একটা বিপ্লব আসছে।
বিজ্ঞান জগৎকে দুটি বম্বশেল নাড়া দিয়েছিল ২০১৯ এবং ২০২০ সালে। এ সময় দুটি দল ঘোষণা দিয়েছিল, তারা কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি বা কোয়ান্টাম শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। আসলে এটা এমন এক কল্পিত বিন্দু, যেখানে কোয়ান্টাম কম্পিউটার নামে একেবারে নতুন ধরনের কম্পিউটার নির্দিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে যেকোনো সাধারণ ডিজিটাল সুপারকম্পিউটারকে সন্দেহাতীতভাবে ছাড়িয়ে যাবে। এই আগমনের ঘোষণা সূচনা করেছে এক আকস্মিক অস্থিরতার। সেটাই বদলে দিতে পারে গোটা কম্পিউটিংয়ের চেনা দৃশ্যপট। এমনকি উল্টে দিতে পারে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি দিকও।
প্রথমত গুগল ঘোষণা দিয়েছে, তাদের সিকামোর কোয়ান্টাম কম্পিউটার একটা গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে পারে মাত্র ২০০ সেকেন্ডে। একই গাণিতিক সমস্যাটি বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির সুপারকম্পিউটারের মাধ্যমে সমাধান করতে লাগবে প্রায় ১০ হাজার বছর। এমআইটির টেকনোলজি রিভিউয়ের রিপোর্ট অনুসারে, এ ঘটনাকে বড় এক বেকথ্রু হিসেবে অভিহিত করছে গুগল। একে স্পুটনিক বা রাইট ভাইদের আকাশে প্রথম বিমান উড়ানোর ঘটনার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে ওই রিপোর্টে। সেটা হবে ‘যন্ত্রের নতুন এক যুগের দ্বারপ্রান্ত, যার কাছে আজকের সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারও মনে হবে মামুলি অ্যাবাকাসের মতো।’
এরপর চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সসের কোয়ান্টাম ইনোভেশন ইনস্টিটিউট এগিয়ে গেছে আরেকটু সামনে। তারা দাবি করে বসল, সাধারণ সুপারকম্পিউটারের তুলনায় তাদের কোয়ান্টাম কম্পিউটার ১০০ ট্রিলিয়ন গুণ বেশি দ্রুতগতির। [এক ট্রিলিয়ন= ১০,০০০,০০০,০০০,০০০]
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের এরকম উল্কার মতো উত্থান দেখে আইবিএমের ভাইস প্রেসিডেন্ট বব সুটোর মন্তব্য করেছেন, ‘আমার ধারণা, আমাদের শতাব্দীতে এটাই হতে যাচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কম্পিউটিং প্রযুক্তি।’
কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে বলা হয় আলটিমেট বা ‘চূড়ান্ত কম্পিউটার’। কারণ এটাই হবে গোটা বিশ্বের জন্য গভীর তাৎপর্যসহ প্রযুক্তিতে একটা চূড়ান্ত লাফ। অতিক্ষুদ্র ট্রানজিস্টরে গণনার বদলে এই কম্পিউটার গণনা করবে সম্ভাব্য সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম বস্তুতে। অর্থাৎ পরমাণুর ওপর। কাজেই আমাদের সেরা সুপারকম্পিউটারের শক্তিকেও ছাড়িয়ে যাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এই যন্ত্র হয়তো অর্থনীতি, সমাজ ও আমাদের জীবনযাত্রায় সূচনা করবে পুরোপুরি নতুন যুগের।
কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিছক অন্য আরেকটি শক্তিশালী কম্পিউটার নয়। তার চেয়েও বেশি কিছু। এগুলো নতুন ধরনের কম্পিউটার। এ যন্ত্র এমন সব সমস্যার মোকাবিলা করতে পারে, যা ডিজিটাল কম্পিউটারের পক্ষে কখনই সমাধান সম্ভব নয়। এমনকি অসীম সময় দিলেও ডিজিটাল কম্পিউটারের পক্ষে সেসব সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। যেমন পরমাণুগুলো একত্রিত হয়ে কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক বিক্রিয়া তৈরি করে—বিশেষ করে যে বিক্রিয়াগুলো জীবনকে সম্ভব করে তোলে—সেসব ডিজিটাল কম্পিউটার কখনই নিখুঁতভাবে গণনা করতে পারবে না। ডিজিটাল কম্পিউটার গণনা করতে পারে শুধু ডিজিটাল টেপে। সেখানে অনেকগুলো ০ এবং ১-এর সিরিজ থাকে। কোনো অণুর অনেক গভীরে নৃত্যরত ইলেকট্রনের সূক্ষ্ণ তরঙ্গগুলোর বর্ণনা করার ক্ষেত্রে এ কম্পিউটার একেবারেই স্থুল। যেমন কোনো গোলকধাঁধায় একটা মাউসের অনুসরণ করা পথগুলো ক্লান্তিকরভাবে গণনার সময় ডিজিটাল কম্পিউটারকে সম্ভাব্য সবগুলো পথ একটার পর একটা বিশ্লেষণ করতে হয়। কাজটা এ যন্ত্রের বেদনাদায়করকম জটিল। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভাব্য সবগুলো পথ একই সময়ে বিশ্লেষণ করতে পারে। বলা যায়, কাজটা করে বিদ্যুৎচমকের মতো গতিতে।
ফলে প্রতিযোগী কম্পিউটার জায়ান্টদের মধ্যে এখন তীব্র প্রতিদ্বন্ধিতা বেড়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির জন্য এখন দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করেছে এসব জায়ান্টরা। ২০২১ সালে নিজেদের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কথা ঘোষণা করেছে আইবিএম। নাম ঈগল। আগের সবগুলো মডেলের চেয়ে বেশি কম্পিউটিং শক্তি নিয়ে এটিই এখন নেতৃত্বে রয়েছে।
কিন্তু এ রেকর্ডগুলো আসলে খাবার পাইয়ের মচমচে খোসার মতো। এগুলো আসলে তৈরিই করা হয় ভাঙার জন্য।
চলমান এ বিপ্লবের গভীর প্রভাবে প্রেক্ষিতে, বিশ্বের বেশকিছু নেতৃত্বস্থানীয় কর্পোরেশন এ প্রযুক্তির পেছনে যে প্রচুর বিনিয়োগ করবে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। গুগল, মাইক্রোসফট, ইন্টেল, আইবিএম, রিগেটি এবং হানিওয়েল—সবাই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রোটোটাইপ তৈরি করছে। সিলিকন ভ্যালির নেতৃত্বস্থানীয়রা বুঝতে পেরেছে যে তাদেরও এ বিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, নয়ত স্রেফ পড়ে থাকতে হবে ধুলোর মধ্যে।
আইবিএম, হানিওয়েল ও রিগেটি কম্পিউটিং তাদের প্রথম প্রজন্মের কোয়ান্টাম কম্পিউটার ইন্টারনেটে রেখেছে। কৌতুহলী জনসাধারণের ক্ষুধা মেটাতে। যাতে প্রথমবারের মতো সরাসরি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের অভিজ্ঞতা নিতে পারে লোকজন। ইন্টারনেটে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যে কেউ এই নতুন কোয়ান্টাম বিপ্লবের অভিজ্ঞতা পেতে পারে। যেমন ‘আইবিএম কিউ এক্সপেরিয়েন্স’ চালু হয়েছিল ২০১৬ সালে। এতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিনামূল্যে ১৫টি কোয়ান্টাম কম্পিউটার জনসাধারণের জন্য সহজলভ্য করেছিল তারা। ব্যবহারকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিল স্যামসাং এবং জেপিমরগান চেজ। এরই মধ্যে ছিল স্কুলশিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অধ্যাপক পর্যন্ত। প্রতিমাসে সেগুলো ব্যবহার করছে প্রায় ২০০০ মানুষ।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিটেরও এই প্রযুক্তিতে গভীর আগ্রহ আছে। আয়নকিউ প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কোম্পানি, যারা সর্বসাধারণের কাছে গিয়েছে। এভাবে তাদের আইপিও-তে ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে ২০২১ সালে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হল, প্রতিদ্বন্ধীতা এত তীব্র যে নতুন স্টার্ট-আপ সাইকোয়ান্টাম বাজারে কোনো বাণিজ্যিক প্রোটোটাইপ ছাড়েনি। কিংবা আগের কোনো পণ্যের ট্র্যাক রেকর্ড নেই। তবু হুট করে ফুলে ফেপে ওয়াল স্ট্রিটে ৩.১ বিলিয়ন মূল্য মানে দাঁড়িয়েছে এই কোম্পানি। প্রায় রাতারাতি ৬৬৫ মিলিয়ন তহবিল হস্তগত করার ক্ষমতাও আছে তাদের। বাণিজ্য বিশ্লেষকেরা লিখেছেন, নতুন কোনো কোম্পানি স্রেফ ধারণাগত উত্তেজনা ও চাঞ্চল্যকর শিরোনামের জোয়ারে চেপে এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে—এমন ঘটনা তাদের কাছে বিরল।
পরামর্শক ও অ্যাকাউন্টিং ফার্ম ডেলয়েট হিসেব করে দেখেছে, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বাজার ২০২০-এর দশকে কয়েক শ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছা উচিত। আর কয়েক বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে ২০৩০-এর দশকে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার কখন বাণিজ্যিক বাজারে ঢুকবে এবং অর্থনীতির গোটা দৃশ্যপট পাল্টে দেবে, তা এখনও কেউই জানে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অভূতপূর্ব গতির সঙ্গে মেলাতে সবসময়ই ভবিষ্যদ্বাণীর সংশোধন করা হচ্ছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উল্কার মতো উত্থানের কথা বলতে গিয়ে জাপাটা কম্পিউটিংয়ের সিইও ক্রিস্টোফার স্যাভয় বলেছেন, ‘এটা এখন আর “যদি”র মতো কোনো বিষয় নয়, বরং “কখন’’।’
এমনকি নতুন এই কোয়ান্টাম প্রযুক্তির গতি সঞ্চারে সহায়তা করতে ব্যাকুল মার্কিন কংগ্রেস। তারাও বুঝতে পেরেছে, কোয়ান্টাম কম্পিউটারে গবেষণার জন্য এরই মধ্যে উদারভাবে অর্থায়ন করছে অন্য দেশগুলোও। তাই নতুন গবেষণায় স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে সহায়তায় অর্থের যোগান দিতে ২০১৮-এর ডিসেম্বরে ন্যাশনাল কোয়ান্টাম ইনিশিয়েটিভ অ্যাক্ট পাস করেছে মার্কিন কংগ্রেস। এ কংগ্রেস দুই থেকে পাঁচটি নতুন ন্যাশনাল কোয়ান্টাম ইনফরমেশন সায়েন্স রিসার্চ সেন্টার গঠনের নির্দেশ দিয়েছে। এতে তহবিল দেওয়া হবে বছরে ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
শিল্প বিশ্লেষকেরা ট্রিলিয়ন ডলারের জুয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এই প্রযুক্তিকে। এত বেশি প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে কোনো গ্যারান্টি নেই।
কোয়ান্টাম প্রযুক্তিতে ২০২১ সালে ৬২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয় মার্কিন সরকার। এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি। এ প্রজেক্টে আরও ৩৪০ মার্কিন ডলারের যোগান দিচ্ছে মাইক্রোসফট, আইবিএম এবং লকহিড মার্টিনের মতো জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
এ প্রযুক্তিকে গতিশীল করতে শুধু যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রই সরকারী তহবিল ব্যবহার করছে, তা নয়, বরং এখন ন্যাশনাল কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেন্টার নির্মাণ করছে যুক্তরাজ্য সরকারও। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে এটি। কেন্দ্রটি বানানো হচ্ছে অক্সফোর্ডশায়ারের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফ্যাটিলিটি কাউন্সিলের হারওয়েল ল্যাবে। নিজ দেশের সরকারের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ ত্রিশটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুক্তরাজ্যে।
শিল্প বিশ্লেষকেরা ট্রিলিয়ন ডলারের জুয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এই প্রযুক্তিকে। এত বেশি প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে কোনো গ্যারান্টি নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গুগল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চমকপ্রদ প্রযুক্তিগত সাফল্য রয়েছে সত্যি, কিন্তু বাস্তব বিশ্বের সমস্যাগুলো সমাধান করার মতো কার্যকর কোয়ান্টাম কম্পিউটার হাতে আসা এখনও অনেক দিন বাকি। সে জন্য পাহাড়সমান কঠোর পরিশ্রম রয়েছে আমাদের সামনে। এমনকি কজন সমালোচক দাবি করেছেন, এটা বুনো হাঁসের পেছনে তাড়া করার চেষ্টা। তাঁদের কণ্ঠে এমন হতাশা থাকা সত্ত্বেও কম্পিউটার কোম্পানিগুলো বুঝতে পারছে যে দরজার পা রাখলে, তাদের সামনে সেটা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। কাজেই লক্ষ্যের দিকে তাদের এগিয়ে যেতেই হবে।
ম্যাককিন্সে নারে নামের এক কনসালটিং ফার্মের অংশীদার ইভান অসটোজিক বলেছেন, ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কারণে যেসব কোম্পানি পুরোপুরি ভেঙে পড়ার সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা রয়েছে, তাদের এখনই এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করা উচিত।’ রসায়ন, মেডিসিন, তেল ও গ্যাস, পরিবহন, লজিস্টিকস, ব্যাংকিং, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং সাইবার সিকিউরিটির মতো ক্ষেত্রগুলো বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য পরিপক্ক অবস্থায় রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘তাত্ত্বিকভাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সব সিআইও-এর (চিফ ইনফরমেশন অফিসার) জন্য প্রাসঙ্গিক। কারণ এটি বড় পরিসরের সমস্যা সমাধান ত্বরান্বিত করবে। এসব কোম্পানির কোয়ান্টাম ক্ষমতার মালিক হওয়া দরকার।’
কানাডার কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কোম্পানির ডি-ওয়েভ সিস্টেমের সাবেক সিইও ভার্ন ব্রাউনেল। তিনি মন্তব্য করছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, আমরা এমন সক্ষমতা সরবরাহ করতে পারব, যা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিংয়ের মাধ্যমে পাওয়া যাবে না।’
ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোও এই ক্ষেত্রের উন্নয়নগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তারাও বুঝতে পেরেছে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার হয়তো জটিল রাসায়নিক ও জৈবিক প্রক্রিয়াগুলো সিমুলেট করতে পারবে, যা ডিজিটাল কম্পিউটারের ধরাছোঁয়ার একদম বাইরে।
অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, আমরা এখন পুরোপুরি নতুন যুগে প্রবেশ করছি। একে তুলনা করা চলে ট্রানজিস্টর ও মাইক্রোচিপ তৈরির সময়ের শকওয়েভগুলোর সঙ্গে। যেসব কোম্পানির সঙ্গে কম্পিউটার তৈরির সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই, এমন কোম্পানিও (যেমন জায়ান্টাম ডেমলার, যারা মার্সিডিজ-বেঞ্জের মালিক) এখন নতুন এ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করেছে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছে, তাদের নিজস্ব শিল্পে নতুন উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করতে পারে কোয়ান্টাম কম্পিউটারই। অন্যদিকে তাদের প্রতিদ্বন্ধী বিএমডব্লিউয়ের নির্বাহী কর্মকর্তা জুলিয়াস মার্সিয়া লিখেছেন, ‘আমরা অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রিতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের রূপান্তরমূলক সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে উত্তেজিত। পাশাপাশি প্রকৌশল কর্মক্ষমতার সীমা প্রসারিত করতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ ভক্সওয়াগন এবং এয়ারবাসের মতো অন্যান্য বড় কোম্পানিগুলোও তাদের নিজস্ব কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিভাগ বসিয়েছে। সেটা তাদের ব্যবসায় কীভাবে বিপ্লব ঘটায়, তা অনুসন্ধান করতেই এই আয়োজন।
ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোও এই ক্ষেত্রের উন্নয়নগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তারাও বুঝতে পেরেছে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার হয়তো জটিল রাসায়নিক ও জৈবিক প্রক্রিয়াগুলো সিমুলেট করতে পারবে, যা ডিজিটাল কম্পিউটারের ধরাছোঁয়ার একদম বাইরে। লাখো ওষুধ পরীক্ষার জন্য নিবেদিত বিশাল ফ্যাসিলিটিজগুলো হয়তো একদিন ভার্চ্যুয়াল পরীক্ষাগারের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা যাবে। সেগুলো হয়তো সাইবারস্পেসে ওষুধ পরীক্ষা করে দেখবে। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, সম্ভবত একদিন রসায়নবিদদেরও হটিয়ে তার জায়গা দখল করবে এই প্রযুক্তি। কিন্তু ওষুধ আবিষ্কার নিয়ে ব্লগার ডেরেক লো বলেছেন, ‘যন্ত্র একদিন রসায়নবিদদের হটিয়ে দেবে, সেটা সত্য নয়। আসলে যেসব রসায়নবিদ এ যন্ত্র ব্যবহার করবে, তারাই যেসব রসায়নবিদ এই যন্ত্র ব্যবহার করবে না, তাদের হটিয়ে দেবে।’
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক যন্ত্র হলো সুইজারল্যান্ডের জেনেভার বাইরে বসানো লার্জ হ্যার্ডন কলাইডার বা এলএইচসি। এর মাধ্যমে প্রোটন কণাদের পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটানো হয়। তাতে ১৪ ট্রিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট তৈরি করে পুনর্নিমাণ করা হয় আদিম মহাবিশ্বের অবস্থাগুলো। পর্বতপ্রমাণ উপাত্তের জট খুলতে এই এলএইচসিও এখন ব্যবহার করছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। মাত্র এক সেকেন্ডে তারা প্রায় এক বিলিয়ন কণার সংঘর্ষের ফলে উৎপন্ন এক ট্রিলিয়ন বাইট তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারে। কাজেই আশা করা যায়, কোনো একদিন হয়তো মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্যও উন্মোচিত হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হাতে।