বর্তমান পৃথিবীর চালিকা শক্তি বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ ছাড়া আজকের পৃথিবী কল্পনা-ই করা যায় না। এই বিদ্যুৎ তৈরি হয় তড়িৎ উৎপাদন কেন্দ্র বা পাওয়ার প্ল্যান্টে। নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য মিলিয়ে বিভিন্ন ধরনের পাওয়ার স্টেশন রয়েছে পৃথিবীজুড়ে। এর মধ্যে জলবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকেই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পরিমাণ তড়িৎ উৎপাদন করছে মানুষ। নদীর স্রোতের শক্তি ব্যবহার করে জেনারেটরের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয় জলবিদ্যুৎ। এই জলবিদ্যুৎ ছাড়াও বায়ুকল নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের একটি বড় উৎস। অনবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে আছে তেল, গ্যাস, কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর আছে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। উৎস ভিন্ন হলেও উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিন্তু একই রকম। এই বিদ্যুতের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান সভ্যতা। গতিশীল করে তুলেছে জীবনকে। অল্প পরিসরে চলুন জেনে নেওয়া যায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ১০টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র সম্পর্কে।
থ্রি জর্জেস বাঁধ, চীন
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাওয়ার স্টেশনটির নাম চীনের দ্য থ্রি জর্জেস বাঁধ। এ থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎশক্তির পরিমাণ প্রায় ২২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। মধ্য চীনের ইয়াংজি নদীর ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাঁধটি। নদীর প্রাকৃতিক নিম্নস্রোতকে কাজে লাগিয়ে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় এখানে। অর্থাৎ এটি একটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র।
প্রতি বছর এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গড়ে ঘণ্টায় প্রায় ৯৫ টেরাওয়াট শক্তি পায় চীন। ২০০৩ সালে শেষ হয় এর নির্মান কাজ। ২০১২ সাল থেকে কাঙ্ক্ষিত সক্ষমতায় কাজ করে যাচ্ছে থি জর্জেস ড্যাম।
এখন পর্যন্ত বছরে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কৃতিত্বও এই কেন্দ্রটির দখলে। মৌসুমী ভারী বৃষ্টির ফলে ২০২০ সালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ঘণ্টায় প্রায় ১১২ টেরাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছিল।
ইতাইপু বাঁধ, ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ে
বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইতাইপু বাঁধ। এটি ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ের সীমান্তে অবস্থিত। পারানা নদীর জলস্রোত শক্তি জোগাচ্ছে বাঁধটিকে। এই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রটির তড়িৎ শক্তি তৈরির সক্ষমতা প্রায় ১৪ হাজার মেগাওয়াট।
জলস্রোতকে কাজে লাগিয়ে প্রায় ২০টি জেনারেটরের সাহায্য বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় এখানে। প্রতিটি জেনারেটর ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে। প্যারাগুয়েতে বিদ্যুৎ শক্তি সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এই কেন্দ্রটির। দেশটির বাৎসরিক বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ৭৫ ভাগই পূরণ হয় ইতাইপু বাঁধ থেকে।
জিলুওডু বাঁধ, চীন
চীনের জিনসা নদী উপত্যকায় অবস্থিত জিলুওডু বাঁধ, পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাঁধটি প্রায় ২৭৮ মিটার উঁচু, দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৯৮ মিটার। এটা চীনের লেইবো এবং ইয়োশান রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত। এটা বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি একইসঙ্গে সেচ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে। ৯টি ইউনিট সমৃদ্ধ বাঁধটির ভূ-গর্ভস্থ শক্তিশালী জেনারেটর ১৩ হাজার ৮৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে।
বেলো মনটে বাঁধ, ব্রাজিল
বেলো মনটে বাঁধের আরেক নাম কারারাও বাঁধ। সবচেয়ে বড় পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর মধ্যে এটি চতুর্থ। ব্রাজিলের পারা অঞ্চলে জিনজু নদীর ওপরে দাঁড়িয়ে আছে বাঁধটি। বুঝতেই পারছেন, এটা আরেকটা জলবিদ্যুৎকেন্দ্র। ১৮টি টারবাইন সমৃদ্ধ বাঁধটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১৯ সালে। এর বিদ্যুৎ তৈরির সক্ষমতা ঘণ্টায় প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট।
গুরি বাঁধ, ভেনিজুয়েলা
১৯৬৯ সালে শুরু হয়ে গুরি বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৮৬ সালে। ভেনিজুয়েলার পূর্বাংশের ক্যারোনি নদীর ওপর অবস্থিত। ১০ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে এর। গুরি বাঁধ ছাড়াও এই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রটি সিমন বলিভার হাইড্রোইলেকট্রিক প্ল্যান্ট নামেও পরিচিত। এর আগে রাউল লিওনি হাইড্রোইলেকট্রিক প্ল্যান্ট নামে পরিচিত ছিল বাঁধটি। এর উচ্চতা প্রায় ১৬২ মিটার। আর দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ হাজার ৪২৬ মিটার।
উওডং বাঁধ, চীন
চীনের ইয়াংজি নদীর ওপর অবস্থিত আরেকটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র উওডং বাঁধ। এর অবস্থান নদীর উজানে ওপরের অংশে। দক্ষিণ পশ্চিম চীনের সিচুয়ান ও ইউনান প্রদেশের কিছু অংশজুড়ে আছে এই কেন্দ্রটি। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১০ হাজার ২০০ মেগাওয়াট শক্তি তৈরি করতে পারে।
জেবেল আলী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত
তেল ও গ্যাসভিত্তিক একটি সমন্বিত বা সিসিটিজি (CCTG) বিদ্যুৎকেন্দ্র এটি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে এর অবস্থান। এর একপাশে আছে পারস্য উপসাগর, অন্যপাশে জেবেল আলী বিমানবন্দর। তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ৯টি ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলে পুরো জেবেল আলী বিদ্যুৎ কেন্দ্র। অনবায়নযোগ্য অর্থাৎ তেল কিংবা গ্যাসের মতো জ্বালানীতে চলা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিদ্যুকেন্দ্র এটা। জেবেল আলী বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষমতা ৮ হাজার ৬৯৫ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি এখানে প্রতিদিন উৎপন্ন হয় ৪৭ কোটি লিটার পানযোগ্য স্বাদু পানি।
টুকুরুই বাঁধ, ব্রাজিল
ব্রাজিলের পারাতে অঞ্চলের টোক্যানটিন নদীর মাঝে অবস্থিত এটি। অ্যামাজন রেইনফরেস্টের মাঝে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র এটাই ছিল প্রথম। এটি বানানোর সময় অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় বলে অভিযোগ আছে। তবে কেন্দ্রটি বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করছে। এর মোট সক্ষমতা ৮ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট।
জিউকুয়ান উইন্ড পাওয়ার বেজ, চীন
এটি একটি বায়ু-বিদ্যুৎকেন্দ্র। গানসু উইন্ড ফার্ম নামেও পরিচিত। বায়ু-বিদ্যুৎকেন্দ্র মানে কিন্তু উইন্ডমিল না। উইন্ডমিল মানে বায়ুকল। এরকম অনেকগুলো বায়ুকল মিলে তৈরি হয় একটি বায়ু-বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিশালাকার প্রায় ৯২ হাজার বায়ুকল আছে কেন্দ্রটিতে। চীনের গানসু অঞ্চলের মরুভূমিতে বানানো হয়েছে এটি। বর্তমানে সব মিলিয়ে ৭ হাজার ৯৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরিতে পারে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। মজার বিষয় হলো, এটি এখনও নির্মানাধীন। আশা করা হচ্ছে, ২০২৫ সাল নাগাদ এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে। তখন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ শক্তি পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কোরি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, দক্ষিণ কোরিয়া
পৃথিবীর ১০ম বৃহত্তম বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নাম কোরি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট। পারমাণবিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৭ হাজার ৪৮৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে। মোট ও কার্যকর রিয়েক্টরের সংখ্যা অনুযায়ী দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান শহরে অবস্থিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বলা হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস