মঙ্গলে আগের চেয়ে বেশি অক্সিজেন তৈরি করছে নাসার পাঠানো যন্ত্র মক্সি। সম্প্রতি সায়েন্স এডভান্স জার্নালের একটি রিপোর্টে জানানো হয়, এখন ঘন্টায় প্রায় ৬ গ্রাম অক্সিজেন উৎপাদন করছে মক্সি (দ্য মার্স অক্সিজেন ইন-সিটু রিসোর্স ইউটিলাইজেশন এক্সপেরিমেন্ট)।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পারসিভারেন্স রোভারে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মঙ্গলে পাঠানো হয়েছিল মক্সিকে। গত বছর ২০ এপ্রিলে মক্সি প্রথম অক্সিজেন উৎপাদন করেছিল মঙ্গলে। তখন যন্ত্রটির ৫ গ্রাম অক্সিজেন উৎপাদনের কথা জানিয়েছিল নাসা। অর্থাৎ, ঘন্টায় ৫ গ্রাম অক্সিজেন উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল যন্ত্রটির। কিন্তু এখন ঘন্টায় প্রায় ৬ গ্রাম অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে মক্সি। পৃথিবীতে একটি গাছ ঘন্টায় এই পরিমাণ অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে। নাসা অবশ্য মক্সি থেকে ঘন্টায় ১০ গ্রাম অক্সিজেন উৎপাদনের আশা করছে ভবিষ্যতে।
ঘন্টায় ৬ গ্রাম অক্সিজেন উৎপাদন কম কথা নয়। এই পরিমাণ অক্সিজেন ব্যবহার করে একজন নভোচারী ১২ মিনিট শ্বাস নিতে পারবেন মঙ্গলের বুকে। ভবিষ্যতে, মক্সির মতো আরও কয়েকটি যন্ত্র মঙ্গলে পাঠানো হলে, নভোচারীদের অক্সিজেনের অভাব পূরণ করা সম্ভব হবে। নাসা জানিয়েছে, তারা কমপক্ষে ১০০টি যন্ত্র মঙ্গলে পাঠাবে ভবিষ্যতে। অবশ্য, মঙ্গলে নভোচারী যাওয়ার আগেই এই যন্ত্রগুলো মঙ্গলে পাঠানো হবে।
কিন্তু মঙ্গলে অক্সিজেন উৎপাদন করা এতটা জরুরী কেন? এর বেশ কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, মানুষ ভবিষ্যতে মঙ্গলে পৌঁছুলে এই অক্সিজেন ব্যবহার করতে পারবে। তখন পৃথিবী থেকে অতিরিক্তি অক্সিজেন টেনে নিয়ে যাওয়ার দরকার হবে না।
দ্বিতীয়ত, রকেটের জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করা যাবে এই অক্সিজেন। এখন পর্যন্ত আমাদের হাতে যে প্রযুক্তি আছে, সেগুলো ব্যবহার করে শুধু মঙ্গলে পৌঁছুনো যাবে। সেখান থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসা সম্ভব নয়। সুতারাং, ভবিষ্যতে এই অক্সিজেন জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করে মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসা সম্ভব হবে।
তৃতীয়ত, ভবিষ্যতে মঙ্গল থেকে জ্বালানী নিয়ে আরও দূরের কোনো গ্রহে যাওয়াও সম্ভব হবে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে বলাই যায়, মঙ্গলে অক্সিজেন উৎপাদন নতুন একটি মাইলফলক ছিল। সেই মাইলফলকের আরও একধাপ এগিয়ে গেলাম আমরা।
এবার আসি, মঙ্গলে অক্সিজেন উৎপাদন না হলে কী সমস্যা হত? এই ব্যাপারে কিছুটা ধারণা দিয়েছেন নাসার জেট প্রোপালেশনের বিজ্ঞানী মাইকেল হেক্ট। একটি রকেটের জ্বালানীর জন্য রকেটের ওজনের চেয়ে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকতে হয়। সেই হিসাবে, ভবিষ্যতে যদি চারজন নভোচারী মঙ্গলে যেতে চায়, তাহলে তাঁদের মোট ৭ মেট্রিক টন জ্বালানী এবং ২৫ মেট্রিক টন অক্সিজেনের প্রয়োজন হবে। এছাড়াও মঙ্গলে থাকাকালেও অক্সিজেনের প্রয়োজন হবে।
সেক্ষেত্রে চারজন নভোচারী এক বছরের জন্য মঙ্গলে অবস্থান করলে তাঁদের জন্য দরকার হবে এক মেট্রিক টন অক্সিজেন। তাছাড়া পৃথিবী থেকে ২৫ মেট্রিক টন অক্সিজেন নিয়ে মঙ্গলে যাওয়াটাও বেশ কঠিন ও ব্যয়বহুল। সুতরাং মক্সিকে ভবিষ্যতে আরও উন্নত করে এক মেট্রিক টন বা তার চেয়ে বেশি অক্সিজেন উৎপাদন সম্ভব হলে ওই অক্সিজেন পৃথিবী থেকে আর বয়ে নিতে হবে না। এতে মঙ্গলে যাওয়ার খরচও কমিয়ে আনা সম্ভব।
মঙ্গলের পৃষ্ঠে কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে অক্সিজেন উৎপাদন করতে প্রায় ৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (প্রায় ১৪৭২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ মক্সি যন্ত্রটির এই পরিমাণ তাপমাত্রা সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে। এই যন্ত্রে থ্রিডি প্রিন্টেট নিকেলের সংকর ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে উচ্চ তাপমাত্রায় মক্সির কোন সমস্যা হয় না। যন্ত্রটি ডিজাইন করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির গবেষণাগারে।
কিন্তু মক্সি মঙ্গল গ্রহে অক্সিজেন উৎপাদন করে কীভাবে? মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের প্রায় ৯৬ শতাংশ জুড়ে আছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড। তাই অক্সিজেন তৈরি করতে এই কার্বন-ডাই-অক্সাইডকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। এই যৌগটিতে থাকে একটি কার্বন ও দুটি অক্সিজেন পরমাণু। মক্সি (MOXIE) সেই CO2 থেকে অক্সিজেন আলাদা করে বাকি কার্বন মনোক্সাইড (CO) মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয়। এভাবেই বর্তমানে ঘন্টায় ৬ গ্রাম অক্সিজেন উৎপাদন করে চলেছে রোভার মক্সি।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা
সূত্র: সায়েন্স ফোকাস