পৃথিবী ও আকাশ
প্রথম পৃথিবী পরিক্রমা
প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর সম্পর্ক। পৃথিবী ও আকাশ নামের এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…
২০ সেপ্টেম্বর, ১৫১৯ সাল। স্পেনের সেভিল বন্দর থেকে ছাড়ল পাঁচটি ছোট্ট জাহাজের একটি স্কোয়াড্রন।
জাহাজগুলোর নাম সান আন্তনিও, ট্রিনিদাদ, কনসেপসিয়ন, ভিকটোরিয়া ও সান্তিয়াগো। অফিসার এবং নাবিক মিলিয়ে সবসহ যাত্রা করে ২৩৯ জন, ফেরে মাত্র কয়েকজন।
স্প্যানিশ স্কোয়াড্রনটির অধিনায়ক এ্যাডমিরাল ম্যাগেলান। জন্মসূত্রে তিনি স্পেনের লোক নন, প্রতিবেশী পর্তুগাল থেকে এসেছেন।
যে কর্তব্যকর্ম ফার্দিনান্দ দ্য ম্যাগেলান নিজের সামনে রাখেন, তা দুরূহ। সেটি হলো, আটলান্টিক মহাসমুদ্র থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে যাওয়ার একটি পথ বের করা।
মানচিত্রে একবার চোখ বোলাও। দুটি মহাসমুদ্রের মাঝে বিরাট আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র) মহাদেশ, সুমেরু মহাসমুদ্রের (উত্তর মহাসাগর) তুষারাবৃত্ত জল থেকে কুমেরু সমুদ্র (দক্ষিণ বা অ্যান্টার্কটিক মহাসাগর) পর্যন্ত তার বিস্তার। সে সময় আমেরিকার পশ্চিমবর্তী মহাসমুদ্রটি আবিষ্কৃত হয়েছে, তার নামকরণ করা হয় বৃহৎ দক্ষিণ সমুদ্র।
ম্যাগেলানের আগেও সমুদ্রযাত্রীরা নতুন অজানা মহাসমুদ্রটিতে হানা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু যেখানেই তাঁরা যান, বিষুবরেখা থেকে উত্তরে বা দক্ষিণে, তাঁদের পথ রোখে আমেরিকা মহাদেশ। প্রায় সবাই ভাবত যে আটলান্টিক মহাসমুদ্র থেকে এই বৃহৎ দক্ষিণ সমুদ্রে যাওয়া অসম্ভব।
কথাটা মেনে নেননি ম্যাগেলান। তাঁর সন্দেহ ছিল না যে দক্ষিণে কোথাও একটি প্রণালী দুটি মহাসমুদ্রকে যুক্ত করেছে। লোকবল এবং জাহাজ পেলে প্রণালীটি বের করার ভার তিনি নেবেন বলেন। নিজ দেশ পর্তুগালে জাহাজ ও লোকজন জোগাড়ের চেষ্টা বহু বছর করে তিনি ব্যর্থ হন। স্বদেশ ছেড়ে তাই যেতে হলো স্পেনে। সেখানে তাঁকে বিশ্বাস করে, এমন লোকের সন্ধান মিলল। তাঁকে দেওয়া হলো একটি স্কোয়াড্রনের ভার।
অদৃষ্টপূর্ব এমন একটি যাত্রায় স্প্যানিশ অভিযানের নেতা এই ভাবে হলেন পর্তুগালের ম্যাগেলান (পর্তুগীজ ভাষায় মাগেলহায়েনস)।
যাত্রা সফল হলে বিশাল সম্পদের আধকারী হবেন ম্যাগেলান: স্পেনের রাজার সঙ্গে একটি চুক্তি শর্তে নব-আবিষ্কৃত সব দেশের শাসকপদ তিনি পাবেন, আর পাবেন সেসব দেশ থেকে পাওয়া লাভের বিশ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু উচ্চ পদ আর সম্ভাব্য সম্পদের জন্য বড় একটা দাম দিতে হয় তাঁকে: বিদেশির অধীনে নিযুক্ত গর্বিত স্প্যানিশ ক্যাপ্টেন তাঁকে হিংসা করত, সুযোগ পেলে তাঁকে সাবাড় করার শপথ গ্রহণ করে তারা।
এমনকি যাত্রা শুরুর আগেই তাঁকে বাধা দেওয়ার সব আয়োজন তারা করে। অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা তারা জোগাল না, এমনকি তাঁর জান নেওয়ার একটা চেষ্টা পর্যন্ত করা হলো। তাঁকে ওরা দিল পুরোনো পচা কারাভেলা; তাঁর মাঝিমাল্লা হলো নানা দেশের ভবঘুরে, স্বদেশে নানা অপরাধের দণ্ড এড়াবার জন্য পলাতক জার্মান, ইংরেজ ও ইতালীয়রা।
ম্যাগেলান কিন্তু হার মানলেন না। সব অসুবিধা তিনি অতিক্রম করলেন। দুই বছরের জন্য যথেষ্ট খাবার ও সরঞ্জাম কেনার মতো টাকার জোগাড় করলেন তিনি; জাহাজগুলোকে মেরামত করা হলো, তালিম দেওয়া হলো নাবিকদের।
সত্যি, সুদূর দেশে অভিযান চালাবার জন্য ম্যাগেলানকে কেন নিয়োগ করা হয়?
অভিযানের খরচা আর পাঁচটি জাহাজের দাম বেশ উঠে এসেছে ২৬ টন মশলা থেকে। সত্যি বটে, ১৬০ জনের বেশি অফিসার আর নাবিকের মৃত্যু ঘটে, কিন্তু তা নিয়ে সওদাগরদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ওদের মৃত্যুতে পয়সা বের করতে হয়নি গাঁট থেকে।
ম্যাগেলানের আশা ছিল, তিনি সব সংশয়গ্রস্ত লোকের কাছে দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করবেন যে পৃথিবী বলের মতো গোল। সে সময় কিন্তু কয়েকজন মাত্র পণ্ডিত পৃথিবীর আকার নিয়ে মাথা ঘামাতেন। রাজরাজড়া বা সওদাগরদের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তাদের একমাত্র চিন্তা—ম্যাগেলানের অভিযান সফল হলে অঢেল মুনাফা পাওয়া যাবে। তোমাদের হয়তো মজার মনে হবে, এমনকি বিদঘুটে ঠেকবে যদি কোনো দোকানদারকে বলতে শোন: ‘ওহে যা কিনলে, তার জন্য বিশটে গোলমরিচদানা পাওনা রইল।’
একসময় টাকা হিসেবে চল ছিল গোলমরিচের, তখন ধার শোধ করা হতো, খাজনা দেওয়া হতো গোলমরিচে, গোলমরিচ দিয়ে কেনা হতো বাড়ি, খামার, জাহাজ।
এখনকার দিনে বড়লোকদের বলা হয় ‘টাকার থলে’, কিন্তু আগের দিনে এদের নাম ছিল ‘গোলমরিচের থলে’।
আর এই সব দিনে ম্যাগেলান রওনা দিলেন তাঁর সুবিখ্যাত যাত্রায়। প্রাচ্যের মশলা, গোলমরিচ, দারুচিনি আর আদা লাগত বড়লোকদের খাবারে, খাদ্য হতো ঝাঁঝালো আর রসালো, আর রসালো খাবার তো হজমি জিনিস। ওষুধ তৈরি করিয়েদের অতি নিখুঁত নিক্তিতে মশলা ওজন করা হতো, প্রতিটি দানার মূল্য অনেক। প্রাচ্যের নানা ওষুধের, যেমন কর্পুরের বিশেষ সমাদর ছিল, অথচ যেসব দেশে এগুলো জন্মাত অর্থাৎ ভারত এবং মালাক্কাদ্বীপপুঞ্জে (মশলা দ্বীপপুঞ্জ) এরা বিকোত ইউরোপের যইশস্য বা মটরের দামে।
ইউরোপে তাহলে প্রাচ্যের মশলা আর ওষুধপত্তরের এত দাম ছিল কেন? কারণ, ইউরোপে পৌঁছাবার পথ সুদীর্ঘ আর কঠিন; প্রাচ্য থেকে মশলা-আনা সওদাগরদের আসতে হতো ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে, সমুদ্রে জলদস্যু আর ডাঙায় ডাকাতদের হাতে জান যাওয়ার ভয় ছিল তাদের, পথিমধ্যে নানা দেশের রাজাদের দিতে হতো মোটা মাশুল। সুদূর প্রাচ্য থেকে ইউরোপে আসতে দু-তিন বছর যেত কেটে। মার্কো পোলো আর আফানাসি নিকিতিনের কথা মনে আছে তো?
১৪৫৩ সালে তুর্কীরা কনস্টান্টিনোপল দখল করার পর প্রাচ্যে পৌঁছানো আরও কঠিন, বাস্তবিক পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই মালয়ে এক পিপে গোলমরিচের যা দাম, তাই ইউরোপে দিতে হতো এক চিমটি গোলমরিচের জন্য।
ম্যাগেলানকে অভিযানে পাঠানোর সময় ধনী স্প্যানিশ সওদাগররা ভাবে যে তিনি মশলা দ্বীপপুঞ্জে অল্প সময়ে এবং নিরাপদে পৌঁছানোর একটা পথ বের করতে পারবেন। তা ছাড়া তাদের আশা ছিল মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জকে কবলে আনার। শুধু এই কারণে তারা ম্যাগেলানের অভিযানের জন্য পয়সা খরচ করে।
আমেরিকার উপকূল পর্যন্ত রোমাঞ্চকর কিছু ঘটল না। অবশ্য সান আন্তনিও, কনসেপসিয়ন এবং ভিকটোরিয়ার ক্যাপ্টেনরা সর্বদা ম্যাগেলানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যায়, চেষ্টা করে বিভিন্ন জাতির লোকদের ক্ষেপিয়ে দেওয়ার।
প্রধান অসুবিধে শুরু হলো আমেরিকার উপকূলে এসে পড়ার পর। দুটো মহাসমুদ্রের মাঝে একটা প্রণালী আছে বলে ম্যাগেলান অনুমান করেছিলেন বটে, কিন্তু কোথায়, তা তিনি জানতেন না। এক একটা উপসাগরে তিনি ঢোকেন, এক একটা খাঁড়িতে—কোথায় সেই রহস্যময় প্রণালী, যেটা ধরে তিনি যেতে পারেন?
এতে করে অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হলো। শীতকাল আসন্ন, দক্ষিণ গোলার্ধের সেই নিষ্ঠুর কঠিন শীতকাল আর দক্ষিণ মেরু সমুদ্রগুলোর অভিমুখেই তো নাবিকেরা পাড়ি দিচ্ছে।
ম্যাগেলান বুঝলেন যে শীতকালে যাত্রা চালিয়ে যাওয়া পাগলামি হবে, সমুদ্রের হিমশীতল বুকে শীতকালের করাল ঝড়ে মৃত্যু হবে সবার। হাওয়া আসে না, এমন একটা উপসাগরে নোঙর ফেলে রইল পাঁচটি জাহাজ। হাওয়া আসে না বটে, কিন্তু এমন একটা ধুধু নিঃসঙ্গ জায়গা পৃথিবীর বুকে আর বুঝি নেই। তটভূমি রিক্ত, গাছ বা ঝোপঝাড় চোখে পড়ে না। এমনকি শীতের মুখে পাখিরা পর্যন্ত ভয়াল জায়গাটা ছেড়ে চলে গিয়েছে।
নাবিকদের মেজাজ তিরিক্ষি; খাবারের ভাগ অ্যাডমিরালের হুকুমে কমিয়ে দেওয়ায় তারা চটে ছিল—ম্যাগেলানের আশঙ্কা, খাবার না কমালে ফের যাত্রা শুরু করার সময় কিছুই থাকবে না। নাবিকদের অসন্তোষকে আস্কারা দিয়ে স্প্যানিশ ক্যাপ্টেনরা একটা বিদ্রোহ বাঁধাল। বিদ্রোহ দাবিয়ে পাণ্ডাদের শাস্তি দিলেন ম্যাগেলান। এরপর খোলাখুলিভাবে তাঁর বিরোধিতা করার দুঃসাহস কারো রইল না, তবে তাঁর প্রতি স্প্যানিশ অফিসারদের বিদ্বেষ কমল না, তলায় তলায় তারা তাঁর শত্রুই রইল।
পাঁচটি বিরস মাস কাটল শীতের আস্তানায়। তারপর জাহাজগুলো আবার চলল দক্ষিণমুখো, সেই রহস্যময় প্রণালীর খোঁজে।
১৪৫৩ সালে তুর্কীরা কনস্টান্টিনোপল দখল করার পর প্রাচ্যে পৌঁছানো আরও কঠিন, বাস্তবিক পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই মালয়ে এক পিপে গোলমরিচের যা দাম, তাই ইউরোপে দিতে হতো এক চিমটি গোলমরিচের জন্য।
শীত শেষ, কিন্তু স্কোয়াড্রনের দুর্ভোগের শেষ নেই। একটা খাঁড়ির তল্লাসে গিয়ে সবচেয়ে দ্রুতগামী যে জাহাজ, সেই সান্তিয়াগো নষ্ট হলো। ঝড়ে তটে ধাক্কা লেগে ভেঙে গেল জাহাজটা। নাবিকদের উদ্ধার করে অন্য জাহাজগুলোতে ভাগ করে দেওয়া হলো, আবার যাত্রা শুরু। অবশেষে এল দীর্ঘ-প্রত্যাশিত জয়লাভের দিন! একটা উঁচু অন্তরীপ চক্কর দিয়ে সমুদ্রযাত্রীরা দেখল মহাদেশের গভীরে ঢুকেছে অন্ধকার বিষণ্ণ একটি প্রণালী—বিক্ষুদ্ধ জলরাশি, প্রবল বাতাস।
খোঁজখবরের জন্য দুটো জাহাজ পাঠালেন ম্যাগেলান। কয়েক দিন পরে ফিরল জাহাজগুলো, কামানের শব্দে স্যালুট জানিয়ে, মাস্তুল পতাকায় সাজিয়ে; নাবিকরা গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে। সেই মহান আবিষ্কার ঘটেছে, পাওয়া গেছে সেই রহস্যময় প্রণালী!
ম্যাগেলান আনন্দে উদ্বেল। তাহলে তাঁদের মহাশ্রম ও নানা কষ্ট বৃথা যায়নি, সব বাধাবিঘ্ন সার্থক হয়েছে, অবাধ্য স্প্যানিয়ার্ডদের শাস্তিদান নিরর্থক নয় তাহলে; তিনি যা ভেবেছিলেন, ঠিক তা-ই—প্রণালীটা আছে, সেটা ধরা পড়েছে তাঁর কাছে! মহান আবিষ্কারকের সম্মানার্থে পরে প্রণালীটির নাম দেওয়া হলো ম্যাগেলান প্রণালী। দক্ষিণ আমেরিকার মানচিত্রে এখনো নামটা বর্তমান।
বাকি চারটা জাহাজ সাবধানে এবং মন্থর গতিতে চলতে লাগল আবার।
নতুন আবিষ্কৃত প্রণালীটি ধরে পুরো এক মাস চলল যাত্রা। অবশেষে ইউরোপীয়দের অজানা একটি মহাসমুদ্রে এসে পড়ল তারা। আনন্দাশ্রুতে ভরে গেল মাগেল্লানের চোখ।
‘পশ্চিম দিকে! পশ্চিম দিকে পুরো দমে চলো মশলা দ্বীপপুঞ্জের দিকে!’
কিন্তু সাফল্যের একেবারে কাছে এসে আর একটি দুর্বিপাকের মুখোমুখি হলেন অদম্য সেই নাবিক: বিশ্বাসঘাতকতার ফলে সমস্ত যাত্রাটির প্রায় সর্বনাশ হতে চলে। সান আন্তনিওর সহকারী ক্যাপ্টেন দলের মধ্যে বিদ্রোহ বাধিয়ে গোপনে স্পেনের দিকে নিয়ে চলল সান আন্তনিওকে।
বড় কঠিন একটা ধাক্কা খেলেন মাগেল্লান, সবচেয়ে বড় জাহাজ সান আন্তনিও, খাবারের বেশির ভাগ তাতে, আর তাও সেরা খাবার, যেটা দীর্ঘতর যাত্রার জন্য জমিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
তিনটে মাত্র ছোট জাহাজ, খাবারের অবস্থা কাহিল, মাগেল্লান কী করলেন তখন? সুদৃঢ় কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমরা যাত্রা চালিয়ে যাব, জাহাজের রশারশির চামড়ার বাঁধন খেতে হয় তাও সই!’
১৫২০ সালের ২৮শে নভেম্বর তিনটা জাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরের ঊষর বিশাল জলরাশিতে পাড়ি দিল। এর আগে ইউরোপের কোনো জাহাজ এখানে আসেনি।
সে মহাসমুদ্র কত বিশাল, আগে জানলে সমুদ্রে বিধ্বস্ত, জীর্ণ, নড়বড়ে মাস্তুল আর ছেঁড়া পালের জাহাজগুলোকে নিয়ে মাগেল্লান পাড়ি দেবার চেষ্টা করতেন কি না সন্দেহ। কিন্তু ব্যাপারটা তিনি জানতেন না।
মাগেল্লানের সফরের আগে পৃথিবীর প্রকৃত আয়তন সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিল না লোকের। এ্যাডমিরাল ভেবেছিলেন যে তিন চার হাজার কিলোমিটার পরেই মশলা দ্বীপপুঞ্জে এসে পড়বেন। আসলে তাঁর এবং দ্বীপপুঞ্জগুলোর মধ্যকার ব্যবধান ১৮ হাজার কিলোমিটার! অপরূপ আবহাওয়ায় যাত্রীদের স্বাগত জানাল নতুন মহাসমুদ্র। নির্মেঘ আকাশ, দীর্ঘ ‘কঠিন শীতে ভোগা নাবিকদের গা জুড়ালো তপ্ত সূর্য’, ফুরফুরে হাওয়ায় জাহাজগুলো অবিরাম চলল পশ্চিম দিকে। শান্তিপূর্ণ সমুদ্রকে মাগেল্লান প্রশান্ত মহাসাগর নামে অভিহিত করলেন। পরে দেখা গেল মহাসমুদ্রটি অত নিরীহ নয় মোটে। এত বিরাট সে সমুদ্র যে নাবিকেরা বলল এটি বিরাট মহাসমুদ্র, রুশ ভাষায় এখনো দুটো নামে সমুদ্রটি পরিচিত।
১৫২০ সালের ২৮শে নভেম্বর তিনটা জাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরের ঊষর বিশাল জলরাশিতে পাড়ি দিল। এর আগে ইউরোপের কোনো জাহাজ এখানে আসেনি।
সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটল, কিন্তু বাঞ্ছিত কিনারার কোনো লক্ষণ নেই। কাটল এক মাস, আরো একটা মাস, তবু তিনটে ছোট জাহাজকে ঘিরে শুধু মহান রিক্ত মহাসমুদ্র।
জাহাজে ক্ষুধার তাড়না। দেখা গেল, অভিযানের জোগাড়যন্ত্রের সময় তাজা খাদ্যদ্রব্যের জায়গায় মাগেল্লানের শত্রুরা পচা বিস্কুটের বাক্স তার ঘাড়ে চাপিয়েছে।
আরো খারাপ ব্যাপার—ইঁদুরে বাক্সগুলো ফুটো করে খাবার সাবাড় করছে। নাবিকেরা ইঁদুর ধরার জন্য উঠে পড়ে লাগল, এক একটা ইঁদুর ধরা পড়ে, খাবার মতো জিনিস বটে, নাবিকেরা গোগ্রাসে খেয়ে ফেলে।
মদ শেষ হয়েছে অনেক দিন, পিপেতে রাখা টাটকা জল গিয়েছে টকে। সে জলের এমন দুর্গন্ধ যে ন্যক্কার আসে, লোকে খায় নাক টিপে।
মাগেল্লানের সেই বিরস ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হলো, জাহাজের রশিরশার চামড়া কেটে খেতে হলো লোককে। রশিরশা ডেক-এ নামিয়ে লোনা জলে ডুবিয়ে নরম করে নিয়ে তারপর চামড়া কেটে সিদ্ধ করে গিলে ফেলা, চিবোনোর বালাই নেই। এত শক্ত সে চামড়া যে চিবোনো চলে না। খাবার পর পেটে দারুণ যন্ত্রণা।
পুরো তিন মাস ধরে যাত্রা চলল, ডাঙার লক্ষণ নেই। অনাহারে নাবিকেরা মরে যেতে লাগল। মৃতদের জলে ফেলে দিলে সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুধার্ত হাঙরেরা খেয়ে ফেলে।
অবর্ণনীয় একটা বিভীষিকা আচ্ছন্ন করে দিয়েছে সবাইকে। মনে হলো তরঙ্গের সীমাহীন এই মরুভূমিতে অমোঘ মৃত্যু ওৎ পেতে বসে আছে তাদের জন্য। নাবিকদের মনে হলো তাদের যাত্রার আর শেষ হবে না, স্থলদেশ কখনো আর চোখে পড়বে না।
মাগেল্লান কিন্তু জানতেন যে ফেরার উপায় নেই। সামনে কোনো একদিন দ্বীপ দেখা দেবেই। ফেরা অসম্ভব। ফেরার পথ দীর্ঘ, শক্তি বা খাদ্যতে কুলোবে না।
ভয়ঙ্কর সেই যাত্রার তিন মাসেরও বেশি কাটার পর চোখে পড়ল ডাঙা কঠোর রিক্ত পাথুরে জায়গা, নেই এক ফোঁটা জল বা গাছপালা। তবু ভরসা মিলল। ডাঙার মানে জল মরুভূমি শেষ হয়ে এসেছে, সত্বর দেখা দেবে সমৃদ্ধ দ্বীপপুঞ্জ, তাতে মিলবে খাদ্য আর পানীয়। এবারে সত্যি নিরাশ হলো না নাবিকেরা।
১৫২১ সালের ৬ই মার্চ আনন্দমুখর নাবিকদের সামনে দেখা দিল একটি দ্বীপ, সত্যিকার একটি দ্বীপ, পামগাছ আর মিষ্টি পানির স্রোত, ঠান্ডা আর পরিষ্কার পানি, যে পানির তৃষ্ণায় এত দিন তারা কাটিয়েছে। এবার মিলবে টাটকা মাংস! সাহসী নাবিকদের অভাবকষ্টের দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত এবারে।
এখন স্বচ্ছন্দে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে মাগেল্লানের অভিযানের সব দুর্বিপাক শেষ, এবার তারা দ্বীপ থেকে দ্বীপে যাবে বিনা ঝামেলায়, যাবে বন্দর থেকে বন্দরে, টিকে-থাকা তিনটে জাহাজ ইউরোপে ফিরবে জয়গর্বে।
কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম দাঁড়াল না। মাগেল্লান আর তাঁর সহযাত্রীদের সামনে তখনো অনেক দুর্ভোগ, সে দুর্ভোগ তারা নিজেরা ডেকে আনল। তখন দুর্বিপাকের জন্য প্রকৃতির আর দায়িত্ব নেই; নাবিকদের লোভ আর সস্তা জয়াশা দুর্বিপাকের মূলে।
ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের ক্ষুদে রাজাদের যে ঝগড়াঝাঁটি তাতে নাক গলালেন মাগেল্লান: ইউরোপীয় অস্ত্রশস্ত্রের শক্তি তাদের দেখিয়ে দেওয়া তাঁর ইচ্ছে। বর্মাবৃত ষাটজন লোক নিয়ে তিনি যুদ্ধে নামলেন মাটান দ্বীপের অধিবাসী এক হাজার লোকের সঙ্গে যাদের হাতে শুধু তীর ধনুক আর বর্শা। সে যুদ্ধে নিহত হলেন মাগেল্লান।
সারা জীবন যে কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন সেই কাজ অসমাপ্ত রেখে এই ভাবে মারা গেলেন প্রসিদ্ধ সেই সমুদ্রচারী। মাগেল্লান ও তাঁর দলের অনেকের মৃত্যুর পর স্প্যানিশ নাবিকেরা বহু দিন এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বিক্ষিপ্ত নানা দ্বীপে ঘুরে বেড়ায়। তখন তাদের হাতে মাত্র দুটো জাহাজ— ট্রিনিডাড ও ভিত্তরিয়া। ওখানকার লোকদের হাতে যাতে না পড়ে তার জন্য জীর্ণ কনসেপসিয়নকে তারা জ্বালিয়ে দেয়।
তারপর তারা দেখল যে ট্রিনিডাডের এমন দুরবস্থা যে ইউরোপে আর যেতে পারবে না। ঠিক হল পুরোপুরি সারাবার জন্য ট্রিনিডাডকে রেখে যাওয়া হবে, শুধু ভিত্তরিয়াতে করে পাড়ি দিতে হবে ইউরোপে। ভিত্তরিয়ার নাবিকদের সংখ্যা ৪৭, তারা যাঁর অধীনে সেই সেবাস্তিয়ান দেল কানো ছিলেন অবশিষ্টদের মধ্যে সেরা নাবিক।
প্রসঙ্গত ট্রিনিডাড ইউরোপে ফেরেনি। নানা দ্বীপের মধ্যে বহুদিন ঘোরার পর জাহাজটি ডুবে যায়। সঙ্গে মরে নাবিকদের বেশির ভাগ। শেষ পর্যন্ত মাত্র চারজন পৌঁছয় স্পেনে। টাটকা জল আর খাবার নিয়ে ভিত্তরিয়া পাড়ি দিল গৃহমুখে।
পৃথিবীর মানচিত্র আর একবার দেখ। কলম্বাসের আগে ইউরোপীয়রা আমেরিকার অস্তিত্বের কথা জানত না; মাগেল্লানের আগে প্রশান্ত মহাসাগরের প্রকৃত আয়তন সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। এখন মানচিত্র থেকে আমেরিকা আর প্রশান্ত মহাসাগরকে সরিয়ে দাও।
ভয়ঙ্কর সে যাত্রা। পচে গেল খাবার, টকে গেল জল। জাহাজে ছিল ২৬ টন মশলা, তখনকার দিনে রীতিমতো একটা কুবেরভাণ্ডার। প্রাচ্য দ্বীপগুলোতে স্প্যানিয়ার্ডরা জিনিসের বিনিময়ে পায় মশলা। মশলা কিন্তু খাদ্য নয়, খাদ্যকে তারা সুগন্ধি করে, কিন্তু সুগন্ধ করার মতো খাদ্য কোথায়।
স্পেনের সেভিল বন্দরে ভিত্তরিয়া পৌঁছল ১৫২২ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর। স্পেনের পতাকা উড়ছে মাস্তুলে, তার নিচে দাঁড়িয়ে মাত্র ১৮ জন মানুষ। পৃথিবীর এই প্রথম পরিক্রমণে লাগে তিন বছর, মাত্র বারো দিন বাদ দিয়ে তিন বছর।
স্প্যানিশ সওদাগররা খুশি। অভিযানের খরচা আর পাঁচটি জাহাজের দাম বেশ উঠে এসেছে ২৬ টন মশলা থেকে। সত্যি বটে, ১৬০ জনের বেশি অফিসার আর নাবিকের মৃত্যু ঘটে, কিন্তু তা নিয়ে সওদাগরদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ওদের মৃত্যুতে পয়সা বের করতে হয়নি গাঁট থেকে।
এই ভাবে শেষ হলো মাগেল্লানের সুবিখ্যাত অভিযান। এই প্রথম পাকা প্রমাণ মিলল যে পৃথিবী গোল, দেখা গেল যে নৌযোগে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা চলে। সমকালীনদের উপরে মাগেল্লানের আবিষ্কারের বিরাট প্রতিক্রিয়া কল্পনা পর্যন্ত করা আমাদের পক্ষে কঠিন।
পৃথিবীর মানচিত্র আর একবার দেখ। কলম্বাসের আগে ইউরোপীয়রা আমেরিকার অস্তিত্বের কথা জানত না; মাগেল্লানের আগে প্রশান্ত মহাসাগরের প্রকৃত আয়তন সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। এখন মানচিত্র থেকে আমেরিকা আর প্রশান্ত মহাসাগরকে সরিয়ে দাও। বাকি অংশটা কত বড়? কলম্বাস আর মাগেল্লানের অদ্ভুত সমুদ্রযাত্রার আগে, সাড়ে চারশ বছর আগে লোকে ভাবত এই বাকি অংশটাই হলো পুরো পৃথিবী।
(চলবে…)