মহাকাশের সেরা ১০

মহাকাশ গবেষণায় ২০২২ সাল ছিল একের পর এক চমক। প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কারণে মানুষ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও ভালো করে দেখতে পারছে মহাবিশ্ব। জানতে পারছে মহাকাশের অজানা ইতিহাস,  মিলছে জটিল সব প্রশ্নের উত্তর। মহাকাশ নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে এ বছর। সেখান থেকে আলোচিত ১০টি গবেষণা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো এখানে। এই তালিকায় গুরুত্ব অনুযায়ী গবেষণাগুলোর ক্রমবিন্যাস করা হয়নি। শুধু লেখার সুবিধার্থে ক্রমসংখ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
জেমস ওয়েবের তোলা ছবি

১. জেমস ওয়েব : আকাশ দেখার নতুন যুগ

নিঃসন্দেহে চলতি বছরে বিজ্ঞানের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের তোলা ছবি প্রকাশ। প্রায় দুই যুগ ধরে কাজ করার পর, গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর মহাকাশে পাঠানো হয় জেমস ওয়েব নভোদুরবিন। ৩০ দিনের মহাকাশযাত্রা শেষে পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে দ্বিতীয় ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টে গিয়ে পৌঁছে এটি। এর প্রায় ছয়মাস পর, চলতি বছরের ১২ জুলাই নাসা প্রথমবারের মতো এই নভোদুরবিনের তোলা কয়েকটি ছবি প্রকাশ করে। হতবাক হয়ে যায় পুরো পৃথিবী। অবলাল আলোক তরঙ্গ শনাক্ত করে ছবি তুলতে সক্ষম নভোদুরবিনটির তোলা সেই ছবিগুলোর মাঝে ছিল প্রায় সাড়ে ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের গভীর মহাকাশ, তারার জন্ম-মৃত্যু, গ্যালাক্সির বিবর্তন, সৌরজগতের বাইরের গ্রহে পানির উপস্থিতিসহ আরও অনেককিছু। এসব ছবি যে শুধু দেখতে শ্বাসরুদ্ধকর, তা নয়, সেগুলো বিশ্লেষণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জেনেছেন মহাকাশের সুদূরতম অতীতের নানা তথ্য। আগে মানুষ যতটা অতীতের মহাকাশ দেখতে পেয়েছিল, এই নভোদুরবিনের সাহায্যে পেরিয়ে গেছে সেই সীমা। সবমিলিয়ে বলা যায়, মানুষের মহাকাশচর্চার নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে এই টেলিস্কোপের মাধ্যমে।

২. আর্টেমিসের সফল যাত্রা

প্রায় অর্ধশতাব্দী পর আবারও চাঁদে ফিরছে বলে ঠিক করেছে মানুষ। মানুষকে চাঁদে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার এই উদ্যোগটি নিয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। আর্টেমিস মিশনের মাধ্যমে শুধু মানুষকে চাঁদে ফিরিয়ে নেওয়া হবে না, চাঁদ সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণার জন্য সেখানে স্থাপন করা হবে সাময়িক মানব বসতি।

আপাতত তিনটি আর্টেমিস মিশনের পরিকল্পনা করেছে নাসা। এ বছর এর প্রথমটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ১৬ নভেম্বর এসএলএস রকেটের মাধ্যমে চাঁদের কক্ষপথের উদ্দেশ্য যাত্রা করে আর্টেমিস-১। ক্রুবিহীন এই মিশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়।

আর্টেমিসের সফল যাত্রা
ডার্ট মিশন

৩. ডার্ট মিশন

সূর্য এবং গ্রহ-উপগ্রহ ছাড়াও সৌরজগতে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য গ্রহাণু। ছোটখাটো যেকোনো গ্রহাণুর আঘাতেই হতে পারে পৃথিবীর মারাত্মক ক্ষতি। এসব গ্রহাণুর নেই কোনো নির্দিষ্ট কক্ষপথ। তাই হুট করে পৃথিবীর দিকে কোনো গ্রহাণু ছুটে এলে সেটা থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন অনেকদিন। অবশেষে ২০০০ সালে নাসা এই ঝুঁকি থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে মহাকাশে পাঠায় ডার্ট স্পেসক্রাফট। প্রায় ৫৭০ কেজির এই স্পেসক্রাফটি সেকেন্ডে প্রায় ৪ মাইল গতিবেগে ডাইমরফোস নামের একটি গ্রহাণুকে গিয়ে আঘাত করে। ফলে, ডাইমরফোস তার কক্ষপথ থেকে কিছুটা সরে যায়। বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যও ছিল এমনটা। গ্রহাণুর কক্ষপথের সামান্য বিচ্যুতিই রক্ষা করতে পারে পৃথিবীকে আকস্মিক বিপদের হাত থেকে।

ডাইমরফোস পৃথিবীর জন্য ঝুঁকির কারণ ছিলো না। কিন্তু এ সফল অভিযান প্রমাণ করল, গ্রহাণু এখন আর পৃথিবীর জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ নয়।

৪. মিল্কিওয়ে গ্যলাক্সিকেন্দ্রের ব্ল্যকহোলের ছবি

২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ ব্যবহার করে প্রথমবারের মতো কোনো ব্ল্যাকহোলের ছবি তোলেন বিজ্ঞানীরা। ব্ল্যাকহোলটি ছিল সাড়ে ৫ কোটি আলোকবর্ষে দূরের এম৮৭ গ্যালাক্সিতে। এরপর বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছিলেন আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা অতিভারী ব্ল্যাকহোলের ছবি তোলার। অবশেষে ২০২২ সালের ১২ মে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের বিজ্ঞানীরা স্যাজেটেরিয়াস এ* ব্ল্যাকহোলের ছবি প্রকাশ করেন। প্রায় ৪০ লাখ সৌরভরের এই দানবীয় ব্ল্যাকহোলটি পৃথিবী থেকে প্রায় ২৭ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এর আগের ছবির মতো এটাও ছিল মূলত ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হরাইজনে থাকা উজ্জ্বল আলোর ছবি। এ থেকে অতিভারী ব্ল্যাকহোল নিয়ে অনেক অজানা প্রশ্নের জবাব পাওয়ার পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।

মিল্কিওয়ে গ্যলাক্সিকেন্দ্রের ব্ল্যকহোলের ছবি
প্রথম বাণিজ্যিক মহাকাশযাত্রা

৫. অ্যাক্সিওম-১: প্রথম বাণিজ্যিক মহাকাশযাত্রা

চলতি বছরের ৮ এপ্রিল প্রথমবারের মতো বেসরকারি (প্রাইভেট) মিশনের মাধ্যমে নভোচারীরা রওনা দেন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের উদ্দেশ্যে। এ মিশনের নাম অ্যাক্সিওম-১। যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস এক্স কোম্পানির তৈরি বিশেষ রকেটে করে ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে চার নভোচারী এই মহাকাশযাত্রা করেন। অ্যাক্সিওম-১ নামের এ মিশনের নেতৃত্বে ছিলেন নাসার সাবেক নভোচারী মাইকেল লোপেজ-আলেগ্রিয়া। সঙ্গে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন খাতের ব্যবসায়ী ল্যারি কনর, কানাডার ব্যবসায়ী মার্ক প্যাথি ও ইসরায়েলি উদ্যোক্তা ইতান স্টিবল।

এই চারজনই অর্থের বিনিময়ে মহাকাশ ভ্রমণ করেছেন। মোট ৮ দিন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন কাটান তাঁরা। তারপর নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। এজন্য প্রতি টিকিটে খরচ হয়েছে সাড়ে পাঁচ কোটি মার্কিন ডলার। মহাকাশে বাণিজ্যিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

৬. ব্ল্যাকহোলের শব্দ

শুধু ব্ল্যাকহোলের ছবি নয়, এ বছর প্রথমবারের বিজ্ঞানীরা রেকর্ড করেছেন ব্ল্যাকহোলের শব্দ। প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ আলোকবর্ষ দূরের একটি অতিভারী ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হরাইজন থেকে পাওয়া তরঙ্গকে শব্দে রূপান্তর করে প্রকাশ করেন নাসার বিজ্ঞানীরা।

এ বছর প্রথমবারের বিজ্ঞানীরা রেকর্ড করেছেন ব্ল্যাকহোলের শব্দ
মঙ্গলের ইনসাইট মিশনের পাঠানো শেষ ছবি

৭. মঙ্গলের ইনসাইট মিশনের পাঠানো শেষ ছবি

এ বছরের শেষদিকে নাসার পাঠানো স্পেস ক্রাফট ইনসাইট অকেজো হয়ে পড়ে মঙ্গলের বুকে। এর সোলার প্যানেলে অতিরিক্ত ধুলো জমে যাওয়া শক্তি সংকটে বন্ধ হয়ে যায় স্পেসক্রাফটটি। অকেজো হয়ে যাওয়ার আগে ইনসাইটের পাঠানো বার্তা ও শেষ ছবি আপ্লুত করে পৃথিবীর মানুষকে।

৮. শনির বলয়ের ব্যাখ্যা

শনির বলয়ের সঠিক ব্যাখ্যাও মেলে এ বছর। যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি এবং ইউসি-বার্কলের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখান, প্রায় ১৬ কোটি বছরে আগে শনির মহাকর্ষের টানে একটি চাঁদ ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংস হওয়া এই চাঁদের কণা দিয়েই গঠিত হয় শনির বলয়।

শনির বলয়
চীনের মহাকাশ স্টেশন

৯. চীনের মহাকাশ স্টেশন

শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ নয়, ২০২২ সালে মহাকাশ গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছি চীনও। অক্টোবরে চীন তাদের নিজস্ব স্পেস স্টেশনের শেষ অংশটি মহাকাশে পাঠায়। এর মাধ্যমে স্পেশ স্টেশনটির কাজ পুরোপুরি শেষ করলো চীন।

মহাকাশ অভিযানে নতুন প্রযুক্তি

১০. মহাকাশ অভিযানে নতুন প্রযুক্তি

গত নভেম্বরে সূর্যের তাপ ব্যবহার করে চলতে সক্ষম বিশেষ ধরনের নভোযানের প্রোটোটাইপ পরীক্ষা করে দেখেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। ‘সোলার সেইল’ নামের এই প্রযুক্তিটি ঠিকভাবে কার্যকর করা গেলে অনেক কম খরচে ও দ্রুততার সঙ্গে আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণ সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে সূর্যের আলো থেকে শক্তি সংগ্রহ করে, তা ব্যবহার করে চলবে মহাকাশযান। কার্যকরভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে অবশ্য এখনও আরও অনেক বছরের গবেষণা প্রয়োজন।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ

সূত্র: সায়েন্স ফোকাস, স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন, বিগ থিংক, উইকিপিডিয়া, নাসা