যেকোনো পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র বানাতে যে খরচ পড়ে, তারচেয়েও কম খরচে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এই নভোযান পাঠিয়ে দিয়েছে দেশটি! ভারতীয় রুপিতে সংখ্যাটা ৬১৫ কোটি, মার্কিন ডলারে ৭৪.৬ মিলিয়ন।
ভারতীয় নভোযান চন্দ্রযান-৩ ইতিহাস গড়ে ফেলেছে। গত ২৩ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা ৩৪ মিনিটে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করেছে নভোযানটি। সাজ সাজ রব পড়ে গেছে প্রায় পুরো পৃথিবীতে। ভারতবন্দনা চলছে পুরোদমে। সংবাদ মাধ্যমের বরাতে ইতিমধ্যেই জানা গেছে এর পেছনের মূল কারণ। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এর আগে কোনো দেশের নভোযান ‘সফলভাবে’ নামতে পারেনি। এতদিনের অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে ভারত।
ইতিহাস গড়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু কারণ আরও আছে। আর সেটা হেলাফেলা করার মতোও নয়। যেকোনো পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র বানাতে যে খরচ পড়ে, তারচেয়েও কম খরচে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এই নভোযান পাঠিয়ে দিয়েছে দেশটি! ভারতীয় রুপিতে সংখ্যাটা ৬১৫ কোটি, মার্কিন ডলারে ৭৪.৬ মিলিয়ন। ১০০ মিলিয়নের নিচে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানানো কঠিনই বটে। কাজেই বিষয়টা যে ঘটা করে উদযাপন করার মতো, তা বলা বাহুল্য!
মূল ঘটনায় যাওয়ার আগে এখানে কিছু বিষয় একটু স্পষ্ট করা প্রয়োজন। প্রথম অনুচ্ছেদে যে বলা হয়েছে ‘সফলভাবে’, সে কথাটা একটুখানি ব্যাখ্যা করা দরকার। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে যাওয়া নিয়ে সমস্যাটা কী, বোঝা প্রয়োজন সেটাও। তারপর বুঝতে হবে, এত কম খরচে কীভাবে চাঁদে গোটা একটা নভোযান পাঠিয়ে দিল ভারত।
চাঁদের অন্যপাশটা দেখা যায় না বলে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ডার্ক সাইড অব দ্য মুন’। এই ডার্ক মানে অন্ধকার নয়, অজানা। চাঁদের ওপাশটাতেও সূর্যের আলো পড়ে। তবে ওপাশের অংশটার কিছু অঞ্চল ছায়াময়, খাদও রয়েছে।
২.
ল্যান্ডিং কয়েকরকম আছে। ক্র্যাশ ল্যান্ডিং বিষয়টা তো আমরা বুঝিই। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যেকোনো উড়োযান বা নভোযান যখন মুখ থুবড়ে পড়ে, সেটাকে বলে ক্র্যাশ ল্যান্ডিং। বাংলায় বলা যায় অনিয়ন্ত্রিত অবতরণ। কিন্তু আংশিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কোনো উড়োযান বা নভোযান যখন আছড়ে পড়ে, তখন সেটাকে বলে হার্ড ল্যান্ডিং। অর্থাৎ চালকের হাতে এখনো কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আছে, তবে পুরোটা নেই। এটাকে অস্বাভাবিক অবতরণ বলতে পারেন চাইলে। আর একদম ঠিকঠাক অবতরণ করলে সেটাকে বলা হয় সফট ল্যান্ডিং বা স্বাভাবিক অবতরণ।
ভারতীয় নভোযান চন্দ্রযান-৩ স্বাভাবিকভাবেই নেমেছে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে। এর আগে আর কোনো দেশ এটা করতে পারেনি। অবশ্য এর আগে, ২০১৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর চন্দ্রযান-২ একদম নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুখ থুবড়েই পড়েছিল। ওটাও পাঠানো হয়েছিল চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে। তারও আগে চন্দ্রযান-১ নিয়ন্ত্রিতভাবে চাঁদে আছড়ে ফেলা হয়েছিল। অর্থাৎ হার্ড ল্যান্ডিং করানো হয়েছিল ইচ্ছে করেই। কিন্তু সেটা কিছুদিন পরেই বিকল হয়ে যায়। এটাও অবশ্য চাঁদের ‘দক্ষিণ গোলার্ধে’ পাঠানো হয়েছিল।
তাহলে, কততম দেশ হিসাবে ভারত চাঁদে নভোযান পাঠাল? উত্তর: পঞ্চম দেশ হিসাবে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে নভোযান অবতরণের হিসাব করলে ভারত চতুর্থ। আগের তিনটি রাষ্ট্রের নাম যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুক্তরাজ্যের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসাও চাঁদে নভোযান পাঠিয়েছে, তবে সফট ল্যান্ডিং বা স্বাভাবিক অবতরণ করাতে পারেনি।
এবারে একটু গোলার্ধের বিষয়টা বোঝা প্রয়োজন। চাঁদের মাঝখান দিয়ে যে রেখাটা চলে গেছে, পৃথিবীর মতোই সেটাকেও বলা হয় বিষুবরেখা। এই রেখার এক পাশে উত্তর গোলার্ধ বা উত্তরাঞ্চল, অন্য পাশে দক্ষিণ গোলার্ধ বা দক্ষিণাঞ্চল। দক্ষিণ গোলার্ধের একদম দক্ষিণের বিন্দু বা অঞ্চলটিকে বলা হয় দক্ষিণ মেরু। এর আগে, চীনের নভোযান শাঙ-ই ৪-ও চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে গিয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ মেরুতে কোনো নভোযান পাঠাতে পারেনি কোনো দেশ। কেন?
উত্তরটা বুঝতে চাঁদের দুটো পাশ নিয়ে একটু কথা বলা প্রয়োজন। চাঁদ পৃথিবীর আকর্ষণে এমনভাবে আটকে রয়েছে যে এর শুধু একটা পাশই পৃথিবী থেকে দেখা যায়। বিশেষ এই আটকে থাকার বিষয়টাকে বৈজ্ঞানিকভাবে বলা হয় টাইডাল লক। চাঁদ পৃথিবীর সঙ্গে টাইডালি লকড অবস্থায় আছে। নিজের অক্ষের ওপরে ঘুরছে ওভাবেই। যেহেতু পৃথিবী থেকে একটা পাশই দেখা যায়, এ অংশেই নভোযান পাঠানো সহজ। অন্যপাশে নভোযান পাঠানো কঠিন। আর সেটা যদি হয় ওপাশের একদম মেরুতে, তাহলে কাজটা কত কঠিন হয়ে যায় বুঝতেই পারছেন! ওটাই চাঁদের দক্ষিণ মেরু। চন্দ্রযান-৩ এখানেই নেমেছে।
চাঁদের অন্যপাশটা দেখা যায় না বলে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ডার্ক সাইড অব দ্য মুন’। এই ডার্ক মানে অন্ধকার নয়, অজানা। চাঁদের ওপাশটাতেও সূর্যের আলো পড়ে। তবে ওপাশের অংশটার কিছু অঞ্চল ছায়াময়, খাদও রয়েছে। তবে এর সঙ্গে এই ‘ডার্ক’ নামকরণের কোনো সম্পর্ক নেই।
চাঁদের ওপাশে যেতে সমস্যাটা কী, সফলভাবে সফট ল্যান্ডিং কী—সবই বোঝা গেল। এখন প্রশ্ন হলো, ভারত এই দুঃসাধ্য সাধন করল কীভাবে?
৩.
প্রথমেই বলতে হবে ভারত সরকারের প্রচেষ্টার কথা। বিজ্ঞান ও গবেষণায় গত প্রায় ৭০ বছরে যথেষ্ট বিনিয়োগ করেছে ভারত। পারমাণবিক ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে, বিনিয়োগ করেছে মহাকাশ গবেষণায়। এত বছরের বিনিয়োগ ও পরিশ্রম—সব একবিন্দুতে মিলেছে এসে এই অভিযানে।
সেই সঙ্গে যদি ভারত, অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমবাজারের শ্রমের কম মূল্যের কথা বিবেচনায় নেন, তাহলেই খরচ কমের বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। তা ছাড়া ভারত সম্পূর্ণ দেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে এক্ষেত্রে। সব বানিয়েছে নিজেরা। সেজন্যই খরচ এত কমে গেছে।
এ ছাড়াও আরেকটা বিষয় কাজে লাগিয়েছে ভারত। এর নাম স্লিংশট। অর্থাৎ কোনো মহাজাগতিক বস্তুর মহাকর্ষকে কাজে লাগিয়ে নভোযানের গতিপথ বদলে ফেলা। ভারত সেটাই করেছে। সেজন্য চাঁদকে ঘিরে একাধিকবার ঘুরতে হয়েছে চন্দ্রযান-৩ নভোযানটিকে। পৃথিবী ছেড়ে বেরোনোর সময় পৃথিবীকেও অনেকবার পাক দিতে হয়েছে। প্রতিবার ঘোরার সময় কক্ষপথ কিছুটা পরিবর্তন করে নিয়েছে নভোযানটি। সে জন্যই পৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম ১৭ দিন কাটিয়েছে চন্দ্রযান-৩। তারপর চাঁদের কক্ষপথে কাটিয়েছে ২৩ দিন। এত সময় ব্যয় করে অর্থ সাশ্রয় করেছে ভারত। ‘টাইম ইজ মানি’—এই কথার একদম যথার্থ প্রয়োগ বলা চলে!
চাঁদে তো যাওয়া হলো, এখন কী করবে চন্দ্রযান-৩? এ প্রশ্নের জবাব পেতে নভোযানটির গঠন ও যন্ত্রাংশের ব্যাপারে একটু জানা প্রয়োজন।
চাঁদের পাথর, বালু, কোথাও পানি আছে কি না ইত্যাদি খতিয়ে দেখাই চন্দ্রযান-৩ এর মূল উদ্দেশ্য। চাঁদের ওপাশ নিয়ে এখনো অনেক অজানা আমাদের।
৪.
ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর অফিসিয়াল চন্দ্রযান-৩ মিশন পেজের তথ্য মতে, এতে মূল অংশ রয়েছে তিনটি। প্রথম অংশটির নাম প্রোপালশন মডিউল। এতে একটাই মূল পেলোড বা ভার রয়েছে। পেলোড মানে, কোনো নভোযান মূলত যে জিনিসটিকে বয়ে নেয়। এক্ষেত্রে পেলোডটি হলো স্পেকট্রোপোলারিমেট্রি অব হ্যাবিটেবল প্ল্যানেট আর্থ, সংক্ষেপে শেপ (SHAPE)। এই যন্ত্রটি দিয়েই নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হবে এ অভিযানে। বায়ুমণ্ডলীয় বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও পরিমাপ করা, বর্ণালিমিতিক বিশ্লেষণ করাসহ নানা কিছু করা হবে এ যন্ত্র নিয়ে। নভোযানটিকে ছুটিয়ে নিয়েছে ৪৪০ নিউটন তরল জ্বালানিনির্ভর ইঞ্জিন। সঙ্গে একটি স্টার সেন্সর, একটি ট্র্যাকিং, টেলিমেট্রি অ্যান্ড কমান্ড অ্যানটেনা ও একটি সৌরকোষ রয়েছে।
দ্বিতীয় মূল অংশটি হলো বিক্রম ল্যান্ডার। এটিই নভোযানটির স্বাভাবিক অবতরণের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি আগামী ১৪ দিন চন্দ্রপৃষ্ঠে গবেষণাকাজে সাহায্য করবে এটি। এটাতে একটা পেলোড আছে—রেডিও অ্যানাটমি অব মুন বাউন্ড হাইপারসেনসিটিভ আয়োনোস্ফিয়ার অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ার, সংক্ষেপে রাম্ভা (RAMBHA)। আরও নানানরম যন্ত্র, সেন্সর ও বিভিন্ন ধরনের ক্যামেরা রয়েছে এতে।
তৃতীয় অংশটির নাম প্রজ্ঞান রোভার। এতে রয়েছে একটি আলফা পার্টিকেল এক্সরে স্পেকট্রোমিটার বা এপিএক্সএস (APXS) ও লেজার ইনডিউসড ব্রেকডাউন স্পেকট্রোমিটার বা লিবস (LIBS)। এগুলো চন্দ্রপৃষ্ঠের খনিজ ও রাসায়নিক গঠন নিয়ে গবেষণায় কাজে লাগবে।
চাঁদের পাথর, বালু, কোথাও পানি আছে কি না ইত্যাদি খতিয়ে দেখাই চন্দ্রযান-৩ এর মূল উদ্দেশ্য। চাঁদের ওপাশ নিয়ে এখনো অনেক অজানা আমাদের। চন্দ্রযান-৩ অজানার এই অন্ধকারে খানিকটা আলো ফেলবে বলেই আশা করছেন গোটা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা।
লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: আনন্দবাজার, উইকিপিডিয়া ও আলজাজিরা