ফায়েটনের গল্প

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর সম্পর্ক। পৃথিবী ও আকাশ নামের এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…

প্রাচীন গ্রিকদের ধারণা ছিল, বিশ্ব অত্যন্ত ছোট। আকাশ পৃথিবীর খুব কাছে। বিশ্ব নিয়ে তারা নিচের গল্পটা চালু করে।

দেবতারা হলেন বিশ্বের শাসক। এঁদের পিতা ও অধিকর্তা হলেন বজ্রধারী জিউস, তিনি বিদ্যুৎ পাঠান পৃথিবীতে। সূর্যদেবকে গ্রিকরা হিলিয়স বলে ডাকত (রোমানরা বলত অ্যাপোলো)। প্রতিদিন সকালে পুবদিকে হিলিয়স তাঁর হৃষ্টপুষ্ট, জিরিয়ে-নেওয়া ফিটফাট সূর্যঘোড়ায় চেপে দেখা দেন, ঘোড়াগুলো রাত্রি কাটায় মাটির নিচে। সূর্যঘোড়ার দীপ্ত রথে হিলিয়স আকাশপথে প্রতিদিন তাঁর যাত্রা সাঙ্গ করে সন্ধেবেলায় চলে যান মাটির নিচে, ঘোড়াগুলো যাতে জিরোতে পারে।

বাপের রথে আকাশ ভ্রমণের বেজায় শখ নবীন ফায়েটনের। অনেক দিন হিলিয়স মত দেননি, পরে কিন্তু রাজি হলেন। উত্তেজিত ফায়েটন ঝকঝকে রথে উঠে ঘোড়ার লাগাম টেনে আকাশে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে রওনা হলেন।

রাক্ষস, অর্থাৎ নক্ষত্রমণ্ডল পরিবেষ্টিত বেপরোয়া নবীন ফায়েটন সূর্যরথ চালাচ্ছেন আকাশে
পিথাগোরাসের দুই শ বছর পর আরেকজন গ্রিক পণ্ডিত—অ্যারিস্টটল—চাঁদ, শুক্র, মঙ্গল এবং অন্যান্য গ্রহের গতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তাঁর ধারণা ছিল, সূর্য, গ্রহ এবং নক্ষত্রগুলো পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু তারা চলে কীসে, কীভাবে থাকে শূন্যে, এ নিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন
আরও পড়ুন

বৃশ্চিক নামের নক্ষত্রগোষ্ঠী পেরিয়ে যেতে হলো ফায়েটনকে। বৃশ্চিক রাক্ষসটির চেহারা এত ভয়ঙ্কর যে ঘোড়াগুলো ভয় পেয়ে পথ ছেড়ে দৌড়াল। আগুনের মতো তেজী ঘোড়াগুলোকে সামলাবার শক্তি ছিল না কিশোরের, ভীষণ একটি দুর্ঘটনা ঘটল; সূর্যরথ ঠিক পথ ছেড়ে চলে এল পৃথিবীর কাছে। রথের সবদিক থেকে ঝকঝকে তপ্ত রশ্মি ঝলকে ঝলকে বেরিয়ে পুড়িয়ে দিল পৃথিবীর সবকিছু। ধূলিসাৎ হয়ে গেল শহর-গ্রাম, বনে আর মাঠ-ঘাসে আগুন ধরে গেল...

জ্বলন্ত ঘরবাড়ি থেকে আতঙ্কে লোকজন পালিয়ে ভীষণ বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রার্থনা জানাল জিউসকে, মহাদিদেবকে। কিন্তু অগ্নিদীপ্ত রথ থামানো যায় কী করে? ক্ষিপ্রগতি সূর্যঘোড়াগুলোকে ধরবে কে?

ফায়েটনের দিকে বজ্র নিক্ষেপ করলেন জিউস, রথ থেকে পড়ে গেল মৃত কিশোর। ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ঘোড়াগুলো। দৌড়ে গিয়ে হিলিয়স রথকে ঠিক পথে নিয়ে এলেন তিনি। থেমে গেল পৃথিবীর অগ্নিকাণ্ড।

ভয় কাটিয়ে লোকে যখন তাকাল আকাশের দিকে, তখন সূর্য নিজের জায়গায় এসেছেন। প্রাণরক্ষা করেছেন জিউস, তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে পশুমেধের তাড়াহুড়ো পড়ে গেল...

এমনকি সুদূর সেই কালেও সবাই এসব গল্প বিশ্বাস করত না।

অ্যারিস্টটলীয় দর্শন নিয়ে হাসাহাসি করা অন্যায়—সে কালে এর উপকারিতা ছিল—বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে দেবগণ বিতাড়িত হলেন এর ফলে, ধ্বংস হলো ধর্মীয় কুসংস্কার
আরও পড়ুন

পিথাগোরাস নামে এক মহাপণ্ডিত ছিলেন আড়াই হাজার বছর আগে। তিনি বলেন, পৃথিবী বলের মতো, তার ওপর-নিচ নেই।

পিথাগোরাসের দুই শ বছর পর আরেকজন গ্রিক পণ্ডিত—অ্যারিস্টটল—চাঁদ, শুক্র, মঙ্গল এবং অন্যান্য গ্রহের গতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তাঁর ধারণা ছিল, সূর্য, গ্রহ এবং নক্ষত্রগুলো পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু তারা চলে কীসে, কীভাবে থাকে শূন্যে, এ নিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন।

অনেক ভেবেচিন্তে একটা সমাধানে এলেন অ্যারিস্টটল: পৃথিবীর ওপরে আটটি কঠিন ও স্বচ্ছ মণ্ডল আছে। সবচেয়ে কাছেরটি হলো চন্দ্রমণ্ডল—এটি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, চাঁদ এটিতে নিবদ্ধ। এরপর বুধ, তারপর শুত্রু। এদের পর অন্যান্য মণ্ডল বা সূর্য, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনির খ-গোলক। তাঁর ধারণায় তারকাগুলো অষ্টম মণ্ডলে নিবদ্ধ।

অ্যারিস্টটলীয় দর্শন নামে পরিচিত এই তত্ত্ব উদ্ভাবনের পর অ্যারিস্টটল ভাবলেন এই আটটি খ-গোলক ঘোরে কীসে? মাউন্ট অলিম্পাসবাসী সূর্যদেবতা হিলিয়স প্রমুখ দেবতাদের বিষয়ে অজ্ঞ পুরোহিতদের নানা কাহিনিতে বিশ্বাস করতেন না এ মহাপণ্ডিত।

পালতোলা জাহাজ চালায় বায়ুশক্তি; মানুষ চলে নিজের পেশী বলে; গাড়ি টানে ঘোড়া, ঘোড়াও চলে পেশী বলে। অ্যারিস্টটল ঠিক করলেন, নবম একটি মণ্ডল নিশ্চয়ই আছে, অন্য লোকগুলোকে চালাবার মোটর গোছের একটি মণ্ডল। এর নাম তিনি দিলেন ‘প্রাথমিক চালিকা শক্তি’।

অ্যারিস্টটলীয় দর্শন নিয়ে হাসাহাসি করা অন্যায়—সে কালে এর উপকারিতা ছিল—বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে দেবগণ বিতাড়িত হলেন এর ফলে, ধ্বংস হলো ধর্মীয় কুসংস্কার।

ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হলো না পুরোহিতদের। অ্যারিস্টটলকে সক্রোধে আক্রমণ করল তারা।

‘আগুনের মতো তেজী ঘোড়াগুলোকে যে হিলিয়স চালান আকাশপথে, তাঁর স্বর্ণরথ হলো সূর্য—এ কথা অ্যারিস্টটল বলে না, বলে সূর্য হলো একটা জ্যোতিষ্ক—আপনা থেকে চক্কর দেয় পৃথিবীকে। অ্যারিস্টটল ভগবানে বিশ্বাস করে না, ও হলো দেবতাদের শত্রু, ওকে শাস্তি দেওয়া অবশ্যকর্তব্য।’

তাঁদের তাড়নায় বৃদ্ধ বয়সে অ্যারিস্টটল স্বদেশ ছাড়তে বাধ্য হন, তাঁর মৃত্যু ঘটে বিদেশে।

(চলবে…)

মূল: আলেকজান্ডার ভলকভ, অনুবাদ: সমর সেন

* পাঠকের সুবিধার্থে বইয়ের মূলভাব ঠিক রেখে বানানরীতির কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন