এআই পিসি
সত্যিকার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুগের দ্বারপ্রান্তে
আপনার নিজের কম্পিউটারের ভেতরেই থাকবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রসেসর। দৈনন্দিন কাজগুলো দ্রুত করা যাবে তো বটেই, এআই–নির্ভর কাজও করতে পারবেন। এর মাধ্যমে সত্যিকারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুগে প্রবেশ করছি আমরা। কেমন হবে এসব এআই পিসি? কতটা কী করা যাবে?
অবশেষে কম্পিউটারেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চলে এসেছে।
এত দিন কম্পিউটারে ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটি, গুগলের জেমিনি বা মাইক্রোসফটের ডাল.ই-এর মতো এআই টুল ব্যবহার করার পর কথাটা শুনে একটু অদ্ভুত মনে হতেই পারে। অনেক আগে থেকেই তো কম্পিউটারে এআই ব্যবহার করছি, এ আর নতুন কী?
আসলে কম্পিউটারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এবং কম্পিউটার ব্যবহার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত টুলসে কাজ করা এক নয়। চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা মিডজার্নির মতো জেনারেটিভ এআইগুলোর প্রসেসিংয়ের প্রায় পুরোটাই হয় দূরবর্তী একটি সার্ভারে; অর্থাৎ রিমোট (Remote) সার্ভারে বা আমরা আমাদের কম্পিউটার দিয়ে ইন্টারনেটের সাহায্যে শুধু এই টুলসগুলোর ইন্টারফেস ব্যবহার করছি। সরাসরি কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেল নিজেদের কম্পিউটারে ব্যবহার করতে পারছি না। এই ক্লাউড বা ইন্টারনেট–নির্ভর প্রক্রিয়ায় এআই ব্যবহার করতে গিয়ে আমাদের দুটি বড় সমস্যার মুখে পড়তে হয়। এক. লেটেন্সি বা বিলম্ব এবং দুই. ভালনেরাবিলিটি বা আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা।
এ বছরের শুরুতেই এআই পিসির জন্য ইন্টেল বাজারে এনেছে তাদের ইন্টেল কোর আলট্রা সিরিজের প্রসেসর, যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর কাজে সহায়তার জন্য রয়েছে এআই অ্যাকসিলারেশন (AI acceleration)।
চ্যাটজিপিটির কথাই ধরে নিই। চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে একজন ইউজারকে চ্যাটজিপিটির ওয়েবসাইট বা অ্যাপ ব্যবহার করতে হয়। সেখানে যখন ইউজার কমান্ড বা প্রম্পট ইনপুট দেন, সেটি ওয়েবসাইট বা অ্যাপ থেকে ওপেনএআইয়ের সার্ভারে চলে যায়। সেখানে চ্যাটজিপিটির সার্ভার সেই কমান্ড বা প্রম্পট নিয়ে তা বোঝার চেষ্টা করে। এরপর সেই কমান্ড অনুযায়ী ইউজারের দেওয়া তথ্য ব্যবহার করে একটি আউটপুট তৈরি করে। এই আউটপুট জেনারেট করতে চ্যাটজিপিটি সম্পূর্ণরূপে তাদের সার্ভারের কর্মদক্ষতা ব্যবহার করে। ইউজারের ডিভাইসের কর্মদক্ষতার কোনো প্রভাবই নেই এতে। এরপর সেই আউটপুট ওপেনএআই ইউজারের চ্যাটজিপিটি অ্যাকাউন্টে পাঠায়। এই পুরো প্রক্রিয়ায় ইনপুট-আউটপুটগুলোকে ডিভাইস-ইন্টারনেট-সার্ভার-ইন্টারনেট-ডিভাইস পথে চলে পৌঁছাতে হয় ব্যবহারকারীর কাছে। এই পথে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে কিছু সময় লাগে, যা লেটেন্সি বা বিলম্বের সৃষ্টি করে।
তা ছাড়া এ প্রক্রিয়ায় ব্যবহারকারীর দেওয়া তথ্য তাঁর ডিভাইস থেকে দূরবর্তী অন্য একটি সার্ভারে পাঠানো হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহারকারী জানতে পারেন না যে তাঁর দেওয়া সংবেদনশীল তথ্য কীভাবে আদান-প্রদান বা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ফলে এই তথ্য ফাঁস বা চুরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়, যাকে ভালনেরাবিলিটি বা আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বলা হয়। এখনকার প্রায় সব ধরনের এআই টুল, সফটওয়্যার বা প্রোগ্রাম কমবেশি এভাবেই কাজ করে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর এই কাজগুলোকেই যদি দূরের সার্ভারে না পাঠিয়ে ব্যবহারকারীর ডিভাইসে করা যায়, তাহলে লেটেন্সি ও ভালনেরাবিলিটি—দুটি সমস্যারই সমাধান হবে। এই চিন্তা থেকেই এআই পিসির জন্ম; অর্থাৎ এআই পিসি মানে, যেসব কম্পিউটারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর কাজের জন্য সিপিইউতে একটি ডেডিকেটেড নিউরাল প্রসেসিং ইউনিট বা এনপিইউ (NPU) রয়েছে। এই এনপিইউ থাকায় এসব কম্পিউটারে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল বা এলএলএম (LLM) প্রসেসের পাশাপাশি অনেক ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত কাজ করা যায়। এতে ব্যবহারকারীর নির্দেশিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর কাজগুলো সম্পাদন করতে বাহ্যিক সার্ভারের ওপর নির্ভরশীলতা কমে। কমে লেটেন্সি ও ভালনেরাবিলিটিও।
এএমডিও এ বছর তাদের এএমডি রাইজেন এআই সিরিজের প্রসেসর বাজারে এনেছে। এটি গতানুগতিক x86 আর্কিটেকচারের কম্পিউটারের জন্য প্রথম এআই ইঞ্জিন–সংবলিত প্রসেসর। এর সাহায্যে কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা চ্যাটজিপিটি এবং অন্যান্য প্রম্পট–নির্ভর এআইয়ের কাজ করতে পারবেন নিজের পিসিতেই।
তা ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রোগ্রামগুলোর অগ্রগতি হচ্ছে সূচকীয় হারে। খুব শিগগির গতানুগতিক কম্পিউটার ব্যবহার করে এসব প্রোগ্রামের পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ অসম্ভব হয়ে যাবে। তাই ব্যক্তিপর্যায়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালনাকারী ডিভাইস খুব জরুরি হয়ে উঠেছিল কম্পিউটিংয়ের ভবিষ্যতের জন্য। এ জন্যই সিপিইউ ও কম্পিউটার উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো এখনই নিজেদের প্রস্তুত করে ফেলেছে অবশ্যম্ভাবী এআই যুগের জন্য।
এ বছরের শুরুতেই এআই পিসির জন্য ইন্টেল বাজারে এনেছে তাদের ইন্টেল কোর আলট্রা সিরিজের প্রসেসর, যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর কাজে সহায়তার জন্য রয়েছে এআই অ্যাকসিলারেশন (AI acceleration)। এই কম্পিউটারগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে, এগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত কাজগুলোকে পিসির সিপিইউ, জিপিইউ ও এনপিইউতে সুষমভাবে বণ্টন করতে পারে।
এ ধরনের প্রসেসরে ডেডিকেটেড এনপিইউগুলো কম্পিউটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর কাজগুলো সম্পন্ন করার পাশাপাশি গতানুগতিক কাজেও নিয়ে আসে দ্রুততা। এ কারণে এ ধরনের প্রসেসরগুলো প্রথাগত কম্পিউটারের প্রসেসর থেকে অনেক দ্রুতগতিসম্পন্ন হয়। পারফরম্যান্স ও কর্মদক্ষতায় এ প্রভাবের কারণে ইন্টেল এই নতুন প্রসেসরগুলোকে গত দুই দশকে পারসোনাল কম্পিউটিংয়ে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
এএমডিও এ বছর তাদের এএমডি রাইজেন এআই সিরিজের প্রসেসর বাজারে এনেছে। এটি গতানুগতিক x86 আর্কিটেকচারের কম্পিউটারের জন্য প্রথম এআই ইঞ্জিন–সংবলিত প্রসেসর। এর সাহায্যে কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা চ্যাটজিপিটি এবং অন্যান্য প্রম্পট–নির্ভর এআইয়ের কাজ করতে পারবেন নিজের পিসিতেই। এক লাইনের ইনস্ট্রাকশন বা নির্দেশ থেকে শুরু করে ই-মেইল বা রচনা লেখা, টেক্সট থেকে ছবি তৈরি করা, ভিডিও কলে সাবজেক্টকে মাঝখানে রাখা, এডিটিংয়ে সাহায্য করার মতো গতানুগতিক প্রায় সব ধরনের এআই টুলের কাজ করা যাবে এখন এই পিসিতেই। এ ছাড়া সাইবার আক্রমণ থেকে রক্ষার পাশাপাশি ডিভাইসটি কোনোভাবে সাইবার হামলার শিকার হলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত সেলফ-হিল (Self-heal) ফিচারের সহায়তায় কম্পিউটারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সুরক্ষিত হয়ে যাবে।
গতানুগতিক টেক্সট ফিল, টেক্সট-টু-ইমেজ, কনটেন্ট এডিটিংয়ের মতো এআই ফিচার এবং একটি সত্যিকার ভার্চ্যুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টের সব সুবিধার পাশাপাশি এই কম্পিউটার সিরিজে রয়েছে বেশ কিছু বিশেষ ফিচার। এর মধ্যে অন্যতম হলো রিকল (Recall)। এই ফিচার অনেকটা টাইম মেশিনে করে অতীতে ফিরে যাওয়ার মতো।
মাইক্রোসফটও এ ধরনের এনপিইউ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ফিচার গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে গত মাসেই কোপাইলট+পিসি (Copilot+PC) সিরিজ বাজারে এনেছে। তাদের নতুন সার্ফেস ও সার্ফেস প্রো ল্যাপটপের পাশাপাশি, আসুস, এইচপি, ডেল, লেনোভো, এসারসহ প্রায় সব কম্পিউটার প্রস্তুতকারী কোম্পানি তাদের নিজস্ব কোপাইলট+পিসি বাজারে আনছে এ বছর।
গতানুগতিক টেক্সট ফিল, টেক্সট-টু-ইমেজ, কনটেন্ট এডিটিংয়ের মতো এআই ফিচার এবং একটি সত্যিকার ভার্চ্যুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টের সব সুবিধার পাশাপাশি এই কম্পিউটার সিরিজে রয়েছে বেশ কিছু বিশেষ ফিচার। এর মধ্যে অন্যতম হলো রিকল (Recall)। এই ফিচার অনেকটা টাইম মেশিনে করে অতীতে ফিরে যাওয়ার মতো। ধরুন, আপনি কোপাইলট+পিসিতে নতুন একটি কাজ করছেন। কাজের এক পর্যায়ে হয়তো ভুলে গেলেন যে আপনি এ পর্যন্ত কীভাবে এলেন। কোপাইলট+পিসির রিকল ফিচার ব্যবহার করে আপনি কম্পিউটারে কী কী কাজ করেছেন, কোথায় কার্সর ঘুরিয়েছেন, কোথায় কোন বাটন ক্লিক করেছেন—তার সবকিছুই একটা ভিডিও রেকর্ডিংয়ের মতো করে দেখতে পারবেন। যেমনটা বললাম, অনেকটা অতীতে গিয়ে নিজেকে কাজ করতে দেখার মতো।
এ ছাড়া এই কম্পিউটারগুলোতে অ্যাডাভান্সড সার্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যার মাধ্যমে আপনি নিজের কম্পিউটারে যেকোনো ফাইল, ফাইলের ভেতরের কনটেন্ট, এমনকি ব্রাউজ করা কনটেন্ট থেকেও সার্চ করতে পারবেন।
ধরুন, আপনি একটা ওয়ার্ড ডকুমেন্টে একটা বইয়ের নাম লিখেছেন কয়েক মাস আগে। কিন্তু ঠিক কোন ফাইলে সেটা আছে, তা খুঁজে পাচ্ছেন না। আপনি এই অ্যাডভান্সড সার্চ ফিচার ব্যবহার করে ফোল্ডারগুলোতে থাকা ফাইলের পাশাপাশি ফাইলের ভেতরেও খুঁজতে পারবেন। বইটির নাম লিখলেই সেটা কোন ফাইলে আছে, তা বের করে দেবে। শুধু ফাইলের ভেতরেই নয়, কম্পিউটারে থাকা ছবি-ভিডিও কোন কোন ওয়েবসাইটে কী কী পড়েছেন, সেসব আর্টিকেল থেকেও সার্চ করতে পারবেন এই ফিচার ব্যবহার করে। আপনার পিসিতে থাকা কয়েক হাজার ছবির মধ্যে থেকে আপনার বিড়ালের টুপি পরা একটি নির্দিষ্ট ছবি খুঁজতে চান? ছবিটি বর্ণনা করে সার্চ করলে একমুহূর্তেই পাওয়া যাবে তা। কিছুদিন আগে কম্পিউটারের ব্রাউজারে একটা জার্নালে কৌতূহলোদ্দীপক কিছু পড়েছিলেন, কিন্তু মনে নেই ঠিক কোথায়? বিষয়বস্তু বর্ণনা করে সার্চ করলে সেটাও খুঁজে দেবে কোপাইলট। এ ছাড়া এনপিইউ-সংবলিত দ্রুতগতির প্রসেসরের কর্মক্ষমতার কারণে প্রায় ৪০টি ভাষায় তাৎক্ষণিক ট্রান্সলেশন ও ট্রান্সক্রিপশনের সুবিধা পাবেন এই কম্পিউটারে। ধরুন, আপনি একটি স্প্যানিশ কোম্পানির সঙ্গে কাজ করেন। কোম্পানির কোনো মিটিংয়ে ভিডিও কনফারেন্সে যদি কেউ হঠাৎ ইংরেজির বদলে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন, তাহলে আপনার কম্পিউটারের এআই তা বলার সঙ্গে সঙ্গেই আপনার পছন্দের ভাষায় অনুবাদ করে সাবটাইটেলের মতো স্ক্রিনে দেখিয়ে দেবে।
আপনি এই অ্যাডভান্সড সার্চ ফিচার ব্যবহার করে ফোল্ডারগুলোতে থাকা ফাইলের পাশাপাশি ফাইলের ভেতরেও খুঁজতে পারবেন। বইটির নাম লিখলেই সেটা কোন ফাইলে আছে, তা বের করে দেবে। শুধু ফাইলের ভেতরেই নয়, কম্পিউটারে থাকা ছবি-ভিডিও কোন কোন ওয়েবসাইটে কী কী পড়েছেন, সেসব আর্টিকেল থেকেও সার্চ করতে পারবেন এই ফিচার ব্যবহার করে।
এগুলো ছাড়াও আজকাল যেসব এআই টুলস আমরা ব্যবহার করি, তার প্রায় সব সুবিধা থাকবে এই কম্পিউটারগুলোতে। এর অনেকগুলোই আবার মিলবে কোনো ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াই। কেননা সেই এআই প্রসেসিং হবে কম্পিউটারের ভেতরেই।
এআই টুলস ডেভেলপমেন্টেও বেশ কাজে আসবে এ ধরনের কম্পিউটার। যেহেতু এআই পিসিগুলো প্রসেসরের ভেতরেই নিজস্ব এনপিইউ ব্যবহার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর কাজ করতে পারে, ডেভেলপাররা তাঁদের নেটিভ বা নিজস্ব এনভায়রনমেন্টেই এলএলএম মডেল রান করতে পারবেন। অ্যাডভান্সড ডেভেলপমেন্ট থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজে দ্রুততা ও সহজসাধ্যতা আনবে নতুন এই এআই কম্পিউটারগুলো।
সফটওয়্যার, প্রোগ্রাম ও ফোনের পর কম্পিউটারেও এই বিল্ট-ইন এআই ইন্ট্রিগ্রেশনের মাধ্যমে এখন আমরা সত্যিকার অর্থেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে প্রবেশ করে ফেলেছি।