ল্যাপটপের বিকিরণ কি ক্ষতিকর

ল্যাপটপ বা কম্পিউটার থেকে বেরিয়ে আসে নানা ধরনের বিকিরণ। অনেকের ধারণা, এসব বিকিরণ আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর। আসলেই কি তাই?

ল্যাপটপ থেকে বেরিয়ে আসে নানা ধরনের বিকিরণ, প্রতীকী ছবি

এককালে একটা কম্পিউটারের জন্য জায়গা লাগত একটা প্রমাণ সাইজের ঘর। সেই বিশাল কম্পিউটার এখন জায়গা করে নিয়েছে আপনার-আমার ল্যাপের ওপর। মানে কোলের ওপর। সে কারণেই এর নাম ল্যাপটপ। আদরের পোষা প্রাণীর মতোই এখন তা ব্যবহারকারীদের প্রিয় বস্তু। তবু অনেকের ভয় কাটে না। কেউ কেউ সন্দেহ করেন, ল্যাপটপ থেকে কোনো ক্ষতিকর বিকিরণ নিঃসৃত হয়। সেগুলো হয়তো দেহের জন্য ক্ষতিকরও। বিষয়টি সত্যি কি না, চলুন খতিয়ে দেখা যাক।

ল্যাপটপ থেকে বিকিরণ নিঃসৃত হয়, তাতে কোনো ভুল নেই। তাও এক বা দুই ধরনের নয়, বেশ কয়েক ধরনের। প্রথমত ল্যাপটপের পর্দা থেকে যে দৃশ্যমান আলো বের হয়, সেটাও এক ধরনের বিকিরণ। একে বলে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বিকিরণ। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রাম বা বিচ্যুৎ-চুম্বকীয় বর্ণালি রেখায় এর কম্পাংকের পরিসর প্রায় ৪০০ থেকে ৮০০ টেরাহার্জ এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার [১ ন্যানোমিটার= ০.০০০০০০০০১ মিটার বা ১০-৯ মিটার। আরও সহজ করে বললে, ১ মিটারের এক বিলিয়ন বা একশ কোটি ভাগের এক ভাগ]। এই বিকিরণের কারণেই ল্যাপটপের ডিসপ্লে আমরা চোখে দেখতে পাই।

আবার ল্যাপটপ কিছুক্ষণ চালু রাখলে ব্যাটারিসহ নানা কারণে তার বিভিন্ন অংশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ কারণেও একধরনের বিকিরণ নিঃসৃত হয়। একে বলা হয় ইনফ্রারেড রেডিয়েশন। বাংলায় অবলোহিত বা অবলাল বিকিরণ। এর কম্পাংক ১০ থেকে ১০০ টেরাহার্জ। আর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ থেকে ৩ মাইক্রোমিটার। একে থার্মাল বা তাপীয় নিঃসরণ বলা হয়। এই বিকিরণ আমরা চোখে দেখতে পাই না।

ল্যাপটপ থেকে বিকিরণ নিঃসৃত হয়, তাতে কোনো ভুল নেই। তাও এক বা দুই ধরনের নয়, বেশ কয়েক ধরনের
আরও পড়ুন

আধুনিক সব ল্যাপটপেই এখন ওয়াইফাই অ্যান্টেনা থাকে। তারবিহীন যোগাযোগের জন্য এই অ্যান্টেনা ব্যবহার করা হয়। আপনার ল্যাপটপে যখন ওয়াইফাই চালু করা হয়, তখন নিঃসৃত হয় ৫ গিগাহার্জ থেকে ২.৪ গিগাহার্জ বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকিরণ। একে বলা হয় রেডিও ওয়েভ। এই তরঙ্গেই রেডিও সম্প্রচার করা হয়। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ মিলিমিটার থেকে ১২৪ মিলিমিটার।

শুধু ওয়াইফাই নয়, কর্ডলেস বা তারবিহীন মাউস ও কিবোর্ডও এখন বেশ জনপ্রিয়। এই দুটি পেরিফেরাল ডিভাইস ল্যাপটপের সঙ্গে সংযুক্ত করতে ব্যবহার করা হয় ব্লুটুথ প্রযুক্তি। সে জন্য ল্যাপটপের ব্লুটুথ অ্যান্টেনা থেকে নিঃসৃত হয় প্রায় ২.৪ গিগাহার্জ বিকিরণ। এটিও রেডিও ওয়েভ, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ১২৪ মিলিমিটার।

ল্যাপটপ থেকে মূলত ওপরের এই চার ধরনের বিকিরণ নিঃসৃত হয়। অবশ্য এর বাইরেও আরও কিছু বিকিরণ বেরিয়ে আসে এই যন্ত্র থেকে। সেগুলো নিম্ন কম্পাংকের বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকিরণ। ল্যাপটপের ভেতরে যেসব ইলেকট্রনিক সার্কিট থাকে, সেগুলো থেকে লিক হয়ে বেরিয়ে আসে এসব রেডিও তরঙ্গ। আবার কম্পিউটার বা ল্যাপটপের কিছু যন্ত্রাংশে পারমাণবিক আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়। সেগুলোর প্রাকৃতিকভাবে তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের কারণে নিঃসৃত হয় নিউক্লিয়ার বিকিরণ।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, ল্যাপটপ থেকে এসব বিকিরণের মধ্যে কোনটা ক্ষতিকর, আর কোনটা ক্ষতিকর নয়?

২.

দেখতেই পাচ্ছেন, আপনার ল্যাপটপ থেকে বিভিন্ন ধরনের বিকিরণ বের হয়। কিন্তু এসব বিকিরণ এত কম কম্পাংক (ফ্রিকোয়েন্সি) ও কম তীব্রতার যে তা মানবদেহের পক্ষে তেমন ক্ষতিকর নয়। আবার ল্যাপটপ থেকে যেসব বিকিরণ বের হয়, তা অনন্যও নয়। মানে সেগুলো যে শুধু ল্যাপটপ থেকেই নিঃসৃত হয়, তা নয়; বরং দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে এদের মুখোমুখি হচ্ছি।

শুরুতেই ল্যাপটপের পর্দার দৃশ্যমান আলোর কথা বলা যাক। যেসব বস্তু দৃশ্যমান আলো নিঃসরণ করে, স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো বিকিরণ নিঃসরণ করে। কারণ আলো নিজেই একধরনের বিকিরণ। মানে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বিকিরণ। এর মধ্যে রয়েছে মোমবাতি, আগুন, লাইট বাল্ব, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের পর্দা।

এবার আসি ইনফ্রারেড রেডিয়েশনের ব্যাপারে। সব বস্তুই তাপীয় বিকিরণ নিঃসরণ করে। পরমাণু দিয়ে গঠিত যেকোনো বস্তু এবং যার তাপমাত্রা আছে, তার জন্যই কথাটা সত্য। তাত্ত্বিকভাবে কোনো বস্তুর তাপমাত্রা যদি পরম শূন্য (মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) হয়, তাহলে তা থেকে কোনো তাপীয় বিকিরণ নিঃসৃত হবে না। কিন্তু বাস্তবে কোনো বস্তুকে একদম পরম শূন্য তাপমাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। কাজেই সব বস্তু থেকে এ ধরনের বিকিরণ নিঃসৃত হবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যেসব বস্তুর তাপমাত্রা মানুষের জন্য আরামদায়ক, সেসব বস্তু যে বিকিরণ নিঃসরণ করে, তার সিংহভাগই ইনফ্রারেড। তার চেয়ে বেশি উত্তপ্ত বস্তু থেকে দৃশ্যমান আলো ছাড়াও আল্ট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মি নিঃসৃত হতে পারে। যেমন ইনক্যানডেসেন্ট লাইট বাল্ব থেকে এ ধরনের দৃশ্যমান আলো ও ইনফ্রারেড আলো নিঃসৃত হয়। আবার আপনার দেহ থেকেও সবসময় ইনফ্রারেড আলো বেরিয়ে আসছে। বিশেষ ধরনের ইনফ্রারেড ডিটেক্টরে তা শনাক্ত করা যায়। আবার আপনার বাসার টিভি বা এসির রিমোটও কাজ করে এই আলো ব্যবহার করে। (আপনার মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়ে তা শনাক্ত করতে পারবেন।) কাজেই ল্যাপটপের ইনফ্রারেড আলো নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

প্রায় সব ধরনের ইলেকট্রনিক সার্কিট থেকে সামান্য পরিমাণ নিম্ন কম্পাংকের রেডিও তরঙ্গ লিক হয়। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আবার বাঁকানো তারের ভেতর দিয়ে বৈদ্যুতিক প্রবাহ যাওয়ার সময়ও অল্প পরিমাণ নিঃসৃত হয় বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকিরণ

যেসব যন্ত্রপাতি বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে যোগাযোগ করে বা অন্য যন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত হয়, সেগুলোতে একটা অ্যান্টেনা, লেজার বা রেডিও তরঙ্গ নিঃসরণকারী বাল্ব, ইনফ্রারেড বা দৃশ্যমান বিকিরণ থাকে। এর মধ্যে রয়েছে ওয়াইফাই ও ব্লুটুথ ডিভাইস, ওয়াকিটকি, রেডিও, হ্যাম রেডিও, মোবাইল বা স্মার্ট ফোন, টেলিভিশনের রিমোট এবং রিমোট নিয়ন্ত্রিত খেলনা। কিন্তু এই তরঙ্গও আমাদের জন্য ক্ষতিকর নয়।

প্রায় সব ধরনের ইলেকট্রনিক সার্কিট থেকে সামান্য পরিমাণ নিম্ন কম্পাংকের রেডিও তরঙ্গ লিক হয়। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আবার বাঁকানো তারের ভেতর দিয়ে বৈদ্যুতিক প্রবাহ যাওয়ার সময়ও অল্প পরিমাণ নিঃসৃত হয় বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকিরণ। এগুলোও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়।

বেশির ভাগ বস্তুতে খুবই সামান্য পরিমাণ হলেও প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয় পরমাণু থাকে। তাতে এসব অস্থিতিশীল আইসোটোপের তেজস্ক্রিয় ক্ষয় প্রক্রিয়ার কারণে খুব অল্প হলেও নিউক্লিয়ার রেডিয়েশন নিঃসৃত হয়। কিন্তু এতেও দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ বেশির ভাগ বস্তু থেকে যে নিউক্লিয়ার রেডিয়েশন বা বিকিরণ নিঃসৃত হয়, তা সাধারণত খুবই দুর্বল থাকে। আবার সেগুলো ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের অংশ। আপনার দেহেও এমন পরমাণু আছে, যেগুলো তেজস্ক্রিয়। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, এই মুহূর্তে সেগুলো থেকেও পারমাণবিক বিকিরণ নিঃসৃত হচ্ছে। আবার অনেকের প্রিয় খাবার কলা থেকেও তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নিঃসৃত হয়। কিন্তু আমাদের দেহের ক্ষতি করার জন্য তা যথেষ্ট মাত্রার নয়। মানবদেহে তেজস্ক্রিয় পরমাণুর বেশির ভাগই আসলে কার্বন ও পটাশিয়ামের অস্থিতিশীল আইসোটোপ। অন্যদিকে কলার তেজস্ক্রিয়তার উৎসও ওই পটাশিয়াম। (ভয়ের কিছু নেই, একটা কলায় তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ এক সিভার্টের দশ লাখ ভাগের এক ভাগ বা ০.০০০১ মিলিসিভার্ট। বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন প্রদীপ দেবের লেখা ট্রাইবোলজি ও কলার খোসা)।) তাই এই বিকিরণ নিয়েও, নো টেনশন!

৩.

তাহলে সিদ্ধান্ত আসা যায়, ল্যাপটপ থেকে বের হওয়া বিকিরণগুলো মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, তাহলে মানুষের জন্য ক্ষতিকর বিকিরণ কোনগুলো? সেটার সহজ উত্তর হলো, উচ্চশক্তির বিকিরণ। বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে চাইলে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বর্ণালি রেখাটায় ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। ছবির বাম পাশ থেকে দেখলে প্রথমেই পড়বে রেডিও ওয়েভ বা বেতার তরঙ্গ। এরপর ক্রমান্বয়ে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত, দৃশ্যমান আলো, অতিবেগুনি, এক্স-রে এবং সবশেষে গামারশ্মি।

বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বর্ণালি রেখা
আরও পড়ুন

যেকোনো বিকিরণ হয় উচ্চশক্তির হয়, না হলে নিম্নশক্তির হয়। উচ্চশক্তির হওয়ার কারণ ওই বিকিরণের প্রতিটি কণার শক্তি অনেক বেশি। আর নিম্নশক্তির হওয়ার কারণ প্রতিটি কণার শক্তি কম বা দুর্বল। বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বর্ণালি রেখায় উচ্চশক্তির বিকিরণগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিবেগুনি রশ্মি, এক্স-রে ও গামারশ্মি। অর্থাৎ দৃশ্যমান আলোর ডানদিকের অংশের বিকিরণগুলো উচ্চশক্তির। এ ছাড়াও রয়েছে নিউক্লিয়ার বিকিরণ (যেমন আলফা, বিটা রশ্মি, নিউট্রন ও প্রোটন বিকিরণ)। এসব বিকিরণের প্রতিটি কণার শক্তি এত বেশি হয় যে তা বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বন্ধন ভেঙে ফেলতে পারে। তাতে মিউটেশন, ক্যান্সার ও বিকিরণজনিত বিভিন্ন অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। আবার উচ্চশক্তির কণারা যেকোনো অণুও ভেঙে ফেলতে বা ধ্বংস করে ফেলতে পারে। কিন্তু তবু মানবদেহে ক্ষতি করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বিকিরণের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু সাধারণত সে ধরনের ঘটনা ঘটে না। সে কারণে পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ধরনের উচ্চশক্তির কণার (ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন) উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও আমরা সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি না।

বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বর্ণালি রেখার বাঁদিক থেকে দৃশ্যমান আলো পর্যন্ত বিকিরণগুলো কম শক্তির। কিন্তু সাবধান, কম শক্তির বিকিরণও অনেক সময় ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। যদি অল্প জায়গায় গুচ্ছ বা বিম আকারে কম শক্তির কণারা জড়ো হয়, তাহলে সেটাও উচ্চশক্তির বিকিরণে পরিণত হতে পারে। যেমন উজ্জ্বল লাইট বাল্ব ও উচ্চশক্তির লেজার। এ ধরনের বিকিরণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। কাজেই সাবধান।

সূত্র: জ্যাপড/ বব বারম্যান

টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটি ওয়েবসাইট

উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন