মহাজাগতিক রশ্মির মহারহস্য

পৃথিবীর বাইরে, মহাকাশের গভীর থেকে ছুটে আসে এসব কণা। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন মহাজাগতিক রশ্মি। সেই রশ্মি এখন হয়ে উঠেছে এক মহারহস্য। জিনিসগুলোর উৎস কোথায়? কোত্থেকে আসছে এসব কণা?

মহাজাগতিক রশ্মি বলতে সাধারণত মহাকাশ থেকে আসা চার্জিত কণাকে বোঝায়

কোনো শব্দের সঙ্গে ‘মহা’ যুক্ত থাকলে মনে হয়, একটা বিশাল কিছু। হুলুস্থুল কোনো ব্যাপার। মহাজাগতিক রশ্মির বিষয়টাও অনেকটা সে রকম। এ মহাঘটনা ১০০ বছরের বেশি পুরোনো।

মহাজাগতিক রশ্মির ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রান্সিস হেসের হাত ধরে। এর আগে অনেক বছর ধরেই বায়ুমণ্ডলে আয়নিত বিকিরণের মাত্রা নিয়ে বেশ হিমশিম খাচ্ছিলেন বিজ্ঞানীরা। সে যুগে অনেকের ধারণা ছিল, পৃথিবীর যত ওপরে ওঠা যাবে, এই বিকিরণের মাত্রা তত কমতে থাকবে। কারণ, তখন বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস ছিল, তেজস্ক্রিয় বিকিরণের উৎস পৃথিবী। এ নিয়ে একটা সূত্র দাঁড় করিয়ে ফেললেন বিজ্ঞানীরা। সেটা অনেকটা এ রকম—কোনো জায়গার তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ হবে দূরত্বের বর্গফলের ব্যস্তানুপাতিক, অর্থাৎ কোনো জায়গায় তেজস্ক্রিয় বস্তু রেখে তার ১ মিটার দূরে ডিটেক্টর রাখলে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া যাবে, দুই মিটার দূরে রেখে মাপলে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ হবে চার ভাগের এক ভাগ।

ব্যাপারটা সত্যি কি না, সেটাই পরীক্ষা করতে দেখতে চাইলেন তরুণ বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস হেস। সে জন্য বেলুনে চেপে আকাশে উড়লেন তিনি। একবার নয়, একাধিকবার মহাশূন্যে বেলুনে ভেসে বায়ুমণ্ডলের ওপরের অংশে গবেষণা চালাতে লাগলেন। ১৯১১ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত ইলেকট্রোস্কোপ ব্যবহার করে পৃথিবীর ওপর আয়নিত বিকিরণ মাপেন হেস। কিন্তু তাঁর পরিমাপে সে কালের বিজ্ঞানীদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। দেখা গেল, প্রায় ১৭ হাজার ফুট বা প্রায় ৩ মাইল উচ্চতায় ভূপৃষ্ঠের তুলনায় অন্তত দ্বিগুণ বিকিরণ রয়েছে। কাজেই এ বিকিরণ অবশ্যই পৃথিবী থেকে আসছে না। তাহলে কোথা থেকে আসছে?

এক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রে ব্যাখ্যাটা দিলেন হেস। তিনি ঘোষণা করেন, ‘আকাশের ওপর থেকে আমাদের বায়ুমণ্ডলে খুবই উচ্চ শক্তির বিকিরণ ঢুকছে।’

১৯১২ সালে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণার পর বেলুন থেকে নামছেন বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রান্সিস হেস

এরপর একবার সূর্যগ্রহণের সময়ও বেলুনে চেপে আকাশে ওঠেন তিনি। ইলেকট্রোস্কোপে বিকিরণ মাপেন। হিসাবমতো, সূর্যগ্রহণের সময় সূর্য থেকে আসা বিকিরণ চাঁদে বাধা পাওয়ার কথা। কাজেই এর উৎস যদি সূর্য হয়ে থাকে, তাহলে বিকিরণের মাত্রা কম হওয়ার কথা। কিন্তু বিকিরণের মাত্রা মেপে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলেন হেস। পরিমাপে বিকিরণের তীব্রতার কোনো হেরফের পাওয়া গেল না। কাজেই এ বিকিরণ অবশ্যই সূর্য থেকে আসছে না। তাহলে কোথা থেকে আসছে?

যৌক্তিকভাবে হেস সিদ্ধান্ত এলেন, এসব বিকিরণ যদি সূর্য থেকে না এসে থাকে, তাহলে অবশ্যই বাইরের গভীর মহাকাশ থেকে আসছে। ১৯১৩ সালে এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে হেস এই ব্যাখ্যা প্রকাশ করলেন। অচিরেই তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বিজ্ঞানীরা। এর প্রায় এক দশক পর এ বিষয়ে গবেষণা চালান মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট মিলিকান। তিনিও একই ফল পেলেন। এই মিলিকানই এ বিকিরণের নামকরণ করেন কসমিক রে। যাহোক, এই গবেষণার কারণে ১৯৩৬ সালে নোবেল পুরস্কার পান ভিক্টর ফ্রান্সিস হেস।

মানবদেহের জন্য বেশি বিপজ্জনক কণা হলো প্রোটন বা পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের মতো চার্জিত কণা। উচ্চশক্তির প্রোটন আমাদের দেহে গুরুতর ক্ষতি করতে পারে। সেটা থেকে বাঁচতে মহাকাশে যেতে বিশেষ ধরনের পোশাক পরেন নভোচারীরা।

গত কয়েক দশকে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে অসংখ্য গবেষণা হয়েছে। শুধু বেলুন উড়িয়ে নয়, ভূপৃষ্ঠে ডিটেক্টর বসিয়ে কিংবা মহাকাশে একাধিক স্যাটেলাইট পাঠিয়েও এ রশ্মি সম্পর্কে আরও বিশদ গবেষণা চালিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাতে একই সঙ্গে যেমন নতুন অনেক কিছু জানা গেছে, তেমনি মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে রহস্য ঘনীভূত হয়েছেও আরও। দেখা দিয়েছে অনেক নতুন প্রশ্ন। চলুন, বিষয়টা একটু খুলে বলা যাক।

আশা করি এতক্ষণে বুঝে গেছেন, মহাজাগতিক রশ্মি বলতে সাধারণত মহাকাশ থেকে আসা চার্জিত কণাকে বোঝায়। মহাবিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নক্ষত্র এবং অন্যান্য বস্তু থেকে অনবরত ফোটন, প্রোটন, নিউট্রিনো কণাসহ আরও কিছু ভারী আয়ন বেরিয়ে আসছে। এরাই তীব্রবেগে প্রতিনিয়ত ছুটে আসছে পৃথিবীর দিকে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ধাক্কা খেয়ে সেগুলো ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যাচ্ছে, কিংবা বদলে যাচ্ছে তাদের রূপ। এভাবে মহাজাগতিক রশ্মি থেকে বায়ুমণ্ডলে তৈরি হচ্ছে আয়নিত বিকিরণ। এটিকে বলা হয় মহাজাগতিক রশ্মি।

যেমন আমাদের সূর্য এসব মহাকাশীয় কণার অন্যতম প্রধান উৎস। সূর্য শুধু দৃশ্যমান আলোই নয়, উচ্চশক্তির ফোটনও তৈরি করে (যেমন আলট্রাভায়োলেট আলো, গামারশ্মি)। এসব কণার শক্তি এত বেশি যে তা আমাদের দেহে ক্যানসারও তৈরি করতে পারে। আবার সূর্যের অতি উত্তপ্ত পারমাণবিক ফিউশন চুল্লি থেকে আসে আরেকটি দ্রুতগতির ও হালকা কণা। এর নাম নিউট্রিনো। প্রতি সেকেন্ডে আপনার হাতের নখের সমান জায়গা দিয়ে সূর্য থেকে আসা ১০০ বিলিয়ন নিউট্রিনো কণা চলে যাচ্ছে। কিন্তু সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো, কণাটি অন্য কোনো কণার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে না বললেই চলে। তাই এই কণা নিয়ে আপাতত দুশ্চিন্তার তেমন কিছু নেই।

মানবদেহের জন্য বেশি বিপজ্জনক কণা হলো প্রোটন বা পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের মতো চার্জিত কণা। উচ্চশক্তির প্রোটন আমাদের দেহে গুরুতর ক্ষতি করতে পারে। সেটা থেকে বাঁচতে মহাকাশে যেতে বিশেষ ধরনের পোশাক পরেন নভোচারীরা।

সূর্যকে বিশাল এক অগ্নিগোলক বলা চলে। যেখানে প্রতিমুহূর্তে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন ফিউশন প্রক্রিয়ায় হিলিয়াম তৈরি করছে। এই প্রক্রিয়ার উপজাত হিসেবে তৈরি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ শক্তি। তবে সূর্যের গতিপ্রকৃতি সব সময় আগাম বোঝা যায় না। বেশির ভাগ সময় সূর্যের প্রচণ্ড তাপে সবকিছু বেশ ভালোভাবে হজম হয়ে যায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে ওই অগ্নিগোলকের বদহজম হতেও দেখা যায়। এর ফলে সৃষ্টি হয় সোলার ফ্লেয়ার বা সৌরশিখা। এতে মাঝেমধ্যে প্লাজমা ছুটে আসে মহাকাশে। অতিরিক্ত ডোজের বিপজ্জনক এসব কণা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেও হানা দেয়। মোদ্দাকথা হলো, এভাবে পৃথিবীতে প্রতিমুহূর্তে কোটি কোটি কণা আঘাত হানছে। সঙ্গে বয়ে আনছে বিপুল পরিমাণ শক্তি।

মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে অধ্যাপক রসির গবেষণা তত দিনে পরিণত হয়েছে কিংবদন্তিতে। যুদ্ধকালে লস অ্যালামোসে একটা বিভাগের প্রধান ছিলেন তিনি

আমাদের পরম সৌভাগ্য, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও এর চারপাশে বিস্তৃত চৌম্বকক্ষেত্র এসব ক্ষতিকর কণার বিরুদ্ধে কাজ করছে ঢাল হিসেবে; অর্থাৎ এগুলোই ভয়াবহ এ বিপদ থেকে রক্ষা করছে পৃথিবীর তাবৎ জীবকুলকে। কিন্তু কীভাবে? আসলে বেশির ভাগ উচ্চশক্তির কণা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাতাস ও গ্যাসীয় পদার্থের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যায়। তার শক্তিও তখন অনেক কমে যায়; অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলে উচ্চশক্তির ক্ষতিকর কণাগুলো ধাক্কা খেয়ে নিম্নশক্তির কণায় রূপান্তরিত হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। পৃথিবীর মেরু অঞ্চলে যে মেরুজ্যোতি দেখা যায়, তার পেছনের কারণ উচ্চশক্তির কণাগুলোর এই রূপান্তর। আসলে পৃথিবীর চুম্বকীয় ক্ষেত্রে মহাজাগতিক রশ্মি রূপান্তরিত হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে এই জ্যোতির সৃষ্টি হয়।

ভূপৃষ্ঠে থাকলেই কেবল পৃথিবীর এই সুরক্ষা ব্যবস্থা কাজে লাগে। ভূপৃষ্ঠ থেকে একটা নির্দিষ্ট সময় অনেক ওপরে থাকলে (যেমন বিমানে অনেক ঘন ঘন যাতায়াত করলে) সেটা কাজ করবে না। তখন দেহে অনেক বেশি বিকিরণ ঢুকে পড়বে। কাজেই বিমানে বসে সানস্ক্রিন ব্যবহার করেও তখন কোনো লাভ হবে না। অবশ্য বিমানগুলো নিয়মিত মেরু দিয়ে যাতায়াত না করলে এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই তেমন এ ক্ষেত্রে।

একদল বিজ্ঞানীর ধারণা আরও পাগলাটে। তাঁদের অনুমান, আমাদের মহাবিশ্ব হয়তো কোনো মহাজাগতিক কম্পিউটারের ভেতরে সিমুলেশনমাত্র। অনেকটা হলিউডের ম্যাট্রিক্স মুভির মতো। কোনো বড় মেটা–ইউনিভার্সের প্রাণীরা হয়তো আমাদের মহাবিশ্বে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, এসব কণার গতি কেমন? পৃথিবীতে কণাকে দ্রুতবেগে ছুড়ে বিশ্বরেকর্ড করেছে সার্নের লার্জ হ্যার্ডন কলাইডার। সেখানে একটা কণাকে প্রায় ১০ টেরা–ইলেকট্রন ভোল্ট (বা ১০১৩ ইলেকট্রন ভোল্ট) গতিশক্তিতে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মহাকাশে ছুটে আসা কণার তুলনায় এই গতিশক্তিও বেশ কম। পৃথিবীতে ১০ টেরা–ইলেকট্রন ভোল্ট গতিশক্তিতে ছুটে আসা মহাজাগতিক রশ্মি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই মুহূর্তে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রতি সেকেন্ডে প্রতি বর্গমিটারে প্রায় একটি কণা আঘাত হানছে। বোঝার সুবিধার্থে, এই শক্তিকে প্রতি সেকেন্ডে আমাদের পৃথিবীর প্রতি বর্গমিটারে ধীরগতির স্কুলবাস আঘাত করার সঙ্গে তুলনা করা চলে।

কিন্তু এর চেয়ে বেশি শক্তিসম্পন্ন মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীতে আঘাত করছে। সেগুলোর তুলনায় এলএইচসির কণার শক্তিও মনে হতে পারে হামাগুড়ি দেওয়ার শামিল। পৃথিবীতে সবচেয়ে উচ্চগতিসম্পন্ন যে কণার সন্ধান পাওয়া গেছে, সেটি ১০২০ ইলেকট্রন ভোল্টের। এলএইচসির তুলনায় এসব কণা ২০ লাখ গুণ বেশি শক্তিসম্পন্ন। প্রতিবছর প্রায় ৫০০ মিলিয়ন এ রকম অতিশক্তিসম্পন্ন মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীতে আঘাত হানে। তার মানে, প্রতিদিন ১০ লাখের বেশি। এই শক্তি দুই বিলিয়ন ধীরগতির স্কুলবাস পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার সমতুল্য। কিন্তু মজার ও একই সঙ্গে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এসব উচ্চশক্তিসম্পন্ন কণা মহাবিশ্বের কোথা থেকে আসছে, এ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। মানে, মহাকাশের কোন বস্তু এই কণার উৎস, তা নিয়ে এখনো গোটা বিজ্ঞান মহল রয়েছে পুরোপুরি অন্ধকারে।

আরও পড়ুন

সত্যি বলছি, প্রতিদিন লাখ লাখ উচ্চগতির মহাজাগতিক কণা আমাদের পৃথিবীতে আছড়ে পড়ছে, কিন্তু সেগুলো কোথা থেকে আসছে, তা কারও জানা নেই। তাই মহাজাগতিক রশ্মির ব্যাপারটা আমাদের কাছে এখনো রহস্যময়। কারণ, মহাবিশ্বে আমরা যেসব বস্তু সম্পর্কে জানি, তা দিয়ে এগুলোর ব্যাখ্যা করা যায় না। কাজেই কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন, মহাবিশ্বে হয়তো এমন কোনো বস্তুও থাকতে পারে, যাদের সম্পর্কে আমাদের এখনো কিচ্ছু জানা নেই। অবিশ্বাস্য!

প্রশ্ন আসতে পারে, হাজার হাজার বছর ধরে মহাবিশ্ব নিয়ে নিত্যনতুন যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরও এমন কি হওয়া সম্ভব? মহাবিশ্বের কোনো কিছু কি এখনো আমাদের জানা বা দেখা বাকি রয়ে গেছে?

কেউ যদি আপনার দিকে অতি উচ্চশক্তির কোনো কিছু ছুড়ে মারেন, তাহলে প্রথম কাজটি হবে চারদিকে তাকিয়ে সেটা কোথা থেকে আসছে, তা খুঁজে বের করা। উচ্চ গতিশক্তির মহাজাগতিক রশ্মির উৎস খুঁজে বের করতে বিজ্ঞানীরাও ঠিক সেই কাজই করেন। কিন্তু তাতে সফল না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। সেসব কারণেই আসলে মহাজাগতিক রশ্মি আমাদের কাছে এখনো অমীমাংসিত এক হেঁয়ালি। অত্যুচ্চ গতিশক্তির মহাজাগতিক রশ্মির উৎস সন্ধানে বিজ্ঞানীরা মূলত দুটি প্রধান সমস্যার মুখোমুখি হন। প্রথমত, এ ধরনের রশ্মি পৃথিবীতে আঘাত হানে প্রায় হাজার বছরে একবার। দ্বিতীয়ত, টার্গেট হিসেবে পৃথিবী অনেক অনেক বড়।

মহাজাগতিক বিস্ফোরণ
এআই ইমেজ

প্রথম সমস্যাটার কথা একটু খুলে বলি। ১০১৩ ইলেকট্রন ভোল্ট বা এলএইচসির সমমানের কণাগুলো পৃথিবীতে আসে প্রতি সেকেন্ডে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় এক হাজার হারে। অন্যদিকে ১০১৮ ইলেকট্রন ভোল্টের কণাগুলো সে তুলনায় একটু বিরল। প্রতিবছর প্রতি বর্গকিলোমিটারে আঘাত হানে এদের মাত্র একটি। কিন্তু অতি উচ্চশক্তির কণা বা ১০২০ ইলেকট্রন ভোল্টের কণাগুলো আরও বিরল। প্রায় এক হাজার বছরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে মোটামুটি একটি মাত্র কণা পৃথিবীতে আঘাত হানে। এটাই অতিউচ্চ গতিশক্তির কণাগুলো কোথা থেকে আসছে, তা নির্ধারণের কাজটা কঠিন করে তুলেছে। এখন পর্যন্ত মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা কণাই শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তাদের উৎস শনাক্ত করার জন্য তা যথেষ্ট নয়। অনেক বড় কোনো ডিটেক্টর তৈরি করা হলেও, এদের শনাক্ত করার সম্ভাবনা একেবারেই কম।

এত হতাশার মধ্যে একটা ভালো খবরও আছে। বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিজ্ঞানীরা ইঙ্গিত পেয়েছেন, এর উৎস খুব বেশি দূরের হতে পারে না। কারণ, অনেক দূরের উৎস হলে, তা আমাদের কাছে আসতে আসতে মহাকাশে ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য ফোটোনিক কুয়াশা বা মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে তার শক্তি অনেক কমে যেত। তার মানে, সেগুলো হয় তুলনামূলক পার্শ্ববর্তী কোনো উৎস থেকে আসছে, নয়তো পৃথিবীতে যে গতিশক্তিতে আছড়ে পড়ছে, তাদের প্রকৃত গতিশক্তি আসলে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি। তবে বিজ্ঞানীরা প্রথম ধারণটিই সঠিক বলে মনে করেন। মানে, ‘আমরা খুবই বিস্ময়কর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছি। সেটা হলো, আমাদের কাছেই কোথাও থেকে কণাগুলো ওই পাগলাটে শক্তি নিয়ে ছুটে আসছে। কিন্তু সেগুলো কী, এ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।’

তাই মাথা খাটিয়ে বেশ কজন বিজ্ঞানী এই মহাজাগতিক রশ্মির উৎস বোঝার চেষ্টা করেছেন। এতে কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানী যে সৃজনশীল মানুষ, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এবার দ্বিতীয় সমস্যাটি নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। অতি উচ্চ গতিশক্তির কণাগুলো প্রথমে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আঘাত হানে। সরাসরি ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ে না। তা ঘটলে পৃথিবীর জীবজগৎ ধ্বংস হয়ে যেত অনেক আগেই। সে জন্য পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের অনেক বড় একটা ভূমিকা রয়েছে। বায়ুমণ্ডলের বাতাস ও গ্যাসের অণুর সঙ্গে সংঘর্ষে ১০২০ গতিশক্তির কণাগুলো ভেঙে দুই টুকরা হয়ে যায়। তাদের শক্তিও হয়ে যায় অর্ধেক। খণ্ডিত কণাগুলোর এরপর আরও বাতাস ও গ্যাসের অণুর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে। তাতে দুই ভাগে খণ্ডিত কণাগুলো আবার ভেঙে যায়। তাদের শক্তি বিভক্ত হয়ে যায় চার ভাগে। বিজ্ঞানীদের হিসাবে, এভাবে ভাঙনপ্রক্রিয়া কয়েক ধাপে চলতে চলতে অতিউচ্চ গতিশক্তির কণার শক্তি বিশ্লিষ্ট হয়ে ১০৯ ইলেকট্রন ভোল্টের অসংখ্য কণা তৈরি হয়। কণার এই ঝরনাধারা সাধারণত এক বা দুই কিলোমিটার প্রশস্ত হয়ে ভূপৃষ্ঠের দিকে নেমে আসতে থাকে। এদের মধ্যে থাকে উচ্চশক্তির ফোটন (গামারশ্মি), ইলেকট্রন, পজিট্রন ও মিউয়ন। এ রকম বিস্তৃত ও শক্তিশালী ঝরনাধারা দেখেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, পৃথিবীতে অতি উচ্চশক্তির কোনো কণা আঘাত হেনেছে।

কিন্তু সমস্যা হলো, এক বা দুই মাইলজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়া কণার ঝরনা দেখার জন্য দরকার অনেক বড় টেলিস্কোপ বা ডিটেক্টর। কিন্তু এ রকম এক বা একাধিক মাইলজুড়ে কণা ডিটেক্টর তৈরি করতে আমরা সক্ষম হইনি। বিজ্ঞানীরা সে জন্য বিকল্প একটি পদ্ধতির আশ্রয় নেন। অনেকগুলো ছোট ছোট পার্টিকেল ডিটেক্টর বেশ দূরে দূরে বসিয়ে সামগ্রিকভাবে বড় একটা ডিটেক্টর তৈরি করেন। দক্ষিণ আমেরিকায় স্থাপিত পিয়ের অগার অবজারভেটরি এ রকমই একটি টেলিস্কোপ। প্রায় ৩ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১ হাজার ৬০০টি ছোট ছোট পার্টিকেল ডিটেক্টর বসানো হয়েছে। এই বিশেষ টেলিস্কোপ দিয়ে সত্যিই বেশ বড় এলাকাজুড়ে অতি উচ্চগতির মহাজাগতিক রশ্মি শনাক্ত করার জন্য অনুসন্ধান চালানো সম্ভব। কিন্তু আগেই বলেছি, প্রতি হাজার বছরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে এই অতি উচ্চগতিশক্তির কণাগুলো মাত্র একবার পাওয়া যায়। কাজেই বছরের পর বছর চেষ্টা করেও এই রহস্যের মীমাংসা করতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা। আবার গোটা পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করলে ৩ হাজার বর্গকিলোমিটার বেশ ছোট একটা জায়গা। তাই দক্ষিণ আমেরিকায় টেলিস্কোপ তাক করে বিজ্ঞানীরা দিনরাত বসে থাকলেও, এই মুহূর্তে হয়তো পৃথিবীর অন্য কোথাও আঘাত হানছে ওই সব কণা। কাজেই সেটা শনাক্তের জন্য এর চেয়ে আরও বড় টেলিস্কোপ নির্মাণ করতে হবে। সেটা হতে পারে, গোটা পৃথিবীর সমান আকারের। কিন্তু সে জন্য দরকার প্রচুর অর্থ বরাদ্দ। বলে রাখা ভালো, অগার টেলিস্কোপের নির্মাণ খরচ প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফলে এত বড় টেলিস্কোপ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাচ্ছেন না বিজ্ঞানীরা। সব মিলিয়ে মহাজাগতিক রশ্মির রহস্যের কিনারাও করা যাচ্ছে না।

বিজ্ঞানীরাও কম যান না। এই কণাগুলো পরীক্ষা করার সরাসরি সুযোগ না পেলেও তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনাতে তো বাধা নেই। তাই মাথা খাটিয়ে বেশ কজন বিজ্ঞানী এই মহাজাগতিক রশ্মির উৎস বোঝার চেষ্টা করেছেন। এতে কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানী যে সৃজনশীল মানুষ, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। যেমন একদল বিজ্ঞানীর ধারণা, অতি উচ্চশক্তির কণাগুলো আসছে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা কোনো অতিভারী ও অতিশক্তিশালী কৃষ্ণগহ্বর থেকে। এসব কৃষ্ণগহ্বরের ভর হয়তো আমাদের সূর্যের চেয়ে কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ গুণ বেশি হতে পারে। ওই কৃষ্ণগহ্বর তার চারপাশের সবকিছু অনবরত গিলে ফেলছে ক্ষুধার্ত জানোয়ারের মতো। গিলে ফেলার অপেক্ষায় প্রতিনিয়ত তার চারপাশে জড়ো হচ্ছে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও ধূলিকণা। সেগুলো কৃষ্ণগহ্বরকে কেন্দ্র করে ঘুরছে অকল্পনীয় প্রচণ্ড বেগে। সেগুলোর শেষ গন্তব্য অবশ্য কৃষ্ণগহ্বরের ক্রমবর্ধমান পেট। প্রচণ্ড বেগে ঘুরতে গিয়ে এসব গ্যাস ও ধূলিকণা শক্তিশালী বলের প্রভাবে তীব্র বিকিরণ নিঃসরণ করছে। এই বিজ্ঞানীদের ধারণা, সেগুলোই বিপুল বেগে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে ছুটে আসছে পৃথিবীতে। তবে এই ধারণা শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। কারণ, হাতে গোনা যেসব অতি উচ্চশক্তির মহাজাগতিক রশ্মি আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি, তার উৎস গ্যালাক্সিকেন্দ্রের এসব কৃষ্ণগহ্বর নয় বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন
কয়েক দশক আগে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, মহাবিশ্বের প্রায় ৬৮ ভাগ হলো গুপ্তশক্তি বা ডার্ক এনার্জি। কাজেই এই আবিষ্কার এমনও ইঙ্গিত দেয় যে মহাবিশ্বে আমাদের অজানা অন্য কোনো বল থাকতেও পারে।

এর চেয়েও মজার ধারণা করেছেন আরেক দল বিজ্ঞানী। তাঁদের ধারণা, কোনো বুদ্ধিমান এলিয়েন প্রজাতির বিজ্ঞানীরা হয়তো মহাবিশ্বের কোথাও বসে বস্তুকণাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এককে ভাঙার গবেষণা করছেন। সেখান থেকেই কিছু কণা আমাদের পৃথিবীতে আছড়ে পড়ছে। আইডিয়াটা মজার, সন্দেহ নেই; কিন্তু বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

একদল বিজ্ঞানীর ধারণা আরও পাগলাটে। তাঁদের অনুমান, আমাদের মহাবিশ্ব হয়তো কোনো মহাজাগতিক কম্পিউটারের ভেতরে সিমুলেশনমাত্র। অনেকটা হলিউডের ম্যাট্রিক্স মুভির মতো। কোনো বড় মেটা–ইউনিভার্সের প্রাণীরা হয়তো আমাদের মহাবিশ্বে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। আমাদের মহাবিশ্বকে যে মহাজাগতিক কম্পিউটার চালাচ্ছে, তার কোনো ত্রুটির কারণে আমরা এসব মহাজাগতিক রশ্মি দেখতে পাচ্ছি বলে সন্দেহ করেন এই বিজ্ঞানীরা। এই ধারণায় বিশ্বাস করবেন কি না, তা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

এভাবেই ছুটে আসা মহাজাগতিক কণারা ভেঙে যায় বায়ুমণ্ডলে

এখন পর্যন্ত আমাদের জানা সব মহাজাগতিক বস্তু এবং প্রকৃতির বল ব্যবহার করে এই মহাজাগতিক রশ্মি ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু অনেক দিন ধরেই সেটা অমীমাংসিত রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে। তাই অনেকে মনে করেন, নতুন কোনো অনাবিষ্কৃত বল হয়তো এই মহাজাগতিক রশ্মির জন্য দায়ী। কয়েক দশক আগে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, মহাবিশ্বের প্রায় ৬৮ ভাগ হলো গুপ্তশক্তি বা ডার্ক এনার্জি। কাজেই এই আবিষ্কার এমনও ইঙ্গিত দেয় যে মহাবিশ্বে আমাদের অজানা অন্য কোনো বল থাকতেও পারে। ব্যাপারটা একেবারেই অমূলক নয়। তবে এটা এখনো স্রেফ কল্পনা, বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই।

কে জানে, মহাজাগতিক রশ্মি মীমাংসা করতে গিয়ে ভবিষ্যতের কোনো বিজ্ঞানী হয়তো নতুন বল আবিষ্কার করে বসবেন। কিংবা উন্মোচন করবেন জ্ঞানের নবদিগন্ত। কোটি কোটি আলোকবর্ষ পাড়ি দিয়ে বুলেটের মতো ছুটে আসা এই মহাজাগতিক ধাঁধার সমাধান হয়তো সেদিন পাওয়া যাবে হাতের মুঠোয়। সেটিই হয়তো হবে মহাবিশ্বের নতুন তথ্যভান্ডার। তার অর্থ উদ্ধার করবেন নতুন প্রজন্মের নবীন বিজ্ঞানীরাই। তাঁদের নিয়ে আমরা আশাবাদী।

সূত্র: উই হ্যাভ নো আইডিয়া/ জর্জ চ্যাম এবং ড্যানিয়েল হোয়াইটসন

জ্যাপট/ বব বারম্যান

মহাজাগতিক রশ্মি/ প্রদীপ দেব, বিজ্ঞানচিন্তা, জুন ২০২২

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন