প্রযুক্তি
নিউরাল নেটওয়ার্কের সূচনা
কেমন করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সূচনা হলো? কার হাত ধরে এল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভাবনা? এই গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষের জীবন বাঁচানোর তাড়না। অ্যালান ট্যুরিংকে হয়তো আপনি চেনেন, কিন্তু ওয়াল্টার হ্যারি পিটসকে কি চেনেন? তিনি কি আসলেই সফল হয়েছিলেন প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বানাতে? এই লেখায় থাকছে সেই নায়কের শুরুর রোমাঞ্চকর গল্প…
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সঙ্গে আমরা কম-বেশি সবাই পরিচিত। যারা এই টুল এখনও ব্যবহার করেননি বলে মনে করেছেন, তাঁরাও কিন্তু নিজের অজান্তেই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। আপনি যখন ফেসবুক দেখছেন, তখন ফেসবুক অ্যাপের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেমটি আপনার আগ্রহের বিষয়গুলো মুহূর্তের মধ্যেই সংগ্রহ করে আপনাকে দেখাচ্ছে। অর্থাৎ নিজের অজান্তেই এ প্রযুক্তি আপনাকে ঘিরে রেখেছে। বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত হলেও কে প্রথম এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিল? বিশ্ববাসীকে কে দেখিয়েছিল যে যন্ত্রকে দিয়েও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করানো যায়? আপনি হয়তো ওয়াল্টার হ্যারি পিটস এবং অ্যালান ট্যুরিংয়ের নাম শুনেছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুরুর গল্পের নায়ক এই দুজন। ১৯৪৩ সালে প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারণাটি দেন তাঁরা। সঙ্গে কিছু মৌলিক তাত্ত্বিক কাজও করেন। কিন্তু সত্যিকারের এমন একটি মেশিন বানিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন কে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে।
১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মকালে বিশ্বজুড়ে একটি পরিবর্তনের হাওয়া বইছিল। মাত্র তিন বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধের পরে যে ক্ষতি হয়েছে, তা বয়ে যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। যুদ্ধ থেমে গেলেও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুরু হয়েছে একটা শীতল যুদ্ধ। বিশেষ করে প্রযুক্তি জগতে কে কার থেকে বেশি এগিয়ে আছে, সেটাই একে অপরকে প্রমাণ করতে ব্যস্ত। মাত্র এক বছর আগে স্পুটনিক উৎক্ষেপণ করে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্র বিপরীতে কিছু একটা দেখিয়ে বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চাইছে যে তারাও পিছিয়ে নেই। সেই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার স্থাপন করলেন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। পাশাপাশি কম্পিউটার প্রযুক্তিও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হলো প্রথম কম্পিউটার এনিয়াক। তখন বাণিজ্যিকভাবে কম্পিউটার তৈরির প্রতিযোগিতাও শুরু হয়েছে।
সেই সময়ে নিউইয়র্ক শহর থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে বাফালো শহরে এক বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণাগারে বসে ভাবছেন, মেশিন কি মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে? মেশিন দিয়ে কি কোনো বুদ্ধিমত্তার কাজ করিয়ে নেওয়া যায়? দুই বছর আগে তাঁর পিএইচডি গবেষণা শেষ করেছেন মানুষের শেখার প্রক্রিয়ার ওপর। তিনি পিটস এবং ট্যুরিংয়ের গবেষণাপত্রটি পড়ে খুব উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তবে তাত্ত্বিক ভাবে নয়, তিনি হাতে-কলমে তা তৈরি করার স্বপ্নে বিভোর। কীভাবে এমন একটি যন্ত্র তৈরি করা যায়, যার বুদ্ধি রয়েছে? অনেক ভাবনা-চিন্তা করে তিনি খুব সাধারণ একটা পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন, আদৌ যন্ত্রকে শেখান যায় কিনা? ভাবলেন, প্রথমে যন্ত্রকে কিছু ছবি দেখাবেন। তারপর প্রশ্ন করে দেখবেন যন্ত্র উত্তর দিতে পারে কিনা। যন্ত্র যদি ভুল করে, তাহলে তা শুধরে দেবেন। ঠিক বলতে পারলে জানাবেন যে ঠিক আছে। এভাবে অনেকবার ভুল করতে করতে মেশিন নিশ্চয়ই শিখতে পারবে। আর ধীরে ধীরে কমবে ভুলের পরিমাণ। এমনটা হলে বিজ্ঞানী প্রমাণ করতে পারবেন যে মেশিন শিখছে। ধারণাটি চমৎকার, কিন্তু করবেন কীভাবে? আর যে বিজ্ঞানী এই কাজটা করেছেন, তাঁর নাম ফ্র্যাঙ্ক রোজেনব্লাট।
রোজেনব্লাট যে গবেষণাগারে কাজ করেন, তার নাম কর্নেল অ্যারোনটিক্যাল ল্যাবরেটরি। মূলত গাড়ির দুর্ঘটনা ঘটলে মানবদেহে কী ধরনের প্রভাব পড়ে তা নিয়ে কাজ করা হয় ওই ল্যাবরেটরিতে। কিন্তু রোজেনব্লাট একটি অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে দেখা করেন সেই ল্যাবরেটরির পরিচালক জন এম. কেলেহেরের সঙ্গে। রোজেনব্লাট জানান, ‘আমি এমন একটি যন্ত্র তৈরি করতে চাই, যা মানুষের মতো শিখতে পারবে’।
কেলেহের ভাবলেন, এমন একটি যন্ত্র তৈরি হলে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বেশ প্রয়োগ করা যাবে। তখন যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণাগারের বেশিরভাগ টাকা বিনিয়োগ করা হতো প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে। এমন একটি যন্ত্র তৈরি করতে পারলে দুর্দান্ত হয়। আর সেটি যদি হয় তাঁর পরিচালিত গবেষণাগারে, তাহলে তো মন্দ হয় না। রোজেনব্লাটের কথা পাগলাটে শোনালেও তিনি বিজ্ঞানীদের চিনতেন। ফলে তিনি রাজি হয়ে গেলেন। নৌবাহিনীর কাছে আবেদন করে রোজেনব্লাটের জন্য এক মিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন করে দিলেন। রোজেনব্লাট একটি বড় টিম নিয়ে শুরু করলেন কাজ।
সে কালে কম্পিউটারে পোগ্রামিং করা এখনকার মতো সহজ ছিল না। এই প্রোজেক্টের জন্য রোজেনব্লাট পেয়ে গেলেন আইবিএমের সিপিসি নামে একটি কম্পিউটার। আজকের দিনের কম্পিউটারের তুলনায় সেটি ছিল অনেক বড়। একটি বিশাল রুমের প্রায় পুরোটা জুড়ে ছিল এই কম্পিউটার। আর ওটায় প্রোগ্রাম করার জন্য ব্যবহৃত হতো বিশেষ ধরনের পাঞ্চ কার্ড। সেসময় কম্পিউটারে ভ্যাকুয়াম টিউব দিয়ে গাণিতিক হিসাব ও লজিক্যাল অপারেশনের কাজ করা যেত। তখনও সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবহার শুরু হয়নি। পাঞ্চ কার্ডে হিসেব কষে নির্দিষ্ট জায়গাতে ফুটো করে তা দিয়েই কম্পিউটারে নির্দেশনা দিত। কাজটি অনেক শ্রমসাধ্য। আবার সামান্য ভুল হলে সব পণ্ডশ্রম। মানে নতুন করে আবার কাজটা করতে হতো। এছাড়া ভ্যাকুয়াম টিউবগুলো প্রায় প্রতিদিনই নষ্ট হয়ে যেত। সেজন্য প্রতিটি কম্পিউটার দেখাশোনার জন্য কয়েকজন টেকনিশিয়ান রাখা হতো। তাদের কাজ ছিল সেই নষ্ট টিউবগুলো পরিবর্তন করে দেওয়া। আজকের যুগের কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের সেই সময়ের পরিশ্রমের কথা ভাবাটা একটু কঠিনই।
আমাদের আজকের গল্পের নায়ক রোজেনব্লাট ছিল কাজ পাগলাটে টাইপের। দিন রাত তিনি পড়ে থাকলেন তাঁর ল্যাবরেটরিতে। মাঝে মধ্যে তাঁর টিমকে নিয়ে চলে যেতেন খামার বাড়িতে। সেখানে সবাই মিলে রাতের আকাশে নক্ষত্র দেখতেন। পুরো টিমকে তিনি স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসতেন। তবে কর্মীদের খাটিয়ে নিতেও ভুলতেন না।
এর মধ্যে একদিন রোজেনব্লাট ভাবলেন, যন্ত্রকে দিয়ে কোনো কিছু শেখানোর প্রথম ধাপ হবে যন্ত্রকে একটি বৃত্ত ও চতুর্ভুজ বোঝানো। মানব মস্তিষ্কের নিউরনের মতো কাজ করে এমন একটি গাণিতিক মডেল তিনি তৈরি করলেন। নাম দিলেন পার্সেপট্রন (Perceptron)। এটি একটি নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেল, যা একটি সংখ্যা নিয়ে কাজ করতে পারে। এটি সহজেই দুটি শ্রেণিকে আলাদা করতে পারে। আজকের যুগের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রথম যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে তার হাত দিয়েই। বিভিন্ন ধরনের ইনপুট বা তথ্য ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে যন্ত্রকে শেখান হয়। যখন ভুল হয় তখন যন্ত্রটিকে বলে দেওয়া হয় যে এটি ভুল হয়েছে। মানব মস্তিষ্ক ভুল থেকে ধীরে ধীরে যেভাবে শেখে, সেভাবে যন্ত্রটি শিখতে পারে। যন্ত্রটি ভুলগুলো থেকে নিজের ভুল শুধরে নেয়, প্যারামিটারগুলো পরিবর্তন করেও নিতে পারে।
কিন্তু যন্ত্রটিতে ছবির তথ্য কীভাবে ঢোকানো যায়, তা নিয়ে বাধে সমস্যা। আজকের মতো তখন ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল না। তাই ছবি তুলে সরাসরি যন্ত্রে প্রবেশ করাও সম্ভব হয়নি। রোজেনব্লাট সেজন্য ব্যবহার করেছিলেন ফটোসেন্সর। এই সেন্সরগুলোতে যে কোনো আলো পড়লে তা বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করে।
অনেক কঠোর পরিশ্রমের পরে রোজেনব্লাটের টিম তৈরি করলেন প্রথম ‘পারসেপট্রন মেশিন। নাম দিলেন মার্ক। রোজেনব্লাট তার সৃষ্টিকে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেন। কর্নেল অ্যারোনটিক্যাল ল্যাবরেটরির পরিচালক কেলেহের এই যন্ত্র নিজ হাতে ব্যবহার করে দেখলেন। আসলেই যন্ত্রটি ধীরে ধীরে তার ভুলগুলো থেকে শিখতে পারছে এবং পরে বৃত্ত ও চতুর্ভুজকে নির্ভুল ভাবেই চিহ্নিত করতে পারছে। এই আবিষ্কারের গুরুত্ব বুঝতে পেরে তিনি নিউইয়র্ক টাইমস এবং অন্যান্য প্রধান সংবাদমাধ্যমকে আমন্ত্রণ জানান। তাঁর বার্তাটি ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু আকর্ষণীয়, ‘আমরা এমন একটি যন্ত্র উপস্থাপন করতে যাচ্ছি, যা মানুষের মতো শিখতে পারে’।
২.
একটি ছোট ঘরে প্রায় ৬০ জন অতিথি উপস্থিত। সামনে রয়েছে ‘মার্ক পারসেপট্রন’। একটি ডেস্ক আকারের যন্ত্র, যার মধ্যে ফটোসেল, তার এবং মোটর রয়েছে। রোজেনব্লাট শান্ত, কিন্তু উত্তেজিত। যদিও তিনি অনেকবার পরীক্ষা করে দেখেছেন, তবুও সবার সামনে যন্ত্রটি ঠিকভাবে কাজ করবে তো? ব্যাপারটা নিয়ে তাঁর চাপা টেনশন ছিল বৈকি। হলরুমে অনেক ফ্যানের ব্যবস্থা থাকলেও তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তিনি রুমাল দিয়ে ঘামটা মুছলেন। তারপর একটা কার্ড তুলে ধরেন ফটোসেন্সরে।
কার্ডটির মাঝখানে একটা উল্লম্ব কালো লাইন রয়েছে। যন্ত্রটি প্রথমে ভুল উত্তর দেয়। রোজেনব্লাট মেশিনের ‘X’ সুইচটি চাপ দিয়ে মেশিনটিকে জানিয়ে দেন ভুল হয়েছে। এরপরে ফটোসেন্সরে আরেকটি একইরকম কার্ড তুলে ধরেন। দেখতে একই রকম হলেও এটা আগেরটার তুলনায় ভিন্ন ছিল। এবার যন্ত্রটি ঠিক উত্তর দেয়। তিনি টিক চিহ্নের সুইচ চাপ দিয়ে মেশিনটিকে জানিয়ে দেন উত্তর ঠিক হয়েছে। এভাবে বেশ কয়েকবার চেষ্টা চালিয়ে, সংশোধন করে যন্ত্রকে শেখাতে থাকেন। পঞ্চম বা ষষ্ঠ কার্ডের পর মেশিনটি সঠিকভাবে শনাক্ত ছবি শনাক্ত করতে পারে। শ্রোতারা বিস্মিত, ভবিষ্যৎ যেন তাদের সামনে উদ্ভাসিত হচ্ছে।
বর্তমানে মোবাইলে ছবি তোলার সময় মোবাইল ফোন স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের মুখ শনাক্ত করতে পারে। তারপর সে অনুযায়ী মোবাইল ফোন বিভিন্ন ধরনের অ্যালগরিদম দিয়ে ছবিটি আরও সুন্দর করে তোলে।
পরদিন নিউইয়র্ক টাইমস বড় করে শিরোনামে লেখে: ‘ইলেকট্রনিক ব্রেন নিজেই শেখে, অভিজ্ঞতা থেকেও শিখতে পারে।’ প্রতিবেদনে রোজেনব্লাটের একটি উদ্ধৃতি ছিল: ‘পারসেপট্রন হাঁটতে, কথা বলতে, দেখতে, লিখতে, নিজেকে পুনরুৎপাদন করতে এবং তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে সক্ষম হবে।’
যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এই আবিষ্কার নিয়ে। মার্কিন সামরিক দপ্তর পেন্টাগনও আগ্রহী হয়ে ওঠে, কীভাবে যন্ত্রটা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়? আমজনতা ও দার্শনিকরা মেশিনের চেতনা নিয়ে বিতর্ক শুরু করে। শুরু হয় মেশিনের মধ্যে ‘বুদ্ধি’ ঢোকানোর মানুষের নতুন যাত্রা। আর এই যাত্রা শুরু হয় ফ্র্যাঙ্ক রোজেনব্লাটের হাত ধরে। তিনিই সর্বপ্রথম প্রমাণ করে দেখান, যন্ত্রকেও শেখানো সম্ভব।
বর্তমানে মোবাইলে ছবি তোলার সময় মোবাইল ফোন স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের মুখ শনাক্ত করতে পারে। তারপর সে অনুযায়ী মোবাইল ফোন বিভিন্ন ধরনের অ্যালগরিদম দিয়ে ছবিটি আরও সুন্দর করে তোলে। কিন্তু যন্ত্রকে দিয়ে এই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজও যে করানো সম্ভব, সে ভাবনাটা প্রথম করেন ফ্র্যাঙ্ক রোজেনব্লাট। ব্যবহারিক প্রয়োগ করিয়েও দেখান তিনি। তাঁর সার্থকতা এখানেই। স্বপ্ন তো যে কেউই দেখতে পারে, তবে তা প্রমাণ করে দেখানো আরোও চ্যালেঞ্জিং। আর সেই চ্যালেঞ্জটাই নিয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক রোজেনব্লাট।
এই আবিষ্কারের পর রোজেনব্লাটকে নিয়ে সবাই মাতামাতি শুরু করে। টিভি আর সংবাদপত্রে তাঁকে নিয়ে বড় বড় ফিচার হয়। কিন্তু তাঁর মন পড়ে থাকে গবেষণাগারে। তিনি আরও বড় স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। যন্ত্রকে দিয়ে কার্ড দেখিয়ে শেখানো যেহেতু সম্ভব, তাহলে কি শব্দ দিয়েও শেখানো যাবে। এরপর তিনি গবেষকদের নিয়ে শব্দ দিয়ে যন্ত্রকে শেখানোর কাজে হাত দিলেন। মার্ক পারসেপট্রন নিয়ে তাঁর সফলতার কারণে আরও বড় ফান্ড পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু তাঁর সেই সুখের দিন বেশি দিন রইল না।
একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসলেন তাঁরই হাই স্কুলের এক জুনিয়র, মারভিন মিনস্কি। মিনস্কি মূলত গণিতের প্রতি আকৃষ্ট। রোজেনব্লাট কলেজে থাকতেই মিনস্কিকে চিনতেন। কোনো এক অজানা কারণে ছেলেটাকে তিনি পছন্দ করতেন না। রোজেনব্লাটের সঙ্গে দেখা করে মিনস্কি বোঝানোর চেষ্টা করলেন, পারসেপট্রন একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে শিখতে পারলেও তাঁকে অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার জন্য আরও ভালো গাণিতিক মডেল তৈরি করতে হবে। পারসেপট্রনের ক্ষমতা অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। তাঁর তৈরি পারসেপট্রনের সমালোচনা রোজেনব্লাট গ্রহণ করতে পারলেন না। এরপর তাঁদের দুজনার মধ্যে শুরু হলো এক বৈজ্ঞানিক বিতর্ক। সেই বিতর্ক শুধু পেশাগত নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়েও পৌঁছে গেল অচিরেই। বিতর্ক চলে প্রায় ১০ বছর।
এদিকে রোজেনব্লাট শব্দ দিয়ে যন্ত্রকে শেখানোর কাজ করলেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন। অন্যান্য নতুন গাণিতিক মডেল তৈরি করেও সফল হতে পারছিলেন না। শুরুর দিকে তাঁর যন্ত্র ভালোভাবে কাজ করলেও শেষ দিকে সব গোলমেলে হয়ে যাচ্ছিল। এ ব্যর্থতার কারণ অনেক পরে, আশির দশকে বুঝতে পারলেন বিজ্ঞানীরা। চুপিচুপি আপনাদের রোজেনব্লাটের সেই ভুলটা বলে দিই।
রোজেনব্লাট নিউরাল নেটওয়ার্কের যে বিশেষ ধরনটি তৈরি করেছিলেন, তা মূলত এক স্তরের। পরে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, যন্ত্রকে শেখানো জন্য এক স্তর যথেষ্ট নয়, বরং অনেক স্তর দিয়ে শেখাতে হবে। এছাড়া পরে বিজ্ঞানীরা ব্যাকপ্রোপাগেশন নামে এক ধরনের ফিডব্যাক লুপ প্রয়োগ করেন। এর ফলেই আজকের দিনের কৃত্রিম বু্দ্ধিমত্তা সফল হয়েছে। আশির দশকের বিজ্ঞানীদের সেই গল্পটি বলব অন্য কোনো দিন। আপাতত রোজেনব্লাটের গল্পে ফেরা যাক।
১৯৬৯ সালে মিনস্কি এবং তাঁর একজন সহকর্মী সেমুর প্যাপার্ট পারসেপট্রনস নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইয়ে তাঁরা প্রমাণ করেন, এক স্তরবিশিষ্ট পারসেপট্রন XOR ফাংশন সমাধান করতে অক্ষম। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, মিনস্কি ব্যক্তিগত ঈর্ষা থেকে এই সমালোচনা করেছেন। রোজেনব্লাটও এটিকে ঈর্ষা বলেই মনে করেছিলেন। তাই মানতে নারাজ ছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা ব্যক্তিগত বিষয়ের থেকে বৈজ্ঞানিক ভুলকে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না। ব্যক্তিগত পরিচয়, পক্ষপাতিত্ব কিংবা ঈর্ষা নয়, বরং যা সঠিক বলে মনে করেন, তা-ই যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করেন। আর এ কাজটি বিজ্ঞানীরা যুগের পরে যুগ করে এসেছেন। মিনস্কি যে ভুল বলেননি, তা রোজেনব্লাট বুঝতে পারেন অনেক পরে। এ ছাড়া তখনকার কম্পিউটার প্রযুক্তি বর্তমান সময়ের মতো এত দক্ষ ছিল না। তাই কারিগরি কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল।
এরপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মানুষের হৈচৈ কমে গেল। কেননা কারিগরিভাবে অনেক কিছুই করা সম্ভব হল না। আশির দশক পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আর কোনো কাজ হয়নি। এই সময়টা ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শীতকাল’ বা ‘এআই উইন্টার’ নামে পরিচিত। মারভিন মিনস্কি কি তাহলে এই গল্পের ভিলেন? মোটেও না। পারসেপট্রনসের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি তিনি। এই সীমাবদ্ধতার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার বাজেটে যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তার জন্য অর্থ বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে গবেষকদের আগ্রহও গেল কমে।
পরে মিনস্কি অবশ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে অনেক চমৎকার কাজ করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি ‘দ্য সোসাইটি অব মাইন্ড থিওরি’ প্রকাশ করেন। এই তত্ত্বে তিনি বলেন—মানুষের বুদ্ধিমত্তা আসলে কোনো একক বা একটিমাত্র প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি অনেকগুলো ছোট ও সহজ প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে গঠিত। এই ছোট ছোট প্রক্রিয়াগুলোকে মিনস্কি বলতেন এজেন্ট। প্রতিটি এজেন্ট একেকটি সহজ কাজ করে, কিন্তু তারা যখন একসঙ্গে কাজ করে, তখন অনেক জটিল চিন্তাভাবনা বা বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টি হয়। বর্তমানে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতে এই এজেন্ট শব্দটি ব্যবহার করি, যা মূলত মিনস্কির দেওয়া। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক হিসেবে পরিচিত এবং এমআইটি মিডিয়া ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা। এখানে বিজ্ঞানীরা শুধু গবেষণা করেন না, শিল্পী, ডিজাইনার, লেখক, সমাজবিজ্ঞানী—সবাই একসঙ্গে কাজ করেন।
এরপর রোজেনব্লাট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্র তৈরির কাজে ইস্তফা দিয়ে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা কীভাবে কাজ করে, তা জানার জন্য ইঁদুর নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। তাঁর হাতে তৈরি মার্ক পারসেপট্রনস যন্ত্রটি বর্তমানে ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। তবে রোজেনব্লাটের নাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে সোনার অক্ষরে। কেননা তাঁর হাত দিয়েই যন্ত্রে বুদ্ধি প্রয়োগের প্রথম কাজটি সম্পন্ন হয়। সেই সময় তিনি একটু বাড়িয়ে বললেও আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে এসে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, রোজেনব্লাট মোটেও বাড়িয়ে বলেননি।