সোশ্যাল মিডিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপ্লব

প্রতিবছর ফেসবুকের মাতৃপ্রতিষ্ঠান মেটা নতুন পণ্য ও প্রকল্পগুলোর ঘোষণা দেয় ‘মেটা কানেক্ট’ নামের এক ইভেন্টে। এ বছরের অনুষ্ঠানে মেটা জানিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আসছে তারা। আপনার ভার্চ্যুয়াল জীবনে এই এআই কী প্রভাব ফেলবে?

ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য মার্ক জাকারবার্গের প্রতিষ্ঠান ‘মেটা’ দারুণ বিখ্যাত। এটা ফেসবুকের মাতৃপ্রতিষ্ঠান। তবে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গণ্ডি পেরিয়ে এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এলএলএএমএ (LlaMA), এনএলএলবি (NLLB), সিমলেসএম৪টি (SeamlessM4T), ভয়েসবক্স (Voicebox) ও ডাইনোর ((DINO) মতো এআই প্রকল্পে সফলতাও এসেছে অনেক। এই অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে মেটা তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মেসেজিং প্ল্যাটফর্মগুলোয় আনছে বেশ কিছু এআইনির্ভর ফিচার।

প্রতিবছর মেটা তাদের নতুন পণ্য বা প্রকল্পগুলো সম্পর্কে ডেভেলপার কমিউনিটি ও গোটা বিশ্বকে জানাতে মেটা কানেক্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আগের বছরগুলোতে কানেক্ট ইভেন্টে মেটার ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি গিয়ার ‘কোয়েস্ট’ প্রাধান্য পেয়েছিল। তবে এ বছরের কানেক্টে তাদের নতুন ‘কোয়েস্ট–৩’ মিক্সড রিয়েলিটি ডিভাইসের পাশাপাশি মার্ক জাকারবার্গের দল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এসব প্রয়োগ নিয়েও আলোচনা করেছে।

চ্যাটজিপিটি ও গুগল বার্ডের মতো মেটাও তাদের নিজস্ব এআই চ্যাটবট নিয়ে আসছে। নাম দিয়েছে ‘মেটা এআই’। তবে চ্যাটজিপিটি বা বার্ডের মতো মেটা এআই ব্যবহার করতে যেতে হবে না ভিন্ন কোনো অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে। মেটার যেসব অ্যাপ আমরা ব্যবহার করে অভ্যস্ত, সেগুলো থেকেই মেটা এআইয়ের সঙ্গে কথা বলা যাবে।

কোয়েস্ট-৩ চোখে মার্ক জাকারবার্গ
ছবি: সংগৃহীত

ফেসবুকের মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম ডিরেক্ট মেসেজ থেকে সরাসরি চ্যাট করা যাবে মেটা এআইয়ের সঙ্গে। চ্যাটজিপিটির মতোই জিজ্ঞাসা করা যাবে যেকোনো প্রশ্ন। তবে চ্যাটজিপিটির মতো এর ডেটাবেজ কোনো নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে না। ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকায় হালনাগাদ তথ্য দিতে পারবে এই এআই। এটা সম্ভব হয়েছে মেটার সঙ্গে মাইক্রোসফটের সার্চ ইঞ্জিন বিংয়ের ইন্টিগ্রেশন বা সম্মিলনের জন্য। মেটা এআইকে যেকোনো প্রশ্ন করা হলে প্রয়োজনে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিং সার্চের মাধ্যমে ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে উত্তর দিতে পারবে।

হায়দরাবাদি বিরিয়ানির রেসিপি জিজ্ঞাসা করলে সেই রেসিপি লিখে দেবে মেটা এআই। অথবা আপনার আশপাশে কোন রেস্টুরেন্টে ভালো হায়দরাবাদি বিরিয়ানি পাওয়া যাবে, জিজ্ঞাসা করলেই ইন্টারনেটে খুঁজে বলে দেবে রেস্তোরাঁগুলোর নাম। অর্থাৎ মেটা এআই চ্যাটজিপিটি ও স্মার্টফোনের অ্যাসিস্ট্যান্টের সংমিশ্রণ, অনেকটা গুগল বার্ডের মতো।

তবে গুগল বার্ডের সঙ্গে মেটা এআইয়ের একটা বড় তফাত আছে। বার্ড ব্যবহার করতে হলে বার্ডের ওয়েবপেজে (bard.google.com) গিয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে হয়। কিন্তু মেটা এআই মেটার যেকোনো মেসেজিং অ্যাপ থেকেই ব্যবহার করা যাবে। এ জন্য মেটা এআইকে আলাদা করে সার্চও করতে হবে না। যেকোনো চ্যাট থেকেই @Meta AI লিখে প্রশ্ন করা যাবে।

শুধু প্রশ্নের জবাবই নয়, ছবিও এঁকে দিতে পারবে মেটা এআই। ডাল-ই বা মিডজার্নির মতো ইমেজ জেনারেটিভ এআইদের টক্কর দিতে বাজারে মেটা তাদের নিজস্ব জেনারেটিভ এআই ইমু (Emu—Expressive Media Universe) নিয়ে এসেছে।

ধরুন, আপনি কোনো বন্ধুর সঙ্গে মেসেঞ্জারে ভারত বনাম বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে কথা বলছেন। কথা প্রসঙ্গে যদি ভারত বা বাংলাদেশের একাদশে কে কে আছেন জানতে চান, তাহলে মেসেঞ্জার থেকে বের হয়ে ব্রাউজার ওপেন করে, তাতে গুগল সার্চ করে দেখতে হয়। বন্ধুকে যদি সেই লাইনআপ দেখাতে চান, তবে সেই একাদশের স্ক্রিনশট নিয়ে আবার সেই মেসেজিং অ্যাপ ওপেন করে তাকে সেন্ড করতে হয়। কিন্তু মেটা এআইয়ের সাহায্যে এসব করা যাবে কেবল এক লাইন লিখেই। মেসেঞ্জারে বন্ধুর সঙ্গে চ্যাটের মাঝখানেই @Meta AI লিখে এরপর বাংলাদেশের একাদশ লাইনআপ জানতে চাইলে চ্যাটের মধ্যেই লিখে দেবে মেটা এআই। কোনো কিছু কপি করতে বা স্ক্রিনশট নিতে হবে না, এমনকি বের হতে হবে না মেসেঞ্জার থেকেও।

শুধু প্রশ্নের জবাবই নয়, ছবিও এঁকে দিতে পারবে মেটা এআই। ডাল-ই বা মিডজার্নির মতো ইমেজ জেনারেটিভ এআইদের টক্কর দিতে বাজারে মেটা তাদের নিজস্ব জেনারেটিভ এআই ইমু (Emu—Expressive Media Universe) নিয়ে এসেছে। মেটা এআইয়ের মতো ইমু ব্যবহার করতেও যেতে হবে না অন্য কোনো অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে। চ্যাটের মধ্যেই ‘@Meta AI/imagine’ লিখে তারপর কিছু একটা আঁকতে বললে মেটার এআই তা পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই বানিয়ে দেবে। মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ইনস্টাগ্রাম—সব প্ল্যাটফর্মেই ব্যবহার করা যাবে এই ইমু।

মেটার মেসেজিং প্ল্যাটফর্মগুলোর স্টিকারেও ব্যবহার করা যাবে ইমু। নিজের ইচ্ছেমতো যেকোনো স্টিকার বানানো ও ব্যবহার করা যাবে সরাসরি অ্যাপ থেকে। মেটা এআই ছাড়াও জাকারবার্গ ও তাঁর দল মেটা এআইয়ের কয়েকটি ভেরিয়েশন বা সংস্করণ নিয়ে কাজ করেছেন। এসব এআই সংস্করণ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব বা মানুষের মতো।

শিগগিরই এসব এআইকে নিজস্ব স্বর দেওয়া হবে। ফলে এআইগুলোর সঙ্গে কনভারসেশন আরও বেশি ন্যাচারাল ও ইন্টার‍অ্যাকটিভ হয়ে উঠবে।

রচনা বা স্ক্রিপ্ট লিখতে সাহায্য দরকার? ঠিক এই কাজের জন্যই রয়েছে ‘লিলি’ নামের এআই-টি। জিমে শারীরিক কসরত করতে ফিজিক্যাল ট্রেইনার দরকার? আছে ‘ভিক্টর’। রান্নায় সাহায্যের জন্য রাখা হয়েছে ‘ম্যাক্স’কে। কোনো নির্দিষ্ট কাজ নয়, কারও সঙ্গে আড্ডা দিতে চাচ্ছেন? সে জন্য ‘দ্য ফানি গাই’ চরিত্রে রয়েছে বিখ্যাত ইউটিউবার ‘মিস্টার বিস্ট’-এর আদলে তৈরি এক এআই ব্যক্তিত্ব। কোনো বিষয়ে উপদেশ চান? সে জন্য বড় বোনের ভূমিকায় আছে ‘ক্যান্ডল জেনার’সদৃশ এআই। এ রকম আরও ডজনখানেক ভিন্ন ভিন্ন এআই আসছে মেটার সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলোয়।

শিগগিরই এসব এআইকে নিজস্ব স্বর দেওয়া হবে। ফলে এআইগুলোর সঙ্গে কনভারসেশন আরও বেশি ন্যাচারাল ও ইন্টার‍অ্যাকটিভ হয়ে উঠবে।

এ রকম সুনির্দিষ্ট কাজভিত্তিক কিংবা ব্র্যান্ড বা ব্যক্তিত্বনির্ভর এআইয়ের সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়তে থাকবে। কারণ, এ রকম বিভিন্ন এআই ব্যক্তিত্ব তৈরির জন্য মেটা চালু করছে এআই স্টুডিও। এই টুল ব্যবহার করে বিভিন্ন কাজের জন্য বা নির্দিষ্ট কোনো ব্র্যান্ড বা ব্যক্তির আদলে তৈরি করা যাবে নিজস্ব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এআই।

এ ধরনের এআইগুলো শুধু টেক্সট বা ইমেজেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। ভবিষ্যতে এগুলো ভয়েস ইন্টারঅ্যাকটিভও হবে। কাজ করবে অ্যাসিস্ট্যান্ট বা কলিগের মতো।

এ বছরের মেটা কানেক্টে উন্মোচিত ‘রে-ব্যান মেটা স্মার্ট গ্লাসেস’-এ মেটা এআই ইতিমধ্যে ভার্চ্যুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টের মতো কাজ শুরু করেছে। নতুন এই স্মার্ট গ্লাসে ভয়েস কমান্ডেই কাজ করে মেটা এআই। এসিলরলুক্সোট্টিকা ও রে-ব্যানের সঙ্গে মেটার যৌথ প্রচেষ্টার ফল এই স্মার্ট গ্লাসে স্মার্টফোনের মতোই রয়েছে ক্যামেরা, স্পিকার ও মাইক্রোফোন।

ধরুন, একদিন মিরপুরের চিড়িয়াখানায় ঘুরতে গিয়েছেন। সেখানে নতুন ব্যাঘ্রশাবকটা দেখতে ঠিক আপনার বন্ধু তানজিমের পোষা বিড়ালের মতো। এখন ওটার ছবি তুলে বন্ধুকে পাঠাতে হলে প্রথমে আপনাকে পকেট থেকে ফোন বের করতে হবে। ফোনে ছবি তুলে সেই ছবি মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুকে খুঁজে পাঠাতে হবে।

আপনার বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোলা ছবিকে চাইলেই কাশ্মীরের পাহাড়ে তোলা ছবি বানিয়ে ফেলা যাবে। ব্যাকড্রপ অপশন ব্যবহার করে শুধু লিখে দিলেই ছবির সাবজেক্টের পেছনে থাকা বিল্ডিং সরিয়ে হিমালয়ের পর্বতমালা বসিয়ে দেবে এআই।

কিন্তু নতুন এই স্মার্ট গ্লাসে এআইয়ের মাধ্যমে পুরো কাজ সেরে ফেলা যাবে এক লাইনেই। শুধু মুখে বলতে হবে ‘হেই মেটা, টেক আ ফটো অ্যান্ড সেন্ড ইট টু তানজিম।’ এই ভয়েস কমান্ড শোনার সঙ্গে সঙ্গে মেটা এআই স্মার্ট গ্লাসের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে ফেলবে। আপনার বন্ধুটির সঙ্গে যে অ্যাপের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ করেন, সেই অ্যাপেই পাঠিয়ে দেবে ছবিটা। পকেট থেকে ফোন বের করারও প্রয়োজন হবে না।

ভয়েস কমান্ডের মাধ্যমে তোলা সেই ছবি সরাসরি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শেয়ার করা যাবে। সে জন্য ক্যাপশনও লিখে দিতে পারবে মেটা এআই।

কিছুদিনের মধ্যে মেটা এআইকে গ্লাসে থাকা ক্যামেরা দিয়ে দেখার অপশনও দেবে মেটা। ফ্রান্সের কোনো জাদুঘরে বিখ্যাত কোনো চিত্রকর্ম দেখছেন, কিন্তু তার নাম জানেন না। মেটা এআইকে বললে সঙ্গে সঙ্গে স্মার্ট গ্লাসের ক্যামেরা দিয়ে দেখে আপনাকে ছবিটির নাম বলে দেবে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।

চ্যাটবট, ইমেজ জেনারেটর ও অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি মেটার এআই ব্যবহৃত হবে সোশ্যাল মিডিয়ার ফটো এডিটিংয়েও। ইনস্টাগ্রামে ফটো এডিট অপশনে গেলে যেকোনো ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড, এমনকি ছবির মূল সাবজেক্টকেও পরিবর্তন করে ফেলা যাবে এআই ব্যবহার করে।

আপনার বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোলা ছবিকে চাইলেই কাশ্মীরের পাহাড়ে তোলা ছবি বানিয়ে ফেলা যাবে। ব্যাকড্রপ অপশন ব্যবহার করে শুধু লিখে দিলেই ছবির সাবজেক্টের পেছনে থাকা বিল্ডিং সরিয়ে হিমালয়ের পর্বতমালা বসিয়ে দেবে এআই। ব্যাকগ্রাউন্ড তো চেঞ্জ করা হলো, কিন্তু হিমালয়ের ঠান্ডায় এভাবে টি–শার্ট পরা ছবি কে বিশ্বাস করবে? এরও সমাধান আছে অ্যাপে। ইনস্টাগ্রামের রি-স্টাইল অপশন ব্যবহার করে টি–শার্টের জায়গায় শীতের সোয়েটার বসিয়ে দেওয়া যাবে গায়ে।

এসব এআই ফিচারগুলো শিগগিরই আসছে মেটার প্ল্যাটফর্মগুলোয়। তবে চ্যাটজিপিটি ও বার্ডের মতো এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাগুলো প্রথম দিকে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ব্যবহার করা যাবে। ধীরে ধীরে অন্য দেশগুলোতে এসব ফিচার সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে বিনা মূল্যে। এতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এসব জেনারেটিভ এআইয়ের সুফল আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে খুব দ্রুত।

লেখক: ব্যবস্থাপক, ডেফ্টাইল্ড

সূত্র: মেটা কানেক্ট ও মেটা এআই