রেডিও বা বেতার শুধু যোগাযোগ মাধ্যম নয়; সময়ের সাক্ষী, ইতিহাসের বাহক ও সংস্কৃতির প্রতীক। যুগে যুগে মানুষের জীবনে এর প্রভাব অপরিসীম। রেডিও থেকে শুরু হয়েছিল তারহীন যোগাযোগের বিস্ময়কর যুগ। এটি আমাদের জীবনে যোগ করেছে নতুন ছন্দ। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংবাদ ও বিনোদনের বাহক হিসেবে সব সময় সঙ্গে ছিল এই রেডিও। এককালে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে রেডিও ছিল। সংবাদের পাশাপাশি এটি ছিল বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। আজ হয়তো সবাই রেডিও শোনেন না, তবে আধুনিক যোগাযোগে এর অবদান অনস্বীকার্য। তাই আজ বিশ্ব রেডিও দিবসে এ যন্ত্র সম্পর্কে চলুন, ১০টি তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
১) প্রথমবার রেডিওতে মানব কণ্ঠস্বর প্রেরণ
ইতালীয় উদ্ভাবক গুলিয়েলমো মার্কোনির হাত ধরে ১৮৯৭ সালে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতি আসে। তিনি রেডিও বা বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে শব্দ প্রেরণের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এটিই ছিল রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে কণ্ঠস্বর প্রেরণের প্রথম ঘটনা। যাকে আমরা এখন রেডিও হিসাবে জানি। মার্কোনির এই উদ্ভাবন পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে চিরতরে। তবে ইতিহাস ভুলে যায়নি, এরও দুই বছর আগে, ১৮৯৫ সালে মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ প্রেরণের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। তবে মার্কোনি এ প্রযুক্তির উন্নয়ন করেন এবং ১৯০১ সালে আটলান্টিক মহাসাগরের দুপ্রান্তের মধ্যে রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে তথ্য প্রেরণ করেন। পাশাপাশি, তিনি এ প্রযুক্তি পেটেন্ট করেও নেন। বহুদূরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, তথ্য আদান-প্রদান, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংবাদ, বিনোদন, সামরিক ব্যবস্থা, জরুরি সেবাসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে রেডিও।
২) ১৯২২ সালে রেডিওর বাণিজ্যিক সম্প্রচার শুরু
রেডিও জনসাধারণের হাতের নাগালে আসে ১৯২২ সালে। তখন রেডিও ছিল রহস্যময় ও কৌতূহলোদ্দীপক বস্তু। এ সময় প্রথমবার বাণিজ্যিক রেডিওর বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। রেডিওকে জনপ্রিয় করতে এবং আধুনিক বিজ্ঞাপন মাধ্যমের ভিত্তি স্থাপন করতে এ সম্প্রচার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৩) আলোর গতিতে চলে বেতার তরঙ্গ
বেতার তরঙ্গ একপ্রকার শক্তি। এ শক্তি তরঙ্গ আকারে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়। শব্দ তরঙ্গ যেমন বাতাসের মধ্য দিয়ে যায়, বেতার তরঙ্গের জন্য এরকম কোনো মাধ্যম লাগে না চলাচলের জন্য। কারণ এটি তড়িৎ-চুম্বক তরঙ্গ হিসেবে চলাচল করে। বেতার তরঙ্গ আলোর গতিতে স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে এর বেগ প্রায় ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল বা ৩ লাখ কিলোমিটার। মানে বেতার তরঙ্গ মাত্র কয়েক সেকেন্ডে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে পারে।
৪) গণমাধ্যমে প্রথম রেডিও
রেডিও আবিষ্কারের আগে তথ্য আদান-প্রদান করা হতো চিঠি ও টেলিগ্রাফের সাহায্যে। কিন্তু এগুলো ছিল অনেক সময় সাপেক্ষ এবং কিছু ক্ষেত্রে সমস্যাজনক। তাই রেডিও ছিল প্রথম প্রযুক্তি, যা মানুষকে মূহূর্তের মধ্যে যোগাযোগের সুযোগ করে দিয়েছিল। শুরুর দিকে রেডিও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পরে সঙ্গীত, সংবাদ ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার কেডিকেএ (KDKA) রেডিও স্টেশন থেকে প্রথম রেডিও সম্প্রচারিত হয়।
৫) মানুষকে সতর্ক করতে রেডিও সম্প্রচার শুরু
এককথায় বলা যায়, রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে সবার কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার পদ্ধতিই রেডিও সম্প্রচার। যাদের কাছে রেডিও আছে, তারা এই সম্প্রচার শুনতে পারে। অর্থাৎ একই সময়ে অনেক মানুষ একই তথ্য জানতে পারে এর মাধ্যমে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, যুদ্ধের খবরসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো মানুষকে জানাতে রেডিও সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার কেডিকেএ রেডিও মানুষকে সতর্ক করতে প্রথম রেডিওতে সরাসরি সংবাদ সম্প্রচার করে। তারা সেবার মানুষকে বন্যা সম্পর্কে সতর্ক করেছিল।
৬) ২ হাজারের বেশি ভাষায় রেডিও সম্প্রচার
বর্তমানে প্রায় ২ হাজারের বেশি ভাষায় মানুষ তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে রেডিওতে। মানুষের চাহিদার কথা মাথায় রেখে রেডিওতে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
৭) ইলেকট্রনিক যোগাযোগের প্রাচীনতম রূপ রেডিও সম্প্রচার
ইলেকট্রনিক যোগাযোগের প্রাচীন রূপ বলা যায় রেডিওকে। ১২০ বছর আগে রেডিও আবিষ্কার হলেও এখনও মানুষ রেডিও ব্যবহার করছে। মোবাইল ও ইন্টারনেটের কল্যাণে এর ব্যবহার কমলেও এখনও একদম ফুরিয়ে যায়নি।
৮) প্রথম এফএম রেডিও স্টেশনের উত্থান
১৯৪০ সালে যোগাযোগের জগতে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে। প্রথম ফ্রিকোয়েন্সি মডুলেশন বা এফএম (FM) রেডিও স্টেশন সম্প্রচার শুরু করে। এটা রেডিও শোনার অভিজ্ঞতাকে বদলে দেয় চিরতরে। এফএম রেডিও এমন এক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে, যেখানে তথ্য (শব্দ, সঙ্গীত) বহন করার জন্য রেডিও তরঙ্গের কম্পাঙ্ক (Frequency) পরিবর্তন করা যায়। এ জন্য ৮৮-১০৮ মেগাহার্জ কম্পাঙ্কের তরঙ্গ ব্যবহৃত হয়। এর আগে, এএম (AM) বা এমপ্লিচ্যুড মডুলেশন রেডিও স্টেশনই ছিল একমাত্র মাধ্যম, যা তরঙ্গের বিস্তার বা শক্তি পরিবর্তন করে তথ্য বহন করত।
৯) ১৯৯৫ সালে ডিজিটাল অডিও ব্রডকাস্টিং চালু
১৯৯৫ সালে যুক্তরাজ্যে চালু হয় ডিজিটাল অডিও ব্রডকাস্টিং বা ড্যাব (DAB) রেডিও। এর আগে শ্রোতারা অ্যানালগ সংকেত ব্যবহার করে রেডিও শুনতেন। এতে রেডিও শোনার অভিজ্ঞতা অত ভালো ছিল না। ড্যাব ডিজিটাল সংকেত ব্যবহার করায় পরিষ্কার কথা শোনা যেত। ফলে রেডিও শোনা অনেক উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
১০) রেডিও সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণ
রেডিও সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাজ্যের অফকম নামে একটি সংস্থা। রেডিও লাইসেন্স, সম্প্রচার মান এবং সম্প্রচার কোড (কোন কোন বিষয় সম্প্রচার করা যাবে) তদারকি করা এ সংস্থার কাজ। আমাদের দেশে রেডিও সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসি (BTRC)। এটি বেসরকারি রেডিও স্টেশনগুলোকে লাইসেন্স দেয় এবং সম্প্রচারের মান নিয়ন্ত্রণ করে।