কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। শুধু চ্যাটবট বা এআই আর্ট, অর্থাৎ লেখা, কথা বা আঁকাআঁকি নয়, কৃষির মতো প্রায়োগিক খাতেও হচ্ছে এর ব্যবহার। কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে ফলন বাড়ছে, কমছে অপচয়। ফলন নষ্ট হচ্ছে কম। প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারের এই বাজার…

কৃষিপ্রধান এই উপমহাদেশে আমাদের জীবন পরিবেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, নির্বিচার বন নিধন ও অদক্ষ বা অপরিকল্পিত চাষাবাদের কারণে ধীরে ধীরে আমাদের আবহাওয়া বৈরী রূপ ধারণ করছে। দৈনন্দিন জীবনের পাশাপাশি এগুলো সরাসরি প্রভাবিত করছে কৃষি খাতকে।

গত দুই থেকে তিন বছরে ডিজিটাল কনটেন্ট ক্রিয়েশন, ভিজ্যুয়াল ইডিটিং, ডেটা প্রসেসিং ও যোগাযোগমাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ফলে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। স্বস্তির কথা হলো, সেই ধারাবাহিকতায় এখন পরিবেশ সংরক্ষণ ও কৃষি খাতে উন্নয়নের কাজেও শুরু হয়েছে এর ব্যবহার।

মার্কেটসঅ্যান্ডমার্কেটস-এর এক জরিপ অনুযায়ী, কৃষিতে এআই প্রযুক্তি খাত ২০২৫ সাল নাগাদ প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের শিল্পে রূপ নেবে। প্রযুক্তির এই যোগসূত্রে এত বড় বাজার সৃষ্টি হওয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে সেচের জন্য পানির ব্যবহার অর্ধেকে কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব। কীটনাশক ব্যবহার কমানো সম্ভব ৬০ শতাংশ। ফলে প্রথমত, কৃষিকাজে কমবে খরচ, অপচয় কমবে মূল্যবান ভূগর্ভস্থ পানির এবং কীটনাশকের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার কমায় কমবে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

গুগলের দুটি দল, গুগল পার্টনার ইনোভেশন (Google Partner Innovation) এবং অ্যান্থ্রোকৃষি (AnthroKrishi) ইতিমধ্যে ভারতে কৃষিকাজে এআই প্রযুক্তির প্রয়োগ শুরু করেছে।

দল দুটি গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চালিত এমন কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছে, যা কৃষি-সংক্রান্ত উপাত্ত খুব সহজে ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করে অর্থবোধক তথ্য দিয়ে কৃষিকাজে সাহায্য করতে পারে। এই ফাউন্ডেশন মডেলকে তারা বলছে ল্যান্ডস্কেপ আন্ডারস্ট্যান্ডিং (Landscape Understanding) বা ‘ভূপ্রাকৃতিক অবস্থা বোঝা’।

এই প্রক্রিয়ায় স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি নিয়ে মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে জমির সীমানা শনাক্ত করা হয়। এভাবে ভূমিতে জমির বিভিন্ন খণ্ডগুলোকে আলাদা করা হয়। মাপা হয় জমির সীমানা, আলাদা করা হয় আবাদযোগ্য জমি, অনুর্বর জমি ও বনাঞ্চল। এরপর সেই তথ্য ব্যবহার করে সাধারণ চাষাবাদ ও খরাকালীন উপযুক্ত সেচ পরিকল্পনা করে দিতে কাজ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বলে দেবে, কোথায় কূপ খনন করলে বা কোথা থেকে পানি আনলে সবচেয়ে কম সময়ে, কম খরচে সব জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পৌঁছানো যাবে।

তা ছাড়া গবেষণা দল দুটি ল্যান্ডস্কেপ মনিটরিং (Landscape Monitoring) বা ‘ভূপ্রাকৃতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ’-এর জন্যও বিভিন্ন মডেল তৈরি করছে। এসব মডেলের কাজ জমিগুলোর জন্য আরও বিস্তারিত তথ্যবহুল পরামর্শ দেওয়া। এ থেকে কৃষকেরা চাষের জমির বর্তমান ফলন, অবস্থা, ভবিষ্যতে জমিতে আর কোন কোন ধরনের সার, জৈব উপাদান ও রাসায়নিক প্রয়োজন হবে—এসব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। এ ধরনের ফিউচার ল্যান্ডস্কেপ মনিটরিং মডেলগুলো রোপিত শস্য, জমির পরিমাণ, পানির উৎস থেকে জমির দূরত্ব, বীজ বপন, শস্য উত্তোলনের সময়সহ কৃষি-সংক্রান্ত যাবতীয় আরও অনেক তথ্য নিয়ে কাজ করতে পারবে। এসব তথ্য এই এআইয়ের কাছে জমাও থাকবে। এতে ভবিষ্যতে ওই জমিতে চাষাবাদের সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাটি অতীতের তথ্য-উপাত্ত থেকে নতুন ফলন বৃদ্ধি এবং বন্যা-খরার মতো বৈরী আবহাওয়া থেকে জমিকে সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারবে।

অ্যান্থ্রোকৃষিতে এআই ও স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করে ফসলের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো এভাবেই তুলে ধরা হয়।
ছবি: গুগল

এ ধরনের কৃষিকাজ প্রিসিশন ফার্মিং (Precision Farming) অথবা প্রিসিশন অ্যাগ্রিকালচারের অন্তর্ভুক্ত। প্রিসিশন ফার্মিং বা ‘নির্ভুল কৃষিকাজে’ এআই-চালিত বিভিন্ন সেন্সর, ড্রোন এবং মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে শস্য রোপণ থেকে শুরু করে এর ক্রমবিকাশ ও ফলন পর্যবেক্ষণ করা হয়। ফলে কৃষকেরা মাটির অবস্থা, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, ফলিত শস্যের শারীরিক ও গুণগত অবস্থা সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারে। এতে তাঁরা সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি সেচ এবং কীটনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে ফলনকে বৈরী পরিবেশ থেকে রক্ষা করতে ও ক্ষেত্রবিশেষে ফলন বৃদ্ধিও করতে পারেন।

এসব কাজে কৃষকদের সহায়তা করতে অনেক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত পণ্য ও প্রযুক্তি ইতিমধ্যে বাজারে চলে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দ্য ক্লাইমেট করপোরেশনের ফিল্ডভিউ (FieldView) প্ল্যাটফর্মটি এআই ব্যবহার করে প্রিসিশন ফার্মিংয়ের জন্য নানা রকম তথ্য দিয়ে সহায়তা করে কৃষকদের। এটি শস্য ও জমির ওপর ভিত্তি করে সেই অনুযায়ী বীজ বপনের হার, চারার দূরত্ব ইত্যাদি তথ্য দিয়ে ফসল আবাদে সহায়তা করে। এই টুল আবহাওয়া পরিবর্তন, চারা রোপণের ঘনত্ব, ফলনের হার—এসব নিয়ে আগাম সংকেতও দিতে পারে।

ভারতের ইন্টেলো ল্যাবস স্টার্টআপ কম্পিউটার ভিশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ফল বা সবজির অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করতে পারে।

এ রকম আরেকটি এআই-চালিত অ্যাপ্লিকেশন হলো প্ল্যান্টিক্স (Plantix)। জার্মান প্রতিষ্ঠান পিটের (PEAT) বানানো অ্যাপ্লিকেশনটি মাটির পুষ্টিঘাটতি শনাক্ত করার পাশাপাশি জমিতে ফসলের কী কী রোগ হতে পারে, এসব তথ্য ব্যবহার করে সেই জমি এবং শস্যের জন্য উপযুক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহারের উপদেশ দিতে পারে। এ জন্য কৃষককে শুধু তাঁর ফসলের কয়েকটি ছবি তুলে দিলেই হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বাকি কাজ নিজে থেকেই করে দেবে অ্যাপ্লিকেশনটি।

ভারতের ইন্টেলো ল্যাবস (Intello Labs) নামের আরেকটি স্টার্টআপ কম্পিউটার ভিশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ফল বা সবজির অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করতে পারে। এতে বাজারজাত করার সময় ফল ও সবজির পচনজনিত অপচয় কমানো যায়।

নেদারল্যান্ডসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রোকেয়ারস (Agrocares) কৃষিকাজে ব্যবহারযোগ্য এআই–চালিত হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার তৈরি করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো তাদের নিউট্রিয়েন্ট স্ক্যানার (Nutrient Scanner)। টুলটি জমির মাটি স্যাম্পল হিসেবে নিয়ে তাতে কোন কোন উপাদানের ঘাটতি আছে, তা জানিয়ে দিতে পারে। এতে কৃষক আগে থেকেই তাঁর জমি চাষের জন্য যথাযথ সার দিয়ে প্রস্তুত করতে পারবেন।

আগাছা নিধনেও এআই ব্যবহার শুরু করেছে বেশ কিছু কোম্পানি। এদের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি বাজারে এনেছে ব্লু রিভার টেকনোলজি। তাদের ‘সি অ্যান্ড স্প্রে’ (See and Spray) মেশিন কম্পিউটার ভিশন ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে জমিতে ফসল ও আগাছা আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারে। এরপর শুধু যে জায়গাটুকুতে আগাছা রয়েছে, সেখানে হার্বিসাইড (Herbicide) প্রয়োগ করে আগাছা নিধন করে।

চ্যাটজিপিটির মতো কৃষি-সংক্রান্ত চ্যাটবটেও হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। মাইক্রোসফটের ফার্মভাইবস.বট এমনই একটি চ্যাটবট।

চাষাবাদের পাশাপাশি গবাদিপশু পালনেও শুরু হয়েছে এআই ব্যবহার। ক্যাটেলআই (CattleEye) নামে একটি কোম্পানি গবাদিপশুর যত্নে এআই ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করছে। ড্রোনের সাহায্যে এই প্রযুক্তি সার্বক্ষণিক গবাদিপশুর ওপর নজরদারি রাখে। খেয়াল করে, পশুগুলো কীভাবে আচার-আচরণ করছে, ঠিকমতো খাচ্ছে কি না, বাচ্চা প্রসবে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না ইত্যাদি। এসব তথ্য ব্যবহার করে গবাদিপশুর আচরণে এবং স্বাস্থ্যে অসংগতি খুঁজে মালিককে জানায় আগে থেকেই। এতে পশুটির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যায় খুব দ্রুত।

মাঠের এসব ব্যবহার ছাড়াও চ্যাটজিপিটির মতো কৃষি-সংক্রান্ত চ্যাটবটেও হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। মাইক্রোসফটের ফার্মভাইবস.বট (FarmVibes.bot) এমনই একটি চ্যাটবট। এর কাজ হলো কৃষকদের ফসল, জমি ও আবহাওয়া বিবেচনা করে ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ এবং উপদেশ দেওয়া। সাব-সাহারান আফ্রিকার প্রায় পাঁচ লাখ কৃষক ইতিমধ্যে এটি ব্যবহার করে সুফলও পাচ্ছে।

এমন অনেক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত প্রযুক্তিই এখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যবহার হতে শুরু করেছে। তাই সেদিন খুব বেশি দূরে নেই, যখন আমাদের দেশের কৃষকেরাও সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুফল ভোগ শুরু করবেন।

লেখক: ব্যবস্থাপক, ডেফ্টাইল্ড

সূত্র: গুগল, জিভা ও স্মার্টটেক সল্যুশনস

* লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত