সাক্ষাৎকার
‘মেয়ে হয়ে আগেই নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া চলবে না’ — ফারিবা খান, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, অ্যাপল ইনকরপোরেটেড
আমাদের সংস্কৃতির শুরু থেকেই জড়িয়ে আছে নারীদের সুপ্ত অবদান। এর ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশের মেয়েরা এখন নিজেদের তুলে ধরছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের মঞ্চে। তাঁদের মাঝে এক উজ্জ্বল নাম ফারিবা খান।
বাবা চিকিত্সক হওয়ায় তাঁর ইচ্ছা ছিল মেয়েকে চিকিত্সক বানানোর। তবে গণিতপ্রেমী ফারিবা কিন্তু নিজের পছন্দেই পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান বিভাগে। এরপর ইলিনয় আরবানা-ক্যাম্পেইন বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার নিরাপত্তা বিষয়ে পিএইচডি করতে পাড়ি জমান তিনি। পরে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। টেলিনাভ, ভিএমওয়ারসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৫ সালে গুগলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ শুরু করলেও সেখানে মন টেকে না ফারিবার। সবশেষে বর্তমানে (২০১৭) তিনি অ্যাপলের নিরাপত্তা বিভাগে দক্ষ প্রোগ্রামার হিসেবে কর্মরত আছেন।
সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। এ সময় মুখোমুখি হন বিজ্ঞানচিন্তা প্রতিবেদকের। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। সাক্ষাত্কারের চুম্বক অংশ এখানেছাপা হলো।
বিজ্ঞানচিন্তা প্রতিবেদক :
বিজ্ঞানচিন্তা: আপনার প্রোগ্রামিং জীবনের অভিজ্ঞতা, কাজ শুরুর গল্প এবং অনুপ্রেরণা নিয়ে জানতে চাই।
ফারিবা খান: আমাদের দেশের আরও অনেক শিক্ষার্থীর মতো আমি ভুল করে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ি। সিএসইতে পড়ার আগে আমার কোনো প্রোগ্রামিং অভিজ্ঞতা ছিল না। বাবা চিকিত্সক হওয়ায় তাঁর ইচ্ছা ছিল আমাকে চিকিত্সাশাস্ত্রে পড়ানোর। কিন্তু আমি ওনার মতো দিনরাত পরিশ্রম করতে চাইতাম না। পরে বাবা বললেন, আমি যদি কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ার সুযোগ পাই, তাহলেই আমাকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দেওয়া হবে। এমনিতে আমি অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কম্পিউটার সায়েন্সের মতো জটিল বিষয় আমি কীভাবে শিখেছি, সেটা এখনো আমায় অভিভূত করে।
কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচডি শুরুর পর বুঝতে পারি, এটি আসলে গণিতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গণিত ছোটবেলা থেকে অনেক ভালো লাগত। আমি শীতের ছুটিতে পাঠ্যবইয়ের অতিরিক্ত সমস্যাগুলো সমাধান করতাম। আরও ছিল গণিত ও বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন বই। তখন গণিত অলিম্পিয়াড চালু হয়নি। আমাদের সময় বইয়ের অর্ধেক অঙ্কও বোধ হয় শ্রেণিতে করতে হতো না। সেগুলো না করেই অঙ্কে ১০০ পাওয়া যেত। কিন্তু আমি বাকিগুলো নিজেই সমাধান করতাম। এখন বুঝি এই সমস্যা সমাধানের চর্চা পরবর্তী সময়ে আমার অনেক কাজে সাহায্য করেছে। এখান থেকেই আমার মৌলিক চিন্তার দক্ষতার সৃষ্টি হয়েছে।
আমার পিএইচডি ছিল কম্পিউটারের নিরাপত্তা নিয়ে। সেটার জন্য আবার আরেক ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন। সন্দেহ করা, ত্রুটি খোঁজা, যেকোনো ডিজাইন করতে গেলে বা কারও ডিজাইন দেখলেই চিন্তা করতে হয়, এটাকে কীভাবে ব্রেক করা যায়। সেই ভুল ধরার অভিজ্ঞতা নিয়েই কর্মজীবনে পা রাখি। কাজের ক্ষেত্রে একটা বিশাল অনুপ্রেরণা ছিল মানুষের উপকারে আসে এমন জিনিস তৈরি করা। ইন্টারনেট এবং তার বিশালতা আমাকে সব সময় অনুপ্রাণিত করে।
বিজ্ঞানচিন্তা প্রতিবেদক :
বিজ্ঞানচিন্তা: বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে বর্তমানে নারীদেরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার এক বিশাল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। সেই পর্যায় থেকে একজন নারী প্রোগ্রামার হিসেবে বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ফারিবা খান: ২০০ বছর আগেও মেয়েদের এককভাবে বাঁচার অধিকার ছিল না। সাধারণ পড়ালেখার আইনগত অধিকারই ছিল না ১০০ বছর আগে। সেই প্রতিকূলতা পেরিয়ে যে মেয়েরা এত দূর এগিয়েছে, সেটা এভারেস্ট জয় বা চাঁদে অবতরণের মতো একটা বিশাল ব্যাপার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রোগ্রামিং মেয়েরাই করত। এরপর দুই ধরনের ঘটনা ঘটে। প্রথম ক্ষেত্রে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নজর পড়ে প্রোগ্রামিংয়ের দিকে। আর মেয়েরা সব আইনগত অধিকার থাকা সত্ত্বেও লক্ষ করে যে তাদের সেই অধিকার আদায়ে অনেক সামাজিক বাধা। অনেক সময় এত বাধা আমরা ডিঙানোর চেষ্টাই করি না। সেই চেষ্টাই আমাদের করতে হবে। সমাজ আমরা বদলাতে পারব, যদি রাতারাতি আমরা আমাদের মনোভাব বদলাতে পারি। আমাদের চিন্তা হওয়া উচিত যে আমি সবচেয়ে ভালো জায়গায় আবেদন করব। নারী হয়ে আগেই নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া চলবে না।
সবাইকে উত্সাহিত করব গ্রেস হপার কনফারেন্সের কি-নোট স্পিচগুলো ইউটিউবে শুনতে। সারা পৃথিবীতে নারীরা কীভাবে প্রতিকূলতা আস্তে আস্তে পেরোচ্ছেন, সেটা আমাদের অনেক অনুপ্রেরণা জোগাবে।
বিজ্ঞানচিন্তা প্রতিবেদক :
বিজ্ঞানচিন্তা: গুগলকে বলা হয় বিশ্বের সেরা অফিসগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেখানে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলুন।
ফারিবা খান: গুগলকে আসলেই বিশ্বসেরা অফিস বলতে হয়। গুগলের অফিসকে ক্যাম্পাস বলা হয়। কেননা সেটা আসলেই একটা বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মতো। সেখানে কাজে যেন প্রেরণা আসে, তার সব ব্যবস্থা আছে। সব সময় উচ্চমানের খাবার, স্ন্যাকস। মানসিক ও দৈহিকভাবে সবাইকে সুস্থ রাখতে ভালো জিম, ফিজিওথেরাপিস্ট রয়েছেন। এ ছাড়া আছে একান্তে কাজ করার জায়গা। অনেকে মিলে দোলনায় দুলতে দুলতে বা বাইরে ঘাসে বসে কাজ করা যায়। নতুন কিছু শেখার জন্য অনেক ক্লাস এবং কোড ল্যাবের ব্যবস্থা আছে। অনেক সম্মানিত জ্ঞানী ব্যক্তি আসেন কথা বলতে। আবার অনেক শিল্পীও আসেন আমাদের আনন্দ দিতে। সব মিলিয়ে কাজ করার জন্য চমত্কার এক পরিবেশ।
বিজ্ঞানচিন্তা প্রতিবেদক :
বিজ্ঞানচিন্তা: অ্যাপলে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
ফারিবা খান: অ্যাপলে আমি অত্যন্ত মেধাবী সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করি। অ্যাপল একটি বিশ্বসেরা কোম্পানি। তাদের পণ্য শতকোটি মানুষ ব্যবহার করছে। আমাদের কোনো পণ্য ডিজাইনের সময় সেই শতকোটি ব্যবহারকারীর প্রত্যেকের কথা চিন্তা করতে হয়েছে। এই ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন দেশের, তাদের চাহিদা হয়তো ভিন্ন, তাদের পরিবেশও বিভিন্ন। খুব ছোট উদহারণ দিই: কেউ হয়তো খুব ভালো মানের ইন্টারনেট ব্যবহার করছে কিন্তু কেউ হয়তো সে রকম ভালো ইন্টারনেট পাচ্ছে না। একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে এই দুই ধরনের ব্যবহারকারীর জন্যই পণ্যটি তৈরি করতে হচ্ছে। বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের বোঝার সুবিধায় ফেসবুকের একটি উদাহরণ দিই: আপনি হয়তো ফোন থেকে ফেসবুকে কোনো ছবি পোস্ট করলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই পোস্টটি আপনার কম্পিউটারে দেখতে পাচ্ছেন। সেই পোস্টটা বিশ্বজুড়ে আপনার বন্ধুদের বিভিন্ন ডিভাইসের নিউজফিডে চলে যাচ্ছে। তাই আমাদের সব অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে কাজ করতে হয়।
বিজ্ঞানচিন্তা প্রতিবেদক :
বিজ্ঞানচিন্তা: যেসব তরুণ সফল প্রোগ্রামার হতে চান, তাঁদের জন্য কী বলবেন?
ফারিবা খান: আমি প্রথমেই বলব, আমাদের মূলত ভালো সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। প্রোগ্রামার একটি একক ধারণা। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার একটা যৌথ ব্যাপার। একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার জানতে চাইবেন এই প্রোগ্রাম কোথায় ব্যবহার করা হবে? কতজন ব্যবহার করবে? কোন হার্ডওয়্যারে চলবে? প্রোগ্রামটি কেমন চলছে? কী ধরনের ইনপুট ও আউটপুট হয়েছে? কীভাবে মনিটর করা হবে? ব্যবহারকারীর অবস্থান যদি বদলে যায়, প্রোগ্রাম কীভাবে প্রতিক্রিয়া করবে? এসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে। তাঁকে প্রতিনিয়ত চিন্তা করতে হবে কীভাবে প্রোগ্রামের কোডটিকে গুণগতভাবে আরও ভালো করা যায়। এখন প্রোগ্রামিংয়ের জন্য গণিতের মৌলিক জ্ঞান প্রয়োজন। আমার তড়িত্ প্রকৌশলী বন্ধু কম্পিউটারের চিপ ডিজাইন করে, অর্থনীতিবিদ বন্ধু প্রোগ্রাম লিখে বিশ্বের ভবিষ্যত্ অর্থনীতির মডেলগুলো তৈরি করে। জীববিজ্ঞানী বন্ধুও প্রোগ্রাম করে তার গবেষণার কাজগুলো করে। এখনকার একটা গাড়িতে বহু প্রসেসরের কম্পিউটার থাকে, যার প্রোগ্রামের ওপর গাড়ির সম্পূর্ণ ইঞ্জিনব্যবস্থা আর নিরাপত্তা নির্ভর করে। ঢাকায় নতুন চালু হওয়া উবারের (uber) কথা ভাবুন। মোবাইল ফোনে আপনি ট্যাক্সি ডাকতে পারছেন। দেখতে পারছেন এই ড্রাইভারের রেটিং কেমন। নিরাপত্তাসহ অ্যাপেই দেখতে পাচ্ছেন ট্যাক্সি কত দূর। প্রোগ্রামিংয়ের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হচ্ছে এ রকম আরও সমস্যা সমাধান করতে চাওয়া। কেউ করছে না, আমিই করব, এ রকম একটা মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।
উবারের মতো এ রকম ছোট প্ল্যাটফর্ম কি আমরা বানাতে পারি না? বাড়িভাড়া পাওয়া অনেক সমস্যা আমাদের দেশে। সেটার জন্য কি আমরা সব খালি বাড়ি ম্যাপে বসানোর ব্যবস্থা করতে পারি না? এ রকম একটা প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে প্যাডম্যাপার। ঢাকা বা বাংলাদেশের কোনো জায়গা নেই সেখানে, কিন্তু বানানো কি খুব কঠিন? বানাতে হলে কী দেখতে হবে? চাহিদা আছে কি না, কারা ব্যবহার করবে, কী ধরনের বৈশিষ্ট্য দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাবে, কীভাবে ধাপে ধাপে বৈশিষ্ট্যগুলো যোগ করা যাবে? এই বিশ্লেষণমূলক চিন্তাগুলো করতে পারাই প্রোগ্রামিং। চর্চা করতে করতেই সেই ক্ষমতাটা বাড়ে। প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাগুলো ছোট মাত্রায় এই চর্চা করার সুযোগ করে দেয়। আমাদের করপোরেট হাউসগুলো ছাত্রছাত্রীদের ইন্টার্ন হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সেই সুযোগকে আরও বাড়াতে পারে। তাতে বাস্তবজীবনের সমস্যা সমাধানের অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। তারপর ক্লাউডে ছাত্রছাত্রীরা ছোটখাটো অ্যাপ বানাতে পারে। গুগল ক্লাউড বা অ্যামাজনে অনেক ক্ষেত্রেই কম ব্যান্ডউইটেথর একটি সেবা বিনা পয়সায় চালু করা যায়। কিন্তু এর মাধ্যমে একটি ফুল লাইফ সাইকেল মাইক্রো সার্ভিস বানানোর অভিজ্ঞতা হতে পারে এতে। অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা অনেকভাবে সংগ্রহ করা সম্ভব। তাই এ বিষয়ে আগ্রহী ব্যক্তিদের উচিত সুযোগের অপেক্ষায় বসে না থেকে, নিজের অবস্থান থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকা। দুনিয়া আপনাকে একসময় খুঁজে নেবেই।