অনিক সবে মাধ্যমিক স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। একদিন ক্লাশে মহাকাশের মজার কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেন এক শিক্ষক। সেদিন রাতে সে মুগ্ধ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা দেখছিল। তার চোখে অবাক বিস্ময়—কত তারা সেখানে রয়েছে। হঠাৎ তার পাশে এসে হাজির হলো তার দাদু। অনিক তার দাদুকে জিজ্ঞাস করলো, ‘দাদু মঙ্গল গ্রহ কোনটি?’
দাদু তাকে মঙ্গল গ্রহটি দেখালে সে বিস্ময়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘দাদু, আমরা কি একদিন ওখানে থাকতে পারবো?’
দাদু মৃদু হাসলেন। ‘হয়তো পারবো। কিন্তু তার জন্য অনেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চমকপ্রদ সমাধান লাগবে। একে তো মরুভূমির চেয়েও শুষ্ক, তার ওপর বাতাসে অক্সিজেন নেই, আর তাপমাত্রা—মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস!’
‘তাহলে কি কখনো সম্ভব না?’
দাদু এবার এক গাল হেসে বললেন, ‘অসম্ভবকে সম্ভব করার মধ্যে দিয়েই তো আজকের মানব সভ্যতা এ পর্যায়ে এসেছে।’
এই কথোপকথন যেন এক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। আজ বিজ্ঞানীরা যে ধারণাকে বাস্তবতার পথে এগিয়ে নিচ্ছেন, তার নাম টেরাফরমিং (Terraforming)—মানে একটি গ্রহকে মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত করে তোলার প্রযুক্তি।
অনেক দিন ধরেই এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মঙ্গল গ্রহকেও মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তোলার চিন্তাভাবনা করছেন বিজ্ঞানীরা। এই প্রক্রিয়ায় কোনো গ্রহের বায়ুমণ্ডল, তাপমাত্রা, পানির পরিমাণ এবং অন্যান্য পরিবেশগত উপাদানগুলি এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়, যাতে সেখানে পৃথিবীর মতো জীবন টিকে থাকতে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, টেরাফরমিং কি শুধুই বিজ্ঞানীদের স্বপ্ন?
এ ব্যাপারে নাসার প্রাক্তন প্রধান বিজ্ঞানী জেমস গ্রিন বলেছেন, ‘আমাদের প্রযুক্তি দ্রুত উন্নতি করছে। আমি বিশ্বাস করি, আগামী ১০০ বছরের মধ্যে আমরা মঙ্গলের আকাশে নীল আকাশ দেখতে পারবো।’
টেরাফরমিংয়ের ধারণা চমকপ্রদ হলেও সেটি বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে বিজ্ঞানীদের সামনে। প্রথম চ্যালেঞ্জটা হলো এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। তাই একে বাস্তবে পরিণত করতে লেগে যেতে পারে কয়েক শতাব্দী।
আর প্রখ্যাত বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক আর্থার সি ক্লার্ক একবার বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে মানুষ শুধু পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং নতুন নতুন গ্রহের বুকে নতুন ঘর তৈরি করবে।’
বাস্তবে কাজটা কীভাবে করা সম্ভব?
বিজ্ঞানীরা বলেন, মঙ্গলগ্রহ বা অন্য কোনো গ্রহকে মানুষের বসবাস উপযোগী করতে কয়েকটি ধাপে টেরাফরমিং করা সম্ভব। সেগুলো হলো: প্রথমেই গ্রহটির বায়ুমণ্ডল তৈরি করা। মঙ্গলের মতো গ্রহগুলোর বায়ুমণ্ডল বেশ পাতলা। আবার সেখানে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণও প্রচুর। সেজন্য বিজ্ঞানীরা প্রস্তাব করেছেন, গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি করে গ্রহটির তাপমাত্রা বাড়ানো যেতে পারে। কিছু বিজ্ঞানী মঙ্গল গ্রহের চারিদিকে বিশালাকার কৃত্রিম আয়না ব্যবহার করে সূর্যের তাপ মঙ্গলের মাটিতে প্রতিফলিত করার চিন্তাও করেছেন।
শুধু তাপ বাড়ালেই হবে না, সে তাপ নিয়ন্ত্রণও করতে হবে, যাতে গ্রহটি ধীরে ধীরে বসবাসের উপযোগী হয়ে ওঠে। সে কাজটি করা হবে দ্বিতীয় ধাপে। যেমন বর্তমান মঙ্গলের তাপমাত্রা মানব বসবাসের উপযোগী নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রহের মেরু অঞ্চলে থাকা বরফ গলিয়ে জলীয় বাষ্প তৈরি করা যেতে পারে, যা গ্রিনহাউস এফেক্ট তৈরি করবে এবং উষ্ণতা বাড়াবে।
এরপরের ধাপে তৈরি করা হবে জীবন উপযোগী পরিবেশ। সেজন্য একটা গ্রহের মাটির গঠন পরিবর্তন করে বা জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে গাছপালা তৈরি করা হতে পারে। সেগুলো এমন ধরনের গাছ হবে, যা কম অক্সিজেনেও বাঁচতে পারবে। পাশাপাশি গাছগুলো ধীরে ধীরে পরিবেশে অক্সিজেন তৈরি করবে।
চতুর্থ ধাপে বিজ্ঞানীরা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা বংশাণু প্রকৌশল ব্যবহার করে এমন জীবাণু ও গাছপালা তৈরি করার কথা ভাবছেন, যা কঠোর পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারবে এবং অক্সিজেন উৎপন্ন করতে সাহায্য করবে। আর সব শেষ ধাপে গ্রহটির ভূগর্ভস্থ বসবাসের পরিকল্পনা করছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু ভূপৃষ্ঠ নয় কেন? তার কারণ মঙ্গলের পৃষ্ঠে ক্ষতিকর রেডিয়েশন এবং কম বায়ুমণ্ডল। এসব কারণে প্রথমদিকে মানুষের জন্য ভূগর্ভস্থ শহর তৈরি করা হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদী টেরাফরমিং প্রচেষ্টার অংশ হতে পারে।
মঙ্গল ছাড়াও বিজ্ঞানীরা অন্যান্য গ্রহ ও উপগ্রহের টেরাফরমিং সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছেন। যেমন শুক্রগ্রহ, বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা এবং শনির উপগ্রহ টাইটান। পৃথিবী থেকে হিসেব করলে মঙ্গলের চেয়ে শুক্র গ্রহ আমাদের অনেক কাছে। তবে শুক্র গ্রহে ঘন ও বিষাক্ত বায়ুমণ্ডল টেরাফরমিংয়ের জন্য বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা বরফে ঢাকা। কিন্তু এ উপগ্রহে ভূগর্ভস্থ পানি থাকতে পারে, যা জীবনের সম্ভাবনা তৈরি করে। আর শনির উপগ্রহ টাইটানে রয়েছে ঘন বায়ুমণ্ডল। প্রচুর মিথেনও রয়েছে এখানে। এই মিথেন শক্তির উৎস হতে পারে।
এই কথোপকথন যেন এক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। আজ বিজ্ঞানীরা যে ধারণাকে বাস্তবতার পথে এগিয়ে নিচ্ছেন, তার নাম টেরাফরমিং (Terraforming)—মানে একটি গ্রহকে মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত করে তোলার প্রযুক্তি।
তবে টেরাফরমিংয়ের ধারণা চমকপ্রদ হলেও সেটি বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে বিজ্ঞানীদের সামনে। প্রথম চ্যালেঞ্জটা হলো এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। তাই একে বাস্তবে পরিণত করতে লেগে যেতে পারে কয়েক শতাব্দী। আবার অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, আমরা কি আদৌ অন্য গ্রহের প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিবর্তন করার অধিকার রাখি? অন্যদিকে বিশাল খরচ এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প হওয়ায় এটি আদৌ কতটা সম্ভবপর, তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। মহাকাশের কম-আকর্ষণ শক্তি (Low gravity) মানুষের শারীরিক গঠনের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, তাও এখনো নিশ্চিত নয়।
তাই আবারও প্রশ্ন আসে: তাহলে কি টেরাফরমিং শুধুই বিজ্ঞানের কল্পনা? নাকি সত্যিই একদিন আমরা অন্য গ্রহে বসতি গড়তে পারবো?
এসব প্রশ্ন একপাশে সরিয়ে রেখে বহুদিন ধরেই মঙ্গলগ্রহে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করছেন টেসলার প্রতিষ্ঠাতা এলন মাস্ক। তাঁর মতে, ‘আমাদের যদি বহুগ্রহবাসী হতে হয়, তাহলে টেরাফরমিংয়ের কোনো বিকল্প নেই।’
তবে বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে, বিজ্ঞানীরা এখনও টেরাফরমিংকে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প হিসেবে দেখছেন।
অনিক দাদুর কাছ থেকে নতুন গল্প শুনে ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু স্বপ্নে সে নিজেকে দেখলো মঙ্গলের লাল মাটিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে, নীল আকাশের নিচে। হয়তো একদিন এই কল্পনা সত্যি হবে!
আসলে টেরাফরমিং নিছক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নয়, বরং ভবিষ্যতে মানব সভ্যতার এক চরম বাস্তবতা হতে পারে। তবে সেটি কতদূর সম্ভব, তা নির্ভর করবে প্রযুক্তির উন্নয়ন, মানবজাতির সংকল্প এবং প্রকৃতির সাথে আমাদের সম্পর্কের উপর।