জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিপার্কাস ও তাঁর মানমন্দির

Abdul Gaffar

প্রাচীন গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের চরম উত্কর্ষ সাধিত হয়েছিল হিপার্কাসের হাতে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০ অব্দে প্রথম গ্রিসের রোডস দ্বীপে তিনি একটি মানমন্দির স্থাপন করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটিই ‘রোডস মানমন্দির’ বা হিপার্কাসের মানমন্দির নামে পরিচিত। এখন প্রশ্ন হলো, কে এই হিপার্কাস! যিনি প্রাচীনকালেই জ্যোতিষিক চর্চা থেকে বেরিয়ে এসে গাণিতিক ও পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চার জন্য এমন একটি ভিত্তি স্থাপন করলেন।

হ্যাঁ, হিপার্কাস ছিলেন প্রাচীন যুগের অন্যতম সেরা জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ১৯০ অব্দে গ্রিসের বিথিনিয়া প্রদেশের নিকিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। নিকিয়াতে জন্মগ্রহণ করলেও জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটান রোডস দ্বীপে। তিনি মৃত্যুবরণ করেন খ্রিষ্টপূর্ব ১২০ অব্দে। সে সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে দ্বীপটি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী। আস্তরলাব (অ্যাস্ট্রোল্যাব) ও নভোগোলক ব্যবহার করে তিনি প্রথম আকাশের ১ হাজার ২৫টি তারার একটি অবস্থান–তালিকা নির্ণয় করেন। তারাচিত্রের ধারাবাহিক পরিবর্তন পর্যালোচনা করতে গিয়ে তিনি অয়ন-চলন (Precession) আবিষ্কার করেন। এটি ছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ।

এ ছাড়া ঔজ্জ্বল্যতা অনুযায়ী তারাদের ছয়টি শ্রেণিতে ভাগ করেন এবং প্রতিটি তারা অন্য তারার তুলনায় কত উজ্জ্বল, তা–ও স্থির করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৪ অব্দে বৃশ্চিক রাশিতে একটি নবতারা বা নোভা দেখেই তিনি তারার তালিকা প্রণয়নে উত্সাহিত হন। তিনি তাঁর তালিকায় নীহারিকার মতো দুটি বস্তু অন্তর্ভুক্ত করেন। বস্তু দুটির একটি হলো মধুচক্র স্তবক বা প্রিসিপ (এম৪৪), অপরটি পারসিয়াসমণ্ডলের যুগ্ম তারাস্তবক। বর্তমানে এটি এইচ ও কাই পার্সিই নামে পরিচিত। পর্যবেক্ষণ করেন গ্রহগুলোও। এ ছাড়া চন্দ্রের দূরত্বসহ আয়তনও নির্ণয় করেন। গণিতে তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান সমতলীয় ও গোলকীয় জ্যামিতি আবিষ্কার। হিপার্কাসের পূর্বসূরিরা ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী থেলিস, ইউডক্সাস ও অ্যারিস্টার্কাস। থেলিস ছিলেন পৃথিবীর প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানী, যিনি অঙ্ক কষে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৫ অব্দের ২৮ মে সূর্যগ্রহণের কথা বলেছিলেন। সেদিন থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্মদিনের সূচনা বলে ধারণা করা হয়। ইউডক্সাসই প্রথম ‘খ-গোলক’ তৈরি করেন, যার নাম ছিল ‘ইউডক্সাসের গোলক’। আর অ্যারিস্টার্কাসকে বলা হয় গ্রিক যুগের কোপার্নিকাস। তিনি বলেন, সূর্য স্থির আর পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চারদিকে বৃত্তাকার পথে ঘুরছে।

হিপার্কাসের উত্তরসূরি ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমি। টলেমির তারা বর্ণনা প্রায় পুরোটাই হিপার্কাসের বর্ণনার ওপর নির্ভরশীল। পরে হিপার্কাস ও টলেমির হাত ঘুরে গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চলে যায় মধ্যযুগের আরবদের হাতে।

হিপার্কাস প্রচলিত যন্ত্রপাতির সাহায্যে ব্যাপক ও নির্ভুল পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। তিনি প্রাচীন ও পূর্বতন বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণলব্ধ বৈজ্ঞানিক তথ্যের চুলচেরা বিচার ও বিশ্লেষণ করেছেন, বৈজ্ঞানিক তথ্যকে সহজ ও বিধিবদ্ধ উপায়ে প্রকাশ করে, গণিতের সহায়তা গ্রহণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণিত ব্যর্থ হলে গণিতের উন্নতি সাধন অথবা নতুন গণিতের উদ্ভাবন (যেমন: ত্রিকোণমিতি) এবং বিশেষ জ্যামিতিক চিত্রের সাহায্যে চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহদের গতির বর্ণনা ও ব্যাখ্যায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

হিপার্কাস সম্বন্ধে বিখ্যাত ফরাসি গণিতবিদ দ্য লম্বর তাঁর প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাস গ্রন্থে বলেছেন, ‘হিপার্কাসের আবিষ্কার পরবর্তী সমস্যাগুলোর সমাধান, সংশোধন, তাঁর লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা ও অসংখ্য গণনা ইত্যাদির কথা চিন্তা করলে, মনে হয় কী একটা বিরাট প্রতিভা এই হিপার্কাস। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে প্রাচীনকালে এত বড় পণ্ডিত আর ছিল না।’

লেখক : শৌখিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ও সংগঠক