মহাকাশ
সূর্য আর চাঁদ কীসের তৈরি
ছোটদের জন্য সহজ ভাষায় লেখা কঠিন। সহজ কথা যে যায় না বলা সহজে! অথচ একদম সহজ-সাবলীল ভাষায় লেখা এই বই। টেলিস্কোপ কী বলে নামের এ বই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাদুগা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। পাভেল ক্লুশান্ৎসেভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন অরুণ সোম। এ বইয়ে প্রচুর ছবি আছে। সেগুলো এঁকেছেন ইয়ে. ভোইশ্ভিল্লো, ব. কালাউশিন, ব.স্তারোদুব্ৎসেভ এবং ইউ. কিসিলিওভ। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে বইটি প্রকাশিত হচ্ছে…
লোকে একেবারে হাল আমলে মহাকাশে ওড়া শুরু করেছে। মহাকাশে প্রথম যান ইউরি গ্যাগারিন। ১৯৬১ সালে। তারপর থেকে বেশ কিছু সোভিয়েত ও মার্কিন নভোচারী মহাকাশে গেছেন।
কিন্তু এ রকম বিপদসঙ্কুল যাত্রায় মানুষকে পাঠানোর আগে মহাকাশ সম্পর্কে অন্তত কিছু জানা দরকার ছিল।
রাতের কালো আকাশ কী, চন্দ্র-সূর্য-তারা কী—মানুষ পৃথিবীতে বসে এসব কী করে জানল? কেননা আকাশের দিকে যতক্ষণ খুশি চেয়ে দেখ না কেন, এমনকি যদি সারা রাত ধরেও চেয়ে দেখ, তবু আকাশকে তোমার মনে হবে যেন একটা ছাউনি। সূর্য আর চাঁদ, জ্বলজ্বলে চ্যাপ্টা তাওয়া আর তারাগুলো নিছক কতকগুলো উজ্জ্বল বিন্দু। কীভাবে ওদের আরও ভালো করে নিরীক্ষণ করা যায়?
কাগজের ওপর একটা কালির বিন্দু বসালে আতশকাচ দিয়ে সেটা নিরীক্ষণ করে দেখতে পারো। কখনও চেষ্টা করে দেখেছ কি? অমনিতে, খালি চোখে দেখতে পাচ্ছ নেহাৎ একটা ছোট্ট বিন্দু। কিন্তু আতশকাচের ভেতর দিয়ে দেখ—একটা বড় ধ্যাবড়া চাকতির মতো। আর কাগজটা এখন আগের সেই মোলায়েম কাগজ নয়, এ যেন আগাগোড়া আঁশ-আঁশ একটা খসখসে পশমি কাপড়।
আতশকাচের ভেতর দিয়ে তোমার নিজের আঙুল একবার দেখ। মনে হয় যেন বিশাল, মোটা। আঙুলের প্রতিটি ভাঁজ আর রেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু কাগজের ওপরে বিন্দু আর নিজের হাতের আঙুল—এসবই কাছের বস্তু। আতশকাচ তাদের সামনে আনা যায়। কিন্তু আকাশের কাছে নিয়ে যাবে কী করে?
তবে দেখা যাচ্ছে, আকাশের জন্যও আতশকাচ আছে। তোমরা কখনও বাইনোকুলার দিয়ে তাকিয়ে দেখেছ কি? সম্ভবত দেখেছ। বাইনোকুলার—এও কিন্তু একধরনের আতশ কাচ, কেবল তফাত এই যে তাকে ‘ঠিক আঙুলের সামনে’ নিয়ে আসতে হয় না। বাইনোকুলার দিয়ে আমরা দূরের সব জিনিস নিরীক্ষণ করতে পারি।
বাইনোকুলার দিয়ে রাস্তার ওপাশে তাকিয়ে দেখ। সব যেন কাছে চলে এসেছে, অনেক বড় হয়ে উঠেছে। তাই না?
ছোট ছোট অপেরা গ্লাসে (বড় থিয়েটার হলে দূরের সারি থেকে দেখার জন্য একধরনের বাইনোকুলার) দেখার জিনিস মোটামুটি তিন গুণ কাছে চলে আসে। আর বড় বড় বাইনোকুলারে, যেমন নাবিকদের কাছে যে বাইনোকুলার থাকে, তাতে আসে আট গুণের মতো কাছে। এ ধরনের বাইনোকুলার দিয়ে দেখলে চাঁদকে মনে হবে বিশাল, মনে হবে আমরা যেন চাঁদের আট গুণ কাছে এগিয়ে এসেছি। এমনকি চাঁদের গায়ের নানা ধরনের বহু ছোট ছোট এমন সব ছোপ চোখে পড়ে, যেগুলো আমরা আগে কখনও দেখিনি।
আচ্ছা, আমরা যদি একটা মস্তবড়, আলমারির সমান বিরাট বাইনোকুলার তৈরি করি, তাহলে কেমন হয়? ও রকম বাইনোকুলার দিয়ে চাঁদ হয়তো আরও কাছে দেখা যাবে? একেবারে নাকের ডগায়? হ্যাঁ, তা তো বটেই।
এমনকি ডান চোখ আর বাঁ চোখের জন্য একজোড়া বাইনোকুলার করারও দরকার নেই। এক চোখেও আকাশ দেখা যায়।
মানুষ তাই ‘একচক্ষু বাইনোকুলার’ তৈরি করল—আলমারির সমান আকারের নয়, পুরোপুরি একটা বাসের সমান।
কাচ লাগানো এই বিশাল চোঙটার নাম দেওয়া হলো টেলিস্কোপ।
এই যন্ত্রটা এত পেল্লায় যে জনাবিশেক লোকেরও সাধ্য নয় তাকে হাতে ধরে তুলতে পারে। তাই একটা মস্তবড় মজবুত স্ট্যান্ডের ওপর তাকে রাখতে হয়। তাকে আর হাত দিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরানো যায় না, ঘোরাতে হয় ইলেকট্রিক মোটর আর বহু খাঁজকাটা চাকার সাহায্যে।
প্রতিটি টেলিস্কোপের জন্য তৈরি করতে হয় আলাদা আলাদা একেকটা পাকা দালান, গোলাকার বিরাট বুরুজ।
এ ধরনের বুরুজের ছাদ ইচ্ছেমতো নাড়ানো যায়। আকাশ দেখার দরকার হলে ছাদটা টেনে সরিয়ে দেওয়া হয়। কাজ শেষ হওয়ার পর জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে ছাদটা আবার ঢেকে দিলেই হলো, যাতে বৃষ্টি পড়ে টেলিস্কোপ ভিজে না যায়। টেলিস্কোপ একটা জটিল ও দামি জিনিস।
কিন্তু তাহলেও যেকোনো জিনিসকে টেলিস্কোপ যে কী দারুণ বড় করে দেখায়, তা যদি তোমরা জানতে! কয়েক শ, এমনকি হাজার গুণ বড় করে দেখায়। এ ধরনের টেলিস্কোপ দিয়ে এক কিলোমিটার দূর থেকে বই পড়া যায়। বইটাকে দেখে মনে হবে যেন এক পা দূরে আছে!
টেলিস্কোপ নামে পরিচিত এ রকম অপূর্ব চোঙের সাহায্যে লোকে গোটা আকাশটা বেশ করে দেখে নিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সূর্য, চাঁদ আর তারা দেখল। পৃথিবীর চারধারে কী কী আছে, সে বিষয়ে আকর্ষণীয় অনেক কিছু জানতে পারল লোকে। টেলিস্কোপ মানুষকে আকর্ষণীয় অনেক বিবরণ দিল।
দেখা গেল, সূর্য একটা বিশাল গোলক। চাঁদও তাই। আর তারারাও বিশাল বিশাল গোলক। তারাগুলোকে ছোট ছোট বিন্দুর মতো দেখায় একমাত্র এই কারণে যে ওরা আরও অনেক অনেক দূরে আছে। বহু কিলোমিটার দূর থেকে রাস্তার একটা বড় বাতিকেও তো এইটুকু একটা বিন্দুর মতো দেখায়, তাই না?
মহাকাশে যে সব গোলক আছে, তাদের সবগুলোকে বলা হয় ‘জ্যোতিষ্কমণ্ডলী’। তাদের একটার সঙ্গে আরেকটার অনেক তফাত।
যেমন ধরো সূর্য। সূর্য একটা আগুনের গোলা, স্রেফ আগুনের গোলা। তার ভেতরে শক্ত কিছু নেই। সূর্যের সমান বড় কোনো দৈত্য থাকলে সে অনায়াসে ধুনির আগুনের গোলার মতো সূর্যকে একটা কাঠি দিয়ে ফুঁড়তে পারত। তাতে কাঠিটা সঙ্গে সঙ্গে দপ করে জ্বলেপুড়ে যেত। সূর্যের কিছুই হতো না।
তারারাও আমাদের সূর্যের মতো। ওরাও আগুনের তৈরি। সূর্যের মতো ওরাও আগুনের গোলা। তাদের মধ্যে অনেকে আবার সূর্যের চেয়েও বড়।
আসল কথা হলো, সূর্য আমাদের অনেক কাছে। তাই তাকে বড় মনে হয়। এ কারণেই সূর্য উজ্জ্বল আলো দেয় আর প্রচণ্ড তাপ বিকিরণ করে। আর তারারা সূর্যের তুলনায় আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। এ কারণেই তাদের আলো ক্ষীণ, উত্তাপও এতটুকু নেই।
চাঁদও গোলক। তবে চাঁদ পাথুরে গোলক, কঠিন, ঠান্ডা। পৃথিবীর মতো চাঁদও নিজে আলো দেয় না। ঠান্ডা পাথর কি আর বাতি হতে পারে? আকাশে চাঁদকে দেখা যায় একমাত্র এই কারণে যে সূর্য তাকে আলোকিত করে। সূর্যের আলো নিভিয়ে দাও, চাঁদও নিভে যাবে।
একটা কাগজের টুকরোর ওপর চাঁদ, পৃথিবী আর সূর্যকে পাশাপাশি আঁকা যাক। চাঁদ আর পৃথিবীর জায়গা হবে, কিন্তু সূর্যের হবে না। তাকে আঁকতে হবে আলমারির সমান করে। তাহলে বুঝতেই পারছ, পৃথিবী আর চাঁদের তুলনায় সূর্য কত বড়।
মহাকাশে জ্যোতিষ্কমণ্ডলী পরস্পরের কাছ থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে। আমাদের বিপুল ভূমণ্ডলকে যদি একটা ছোট্ট কুলের আকারে কল্পনা করা যায়, তাহলে তার তুলনায় মটর দানার সমান আকারের চাঁদকে রাখতে হয় আধ মিটার দূরে; আর সে ক্ষেত্রে আলমারির সমান আকারের সূর্যকে রাখতে হবে পৃথিবী থেকে ২০০ মিটার দূরে।
একটা কাগজের টুকরোর ওপর চাঁদ, পৃথিবী আর সূর্যকে পাশাপাশি আঁকা যাক। চাঁদ আর পৃথিবীর জায়গা হবে, কিন্তু সূর্যের হবে না। তাকে আঁকতে হবে আলমারির সমান করে। তাহলে বুঝতেই পারছ, পৃথিবী আর চাঁদের তুলনায় সূর্য কত বড়
আর সূর্যের মতোই আলমারিসমান আকারের সবচেয়ে কাছের তারাটির অবস্থানস্থল হবে মহাসাগরের অপর পাড়ে, আমেরিকায় বা অস্ট্রেলিয়ায়, ওরকম কোথাও। তাহলেই দেখতে পাচ্ছ, জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব কী বিরাট!
আমাদের সবচেয়ে কাছে আছে চাঁদ। কিন্তু চাঁদ পৌঁছাতে ‘তু-১৫৪’- এর মতো শক্তিশালী জেট প্লেনেরও লেগে যাবে দুসপ্তাহ, তাও আবার অবিরাম গতিতে চললে।
লেলিনগ্রাদের (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া) মতো একটা শহরের কথাই মনে মনে কল্পনা করো না কেন। এই এত বড় শহরটার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটে পার হতে গেলে অবিরাম গতিতে চলতে হবে ঘণ্টা পাঁচেক। রাজপথের ওপর দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চললে পেরোতে সময় লাগে পনেরো মিনিট। আর ‘তু-১৫৪’ জেট প্লেন আকাশপথে ওই দূরত্ব পাড়ি দেয় দেড় মিনিটে। একবার ভেবে দেখ, কত দ্রুত ওড়ে!
সেরকম গতিবেগেও কিনা চাঁদে পৌঁছাতে লেগে যাবে দুসপ্তাহ! দেড় মিনিট কাটতেই পুরো শহরটা পড়ে রইল পেছনে। এক ঘণ্টা কাটতে আমরা পেরিয়ে গেলাম চল্লিশটা লেনিনগ্রাদ। চব্বিশ ঘণ্টায় এক হাজার লেনিনগাদ!
আর অমন দানবীয় পদক্ষেপে কিনা দুসপ্তাহ!
চাঁদ বেশ দূরে! তাহলেও আর সব জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর তুলনায় অনেক কাছে। এ কারণেই তাকে বলা হয় পৃথিবীর উপগ্রহ। বাকি সব জ্যোতিষ্কমণ্ডলী, তোমরা দেখতেই পাচ্ছ, বহুগুণ দূরে অবস্থান করছে।
অ্যারোপ্লেনে চেপে সূর্যে যাওয়া সম্ভব হলে সময় লাগত ১৫ বছর! তার মানে প্লেনে যখন তোমরা চাপলে, তখন স্কুলের ছাত্র। আর প্লেন থেকে যখন নামলে, তখন ইয়া দাড়িওয়ালা, দাদা-খুড়োর বয়সী।
আর তারারা যেখানে আছে, সেখানে ওই গতিবেগে পৌঁছাতেই পারবে না। পথের একেবারে শুরুতেই, খানিক দূর যেতে না যেতে বুড়িয়ে যাবে।
কী বিপুল এই মহাকাশ!
অথচ দেখ, পুরোটাই বেমালুম ফাঁকা, একটা ‘শূন্যগর্ভ শূন্যতা’!
কী করে এই শূন্যতার মধ্যে ঝুলছে সূর্য? চাঁদ কেন পড়ে না? পৃথিবীরই বা অবলম্বন কী? সে কথা হবে পরের অধ্যায়ে।