প্রশ্নটা শুনে পাগলামো মনে হতে পারে। অবিশ্বাস্য তো বটেই। কেউ কেউ বলতে পারেন, এসব আজগুবি প্রশ্নের কোনো মানে হয়? তবে বিজ্ঞানীরা কোনো প্রশ্নকে আজগুবি বলে উড়িয়ে দেন না। তাঁরা খুব যত্ন করে, হিসাব কষে ঘেঁটে দেখেন, ঘটনা কী।
এই প্রশ্নটি নিয়েও তাঁরা তা-ই করেছেন। প্রশ্নটি মজার—আমরা কি কোনো কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে রয়েছি? প্রশ্নটা বোঝার জন্য ‘কৃষ্ণগহ্বর’ কী, তা জানা প্রয়োজন। জনপ্রিয় ধারার বিজ্ঞানচর্চার ফলে কৃষ্ণগহ্বর সবারই পরিচিত। তবু সহজ ও অতিসরল করে একটুখানি বলে নেওয়া যাক।
আসলে, মৃত নক্ষত্র। নিজের ভরের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বা টানে সংকুচিত হয়েছে, চুপসে গেছে নিজের ওপরেই। ফলে এর ভেতরে স্থান-কাল এত বেশি বেঁকে গেছে যে জিনিসটা পরিণত হয়েছে তলাবিহীন কুয়ায়। এই কুয়ার মধ্যে কিছু পড়লে তা আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। প্রচণ্ড মহাকর্ষ তাকে ভেতরেই আটকে রাখে। আলোও পালাতে পারে না সেখান থেকে। সহজ কথায় এই হলো কৃষ্ণগহ্বর। এখন এর আকার-আকৃতি, ধরন-ধারণ কিংবা এর ভেতরে যে স্থান-কালের রেখা উল্টে যায়, এরকম আরও অনেক বিষয়ের কথা আপনার মাথায় আসতেই পারে। ছোট্ট এ লেখায় আমরা ওসব জটিলতা এড়িয়ে যাই। (কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: কৃষ্ণগহ্বর: তলাবিহীন কুয়া)।
আমাদের মহাবিশ্বের সঙ্গে কৃষ্ণগহ্বরের আরও কিছু মিল আছে। যেমন আমরা যদি মহাবিশ্বের বিস্তৃতি বা প্রসারণ উল্টোভাবে হিসাব করি, অর্থাৎ প্রসারণের দিক উল্টে দিই, তাহলে দেখব এটি কোনো একটি বিন্দু বা পরম বিন্দু থেকে প্রসারিত হতে শুরু করেছে।
প্রশ্নটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা ভেবেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাটির কথা বলি। দৃশ্যমান মহাবিশ্বে আমরা যে পরিমাণ ভর ও শক্তি দেখি, সে পরিমাণ ভর-শক্তির একটি কৃষ্ণগহ্বরের আকার কতটা বড় হতে পারে, তা হিসাব করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। অবাক বিস্ময়ে তাঁরা আবিষ্কার করেছেন, এর আকার ঠিক আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সমান!
কৃষ্ণগহ্বরের ব্যসার্ধ এর ভরের সমানুপাতিক, তবে এর আয়তন ব্যাসার্ধের ঘনকের সমানুপাতিক। ফলে কৃষ্ণগহ্বরের ভর যত বেশি হয়, এর ঘনত্ব হয় তত কম। কাজেই মহাবিশ্বের দৃশ্যমান ব্যাসার্ধের সমান একটি কৃষ্ণগহ্বরের ঘনত্ব যতটা হওয়ার কথা, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ঘনত্বের গড় মান সেরকমই।
আমাদের মহাবিশ্বের সঙ্গে কৃষ্ণগহ্বরের আরও কিছু মিল আছে। যেমন আমরা যদি মহাবিশ্বের বিস্তৃতি বা প্রসারণ উল্টোভাবে হিসাব করি, অর্থাৎ প্রসারণের দিক উল্টে দিই, তাহলে দেখব এটি কোনো একটি বিন্দু বা পরম বিন্দু থেকে প্রসারিত হতে শুরু করেছে। মহাবিশ্বের এই পরম বিন্দুটি ঠিক কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রের বিন্দুটির মতোই। কৃষ্ণগহ্বরের সব ভর যেমন এই বিন্দুতে জমা হয়ে থাকে, মহাবিশ্বের সব ভরও তেমনি সেই একটি বিন্দুতে জমা হয়ে ছিল। এই বিন্দুটিকে—কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্র হোক বা মহাবিশ্বের সেই সূচনাবিন্দুটি—এর ঘনত্ব, তাপমাত্রা ও শক্তি এত বেশি যে পদার্থবিজ্ঞানের সব সূত্র এখানে ভেঙে পড়ে। সে জন্য এই বিন্দুটিকে বলা হয় পরম বিন্দু বা অনন্যতা, ইংরেজিতে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি। এই পরম বিন্দু বা অনন্যতা হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো প্রচণ্ডভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে চারদিকে, যাকে আমরা বলি বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ। গাণিতিকভাবে দেখা যায়, যেমনটা বললাম, কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরের পরম বিন্দুটির সঙ্গে মহাবিশ্বের সেই সূচনা বিন্দুর মিল প্রচুর।
নিজের ভরের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বা টানে সংকুচিত হয়েছে, চুপসে গেছে নিজের ওপরেই। ফলে এর ভেতরে স্থান-কাল এত বেশি বেঁকে গেছে যে জিনিসটা পরিণত হয়েছে তলাবিহীন কুয়ায়। এই কুয়ার মধ্যে কিছু পড়লে তা আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।
আবার কৃষ্ণগহ্বরের যেমন একটি ঘটনা দিগন্ত বা ইভেন্ট হরাইজন আছে, তেমনি মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও, আলোর সসীম গতির জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে আমরা আর কিছু দেখতে পাই না। কারণ, সেখান থেকে কোনো আলো এসে পৌঁছাতে পারেনি আমাদের কাছে—পারেনি, এবং পারে না। সেটাকে তাই বলা চলে কসমোলজিক্যাল ইভেন্ট হরাইজন বা মহাজাগতিক ঘটনা দিগন্ত।
তার ওপর কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টিকালে ‘শিশু মহাবিশ্বের’ জন্ম হতে পারে।
তাত্ত্বিকভাবে এসবই ঠিক আছে, তবে বাস্তবে এর কোনো প্রমাণ নেই। মহাবিশ্বের আরও অনেক রহস্যের মতোই, আমরা কোনো কৃষ্ণগহ্বর-বিশ্বের ভেতরে রয়েছি কি না, এটিও তাই আজও এক অমীমাংসিত রহস্য।