস নিয়ে চাইনিজ উইকিপিডিয়াতে ২০৬টির বেশি নিবন্ধ তৈরি করেন, যার সবগুলোই ছিল বানোয়াট!

এনওআর বা ‘মৌলিক গবেষণা না হওয়া’ নীতি অনুযায়ী, আপনি উইকিপিডিয়ায় লেখার সময় নিজের আবিষ্কৃত কিছু সেখানে যুক্ত করতে পারবেন না (আগের পর্বগুলোতে যেমনটা বলা হয়েছে, যে কেউ চাইলে উইকিপিডিয়া এবং এর সহপ্রকল্পগুলতে লিখতে পারেন)। উইকিপিডিয়া একটি সেকেন্ডারি সোর্স, মানে অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্য কেবল উইকিপিডিয়ায় এক করে উপস্থাপন করা হয়। আপনি চাইলেই সেখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণার তথ্য প্রথমবারের মতো যুক্ত করতে পারবেন না। 

এই মূল কন্টেন্ট পলিসিগুলো মোটামুটিভাবে সব উইকিপিডিয়া ভাষা সংস্করণে একইভাবে ব্যবহার করা হয়। যে ভাষা সংস্করণের মান যত ভালো, তার মূল কন্টেন্ট পলিসি সংক্রান্ত পাতাগুলো তত সাবলীল, সুলিখিত ও সহজে বোধগম্য। কোনো কোনো উইকিপিডিয়া ভাষা সংস্করণে স্বেচ্ছাসেবকের অভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ পাতাগুলো ইংরেজিতেই রেখে দেওয়া হয় অথবা সংক্ষিপ্তভাবে অনুবাদ করা হয়। অনেকে ভাবেন, একটি নিবন্ধ ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় থাকবে মানে বাংলা বা অন্য যেকোনো ভাষা সংস্করণেও অবশ্যই থাকবে, কিংবা হুবহু একইভাবে সব ভাষায় থাকবে। এটা পুরোপুরি সত্য নয়। একই নিবন্ধ একটি ভাষায় খুব ভালোমানের হতে পারে, আবার অন্য ভাষায় এর মান ভালো নাও হতে পারে। একটি ভাষা সংস্করণের পেছনে যে স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করেন, তাঁদের দক্ষতা, কাজ করার প্রক্রিয়ার মান, কর্মপরিবেশের সুস্থতা সেই ভাষা সংস্করণে থাকা তথ্যের মান ও ভাষা সংস্করণের নীতিমালার মান অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে।

অনেকসময় সবচেয়ে সমৃদ্ধ উইকিপিডিয়া ভাষা সংস্করণগুলোতেও বড় ভুল তথ্য থাকতে পারে। ২০২২ সালে পুরো উইকিমিডিয়া আন্দোলন একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার মুখোমুখি হয়। একজন চীনা গৃহিনী বাড়িতে কাটানো অলস সময় কাজে লাগানোর জন্য ২০১৯ সাল থেকে মধ্যযুগীয় রাশিয়ান ইতিহাস নিয়ে চাইনিজ উইকিপিডিয়াতে ২০৬টির বেশি নিবন্ধ তৈরি করেন, যার সবগুলোই ছিল বানোয়াট! সেসব নিবন্ধগুলো এত সুকৌশলে লেখা হয়েছিল এবং এত ভালোভাবে সূত্র উল্লেখসহ অন্যান্য সব করা হয়েছিল যে ২০২২ সালের আগে বিষয়টা কেউ ধরতেই পারেনি! এমনকি এসব কাল্পনিক ইতিহাসকে সত্য ভেবে এই নিবন্ধগুলো ইংরেজি, আরবি আর রুশ ভাষার মতো বড় উইকিপিডিয়াগুলোতে অনুবাদও করা হয়! এই ঘটনা ‘ভাইস’ এর মতো আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনে গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো হয় এবং উইকিপিডিয়ার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে অন্যতম কেস স্টাডি হিসেবে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয়। এত বড় ঘটনা ধরাই পড়ত না, যদি না চীনা ঔপন্যাসিক ‘ঈফান’ তাঁর একটি বইয়ের জন্য পড়াশোনা করতে গিয়ে এই মহিলার লেখা নিবন্ধগুলোর তথ্যসূত্র যাচাই না করতেন। যাচাই করতে গিয়ে তিনি দেখেন, যেসব বইয়ের পাতা সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই! 

যেসব বিষয় নিয়ে অনেক বেশি মানুষ একসঙ্গে কাজ করেন, সেখানে তথ্যের মান ভালো থাকে। যেমন বৈজ্ঞানিক বা চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কিত নিবন্ধ। ২০০৫ সালে যখন উইকিপিডিয়া নতুন ছিল, তখন নেচার ইংরেজি উইকিপিডিয়া নিয়ে একটি গবেষণা করে। যেখানে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে বৈজ্ঞানিক তথ্যের দিক থেকে উইকিপিডিয়া বিখ্যাত বিশ্বকোষ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার প্রায় সমকক্ষ। যদিও উইকিপিডিয়া বিনামূল্যেই পাওয়া যায়, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ক্ষেত্রে তেমনটা হতো না। অপরদিকে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাকেও তথ্যসূত্র হিসেবে উইকিপিডিয়ায় ব্যবহার করা হয়। ২০০৫ সালের তুলনায় এখন ইংরেজি উইকিপিডিয়া কয়েকগুণ বেশি পরিণত। এখন গুগল বা ইউটিউব প্রয়োজনে উইকিপিডিয়াকে নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহারকারীদের সাজেস্ট করে।

আরও পড়ুন
উইকিপিডিয়ার কোনো লেখা হুবহু কোনো পরিবর্তন ছাড়া ব্যবহার করলে লাইসেন্সের নিয়মানুযায়ী সেটি যে উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া হয়েছে, তা উল্লেখ করতে হয় এবং সঙ্গে নিবন্ধের নাম স্বীকার করতে হয়।

উইকিপিডিয়ার তথ্য যাচাই করার আগে উইকিপিডিয়ার পাতা সম্পর্কে কিছু সাধারণ ধারণা থাকা জরুরি। প্রতিটি উইকিপিডিয়া পাতার দুটি মূল অংশ থাকে—মূল পাতা আর আলাপ পাতা বা টক পেইজ। নিবন্ধের ওপরে বাঁ পাশে এই দুটো পাতা লিঙ্ক করা থাকে। মূল পাতায় মূল নিবন্ধ থাকে; আর আলাপ পাতায় সেই নিবন্ধ যারা লেখেন, তাঁদের সেই নিবন্ধবিষয়ক আলোচনা থাকে। যেকোনো নিবন্ধ যাচাই করার সময় আলাপ পাতা দেখে নেওয়া ভালো। এতে ওই নিবন্ধ তৈরির সময় কোন কোন বিষয় বিবেচনায় ছিল, কীভাবে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, এমনকি কখনো কখনো ওই নিবন্ধ যাঁরা লিখছেন, তাঁদের দক্ষতা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যেতে পারে। সব সময় যে আলাপ পাতা বা টক পেইজে আলোচনা থাকবে, তা নয়। তবে যদি থাকে, তাহলে পড়ে নেওয়া ভালো। অনেক সময় দেখা যায়, মূল নিবন্ধ পড়ে বিষয়বস্তু সম্পর্কে যতটা জানা যায়, টক পেইজ পড়ে সেই বিষয়বস্তু সম্পর্কে তার চেয়েও বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যায়। নিবন্ধের ওপরে ডানপাশে তিনটা অপশন পাওয়া যায়—নিবন্ধ পড়ার বাটন, সোর্স বা উৎস পাতা দেখার বাটন আর হিস্টোরি বা ইতিহাস দেখার বাটন। মূল নিবন্ধ পড়তে অবশ্যই ‘রিড’ বা পড়ুন বাটন, মূল নিবন্ধ সম্পাদনা বা এডিট করতে ‘এডিট সোর্স’ বা উৎস সম্পাদনা বাটন এবং সম্পাদনা ইতিহাস দেখার জন্য রয়েছে হিস্ট্রি বা ইতিহাস বাটন। এই হিস্টোরি থেকেও অনেক কিছু জানা যায়। প্লস ওয়ান জার্নালের গবেষণায় (Benjakob O, Guley O, Sevin J-M, BlondelL, Augustoni A, Collet M, et al. 2023) বিজ্ঞানীরা দেখানোর চেষ্টা করেছেন, কীভাবে উইকিপিডিয়া পাতার হিস্ট্রি অংশে চলমান বিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাস আটকা পড়ে যায়। তাঁরা ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় ক্রিসপার ক্যাস প্রযুক্তি সম্পর্কিত তথ্য পর্যবেক্ষণ করেন এবং কীভাবে সম্পূর্ণ নতুন একটি আবিষ্কার থেকে ‘জীবপ্রযুক্তিগত বিপ্লব’-এর অংশ হয়ে গেছে এবং বাস্তব জীবনে ক্রিসপার ক্যাসের উন্নয়নের সমান্তরালে উইকিপিডিয়া সম্পর্কিত নিবন্ধগুলোও সমানতালে সমৃদ্ধ হয়েছে, সেটি বেশ স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন তাঁরা। 

বেশির ভাগ উইকিপিডিয়া পাতার ওপরে সংক্ষিপ্ত তথ্যসহ ইনফোবক্স বা ‘তথ্যছক’ থাকে। তথ্যছক কতটা সমৃদ্ধ, তা কিছু ক্ষেত্রে সেই নিবন্ধের মান যাচাইয়ের মাপকাঠি হতে পারে। প্রতিটি উইকিপিডিয়া নিবন্ধেই ‘টেবল অব কন্টেন্ট’ বা সূচী থাকে, যেখানে একনজর তাকিয়েই নিবন্ধের গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। টেবল অব কন্টেন্ট কতটা সুগঠিত, তা নিবন্ধের মানের একটা সাধারণ ধারণা দিতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রেফারেন্স অনুচ্ছেদ। এখানে পুরো নিবন্ধের তথ্য কোন কোন জায়গা থেকে নেওয়া হয়েছে, তার তালিকা দেওয়া থাকে। রেফারেন্স বা তথ্যসূত্রের সংখ্যা, রেফারেন্সগুলোর মান, সেগুলো যাচাই করা যাচ্ছে কি না—এ ধরনের কিছু ক্রাইটেরিয়া নিবন্ধের মান যাচাইয়ের অন্যতম বড় উপায়। উইকিপিডিয়ার কোনো লেখা হুবহু কোনো পরিবর্তন ছাড়া ব্যবহার করলে লাইসেন্সের নিয়মানুযায়ী সেটি যে উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া হয়েছে, তা উল্লেখ করতে হয় এবং সঙ্গে নিবন্ধের নাম স্বীকার করতে হয়। তবে যদি হুবহু লেখা কপি না করা হয়, বরং শুধু তথ্যগুলো নেওয়া হয়, তাহলে সর্বোত্তম উপায় হলো উইকিপিডিয়াকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার না করে উইকিপিডিয়া যেসব সূত্র উল্লেখ করেছে, সরাসরি সেগুলোই ব্যবহার করা। 

তা ছাড়া কিছু ‘মেইন্টেনেন্স টেমপ্লেট’ থাকতে পারে নিবন্ধের ওপরে, মেইন্টেনেন্স টেমপ্লেটেই যেকোনো ইস্যু, যেমন নিবন্ধের নিরপেক্ষতার সমস্যা, জীবন্ত ব্যক্তির নিবন্ধ, বড় পুনর্গঠনের ভেতরে থাকা নিবন্ধ—এরকম অনেক বিষয় সরাসরি লেখা থাকে। এই মেইন্টেনেন্স টেমপ্লেট থাকলে আমরা সরাসরি সেই নিবন্ধের দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে জানতে পারি। 

ইংরেজি উইকিপিডিয়ার একটি মেইন্টেনেন্স টেমপ্লেট
ছবি: ইংরেজি উইকিপিডিয়া সম্প্রদায়, সিসি বাই এসএ ৪.০

ইংরেজি উইকিপিডিয়ার চমৎকার একটি ব্যাপার হলো ‘কন্টেন্ট অ্যাসেসমেন্ট’ পলিসি, যেটি ‘লেটার স্কিম’ ব্যবহার করে। ‘লেটার স্কিম’ মানে ইংরেজি অক্ষর ব্যবহার করে নিবন্ধ বা আর্টিকেলের মান নিরূপন করা। উদাহরণস্বরূপ, কোনো নিবন্ধের ওপরে FA লেখা মানে এটি ইংরেজি উইকিপিডিয়ার সবচেয়ে সেরা নিবন্ধতালিকার (ফিচার্ড আর্টিকেল) একটি। এর পরের গ্রেড হলো A class, তারপর যথাক্রমে GA (Good article), B, C, Start, ও Stub—যেখানে পর্যায়ক্রমে কম মানের নিবন্ধ বোঝায়। এই গ্রেডিং ইংরেজি উইকিপিডিয়ার নিবন্ধের একেবারে ওপরে ছোট করে দেওয়া থাকে, যেখান থেকে সরাসরি সেই নিবন্ধের মান সম্পর্কে জানা সম্ভব। অন্যান্য ভাষার উইকিপিডিয়াগুলো এমন সুগঠিত গ্রেডিং সিস্টেম ব্যবহার নাও করতে পারে। যেমন বাংলা উইকিপিডিয়ায় শুধু ‘নির্বাচিত নিবন্ধ’ (ইংরেজি উইকিপিডিয়ার FA বা featured article-এর সমমান) এবং ‘ভালো নিবন্ধ’ (GA বা good article-এর সমমান) তালিকা রয়েছে। অন্যান্য সমমানের গ্রেডিং এখানে কার্যকর নেই। 

সাধারণত জ্ঞান তৈরির প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের যুক্ত হওয়ার সুযোগ খুব কম থাকে। ফলে তথ্য তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া বাছাই করা মানুষের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে এবং সাধারণ মানুষ সেটি সম্পর্কে বিশদ ধারণা রাখে না।

যেকোনো ভাষার উইকিপিডিয়ায় ভালো আর দুর্বল নিবন্ধের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। সেগুলো হলো:  

ভালো নিবন্ধের বৈশিষ্ট্য

  • নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে পর্যাপ্ত সূত্র 

  • স্পষ্ট ও তথ্যবহুল ভূমিকাংশ

  • একটি বিষয়ের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দিক ও দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখ 

  • ভারসাম্যপূর্ণ ও সুগঠিত 

  • নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি বা এনপিওভি 

দুর্বল নিবন্ধের বৈশিষ্ট্য

  • রেফারেন্স বা তথ্যসূত্র একেবারে নেই বা খুব কম

  • মেইন্টেনেন্স টেমপ্লেটে নিবন্ধের দুবর্লতা নিয়ে কোনো ওয়ার্নিং রয়েছে

  • বানান ভুল

  • সাম্প্রতিক বিষয়ে পুরোনো তথ্য 

  • সূত্রহীন মতামতের উপস্থিতি 

মোটা দাগে ভুয়া তথ্যের দুটো ধরন রয়েছে। মিসইনফরমেশন আর ডিজইনফরমেশন। অনেকে ডিজইনফরমেশনকে ‘কূতথ্য’ নামে অনুবাদ করেন। তবে তা প্রচলিত বাংলা নয়। মিসইনফরমেশন হলো সেসব ভুয়া তথ্য, যেগুলো মানুষ না জেনে সৎ উদ্দেশ্য নিয়েই প্রচার করে। আর ডিজইনফরমেশন হলো যেসব ভুয়া তথ্য নির্দিষ্ট নেতিবাচক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সজ্ঞানে নিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়ানো হয়।

শুধু উইকিপিডিয়াই নয়, যেকোনো জায়গায় ডিজইনফর্মেশন চিহ্নিত করার কিছু সহজ উপায় রয়েছে। 

  • তথ্যের উৎস ও উৎসের মান নিয়ে ভাবা 

  • তথ্যটি কে লিখেছেন বা প্রচার করেছেন, তা জানা

  • তারিখ ও সময় ভালোভাবে যাচাই করা 

  • নিজের ভেতরের পক্ষপাত জানা ও সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা

  • শুধু শিরোনাম না পড়ে ভেতরের পুরো তথ্য মনোযোগ দিয়ে পড়া 

  • তথ্যের উৎস নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব কি না, তা বিবেচনা করা 

  • তথ্যটি প্রচারের পেছনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবা

  • প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া 

  • যেকোনো তথ্য কঠোরভাবে প্রতিটি সম্ভাব্য দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন করা, প্রশ্ন করার সংস্কৃতি তৈরি করা, এমনকি সেটি নিজের পছন্দের পত্রিকা বা লেখক হলেও

সাধারণত জ্ঞান তৈরির প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের যুক্ত হওয়ার সুযোগ খুব কম থাকে। ফলে তথ্য তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া বাছাই করা মানুষের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে এবং সাধারণ মানুষ সেটি সম্পর্কে বিশদ ধারণা রাখে না। জার্মান পরিচালক লরেঞ্জা ক্যাস্টেলা এবং ইয়াশা হ্যানোভার তাঁদের জার্মান ভাষার স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র, ‘উইকিপিডিয়া অ্যান্ড দ্য ডেমোক্র্যাটাইজেশন অব নলেজ’-এ দেখিয়েছেন, কীভাবে উইকিপিডিয়ায় জ্ঞান তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে জ্ঞান প্রকৃত অর্থেই মানবসভ্যতার সম্পদ হয়ে ওঠে এবং সাধারণ মানুষ জ্ঞানের মালিকানা নিতে শেখে। তাই উইকিমিডিয়া আন্দোলনে যেসব মানুষ যুক্ত থাকেন, তাঁরা জ্ঞান তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রচারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান রাখেন বলে তাঁদের মিডিয়া অ্যান্ড ইনফরমেশন লিটারেসি স্কিল অনেক বেশি হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে সামষ্টিক লড়াইয়ে এই দক্ষতা অনেক বেশি সাহায্য করতে পারে। 

কৃতজ্ঞতা: লেখাটি লেখার সময় ‘রিডিং উইকিপিডিয়া ইন দ্য ক্লাসরুম’ প্রোগ্রামের দ্বিতীয় মডিউলের সাহায্য নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু জায়গায়। মডিউলটি সরাসরি শিক্ষক প্রশিক্ষণের সময় শিক্ষকদের জন্য পাঠ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি পাওয়া যাবে এই লিঙ্কে: w.wiki/CffA। পাশাপাশি ২০২১ সালে সার্টিফায়েড ট্রেইনার স্বীকৃতি পাওয়ার সময় যেসব সুপারভাইজারের অধীনে ছিলাম, তাঁরা অল্প কিছু তথ্যের ব্যাপারে সাহায্য করেছেন।


লেখক: শিক্ষার্থী, বায়োইনফরমেটিকস ইঞ্জিনিয়ারিং, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

উইকিপিডিয়া সম্পর্কে আরও পড়ুন