মহাকাশ
মহাবিশ্বের যে ছবি দেখা হয়নি কখনো
রাতের আকাশ, নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ—মহাবিশ্বের অপার রহস্য আমাদের সব সময় মুগ্ধ করে। ফটোগ্রাফার বা আলোকচিত্রীরা ক্যামেরায় সেসব রহস্যের কিছু ধারণ করতে পারেন। প্রতিবছর ইংল্যান্ডের রয়েল মিউজিয়ামস গ্রিনউইচ আয়োজন করে ‘অ্যাস্ট্রোনমি ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার’ প্রতিযোগিতা। সেখানে নিজেদের অসাধারণ দক্ষতা ও সৃজনশীলতা প্রদর্শন করেন বিশ্বের সেরা জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক ফটোগ্রাফাররা।
এ বছর ১৬তম ‘অ্যাস্ট্রোনমি ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার’ প্রতিযোগিতায় ৫৮টি দেশের পেশাদার ও শখের আলোকচিত্রীর কাছ থেকে প্রায় ৩ হাজার ৫০০টি ছবি জমা পড়ে। ১১টি ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরিতে। গত বৃহস্পতিবার ১২ সেপ্টেম্বর, অনলাইন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। বিশ্বের সেরা মহাকাশ ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতার বিশ্ব সেরা ছবিগুলো বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো।
বলয়গ্রাসে চাঁদের কারিকুরি
২০২৩ সালে বলয়গ্রাস পূর্ণগ্রহণের সময় তোলা হয় ছবিটি। পূর্ণ সূর্যগ্রহণের এ ছবিতে “বেইলি’স বিডস” বা ‘বেইলির হার’ প্রভাব দৃশ্যমান। পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় চাঁদ যখন প্রায় পুরোপুরি সূর্যকে ঢেকে ফেলে, তখন এ প্রভাব দেখা যায়। তবে চাঁদের অসমতল পৃষ্ঠের কারণে সূর্যের আলো বেরিয়ে আসে পাশ দিয়ে। এই আলো দেখতে মুক্তার হারের মতো। কিছু মুহূর্ত থাকে এটি, তারপর আর দেখা যায় না। ছবিটি তুলেছেন রায়ান ইম্পেরিও। অ্যাস্ট্রোনমি ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার প্রতিযোগিতায় সব ক্যাটাগরি মিলিয়ে এটি বিজয়ী হয়েছে।
সৌরকরোনার বিবর্তন
এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে সূর্যের কয়েক হাজার কিলোমিটার ওপরে বিস্তৃত বায়ুমণ্ডল। এটি করোনা অঞ্চল নামেও পরিচিত। আলোকচিত্রী এখানে ক্যামেরাবন্দী করেছেন সূর্যের করোনার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সক্রিয়তা কালের দৃশ্য। ছবির নিচের অংশটি ২০১৭ সালে তোলা হয়েছিল। সূর্য সে সময় সবচেয়ে কম সক্রিয় ছিল। ওপরের অংশটি ছয় বছর পরে ২০২৩ সালে তোলা, যখন সূর্য সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল। ফটোগ্রাফার পিটার ওয়ার্ড বিভিন্ন সময়ে তোলা বৃত্তাকার করোনার ছবিগুলোকে রঙিন করে সাজিয়ে একটি আয়তক্ষেত্রাকার চিত্রে মিলিয়েছেন। ফলে এই একটি ছবিতেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের করোনায় যেসব পরিবর্তন হয়েছে, তা এক নজরে বোঝা যায়। এটি প্রতিযোগিতার ‘আওয়ার সান’ ক্যাটাগরিতে রানার আপ হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার আকাশে রঙের খেলা
ল্যারিন রে নিউজিল্যান্ডের কুইন্সটাউনের পাহাড়ের ওপর থেকে তোলা এই ছবিতে অস্ট্রেলিয়ার অরোরার এই অসাধারণ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করেছেন। এটি ১৯টি ছবির সমন্বয়ে গঠিত প্যানারোমা। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দ্রুত গতিসম্পন্ন এই আরোরা ক্যামেরাবন্দী করেন তিনি। অরোরার সবগুলো গোলাপী রং স্পষ্টভাবে ধরতে এ আলোকচিত্রী একটি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন। ‘অরোরা’ ক্যাটাগরিতে সেরা ছবি নির্বাচিত হয়েছে এটি।
চাঁদের বুকে ক্ষত
গাবর বালাজের তোলা এই ছবিতে চাঁদের পৃষ্ঠের একটি বিশেষ গর্ত ‘সাইনাস ইরিডাম’ দেখা যাচ্ছে। এটি ‘বে অব রেইনবো’ নামেও পরিচিত। প্রায় ২৬০ কিলোমিটার ব্যাসের বিশাল গর্ত এটি, যা আবার কয়েকটি ছোট গর্ত দিয়ে ঘেরা। আলোকচিত্রী এ এলাকার ছবি তুলতে মনোক্রোম ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন। ওপরের ডান কোণে যে গর্তটি দেখা যাচ্ছে, ওটার নাম পিথাগোরাস। গর্তটি পৃথিবী থেকে দেখা যায়। এটি ‘আওয়ার মুন’ ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হয়েছে।
গ্যালাক্সির আলোকস্নান
বেন্স টথ ও পিটার ফেল্টো এই অসাধারণ ছবিটি তুলেছেন। এতে এনজিসি ৫১২৮ নামে একটি গ্যালাক্সি ও এর চারপাশের বিভিন্ন বস্তু দেখা যাচ্ছে। ছবিতে গ্যালাক্সি থেকে আলোর গতির কাছাকাছি বেগে বেরোনো শক্তিশালী আলোর কিরণও দেখা যায়। গ্যালাক্সিটির এমন দৃশ্য শুধু দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে দেখা যায় বলে ফটোগ্রাফাররা এ ছবি তুলতে নামিবিয়া গিয়েছিলেন। এটি ‘গ্যালাক্সিজ’ ক্যাটাগরির বিজয়ী ছবি।
সূর্যস্নাত আন্তর্জাতিক নভোস্টেশন
সূর্যের এই এইচ-আলফা ছবিতে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন সূর্যের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। আলোকচিত্রী টম উইলিয়ামস ছবিটি তুলেছেন। এ ছবি তোলা যে দুরূহ কাজ ছিল, তা বলা বাহুল্য। কারণ মহাকাশ স্টেশনটি মাত্র ০.২ সেকেন্ডের মধ্যে সূর্যকে অতিক্রম করে। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, সূর্য তখন খুব সক্রিয় ছিল। এটি ‘পিপল অ্যান্ড স্পেস’ ক্যাটাগরির সেরা ছবি নির্বাচিত হয়েছে।
উপগ্রহের নজরদারি
এই ছবিতে এক ঘণ্টার মধ্যে তোলা সবগুলো উপগ্রহের ছবি একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে। এই সুন্দর দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দী করেছেন আলোকচিত্রী ম্যাট জ্যাকসন। তিনি এই ছবির মাধ্যমে আমাদের জানাতে চেয়েছেন, আজকের দিনে আমাদের ওপর কতগুলো উপগ্রহ নজর রাখছে। এই ছবির মাধ্যমে তিনি গোপনীয়তা ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আমাদের সচেতন করতে চেয়েছেন। ছবিটির তোলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানার গ্যালাটিন কাউন্টি থেকে। এটি ‘পিপল অ্যান্ড স্পেস’ ক্যাটাগরিতে ‘হাইলি কমেন্ডেড’ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে।
আকাশজুড়ে নীহারিকা
নিউজিল্যান্ডের তাসমান পাহাড়ের উপত্যকার এই দৃশ্য রাতের আকাশের সৌন্দর্যকে আরও মনোমুগ্ধকরভাবে তুলে ধরেছে। গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ গোলার্ধে এই দৃশ্যের দেখা মেলে। টম রে নামে এক আলোকচিত্রী ছবিটি তুলেছেন। এই ছবিতে গাম নেবুলা বা নীহারিকা বিশাল হাইড্রোজেন মেঘের কেন্দ্রীয় লাল অংশ ও মিল্কিওয়ের বাহুজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন নক্ষত্র তৈরির সক্রিয় অঞ্চলগুলো দেখা যাচ্ছে স্পষ্টভাবে। ছবিটি ‘স্কাইস্কেপস’ ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হয়েছে।
বর্ণিল নীহারিকা
ক্যাসিওপিয়া নক্ষত্রমণ্ডলের নেরাইডেস নীহারিকার এই অসাধারণ ছবিটি তিনটি মহাদেশের টেলিস্কোপের সাহায্যে তোলা। ৩ হাজার ৫৫৯টি ছবির ফ্রেম ও ২৬০ ঘণ্টা ধরে এক্সপোজারের সাহায্যে তোলা হয়েছে ছবিটি। এই ছবিতে ক্যাসিওপিয়ার কেন্দ্রে একটি নতুন সুপারনোভার অবশিষ্টাংশ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই দলের সদস্যরা হলেন মার্সেল ড্রেচসলার, ব্রে ফলস, ইয়ান সেন্টি, নিকোলাস মার্টিনো এবং রিচার্ড গ্যালি।
লালের আবেশ
১৪ বছর বয়সী দানিয়েল বোর্সারির তোলা এই ছবিতে ক্যালিফোর্নিয়া নীহারিকা এনজিসি ১৪৯৯ দেখা যাচ্ছে। এই নীহারিকা পার্সিয়াস নক্ষত্রমণ্ডলে রয়েছে। এটি পৃথিবী থেকে প্রায় এক হাজার আলোকবর্ষ দূরে। নীল দৈত্যের নক্ষত্র সি পার্সি এই নীহারিকার গ্যাসকে আয়নিত করার ফলে এটি এত উজ্জ্বল দেখায়।