কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা নিয়ে দেশে আসতে চলেছে স্টারলিংক। মার্কিন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এটি। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার স্টারলিংককে সেবা প্রদানের লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের এক বিবৃতিতে। গত ৬ ডিসেম্বর, বুধবার জুনাইদ আহমেদ বলেন, ‘নীতিগতভাবে আমি স্টারলিংককে লাইসেন্স দিতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) বলেছি। আমরা শহর ও গ্রামের মানুষের জন্য সমানভাবে ইন্টারনেট সেবা দিতে চাই। এর মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চল, বিশেষ করে গ্রাম, চর ও দ্বীপগুলোয় ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত হবে।’
গত বছর প্রথম স্টারলিংক বাংলাদেশে কার্যক্রম চালুর প্রক্রিয়া শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় একাধিকবার আলোচনা ও বৈঠক হয়েছে সরকারের কর্মকর্তা ও স্টারলিংকের মধ্যে। চলতি বছরের জুনে স্টারলিংকের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই সূত্র ধরেই সরকারের এ সিদ্ধান্ত এসেছে। ৬ ডিসেম্বর বিটিআরসির সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।
প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর বেশির ভাগ স্থানে স্টারলিংকের ইন্টারনেট ব্যবহার করতে মাসে ১২০ ডলার খরচ করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশি টাকায় এই খরচ পড়বে ১৩ হাজারের মতো
বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৯ সালে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠায় স্টারলিংক। বর্তমানে পৃথিবীর নিম্নকক্ষপথে (ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫৫০ কিলোমিটার ওপরে) প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সাড়ে ৫ হাজার স্যাটেলাইট কার্যকর আছে। এসব স্যাটেলাইট পৃথিবীপৃষ্ঠের বিভিন্ন ডেটা সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত। স্টারলিংকের স্যাটেলাইটগুলো এসব তথ্য তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আকারে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। একই সঙ্গে ভূপৃষ্ঠে ছুড়ে দেয় তরঙ্গ। ফলে স্টারলিংক ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীর কাছেও তরঙ্গ শনাক্তের যন্ত্র থাকতে হয়। এই যন্ত্র বা অ্যান্টেনা প্রতিষ্ঠানটিই সরবরাহ করে। অনেকটা স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মতো একই পদ্ধতিতে কাজ করে এই ইন্টারনেট সেবা। পৃথিবীর কক্ষপথজুড়ে প্রচুর কৃত্রিম উপগ্রহ থাকায় যেকোনো জায়গায় ইন্টারনেট সিগন্যাল পাঠানো সম্ভব। দুর্গম মরু, পাহাড় বা সমুদ্রের মধ্যে, যেখানে সরাসরি তার বা ভূস্থাপনার মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া যায় না, সেখানেও কাজ করবে স্টারলিংক ইন্টারনেট।
কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার প্রচেষ্টা অবশ্য এটিই প্রথম নয়। তবে স্টারলিংকের মতো এত ব্যবহারবান্ধব নয় সেগুলো।
তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ইন্টারনেট সেবার দাম অনেক বেশি। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর বেশির ভাগ স্থানে স্টারলিংকের ইন্টারনেট ব্যবহার করতে মাসে ১২০ ডলার খরচ করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশি টাকায় এই খরচ পড়বে ১৩ হাজারের মতো। ডলারের দাম বাড়া বা কমার সঙ্গে এই অঙ্ক পরিবর্তিত হবে। এ ছাড়া প্রথম মাসে অ্যান্টেনা ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ কেনার জন্য খরচ হয় প্রায় ৫৯৯ ডলার। অঙ্কটা ৬৫ হাজার টাকারও বেশি।
এদিক থেকে দেশের ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ইন্টারনেটের দাম অনেক কম। গ্রামাঞ্চলে বর্তমানে রাউটার ও অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক ইউনিটসহ প্রাথমিক সংযোগ নিতে ২ থেকে ৩ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। প্রতিমাসে ৫০০ টাকায় ৫ এমবিপিএস (প্রতি সেকেন্ডে ৫ মেগাবিট ডেটা আদান-প্রদানে সক্ষম) ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সেবা নেওয়া যায়। এ ছাড়া একমাস মেয়াদে মোবাইল ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে ৩০ জিবি ইন্টারনেটের জন্য জন্য ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পড়তে পারে।
বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের তথ্য অনুযায়ী, স্পেসএক্সের কর্মকর্তার পরিবেশনায় স্টারলিংক ইন্টারনেটের ডাউনলোড স্পিড পাওয়া গেছে প্রায় ৫০০ এমবিপিএস (সেকেন্ডে ৫০০ মেগাবিট ডেটা আদান-প্রদানে সক্ষম)। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি বিভাগের পরীক্ষণে এ গতি প্রায় ১৫০ এমবিপিএস (সেকেন্ডে ১৫০ মেগাবিট ডেটা আদান-প্রদানে সক্ষম) পাওয়া গেছে।
বর্তমানে ৬০টিরও বেশি দেশে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে স্টারলিংক। তাদের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে তাদের গ্রাহক সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি। দেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হলে দুর্গম অঞ্চলে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। পাশাপাশি বর্তমান ইন্টারনেট সেবা ব্যবসায় কিছুটা প্রতিযোগিতা তৈরি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে গ্রাহকদের জন্য তা কল্যাণকর হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে দামের কারণে স্টারলিংক আদৌ জনপ্রিয়তা পাবে না কি না, সে প্রশ্নও রয়েছে।