ফোটনের অদ্ভুতুড়ে কাহিনি

মহাবিশ্বের গভীর অন্ধকার থেকে পকেটের ছোট্ট মোবাইল ফোন, যেখানেই বিজ্ঞানের একটু ছোঁয়া আছে, সেখানেই ফোটনের জয়জয়কার। ফোটনের চরিত্রটি কিন্তু বেশ অদ্ভুত। কখনো কণা, কখনো তরঙ্গ। দ্বিচারী এই কণাটিই যুগে যুগে মানুষের হাজার রকম জিজ্ঞাসার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনো উত্তর মিলেছে, কখনো নিজেকে জড়িয়েছে ধোঁয়াশার চাদরে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও সেই ধোঁয়াশা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। কেন এই ধোঁয়াশা, কেন আর সব কণিকার চেয়ে সে আলাদা, কেনই-বা একে নিয়ে এত আগ্রহ?

ফোটন! ফোটন! ডাকপাড়ি,

ফোটন মোদের কার বাড়ি?

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে এভাবে প্রশ্ন করলে তাঁরা হয়তো হেসে উড়িয়ে দেবেন, কিন্তু এই প্রশ্নটিরই উত্তর নিয়ে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা যে একদম শতভাগ একমত হয়েছেন, তা বলা যাবে না। ফোটনের ধারণার শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও এ নিয়ে বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের কৌতূহলের শেষ নেই।

এর কারণ হয়তোবা যেসব আধুনিক প্রযুক্তি আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করি, তার অনেকাংশই এই ফোটনের ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবার এই ফোটনকে কীভাবে গুনতে হবে, সেই নিয়মটা তো বের করে গেছেন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু। আবার এই ফোটনের ধারণার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, আলবার্ট আইনস্টাইন, পল ডিরাকের মতো বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীর নাম। সে জন্য ফোটন নিয়ে এ দেশের ছেলেমেয়েদের যে কৌতূহল থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

ফোটন কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ ভাষায় দিতে গেলে বলতে হবে, গ্রিক ভাষায় আলোকে বলা হয় ফোস (Phos)। সেটা থেকেই আমাদের চিরায়ত ফোটো শব্দের উত্পত্তি। আর সে জন্য আলোর কণাকেই আমরা বলি ফোটন। এটা না হয় গেল শুধু নাম নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া, কিন্তু আলো আসলে কী? আমরা তো জানি বস্তু মূলত কণা দিয়ে তৈরি। আলোর যদি কণা থাকে, তার মানে কি আলো একধরনের বস্তু? কিন্তু আলো তো ছড়ায় ঠিক ঢেউয়ের মতো। তাহলে তো এটা একটা তরঙ্গ। আর সেটা হলে এটা কিসের তরঙ্গ? এ রকম ধরনের সব যৌক্তিক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শতবর্ষের আগের বিজ্ঞানীদেরও হয়তো বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে। এখন আমরা জানি, আলো ফোটন নামের এক কণার সমাহার (Ensemble)। কিন্তু আলোর এই কণাটি আবার ঠিক বালুকণার মতো আচরণ করে না। আলোর এই দ্বিচারী আচরণের ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়েই বিজ্ঞানীরা বের করলেন কোয়ান্টাম মেকানিকস বা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা।

যদিও বিজ্ঞানচিন্তায় আলোর ইতিহাস নিয়ে অন্যরাও লিখছেন, তবু আলোচনার সম্পূর্ণতার স্বার্থে সামান্য কিছু ইতিহাস পুনরায় ঘাঁটা যাক। আলোর ধারণাটি একটি অত্যন্ত প্রাচীন ধারণা। বাইবেলের শুরুতেই আছে, ‘শুরুতেই ঈশ্বর স্বর্গ আর পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। এবং পৃথিবী গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। ঈশ্বর পানির দিকে মুখ ফেরালেন এবং বললেন, আলোকিত হও: অমনি আলোর জন্ম হলো।’ তবে আধুনিক কসমোলজি বা বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্বের কাঠামোর মধ্যে আমরা দেখি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুত্চুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়া তথা ফোটন কণার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এর মানে এই নয়, ফোটনের সংখ্যা একটি সংরক্ষিত রাশি, বরং ঠিক উল্টোটা। এটার ব্যাখ্যায় অবশ্য পরে আসছি।

ছবি ১: বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের বর্ণালি

আলো যে কণার সমন্বয়ে তৈরি, সেটা নিউটন ছাড়া আর কে প্রস্তাব করার সাহস রাখবেন? হাজার হলেও তত্কালীন পদার্থবিজ্ঞানের সমস্ত মৌলিক সূত্র তো এই মহাবিজ্ঞানীর হাত দিয়েই প্রণীত। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান তো কোনো ব্যক্তির নাম দিয়ে চলে না। বিশ্ব তার নিজস্ব নিয়মেই চলবে, সেখানে কোনো জোর-জবরদস্তি চলে না। থমাস ইয়ং, ফ্রেনেল আর অন্যান্য বিজ্ঞানীর নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আলো যে একটা তরঙ্গের মতো চলে, তা ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন দশকের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। কিন্তু ১৮৬০-এর দশকে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের হাতে আলোর বিজ্ঞান যেন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটা মহা ধাক্কা খেল। ম্যাক্সওয়েলের কাজটির গুরুত্ব কতখানি, তা বোঝানোর জন্য বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের এ কথাটাই যথেষ্ট—‘মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে, ধরা যাক আজ থেকে ১০ হাজার বছর পর—এটা সন্দেহাতীত যে উনিশতম শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুত্চুম্বকের সমীকরণগুলোর আবিষ্কার। একই দশকে সংঘটিত যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ তখন একটা আঞ্চলিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে।’ ফাইনম্যানের এ কথাটি যে মোটেও অত্যুক্তি নয়, সেটা উচ্চতর পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী নন, এমন কাউকে বোঝানো খুব সহজ কাজ হবে না। আদতে ম্যাক্সওয়েল আলো নিয়ে তাঁর সমীকরণ লেখেননি, তিনি বরং বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র আর চুম্বকক্ষেত্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের সমীকরণগুলোর সমন্বয় করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ঘটনা ঘটল পাকা কিউবিস্টের হাতে রুবিকস কিউব মেলানোর মতো, যে শুধু কিউবের ওপর আর নিচের তল মেলাতে গিয়ে ঠিক একই সঙ্গে বাকি চার দিক মিলিয়ে ফেলে। ম্যাক্সওয়েল এই কাজের মাধ্যমে একই সঙ্গে বিদ্যুৎ, চুম্বকত্ব, আলো, এক্স-রে, বেতার তরঙ্গ, গামা-রে, মাইক্রোওয়েভ—সবকিছুকে একই কলকব্জার অধীনে নিয়ে এলেন। এর মানে হলো, ফোটন শুধু আলোর কণা নয়, এটা বেতার তরঙ্গেরও কণা। আমাদের হাতের মুঠোর মোবাইল ফোনও ঝাঁকে ঝাঁকে ফোটন কণা তৈরি করে, পাশাপাশি ওই একই ধরনের ফোটন কণাও শনাক্ত করে। তবে আমরা চোখে দেখি না, তাই এটা বিশ্বাস করতে আমাদের প্রথমে একটু খটকা লাগতে পারে।

আলো যে কণার সমন্বয়ে তৈরি, সেটা নিউটন ছাড়া আর কে প্রস্তাব করার সাহস রাখবেন? হাজার হলেও তত্কালীন পদার্থবিজ্ঞানের সমস্ত মৌলিক সূত্র তো এই মহাবিজ্ঞানীর হাত দিয়েই প্রণীত। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান তো কোনো ব্যক্তির নাম দিয়ে চলে না

বিংশ শতাব্দীর একদম শুরুতেই কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক দেখতে পেলেন যে বিদ্যুত্চুম্বকীয় বিকিরণ ওই বস্তু কর্তৃক শুধু একটা নির্দিষ্ট মাত্রার গুণিতক আকারেই বিকিরিত বা শোষিত হয়। এটার উদাহরণ হতে পারে একটা ব্যাংকের বুথের মতো, যেখানে (ধরা যাক) শুধু ২০ টাকা , ৪০ টাকা, ৬০ টাকা ইত্যাদি জমা দেওয়া যায়। আর ওই একই সংখ্যার টাকা তোলা যায়। অন্যদিকে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ ব্যবহার করেও আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ার (ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট) ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না। এ ঘটনায় নির্দিষ্ট মানের দৈর্ঘ্যের চেয়েও বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ব্যবহার করলে কতগুলো ধাতু থেকে ইলেকট্রন নির্গত হচ্ছিল। আপাতদৃষ্টিতে এটা কোনো জটিল বিষয় মনে হচ্ছিল না। কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় খটকার ব্যাপার ছিল, ধরা যাক দস্তার ওপর প্রবল উজ্জ্বল লাল আলো (যেমন সার্চলাইট নির্গত) ফেললে কোনো ইলেকট্রন বেরোয় না। কিন্তু নীল আলো দেয়, এমন একটি টিমটিমে মোমবাতির আলোয় ইলেকট্রন চটপট বেরিয়ে পড়ছে। এই ধাঁধাটি আইনস্টাইন সমাধান করলেন চমত্কারভাবে। তিনি বললেন, আলো ফোটন নামের কণা দিয়ে তৈরি। প্রতিটি কণার শক্তি তার কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। ফোটনের শক্তি E আর কম্পাঙ্ক f হলে আইনস্টাইনের হিসাবে E = hf, যেখানে h হচ্ছে প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক।

এখানে দুটি ব্যাপার লক্ষ করার মতো। প্ল্যাঙ্ক তাঁর ধ্রুবকের অবতারণা করেছিলেন বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গের শোষণ ও বিকিরণের ক্ষেত্রে। আর আইনস্টাইন সেটার ব্যবহার করলেন বিকিরণের ক্ষেত্রেই—শুধু কোনো বিশেষ প্রক্রিয়ার জন্য নয়। যদি আমরা আবার ব্যাংকের টাকা আদান-প্রদানের ব্যাপারটার সাথে তুলনা করি, আইনস্টাইনের ব্যাখ্যাটা এ ক্ষেত্রে হবে—ব্যাংক ২০, ৪০, ৬০ ইত্যাদি সংখ্যা ছাড়া অন্য অঙ্কের টাকা আদান-প্রদান করতে অক্ষম। কারণ, ২০ টাকার নোট ছাড়া অন্য কোনো নোট পাওয়া যায় না। এভাবে দেখলে হয়তো আমাদের কাছে এটা অত্যন্ত সহজ ব্যাখ্যা মনে হতে পারে। কিন্তু ওই সময়ে যখন বিদ্যুত্চুম্বকীয় বিকিরণে ম্যাক্সওয়েলীয় বিবরণ জেঁকে বসেছে, সে সময় প্ল্যাঙ্কের ধারণার এ রকম ব্যাখ্যা অবশ্যই বৈপ্লবিক ছিল।

ছবি ২: আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া
এখন সবচেয়ে ভূতুড়ে ব্যাপার হচ্ছে, আমরা বলি ফোটন একটা কণা, কিন্তু সেটা একই সঙ্গে তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ধারণ করে কীভাবে? এই সমস্যাটা শুধু ফোটনের নয়, বরং কোয়ান্টাম জগতের সব অধিবাসী এই একই সমস্যায় জর্জরিত

এখান থেকে আরও একটা কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার আমরা দেখতে পারি। সেটা নিয়ে অনেকের মনেই বিভিন্ন প্রশ্ন থাকে। সেটা হলো, ঠিক আছে, না হয় মানলাম যে ফোটন নামের মৌলিক কণা দিয়ে আলো তৈরি, কিন্তু এটার ভর কত?

এর উত্তর হলো, ফোটনের ভর শূন্য (০)। এটা ব্যাখ্যা করার জন্য আমরা একটু বাঁকা রাস্তায় হাঁটবো। এজন্য আমাদেরকে আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E = mc2 এর পূর্ণাঙ্গ রূপ ব্যবহার করতে হবে, যেটা হচ্ছে:

E = (m2c2 + p2) c2

ছবি ৩: আলো যদি শুধু কণা চরিত্রের হতো তাহলে ইয়ংয়ের ব্যতিচার পরীক্ষাটির চিত্র বাঁ পাশের ছবির মতো হওয়ার কথা। আলোর তরঙ্গ চরিত্রের কারণে পরীক্ষাটির চিত্র পাওয়া যায় ডান পাশের ছবির মতো

যে p হচ্ছে ভরবেগ, m হলো কণার ভর। নিউটনীয় কাঠামোয় আমরা লিখি p = mv এবং ঠিক এ কারণে বাংলায়ও আমরা এর নাম দিয়েছি ভরবেগ। কিন্তু আপেক্ষিকতার কাঠামোয় এই p = mv সমীকরণটা প্রযোজ্য নয়। কারণ, ভরহীন কণার ক্ষেত্রে নিউটনীয় সমীকরণ ব্যবহার করলে দেখা যায় যে, ফোটনের ভরবেগ শূন্য। অন্যদিকে উপরের আইনস্টাইনীয় সমীকরণ অনুযায়ী ভরহীন কণার জন্য m = 0 ব্যবহার করলে আমরা পাই, p = E/c। আবার প্ল্যাঙ্ক ও আইনস্টাইনের কোয়ান্টাম সমীকরণ E = hf প্রয়োগে পাওয়া যাচ্ছে, p = h/λ বা λ = h/p, যেখানে λ হলো তরঙ্গদৈর্ঘ্য। এখানে পুনরায় মনে করিয়ে দেয়া দরকার যে আলোর ক্ষেত্রে λ = c/f, যেখানে f হলো কমপাঙ্ক। লুই দ্য ব্রগলি পরবর্তীতে দেখিয়েছিলেন যে λ = h/p সমীকরণটি শুধু ফোটন নয়, সব কোয়ান্টাম কণার জন্যই প্রযোজ্য। এই সমীকরণটিকে সার্বজনীন ধরে নিলে আমরা দেখতে পাই, ফোটনের জন্য নিউটনীয় ভরবেগের ধারণা এক অসঙ্গতির জন্ম দেয়। ফোটনের ভর শূন্য হলে নিউটনীয় ধারণায় এর ভরবেগ শূন্য—অতএব, সেক্ষেত্রে আমরা দ্য ব্রগলির সমীকরণ অনুযায়ী আমরা শুধু অসীম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ পেতাম। আমাদের পক্ষে আলো, এক্স-রে অথবা মাইক্রোওয়েভ ইত্যাদি কিছুই পাওয়া সম্ভব হতো না। আবার ফোটনের ভরবেগ থাকার কারণেই আমরা লেজার ব্যবহার করে ধাতুর পাত কাটতে পারি বা সার্জারী করতে পারি। পাশাপাশি আরেকটা মজার জিনিস বলি, ফোটনের ভর শূন্য হওয়ার কারণেই গাণিতিকভাবে আমরা দেখাতে পারি, কুলম্বের সূত্রের মাঝের দুরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কটা চলে আসে। ফোটনের ভর থাকলে আমরা এই সুত্রের ব্যতয় পেতাম। আর এর ফলশ্রুতিতে আমরা সূর্য বা অন্যান্য গ্যালাক্সিগুলোকে আমরা এতদুর হতে দুরবীন দিয়েও দেখতে পারতাম না। যেমন নিউক্লিয়ার বলের ক্ষেত্রে পায়ন কণার ভর শূন্য না হওয়ার কারণে সবল নিউক্লিয়ার বল নিউক্লিয়াসের বাইরে অনুভূত হয় না। এখন সবচেয়ে ভূতুড়ে ব্যাপার হচ্ছে, আমরা বলি ফোটন একটা কণা, কিন্তু সেটা একই সঙ্গে তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ধারণ করে কীভাবে? এই সমস্যাটা শুধু ফোটনের নয়, বরং কোয়ান্টাম জগতের সব অধিবাসী এই একই সমস্যায় জর্জরিত।

আরও পড়ুন

এই সমস্যাটা ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের আলোর তরঙ্গ প্রকৃতি বের করার পুরোনো ইয়ংয়ের ব্যতিচার পরীক্ষায় ফেরত যেতে হবে। এটি ইয়ং-এর ডাবল-স্লিট বা দ্বিচির পরীক্ষা নামেও পরিচিত। এই পরীক্ষায় একটি আলোর বিন্দু উত্স আর একটি পর্দার মাঝে দুটি ফুটোবিশিষ্ট আরেকটা পর্দা দেওয়া হয়। আলো যদি কণা হতো, তাহলে সেখানে শেষের (ফুটোবিহীন) পর্দায় মাত্র দুটি আলোকিত স্থান দেখা যাওয়ার কথা। কিন্তু সব পরীক্ষণেই আমরা দেখি, সেখানে আমরা যে দুটি বিন্দু আশা করছি (বাঁয়ের চিত্র) শুধু তা নয়, মাঝে আরেকটি বা একাধিক আলোকিত বিন্দু পাই (ডানের চিত্র)। এই পর্যবেক্ষণে যে জিনিসটা দেখা যায়, তা নাহয় শুধু তরঙ্গ-প্রকৃতি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি, কিন্তু কণা প্রকৃতির ফোটনের পক্ষে এটা কী করে সম্ভব? এই সমস্যাটা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আবির্ভাবের সময় থেকেই আমাদের ভোগাচ্ছে।

এটা মূলত আমাদের সাধারণের চিন্তাকাঠামোর জড়তার প্রকাশ। আমরা হয় কণা, না হয় তরঙ্গ, যেকোনো একটা চিত্র ব্যবহার করে আলো তথা সব কোয়ান্টাম কণার খুঁটিনাটি বুঝতে চাই। এ দুটি চিত্র পরস্পর বিপরীতমুখী। কারণ সাদামাটাভাবে চিন্তা করলে কণা একটা বিন্দুতে অবস্থান করে আর তরঙ্গ তেমনি একটা বিস্তৃত (Distributed) সত্তা। দুর্ভাগ্যবশত, প্রকৃতি আমাদের সেই সুযোগ দেয়নি যে আমরা শুধু একটা চিত্র দিয়ে কাজ চালাতে পারব। যদি আমরা শুধু কণাচিত্র নিয়ে কাজ করতে চাই, তবে সেখানে আমাদের কিছুটা ছাড় দিতে হবে। আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় এটা করা হয়, কণার কোনো একটা মুহূর্তে শুধু একটা বিন্দুতে অবস্থান করার সুবিধাটা কেড়ে নিয়ে। এটাই কোয়ান্টাম কণা আর নিউটনীয় কণার মধ্যে বিশাল পার্থক্য। আর এই ধর্মই ফোটনকে তরঙ্গধর্ম ব্যবহার করার সুযোগ দেয়। যেমন ওপরের পরীক্ষায় তরঙ্গের পক্ষে মাঝের দুটি ফুটোর ভেতর দিয়ে একই সময়ে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু একটি নিউটনীয় বিন্দুসদৃশ কণার পক্ষে সেটা অসম্ভব। কিন্তু কোয়ান্টাম কণাকে যদি কেউ পর্যবেক্ষণ না করে, তখন তার কোনো অবস্থান থাকে না। ফলে সে ওই একই সময়ে দুটি ফুটোর মাঝ দিয়ে যেতে পারে। এটাই সব কোয়ান্টাম কণার বিশেষ অধিকার। নিউটনীয় জগতে বসবাসকারী আমাদের কাছে এ ধরনের ব্যবহার দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, বিশাল বিশ্ব কীভাবে চলবে তা মানবজাতি ঠিক করে দেয় না।

কোয়ান্টাম কণার এ রকম ভুতুড়ে ব্যবহার আইনস্টাইনের পছন্দ ছিল না। তাই নিলস বোরের সঙ্গে এক বিতর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই ঈশ্বর পাশা খেলেন না।’ এর জবাবে বোরের উত্তরও ছিল তেমনি তীক্ষ্ণ—‘আপনাকে ঠিক করে দিতে হবে না, ঈশ্বর কী করবেন আর কী করবেন না।’

লেখক: অধ্যাপক, ফিজিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত