পৃথিবী কি ঘুরছে? কত বেগে? তাহলে আমরা বুঝতে পারি না কেন?

উত্তরটা সবারই জানা। পৃথিবী সত্যিই ঘুরছে—লাটিমের মতো বন বন করে। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর গতিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন—আহ্নিক গতি এবং বার্ষিক গতি। আহ্নিক গতি হলো পৃথিবীর নিজ অক্ষের ওপর ঘোরা। এই ঘূর্ণন গতি বিষুবরেখায় সবচেয়ে বেশি। মেরু অঞ্চলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে এ গতিও ক্রমেই কমতে থাকে। বিষুবরেখা বরাবর এই গতির পরিমাণ সেকেন্ডে প্রায় ৪৬০ মিটার। ঘণ্টায় প্রায় ১৬০০ কিলোমটার বা ১০০০ মাইল। অন্যদিকে মেরুবিন্দুতে এই ঘূর্ণন গতি শূন্য।

অন্যদিকে সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘূর্ণনকে বলা হয় বার্ষিক গতি। একপাক ঘুরে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে প্রায় ৩৬৫ দিন। আরও সঠিকভাবে বললে, ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা ৯ মিনিট। এই ঘূর্ণন গতি সেকেন্ডে গড়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার (প্রায় ১৮.৫ মাইল)। ঘন্টায় প্রায় ১০৭ হাজার কিলোমিটার (বা ৬৭ হাজার মাইল)। এই গতি কি খুব বেশি?

অন্য কিছু গতির সঙ্গে তুলনা করলে, একে ধীর গতিরই বলা চলে। যেমন পৃথিবী থেকে মঙ্গল গ্রহে পাঠানো মানুষের তৈরি নভোযান পাথফাইন্ডারের গতি ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১২০ হাজার কিলোমিটার (বা প্রায় ৭৫ হাজার মাইল)। আবার কিছু গ্রহের চেয়েও এই গতি কম। যেমন বুধ গ্রহ সেকেন্ডে ৪৭ কিলোমিটার বেগে সূর্যের চারদিকে পাক খাচ্ছে। অবশ্য পৃথিবীর চেয়ে ধীর গতির গ্রহও আছে এ সৌরজগতে। যেমন নেপচুনের গতি সেকেন্ডে মাত্র ৫.৪ কিলোমিটার।

আরও পড়ুন
আমাদের গ্যালাক্সিও কিন্তু বসে নেই। সেও অক্লান্ত ছুটে চলেছে ইন্টারগ্যালাকটিক স্পেসের ভেতর দিয়ে। মিল্কিওয়ে আসলে পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি গ্যালাক্সি (প্রায় ৬০টি) নিয়ে গড়ে ওঠা একটা ক্লাস্টার বা গ্যালাক্সিগুচ্ছের সদস্য।
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি

স্কুল-কলেজের বইতে সাধারণত পৃথিবীর এই দুটো গতির কথা বলা হয়। কিন্তু এই দুই গতি বাইরেও পৃথিবীর আরও কিছু গতি রয়েছে। আসলে মহাবিশ্বের কোনোকিছুই স্থির নয়, সবকিছুই প্রতি মুহূর্তে ছুটে চলছে। আমাদের সৌরজগতের কর্তা সূর্যও তার পুরো পরিবারসহ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সেই গতির পরিমাণও কম নয়। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, এর পরিমাণ প্রতি সেকেন্ডে গড়ে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার (প্রায় ১৪৩ মাইল)। অর্থাৎ ঘণ্টায় গড়ে প্রায় ৮২৮ হাজার কিলোমিটার (বা ৫১৫ হাজার মাইল)।

অবশ্য এই গতিতে গ্যালাক্সিকেন্দ্র একপাক ঘুরে আসতে সূর্যের সময় লাগে গড়ে প্রায় ২৩০ মিলিয়ন বছর (২২০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন বছর)। একে বলা হয় গ্যালাকটিক ইয়ার। তার মানে, সৌরজগৎ তথা পৃথিবী এখন মিল্কিওয়ের যে জায়গায় আছে, এর আগের বার এখানে থাকার সময় পৃথিবীতে চলছিল ডাইনোসরদের রাজত্ব।

আবার আমাদের মিল্কিওয়ে কত বড়, তা হয়তো এ তথ্য থেকে কিছুটা আঁচ করতে পারবেন। জানেন হয়তো, সূর্যের বয়স এখন প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন বছর। তার মানে, জন্মের পর থেকে সূর্য এ পর্যন্ত নিজ গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে মাত্র ১৫ থেকে ২০ পাক ঘুরতে পেরেছে।

আমাদের গ্যালাক্সিও কিন্তু বসে নেই। সেও অক্লান্ত ছুটে চলেছে ইন্টারগ্যালাকটিক স্পেসের ভেতর দিয়ে। মিল্কিওয়ে আসলে পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি গ্যালাক্সি (প্রায় ৬০টি) নিয়ে গড়ে ওঠা একটা ক্লাস্টার বা গ্যালাক্সিগুচ্ছের সদস্য। এসব গ্যালাক্সিগুচ্ছকে বলা হয় লোকাল গ্রুপ। এদের মধ্যে মিল্কিওয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যালাক্সি বলে ধারণা করা হয়। এই লোকাল গ্রুপের কেন্দ্রের দিকে সেকেন্ডে প্রায় ৪০ কিলোমিটার বা ২৫ মাইল বেগে ছুটে যাচ্ছে মিল্কিওয়ে।

আরও পড়ুন
স্থানের এই অঞ্চলের নাম দেওয়া হয়েছে গ্রেট অ্যাট্রাকটর। এই কাঠামোটি প্রায় ১৫০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এর ভর আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় ১০০ কোয়াড্রিলন গুণ বেশি।

শুধু মিল্কিওয়েই নয়, লোকাল গ্রুপ নিজেও ছুটে চলছে ৪৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের ভার্গো ক্লাস্টারের দিকে। আর লোকাল গ্রুপের ছুটে চলার এই গতি সেকেন্ডে প্রায় ৬০৩ কিলোমিটার বা ৩৭৫ মাইল। এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। বিজ্ঞানীদের আরেক হিসেবে, মিল্কিওয়েসহ লোকাল গ্রুপ প্রতি সেকেন্ডে ছুটে চলছে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার বেগে। কিন্তু লোকাল গ্রুপ এই গতিতে কোথায় ছুটে চলছে?

বিজ্ঞানীদের মতে, আরও বড় ও আরও ভারী একটা কাঠামোর দিকে। স্থানের এই অঞ্চলের নাম দেওয়া হয়েছে গ্রেট অ্যাট্রাকটর। এই কাঠামোটি প্রায় ১৫০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এর ভর আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় ১০০ কোয়াড্রিলন গুণ বেশি। আর কাঠামোটি ছড়িয়ে আছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ জুড়ে। এটি দৃশ্যমান এবং ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তু দিয়ে গঠিত বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।

এ সবগুলো গতি এবং গতির দিক একত্রে হিসেব করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মহাকাশের একটি নির্দিষ্ট দিকে আমাদের পৃথিবীর গতি  সেকেন্ডে গড়ে প্রায় ৩৬৮ কিলোমিটার। সারা বছরে এই গতির মান সেকেন্ডে প্রায় ৩০ কিলোমিটার কম-বেশি হতে পারে।

আরও পড়ুন

পৃথিবীর এই গতি আমরা বুঝতে পারি না কেন

ধরা যাক, আপনি একটি বাসে বা ট্রেনে চড়ে কোথাও যাচ্ছেন। বাস বা ট্রেনটির গতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। মানে প্রতি সেকেন্ডে যানটি পেরিয়ে যাচ্ছে ১ কিলোমিটার পথ। বিপরীত দিক থেকে অন্য একটা বাস যদি একই গতিতে আপনার বাসের পাশ দিয়ে চলে যায়, তাহলে মনে হবে সেটি সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে গেল। মনে হবে যেন উল্টো পাশের বাসটির গতি আপনার বাসের চেয়ে বেশি। ট্রেনের ক্ষেত্রেও একই কথা মনে হবে। তার কারণ, বাস দুটি পরস্পরকে যে বেগে পাশ কাটিয়ে যাবে, তার পরিমাণ দাঁড়াবে দুজনের গতির যোগফল। অর্থাৎ ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। সে কারণেই মনে হয়, বিপরীত দিক থেকে আসা বাসটা সাঁই করে বেরিয়ে গেল।

মহাকর্ষ বলের কারণে আমরা সবাই পৃথিবীতে আটকে আছি। আর আপনাকে-আমাকে-সব্বাইকে পিঠে নিয়ে পৃথিবী মহাবিশ্ব মহাকশে সেকেন্ডে ৩৬৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিচ্ছে।

এবার ধরুন, আরেকটা বাস বিপরীত দিক থেকে নয়, একই দিক থেকে আসছে। কিংবা ধরা যাক, দুটোই একদম পাশাপাশি থেকে একই পথ ধরে একই গতিতে চলতে লাগল। তাহলে বাস দুটোকে পরস্পরের সাপেক্ষে মনে হবে স্থির। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেউ যদি বাস দুটো দেখে, তার কাছে দুটোই গতিশীল মনে হবে। আসলে বাসের যাত্রীদের কাছে বাস দুটো স্থির মনে হওয়ার কারণ দুজনের একই গতি। এবং একই দিক। সে কারণেই দুটো গতিই কাটাকাটি হয়ে যাবে। মানে এখানে হবে গতির বিয়োগফল—পরস্পরের সাপেক্ষে শূন্য গতি।

জটিলতা বাদ দিয়ে সহজভাবে বলতে গেলে, পৃথিবীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। অর্থাৎ মহাকর্ষ বলের কারণে আমরা সবাই পৃথিবীতে আটকে আছি। আর আপনাকে-আমাকে-সব্বাইকে পিঠে নিয়ে পৃথিবী মহাবিশ্ব মহাকশে সেকেন্ডে ৩৬৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিচ্ছে। আপনার-আমার গতিও আসলে একই। মানে ওই সেকেন্ডে ৩৬৮ কিমি। সে কারণেই পৃথিবীর এই বিপুল গতির কিচ্ছুটি আমরা টের পাই না।

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান

বিগ থিংক

নাসা ডট কম

উইকপিডিয়া

আরও পড়ুন