চলমান কাতার বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে সৌদি আরবের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা ম্যাচের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে সেই ম্যাচে একের পর এক অফসাইডের কথা।
অফসাইডের কারণে বাতিল হয় তিনটি গোল। হেরে যায় আর্জেন্টিনা। এই হারের মাধ্যমে এ বিশ্বকাপের প্রথম আপসেট ঘটে। এটুকু সবাই জানেন। পাশাপাশি, প্রকৃত ফুটবলপ্রেমীরা নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবেন, অফসাইড বিষয়ক সিদ্ধান্তগুলো ম্যাচ অফিশিয়ালরা কতটা দ্রুত নিচ্ছিলেন। আগে যেখানে একটা অফসাইডের সিদ্ধান্ত নিতে এক মিনিট বা তার চেয়েও বেশি সময় লেগে যেত, সেখানে এই ম্যাচে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হচ্ছিল কয়েক সেকেন্ডেই। প্রশ্ন হলো, কীভাবে?
ফুটবল নিয়ন্ত্রণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিফা-র হিসেব মতে, অফসাইড নিয়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতে গড়ে ৭০ সেকেন্ড করে সময় লাগে। যদি আর্জেন্টিনা–সৌদি আরবের ম্যাচটির হিসেব করি, তবে শুধু এই ম্যাচেই আর্জেন্টিনার ১০টি ও সৌদি আরবের ১টি, অর্থাৎ মোট ১১টি অফসাইড হয়। গতানুগতিক পদ্ধতিতে এতগুলো অফসাইডের সিদ্ধান্ত নিতে প্রয়োজন হতো মোট ৭০×১১ = ৭৭০ সেকেন্ড বা প্রায় ১২.৮৩ মিনিট। এটি ম্যাচের মোট সময়ের ১৪.২৫ শতাংশ।
কিন্তু ম্যাচটি দেখলে হয়তো খেয়াল করেছেন, অফসাইডের সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছিল খুবই দ্রুত, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। এটা সম্ভব হয়েছে এই বিশ্বকাপের নতুন সেমি-আটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তির (Semi-Automated Offside Technology) জন্য। একে ভিএআর (VAR) প্রযুক্তিতে নতুন সংযোজনও বলা চলে।
ভার্চ্যুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (Virtual Assistant Referee) বা ভিএআর প্রযুক্তি প্রথম ২০১৬ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়। তারপর ২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ও বিগত বছরগুলোতে এ প্রযুক্তি ব্যবহারে খেলায় অপ্রত্যাশিত সময়ের অপচয় ও রেফারির অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল সিদ্ধান্ত অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এর সূত্রধরে ২০১৯ সালে ফিফা তাদের ম্যাচগুলোয় অফসাইডের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ বিষয়টিকে আরও দ্রুততর, কার্যকর ও নির্ভুল করতে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা শুরু করে। ফিফার সেই প্রচেষ্টার ফল এই সেমি-অটোমেটেড অফসাইড টেকনোলজি, যা ভিএআর প্রযুক্তির বাড়তি সংযোজন হিসেবে ম্যাচ সম্পর্কিত যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করছে ম্যাচ অফিসিয়াল ও রেফারিদের।
২০২১ সালের ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ ও ফিফা আরব কাপে এই প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক ব্যবহার হয়ে গেছে। তবে এবারের বিশ্বকাপেই প্রথম এ প্রযুক্তির আনুষ্ঠানিক ব্যবহার শুরু হয়েছে।
অফসাইড সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মাঠের বিভিন্ন স্থানে থাকা ১২টি ক্যামেরার অপটিক্যাল ট্র্যাকিং, লিম্ব ট্র্যাকিং ও কানেক্টেড বলের রেকর্ড করা এসব তথ্য পাঠানো হয় ভিডিও অপারেশন রুমে।
এই অফসাইড প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রতিটি মাঠে বসানো হয়েছে ১২টি করে ক্যামেরা। এই ক্যামেরাগুলো প্রতি মুহূর্তে বল কোথায় আছে ও খেলোয়াড়রা কোথায় কোন পজিশনে আছেন, তা ট্র্যাক করে। খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে হাতের কবজি, কনুই, মাথা, পায়ের গোড়ালি, কোমর, হাতের আঙুল ও কাঁধ—অফসাইড সম্বন্ধিত দেহের এরকম ২৯টি পর্যন্ত পয়েন্ট ট্র্যাক করা হয়। দেহের বিভিন্ন অঙ্গের এই লিম্ব ট্র্যাকিং (Limb Tracking) প্রযুক্তি প্রতি সেকেন্ডে ৫০ বার পর্যন্ত খেলোয়াড়দের অবস্থান ও দৈহিক ভঙ্গি রেকর্ড করে। তা ছাড়া অ্যাডিডাসের তৈরি এবারের বিশ্বকাপের অফিসিয়াল বল আল-রিহলাতে (Al-Rihla) আছে ইনারশিয়াল মেজারমেন্ট ইউনিট (IMU) সেন্সর। এটি প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ বার পর্যন্ত কিক-পয়েন্ট ও অবস্থানের ডাটা রেকর্ড করতে পারে। বল আর এর সেন্সরকে একসঙ্গে বলা হচ্ছে কানেক্টেড বল (Connected Ball) টেকনোলজি। এটি এই সেমি-অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে।
অফসাইড সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মাঠের বিভিন্ন স্থানে থাকা ১২টি ক্যামেরার অপটিক্যাল ট্র্যাকিং, লিম্ব ট্র্যাকিং ও কানেক্টেড বলের রেকর্ড করা এসব তথ্য পাঠানো হয় ভিডিও অপারেশন রুমে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেসব তথ্য তাৎক্ষণিক প্রসেস করে। এ ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের অফসাইড লাইন অতিক্রম করার সময় বলের অবস্থান, খেলোয়ারের অবস্থান ও অফসাইডটির সঙ্গে জড়িত খেলোয়াড়দের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের অবস্থান রেকর্ড করে প্রসেস করা হয়। ভিডিও অপারেশন রুমের অ্যালগোরিদম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আগেই প্রচুর পরিমাণে এ ধরনের অফসাইডের তথ্য ও ছবি দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে এই তথ্যগুলো বিবেচনা করে এটি অফসাইড নির্ধারণ করতে পারে। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার পেছনে ফিফা ও তাদের টেকনিক্যাল পার্টনারদের পাশাপাশি যুক্ত আছে বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দলও।
এই প্রযুক্তির জন্য তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষনের পুরো প্রক্রিয়াটির বৈধতা ও কার্যকারিতা যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পোর্টস ল্যাব নির্ধারণ করেছে। লিম্ব-ট্র্যাকিং প্রযুক্তিটি পরীক্ষা করে দেখেছে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির ‘ট্র্যাক’ নামের অস্ট্রেলিয়ান গবেষণা দলটি। তাছাড়া মাল্টিক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ের পেছনে অবদান রয়েছে সুইজারল্যান্ডের ইটিএইচ জুরিখের গবেষণা দলের। এই তিনটি গবেষণা দল ছাড়াও আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত ছিল পুরো প্রক্রিয়াটি সফল ও নির্ভুল করার পেছনে।
ভিডিও অপারেশন রুমে থাকা তথ্য ও তা থেকে তৈরি অ্যানিমেশনের মাধ্যেমে কোনো খেলোয়াড় অফসাইড পজিশনে আছেন কি না, তা খুব সুক্ষ্মভাবে যাচাই করা হয়।
এই প্রক্রিয়ায় খেলা চলাকালীন সময়ে কানেক্টেড বলে সেন্সর, লিম্ব-ট্র্যাকিং ও মাল্টিক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে অফসাইড শনাক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ম্যাচ অফিসিয়াল ও রেফারিকে জানিয়ে দেওয়া হয়। সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ ও জানিয়ে দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি তাৎক্ষণিক। তবে সেটা অফসাইড হবে কি না, সে বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্তটি নেন ম্যাচ অফিসিয়াল ও রেফারি।
অফসাইড ট্রিগার হলে লিম্ব ট্র্যাকিং থেকে পাওয়া তথ্য ও কানেক্টেড বলের অবস্থান ব্যবহার করে কয়েক মুহূর্তেই ভিডিও অপারেশন রুমের কম্পিউটার একটি থ্রিডি অ্যানিমেশন তৈরি করে ফেলে। এই অ্যানিমেশনের সাহায্যে ম্যাচ অফিশিয়াল ও মাঠে বা টিভি স্ক্রিনের সামনে থাকা দর্শকরা অফসাইডের লাইনে আসলে বল ও খেলোয়াড়রা কোন অবস্থানে ছিল, তা স্পষ্ট দেখতে ও জানতে পারেন।
অফসাইড অ্যালার্ট পাওয়ার পর ম্যাচ অফিসিয়ালরা ট্র্যাকিং থেকে পাওয়া তথ্য ও অ্যানিমেশনটি বিশ্লেষণ করে অফসাইড বিষয়ে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নেন ও মাঠে থাকা রেফারিকে জানিয়ে দেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানুষের এমন হস্তক্ষেপ থাকায় এ পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় বলা হচ্ছে না। পুরোটা কম্পিউটার, অ্যালগোরিদম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়ার পরেও একেবলা হচ্ছে সেমি-অটোমেটেড বা অর্ধ-স্বয়ংক্রিয়।
ভিডিও অপারেশন রুমে থাকা তথ্য ও তা থেকে তৈরি অ্যানিমেশনের মাধ্যেমে কোনো খেলোয়াড় অফসাইড পজিশনে আছেন কি না, তা খুব সুক্ষ্মভাবে যাচাই করা হয়। যদি প্রতিপক্ষের কারো আঙ্গুলের একটি অংশও অফসাইড লাইনের ভেতরে থাকে, লিম্ব ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যেম তা নিশ্চিত হওয়া যায়।
এভাবেই কানেক্টেড বলের সঙ্গে সেমি-অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তির মেলবন্ধনে অফসাইডবিষয়ক সিদ্ধান্তগুলো ইতিমধ্যেই কয়েকগুণ দ্রুত ও নির্ভুলভাবে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ভবিষ্যতে ভিএআর-এর সঙ্গে এমন আরও নতুন নতুন প্রযুক্তির সংযোজন যে ফুটবল খেলাকে আরও প্রাণবন্ত, জমজমাট ও নির্ভুল করে তুলবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: ব্যবস্থাপক, ডেফ্টাইল্ড
সূত্র: ফিফা ও ইটিএইচ জুরিখ