টেলিফোনের উদ্ভাবক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল

আজ ৭ মার্চ, আলাকেজান্ডার গ্রাহাম বেল দিবস। প্রতি বছর ৭ মার্চ এই দিবস পালন করা হয়। এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিস তাকে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে শব্দ প্রেরণের জন্য একটি পেটেন্ট দেয় যা আধুনিক টেলিফোন প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করে। এই কানাডিয়ান-মার্কিন উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীর জীবনের এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যা অনেকের অজানা। চলুন, সেসবের কিছু জানা যাক।

আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলফাইল ছবি

১. বধিরদের জন্য ভালোবাসা

আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের যোগাযোগে সহায়তার জন্য কাজ করেছেন। তাঁর মা ও স্ত্রীও ছিলেন বধির। মা ছোটবেলায় রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ভালোভাবে কানে শুনতে পেতেন না। সে জন্য তরুণ আলেকজান্ডার তাঁর মায়ের কানের ট্রাম্পেটের কাছে গিয়ে কথা বলতেন। (কানের ট্রাম্পেট হলো ধাতু, রূপা, কাঠ, শামুকের খোলস বা পশুর শিং দিয়ে তৈরি ফানেল আকৃতির শ্রবণ-সহায়ক যন্ত্র, যা শব্দতরঙ্গ কানের পর্দায় পৌঁছে দেয়।)

স্ত্রী ম্যাবেল গার্ডিনার হুবার্ড এবং দুই মেয়ে এলসি (বাঁয়ে) ও ম্যারিয়ানের সঙ্গে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল (ডানে)। ১৮৮৫
ছবি: লাইব্রেরি অব কংগ্রেস

বেলের বাবা ও দাদা—দুজনেই ছিলেন স্বনামধন্য স্পিচ থেরাপিস্ট। অল্প বয়সেই পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। তাঁর বাবার উদ্ভাবিত ‘ভিজিবল স্পিচ’ পদ্ধতিতে বধিরদের শেখাতেন শব্দ উচ্চারণ। বলে রাখি, ১৮৬৭ সালে গ্রাহাম বেলের বাবা, ব্রিটিশ ভাষাবিদ, আলেকজান্ডার মেলভিল বেল এই ভিজিবল স্পিচ পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করেন। এটি ধ্বনির চিহ্নের একটি পদ্ধতি। উচ্চারণকালে বাক-প্রত্যঙ্গ তথা জিহ্বা, ঠোঁট ও দাঁতের অবস্থান নির্দেশ করে এটি। বধিরদের শব্দ উচ্চারণ শেখানোর জন্য এই প্রতীকগুলো শেখানো হয়। গ্রাহাম বেল এ পদ্ধতিতেই বধিরদের শব্দ উচ্চারণ শেখাতেন।

১৮৭২ সালে পঁচিশ বছর বয়সে গ্রাহাম বেল যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে ‘স্কুল অব ভোকাল ফিজিওলজি অ্যান্ড মেকানিকস অব স্পিচ’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরের বছর ভোকাল ফিজিওলজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ম্যাসাচুসেটসের বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ম্যাবেল হুবার্ডের। তিনি বেলের চেয়ে ১০ বছরের ছোট ছিলেন। এই নারীও স্কারলেট ফিভারে আক্রান্ত হয়ে শ্রবণশক্তি হারান। পরে ম্যাবেলকে বিয়ে করেন বেল। হয়তো শৈশব থেকে শ্রবণশক্তিহীন ব্যক্তিদের সঙ্গে বসবাস ও কাজ করার কারণেই বেল শব্দ নিয়ে আগ্রহী হন।

আরও পড়ুন
১৮৯২ নিউইয়র্ক থেকে শিকাগো টেলিফোন লাইনের উদ্বোধন করছেন গ্রাহাম বেল
ছবি: উইকিমিডিয়া

২. ইতিহাসে দীর্ঘতম পেটেন্ট যুদ্ধ

১৮৭৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টেলিফোনের পেটেন্টের জন্য আবেদন করেন বেল। এর কিছুক্ষণ আগে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী উদ্ভাবক এলিশা গ্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিস থেকে ঘোষণা করেন, তিনিও এ ধরনের একটি আবিষ্কার নিয়ে কাজ করছেন। বেল ২৯ বছর বয়সে ১৮৭৬ সালের ৭ মার্চ টেলিফোনের জন্য প্রথম মার্কিন পেটেন্ট পান। এর তিন দিন পর, অর্থাৎ ১০ মার্চ, বেলের সহকারী টমাস ওয়াটসন বোস্টনের পরীক্ষাগারে প্রথম সফল টেলিফোন ট্রান্সমিশন ঘটান। তিনি একটি তারের মাধ্যমে বেলের কণ্ঠস্বর স্পষ্টভাবে শুনতে পান।

গ্রাহাম বেল টেলিফোনে প্রথম বলেন, ‘মিস্টার ওয়াটসন, এখানে আসুন, আপনাকে আমার প্রয়োজন।’ গ্রাহাম বেলের টেলিফোনের পেটেন্ট নিয়ে পরে অনেক আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে পাঁচটি মামলা মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছেছিল। শেষ পর্যন্ত মার্কিন আদালত বেলের দাবি সঠিক বলে রায় দেয়। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দীর্ঘতম পেটেন্ট যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম।

আরও পড়ুন
গ্রিক শব্দ ‘আলো’ ও ‘শব্দ’ মিলে হয় ফটোফোন
ছবি: উইকিমিডিয়া

৩. ফটোফোন উদ্ভাবন

আধুনিক সেল ফোন প্রচলনের অনেক আগে, আলোক রশ্মির মাধ্যমে কথা বলা এবং শব্দ প্রেরণে সক্ষম একটি তারহীন টেলিফোন উদ্ভাবন করেছিলেন গ্রাহাম বেল। তিনি এই যন্ত্রের নাম দেন ‘ফটোফোন’। গ্রিক শব্দ ‘আলো’ ও ‘শব্দ’ মিলে হয় ফটোফোন।

১৮৮০ সালে পেটেন্ট করা ফটোফোন সম্পর্কে বেল বলেছিলেন, ‘এটি আমার করা সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার; টেলিফোনের চেয়েও বড়।’ তিনি বোস্টন ট্রাভেলার পত্রিকাকে জানান, যুদ্ধের সময় যখন টেলিগ্রাফ লাইন অচল হয়ে যায়, তখন সমুদ্র থেকে উপকূলে যোগাযোগকারী জাহাজের এই যন্ত্র কাজে লাগবে। সে কালে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে ফটোফোনের ব্যবহার ছিল সীমিত। অনেক পরে ফাইবার অপটিক প্রযুক্তির বিকাশের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোর মাধ্যমে সংকেত প্রেরণের ব্যবহার শুরু হয়।

বেল বুলেট খুঁজতে ব্যবহার করেন একটি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক যন্ত্র
ছবি: হিস্ট্রি ডটকম

৪. রাষ্ট্রপতিকে বাঁচাতে মেটাল ডিটেক্টর উদ্ভাবন

মেটাল ডিটেক্টরের প্রথম ব্যবহার মাটির নিচে স্বর্ণের খোঁজে হয়নি। বরং মার্কিন প্রেসিডেন্টের জীবন বাঁচাতে হয়েছিল। ১৮৮১ সালের ২ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডেন্ট জেমস গারফিল্ড গুলিবিদ্ধ হন। কয়েক সপ্তাহ মধ্যে তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটে। কারণ ডাক্তাররা বুলেট খুঁজে বের করতে পারেননি। আহত গারফিল্ডকে দেখতে আসা গ্রাহাম বেল বুলেট খুঁজতে ব্যবহার করেন একটি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক যন্ত্র। গৃহযুদ্ধের সময় যেসব সেনাদের গুলি লেগেছিল, তাঁদের ওপর তিনি এটা পরীক্ষা করেন। হোয়াইট হাউসে বেলকে দুবার ডাকা হয়। কিন্তু তাঁর ‘ইন্ডাকশন ব্যালেন্স’ যন্ত্রটি বুলেট শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। পরে জানা যায়, রাষ্ট্রপতির প্রধান চিকিৎসক শুধু রাষ্ট্রপতির শরীরের ডান দিকে অনুসন্ধান করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু গারফিল্ডের মৃত্যুর পর দেখা গেছে বুলেটটি তাঁর বাঁ দিকে ছিল। তাঁর তৈরি করা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক যন্ত্রটি পরে মেটাল ডিটেক্টর আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

আরও পড়ুন
এইচডি-৪ মডেল বোট, যা ঘণ্টায় ৭০ মাইলের বেশি গতিতে চলে
ছবি: উইকিমিডিয়া

৫. গ্রাহাম বেলের নকশা করা স্পিডবোটের বিশ্ব রেকর্ড

১৮৯০-এর দশকে উড়োজাহাজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন বেল। পানিতে চলতে চলতে প্রয়োজনে সরাসরি উড়তে পারবে, এমন প্লেন বানানো ছিল তাঁর স্বপ্ন। তাই তিনি একটা ডানাযুক্ত হাইড্রোফয়েল বোটের নকশা করেন। ১৯১৯ সালে নোভা স্কটিয়ার একটি হ্রদে পরীক্ষা চালানো হয় তাঁর নকশা করা এইচডি-৪ মডেল বোটের, যা ঘণ্টায় ৭০ মাইলের বেশি গতিতে চলে। স্পিডবোটটি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ব ওয়াটার-স্পিড রেকর্ড ধরে রেখেছিল।

আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল।
ছবি: রয়টার্স

৬. বেলের সম্মানে টেলিফোন পরিষেবা বন্ধ

১৯২২ সালের ২ আগস্ট মারা যান গ্রাহাম বেল। মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানে উত্তর আমেরিকার টেলিফোন পরিষেবাগুলো এক মিনিটের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর দুই দিন পর, অর্থাৎ ৪ আগস্ট যখন তাঁকে সমাহিত করা হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সব টেলিফোন পরিষেবা এক মিনিটের জন্য বন্ধ ছিল। ৬০ হাজার টেলিফোন অপারেটর তাঁর সম্মানে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন। এই এক মিনিটে প্রায় ১৩ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৩০ লাখ টেলিফোন থেকে কোনো কল যায়নি।

আরও পড়ুন
শব্দের মাত্রা মাপার যন্ত্র
ফাইল ছবি

৭. বেলের নামে ‘ডেসিবেল’ নামকরণ করা হয়েছে

আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের মৃত্যুর পরও তাঁকে সবাই মনে রেখেছে। তাঁকে সম্মান জানাতে ১৯২০ সালে শব্দ তরঙ্গের তীব্রতার এককের নাম দেওয়া হয় ‘বেল’। ডেসিবেল (dB) হলো বেলের এক-দশমাংশ, যা শব্দ পরিমাপের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত একক।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: হিস্ট্রি ডটকম, উইকিপিডিয়া, মেন্টালফলস