চীনের কাছে হেরে গেল চ্যাটজিপিটি

চীনের এআই ডিপসিক কাঁপিয়ে দিয়েছে গোটা প্রযুক্তি জগৎ। এনভিডিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিপনির্মাতা প্রতিষ্ঠান এ জন্য একদিনে লোকসান গুণেছে ৬০০ কোটি টাকা! এই এআইয়ের রহস্য কী?

দামে কম মানে ভালো—সবার কাছে চীন ও চীনা পণ্য এভাবেই পরিচিত। ইলেকট্রনিকস থেকে শুরু করে সেলাই করার সুই—সবকিছু কম দামে উৎপাদন করে দেশটি। ফলে আন্তর্জাতিক উৎপাদন হাব বা বিশ্বের ফ্যাক্টরির তকমা পেয়েছে চীন। এখন তারা এআই প্রযুক্তি নিয়েও কাজ শুরু করেছে।

এখানেও সেই কম দামে ভালো জিনিস দেওয়ার মনোভাব নিয়েই এগোচ্ছে চীনা কোম্পানিগুলো। যেখানে ওপেনএআইয়ের মতো মার্কিন কোম্পানিগুলো চ্যাটজিপিটির পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে, সেখানে লিয়াং ওয়েনফেং নামের এক চীনা উদ্যোক্তা মাত্র ৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার খরচ করে তৈরি করেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ডিপসিক (DeepSeek)। এর আর১ মডেল জিপিটি-৪ এবং ক্ষেত্রবিশেষে চ্যাটজিপিটির সবচেয়ে অ্যাডভান্স ও১ (o1) মডেলকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে।

ডিপসিকের প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং

পারফরম্যান্সের দিক থেকে চ্যাটজিপিটির সমকক্ষ হলেও ডিপসিককে প্রশিক্ষণ দিতে চ্যাটজিপিটির খরচের মাত্র ৩-৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। যদিও ৫ দশমিক ৬ মিলিয়নের অঙ্কটা অনেকে মানতে নারাজ, তবু ডিপসিক ও চ্যাটজিপিটির মাঝের এই বিশাল ব্যবধান সবাইকে ভাবতে বাধ্য করছে। সত্যিই কি এ রকম কার্যক্ষম এআই মডেল বানাতে বিলিয়ন বিলিয়ন (কোটির ঘরে) ডলার প্রয়োজন, নাকি স্রেফ কয়েক মিলিয়নেই (লাখের ঘরে অর্থ খরচ করে) চ্যাটজিপিটি বা এর চেয়ে ভালো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করা যায়?

শুধু ডেভেলপমেন্টেই নয়, চ্যাটজিপিটির তুলনায় ডিপসিক এআই ব্যবহারেও খরচ হবে অনেক কম। চ্যাটজিপিটির এখন অবধি সবচেয়ে অ্যাডভান্স মডেল ও১ ব্যবহার করতে প্রতি মাসে ২০ থেকে ২০০ ডলার খরচ করতে হয়। আর ডিপসিক তাদের আর১ মডেল সবার জন্য বিনা মূল্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বার্নস্টিন টেক–বিশ্লেষকদের মতে, এপিআইয়ের মাধ্যমে ডিপসিক আর১-এর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারে ওপেনএআইয়ের তুলনায় প্রায় ৯৬ শতাংশ কম খরচ হবে। যেখানে প্রতি মিলিয়ন টোকেন কিনতে ওপেনএআইয়ের এপিআই খরচ ৭ দশমিক ৫০ ডলার, সেখানে ডিপসিকের ১ মিলিয়ন টোকেন ব্যবহারে খরচ হবে মাত্র শূন্য দশমিক ১৪ ডলার। বলে রাখি, এই এপিআই একধরনের লিঙ্কের মতো। এর মাধ্যমে অন্য ওয়েবসাইট বা অ্যাপের ভেতরে এআই (বা অন্য কোনো অ্যাপের মূল মডেল) ব্যবহার করা যায়।

তার ওপর ডিপসিক পরিচালনা করতে এনভিডিয়ার খুব উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এআই চিপেরও প্রয়োজন হয় না। এআইয়ের ক্রান্তিলগ্ন থেকেই এনভিডিয়া এআই চিপ সরবরাহ করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্বের সবচেয়ে বড় টেক কোম্পানিগুলোর একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে চীনে চিপ সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র, ২০২৩ সালের শেষদিকে। তাই ডিপসিক সহজলভ্য এবং তুলনামূলক কম ক্ষমতার হার্ডওয়্যার দিয়েই চ্যাটজিপিটিকে টক্কর দেওয়ার মতো লজিক ও রিজনিং মডেল বানাতে বাধ্য হয়। সফলও হয়, যা পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়।

চীনা কোম্পানির এ ধরনের সফলতা এনভিডিয়া ও ওপেনএআইয়ের মতো কোম্পানির ওপর নির্ভরতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক দিনে শেয়ারের রেকর্ড দরপতনের মাধ্যমে। ডিপসিক আর১ (DeepSeek R1) মডেল নিয়ে তোলপাড় শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এনভিডিয়া শেয়ার মার্কেটে প্রায় ৬ হাজার কোটি ডলার হারায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ। এনভিডিয়া ছাড়াও আরও বেশ কিছু টেক কোম্পানির পাশাপাশি ওপেনএআইয়ের কর্ণধার স্যাম অল্টম্যানের মতো বিলিয়নিয়ারদের সম্পদেও ভাটা পড়ে ডিপসিকের এই সাফল্যের কারণে।

তবে ডিপসিকের জনপ্রিয়তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ এর ওপেন সোর্স মডেল। ডিপসিক ওপেন সোর্স হওয়ায় যে কেউ এর সোর্স কোড দেখতে বা পরিবর্তন করতে পারেন। ফলে এটি ফ্রিতেই ব্যবহার করা যায়।

ডিপসিকের এই অসম্ভব পারফরম্যান্স দেখে ওপেনএআই খোদ এর বিরুদ্ধে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি চুরির অভিযোগ আনে। আগুনে ঘি ঢালার মতো মাইক্রোসফটও এতে সায় দেয়।

ব্যবহারকারীরা চাইলে নিজের কম্পিউটারে এটি নেটিভ বা অফলাইনে ব্যবহার করতে পারবেন। চাইলেই নিজের মতো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যাবে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে। এসব সুবিধার কারণেই চ্যাটজিপিটি ও গুগলের জেমিনিকে ছাড়িয়ে বাজারে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই ডিপসিক অ্যাপটি অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে ফ্রি অ্যাপের তালিকার শীর্ষে জায়গা করে নেয়।

লজিক ও রিজনিং মডেল হিসেবে ব্যবহারের দিক থেকে ডিপসিককে চ্যাটজিপিটির সমতুল্য বলা চলে। তবে এটি চ্যাটজিপিটির তুলনায় আরও কম খরচ এবং আরও কম শক্তি ব্যয় করেই চ্যাটজিপিটির মতো আউটপুট দিতে পারে।

ডিপসিকের এই অসম্ভব পারফরম্যান্স দেখে ওপেনএআই খোদ এর বিরুদ্ধে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি চুরির অভিযোগ আনে। আগুনে ঘি ঢালার মতো মাইক্রোসফটও এতে সায় দেয়। কেননা, ওপেনএআইয়ের সার্ভারের কাজ মাইক্রোসফটের মাধ্যমেই পরিচালনা করা হয়।

মাইক্রোসফটের দাবি, চ্যাটজিপিটি থেকে এপিআইয়ের মাধ্যমে অনেক বেশি পরিমাণ আউটপুট নেওয়া হয়েছে কিছু চীনা অ্যাকাউন্টে। সন্দেহ করা হচ্ছে, এসব অ্যাকাউন্ট ডিপসিকের সঙ্গে জড়িত। এভাবে এপিআইয়ের মাধ্যমে একটি বড় মডেল থেকে আউটপুট নিয়ে অন্য আরেকটি মডেলকে ট্রেইন করা বা প্রশিক্ষণ দেওয়াকে বলা হয় ডিস্টিলেশন (Distillation)। এমনিতে ডিস্টিলেশনের মাধ্যমে আউটপুট নিয়ে এআই ট্রেইন করা বেআইনি নয়। তবে ওপেনএআইয়ের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, বাজারজাত করার লক্ষ্যে কেউ ডিস্টিলেশন প্রক্রিয়ায় নিজেদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ট্রেইন করতে পারবে না।

এ ছাড়া ডিপসিকের বিরুদ্ধে লামা (Llama) ও কোয়েন (Qwen) থেকেও ডিস্টিলেশনের অভিযোগ রয়েছে। তবে অনেকেই অভিযোগগুলোকে স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস বলে খারিজ করে দিয়েছেন। কেননা, এটা অনেকটা বই থেকে জ্ঞান আহরণ করার মতোই।

ডিস্টিলেশনের মাধ্যমে এআই ট্রেইন করাকে অনেকে বই পড়ে তা থেকে তথ্য–উপাত্ত নিয়ে নিজে আরেকটা বই বা নিবন্ধ লেখার সঙ্গে তুলনা করেছেন। আপনি নিজে একটা নিবন্ধ বা বই লেখার জন্য যেমন অন্য আরও বই পড়তে পারেন, অনেকে এআইয়ের আউটপুট নিয়ে এআইকে ট্রেইন করাকেও তেমন দোষের কিছু মনে করেন না।

তবে এ ক্ষেত্রে ওপেনএআইয়ের অবস্থান খুব শক্ত। তাদের মতে, এটা ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি চুরি। হাস্যকর হলেও সত্যি যে ঠিক এ কারণগুলোর জন্যই যখন চ্যাটজিপিটিকে শিল্পী, লেখক ও সাধারণ ব্যবহারকারীরা চুরির দায়ে অভিযুক্ত করেছিল, তখন ওপেনএআই নিজেই ডিপসিকের মতোই ফেয়ার ইউজের সাফাই গেয়েছিল। তবে চুরি হোক-না হোক, ডিপসিক যে চ্যাটজিপিটিকে টেক্কা দেওয়ার জন্য বাজারে এসেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

ডিপসিকের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে আরেক চীনা এআই—আলিবাবা ক্লাউডের কোয়েন।

লজিক, রিজনিং, কোডিংয়ে ডিপসিককে চ্যাটজিপিটির নতুন মডেলগুলোর সমকক্ষই বলা চলে। এ ছাড়া ডিপসিকের ইমেজ জেনারেশন মডেল জ্যানাস প্রো (Janus Pro) অনেকটা অ্যাডভান্সড। ঠিক এখনই মিডজার্নির মতো না হলেও ওপেনএআইয়ের ডাল–ই-এর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

ডিপসিকের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে আরেক চীনা এআই—আলিবাবা ক্লাউডের কোয়েন। লজিক মডেল না হয়েও কোয়েন ২.৫ ম্যাক্স (Qwen 2.5 Max) রিজনিং, লজিক, ক্রিয়েটিভিটির দিক দিয়ে ডিপসিক আর১ এবং চ্যাটজিপিটির বেশ কিছু ভার্শনকে ছাড়িয়ে যায় অনেক ক্ষেত্রে। ইমেজ জেনারেশনেও কোয়েন অনেক এগিয়ে। এটিও মূলত ফ্রি এবং এর ২.৫ ভার্শনটি ডিপসিক আর১–এর মতোই অফলাইনে ব্যবহার করা যায়।

ডিপসিক ও আলিবাবার মতো আরও অনেক চীনা কোম্পানি এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌড়ে নেমে গেছে। বাইডু, শাওমি, হুয়াওয়ে, টেনসেন্টের মতো অনেক কোম্পানিই এখন এআই নিয়ে মনোযোগী হচ্ছে। চীনা কোম্পানিগুলো দেখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে কম খরচে ও কম সময়ে অ্যাডভান্স এআই মডেল বানানো সম্ভব। ফলে মার্কিন এআই কোম্পানিগুলোর আধিপত্য কমতে চলেছে। ভাঙতে শুরু করেছে এআই বাবল, যাকে অনেকেই তুলনা করছেন ২০০০ সালের ডটকম বাবল বা ২০০৮ সালের ফিন্যান্সিয়াল বাবলের মতো। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই পর্যায়ের উন্নয়ন সাধনের পেছনে যে ওপেনএআইয়ের অগ্রগামী ভূমিকা অনেক বড় নিয়ামক ছিল, সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

লেখক, ব্যবস্থাপক, ডেফটাইল্ড

সূত্র: ডাটাক্যাম্প, গিক ফর গিকস, রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান

*লেখাটি ২০২৫ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত