মঙ্গলগ্রহে মঙ্গলবাসী আছে কি

ছোটদের জন্য সহজ ভাষায় লেখা কঠিন। সহজ কথা যে যায় না বলা সহজে! অথচ একদম সহজ-সাবলীল ভাষায় লেখা এ বই। ‘টেলিস্কোপ কী বলে’ নামের বইটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাদুগা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। পাভেল ক্লুশান্‌ৎসেভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন অরুণ সোম। এ বইয়ে প্রচুর ছবি আছে। সেগুলো এঁকেছেন ইয়ে. ভোইশ্‌ভিল্লো, ব. কালাউশিন, ব.স্তারোদুব্‌ৎসেভ এবং ইউ. কিসিলিওভ। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে বইটি প্রকাশিত হচ্ছে…

মঙ্গলের দিকে উড়ে চলেছি। পৌঁছুতে এখনও ঢের দেরি আছে, কিন্তু গ্রহটিকে দেখা যাচ্ছে লালচে বালি রঙের গোলার মতন।

শুক্রের সঙ্গে মঙ্গলের অমিল বড়ই বেশি। মঙ্গল হালকা স্বচ্ছ বায়ুমণ্ডলে জড়ানো। বায়ুমণ্ডল নির্মেঘ। মঙ্গলে কোনো কিছুর আবরণ নেই, তাই তার সমস্ত খুঁটিনাটি ভালো করে দেখা যায়।

তার ওপরে একটা দিকে জেগে আছে একটা উজ্জ্বল সাদা ছোপ। অনেকটা টোপরের মতো। এটা মঙ্গলের দুটি মেরুর একটি। মঙ্গলে যখন শীতকাল কেবল তখনই এই টোপরটা দেখা যায়। গ্রীষ্মকালে থাকে না। তাহলে কি এটা তুষার?

মঙ্গলের অধিকাংশ জায়গা আলোকিত, লালচে রঙের। এই পটভূমিকার ওপর চোখে পড়ে গাঢ় ধূসর বর্ণের কিছু ছোপ। লোকে যখন প্রথম টেলিস্কোপ দিয়ে মঙ্গলকে দেখতে পায় তখন তারা ঐ ছোপগুলোকে ‘সমুদ্র’ বলত। তারা ভেবেছিল ওগুলো বুঝি আমাদের পৃথিবীর সমুদ্রের মতোই জলপূর্ণ। কিন্তু তা যদি হতো তাহলে তো সূর্যের কিরণে জল চকচক করত। অথচ মঙ্গলে কস্মিনকালে কোনো জিনিস চকচক করতে দেখা যায় না। লোকে শিগগিরই বুঝতে পারল গ্রহটির অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশগুলো একেবারে শুকনো।

কিন্তু ‘সমুদ্র’ নামটা রয়েই গেল।

নিরীক্ষণ করে দেখতে গেলে কখন কখন মনে হতে পারে যে বড় বড় কালো ছোপ ছাড়াও মঙ্গলে যেন অস্পষ্ট ভাবে চোখে পড়ছে অদ্ভুত কালো কালো কিছু রেখা। রেখাগুলো সূক্ষ্ম, টানা সুতোর মতো সোজা চলে গেছে। চলে গেছে নানা দিকে। ভাঙা হাঁড়ির ওপরকার ফাটলের মতো, দেখে মনে হয় এই বুঝি ভেঙে পড়ে যাবে।

এই রহস্যময় রেখাগুলোকে বলা হতো ‘খাল’। যদিও লোকের বুঝতে বাকি ছিল না যে ‘সমুদ্র’ যদি শুকনো হয় তাহলে ‘খালও’ জলপূর্ণ হতে পারে না; বিশেষত প্রন্থে যখন সেগুলো কয়েক ডজন কিলোমিটার!

লক্ষ করা গেছে যে মঙ্গলের ‘সমুদ্র’ ও ‘খালগুলো’ শীতকালে ফিকে। বসন্তকালে সেগুলোতে গাঢ় রঙ ধরতে থাকে—যেন তারা ‘রসে টেটম্বর’ হয়ে উঠছে। কখন-কখন মনে হয় যেন সবজেটে। শরৎকালে আবার ফিকে হতে থাকে। কিন্তু এই একই ব্যাপার তো ঘটে আমাদের পৃথিবীর বনে-জঙ্গলে। শীতকালে গাছপালা নগ্ন। এই সময় যদি ওপর থেকে, এই ধরো, এরোপ্লেন থেকে বনের দিকে তাকানো যায় তাহলে তাকে দেখাবে ধূসর, ম্লান স্বচ্ছ। আর গ্রীষ্মকালে গাছপালা ঢেকে যায় সবুজ পাতায়। বন ক্রমশ গাঢ় রঙ ধারণ করে।

এই কারণে অনেকের ধারণা হলো যে মঙ্গলের ঐ গাঢ় রঙের ছোপগুলো তার বন। আর যেখানে গাছপালা জন্মায় সেখানকার জমি ভিজে ও নাবাল না হয়ে যায় না।

জল যাতে বেশ তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারে তার জন্য পাইপগুলো সোজা টানা হয়। এই পাইপলাইনগুলো বরাবর মঙ্গলগ্রহে গ্রহবাসীদের সবজি খেত, মাঠ ও বাগান আছে—সেখানে জল সেচন করা হয়। এর পরে সর্বত্র ঊষর মরু।

একথা বিশ্বাস না করা কঠিন ছিল, কেননা মঙ্গলের ‘বনভূমি’ ঠিক তখনই গাঢ় হতে শুরু করে যখন তার মেরুর তুষার-টোপরটা গলতে থাকে। গাঢ় রঙ ধরে প্রথমে টোপরটার ঠিক কাছে, তারপর ধীরে ধীরে দূরে আরও দূরে ছড়িয়ে পড়ে। দেখে মনে হয় যেন বরফগলা জল গ্রহের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে আর তার ছোঁয়া পেয়ে উদ্ভিদকুলে প্রাণের সাড়া পড়ে গেছে।

কিন্তু কী ভাবে সেই জল বয়ে চলে? ঐ ‘খালগুলো’ দিয়ে নয় কি? তাহলে ‘খালগুলো’ এমন সোজা চলে গেছে কেন? প্রকৃতিতে সরল রেখা প্রায় হয় না বললেই চলে। নদী একেঁবেঁকে চলে। সমুদ্রের উপকূল ক্ষতবিক্ষত—সেখানে আছে খাড়ির পর খাড়ি। পাহাড়-পর্বত তো যেমন তেমন খুশি ভাই করা।

তবে মানুষ সরল রেখা টানতে ভালোবাসে। সে সরল রেখায় বাঁধ বাঁধে, তাতে বেশ শস্তা হয়। বনের ভেতর দিয়ে পথ কাটে সরল রেখায়, তাতে বিস্তর সুবিধা। মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী, তাই যে কোনো জিনিস যতটা সম্ভব ভালো সে তৈরি করে।

ভাই কোনো কোনো বিজ্ঞানী এই সিদ্ধান্তে এলেন যে মঙ্গলের টানা ‘খালগুলো’ বুদ্ধিমান মঙ্গলবাসীদের তৈরি। তাঁদের মতে, মঙ্গলে জল কম। মঙ্গলের বহুদূর বিস্তৃত আলোকিত ছোপগুলো সবই শুকনো বালু। সেখানে না আছে কোনো সমুদ্র, না সরোবর, না নদী। এমনকি সেখানে বৃষ্টিও হয় না। কিন্তু জল ছাড়া কী ভাবে জীবন ধারণ করা সম্ভব? তাই বসন্তকালে মেরুতে যখন তুষারটোপর গলতে থাকে তখন মঙ্গলবাসীরা সযত্নে মহামূল্যবান বারিকণা সংগ্রহ করে, এক ধরনের পাইপ দিয়ে জল পাঠিয়ে দেয় গরম দেশে, তাদের চাষবাসের জায়গায়, নিজেদের শহরগুলোতে।

জল যাতে বেশ তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারে তার জন্য পাইপগুলো সোজা টানা হয়। এই পাইপলাইনগুলো বরাবর মঙ্গলগ্রহে গ্রহবাসীদের সবজি খেত, মাঠ ও বাগান আছে—সেখানে জল সেচন করা হয়। এর পরে সর্বত্র ঊষর মরু। সমস্ত গ্রহে সরবরাহ করার মতো যথেষ্ট জল নেই।

সুতোয় গাঁথা স্মৃতির মতো জলের পাইপলাইনে গাঁথা এই সবুজ জমিগুলোকেই নাকি আমরা গাঢ়রঙের রহস্যময় ফালির আকারে দূরে থেকে দেখতে পাই।

মানুষের কল্পনায় কী সুন্দরই না মনে হয় এই সব! মঙ্গলের শহর। মঙ্গলবাসীদের প্রাসাদ। তাদের কুসুমিত বাগান!..

কিন্তু মঙ্গলের যত কাছে আমরা আসতে থাকি, একের পর এক আমাদের মোহভঙ্গ হতে থাকে।

প্রায় সমস্ত আলোকিত জায়গাই, আমরা যেমন ভেবেছিলাম, মরুপ্রান্তর। অবশ্য এটাও ঠিক যে কোথাও কোথাও চাঁদের গহহ্বরের মতো গোল গোল নীচু গর্ত আছে। কিন্তু ‘সমূদ্র’ বলতে আমরা যা মনে করতাম দেখা যাচ্ছে তা সম্পূর্ণ উলটো। বনজঙ্গলে ভর্তি কোনো ‘ভিজে নাবাল জমি’ আদৌ নয়। প্রায় সমস্তটাই স্রেফ অনুর্বর পাহাড়ী এলাকা।

অদ্ভুত ব্যাপার এই যে কাছ থেকে কিন্তু ‘খালগুলোকেও’ আর দেখা যাচ্ছে না। সে জায়গায় চোখে পড়ছে একই রকম পাহাড়-পর্বত, গহর, খাত—যেমন আশেপাশের সর্বত্র আছে।

গোটা কয়েক সোভিয়েত ও মার্কিন স্বয়ংক্রিয় স্টেশন মঙ্গলের দিকে যায়। সেগুলো গ্রহের চারধারে ঘুরে ঘুরে যন্ত্রপাতির সাহায্যে তার ওপর অনুসন্ধান চালায়, চতুর্দিক থেকে তার আলোকচিত্র গ্রহণ করে। এ থেকে কৌতূহলজনক অনেক কিছু জানা গেছে।

এরকম কেন হলো? সমভূমির চেয়ে পাহাড়-পর্বত বেশি কালো কেন? বসন্তকালে সেগুলো আরও কালো হয়ে যায় কেন? কোথায় গেল সেই ‘খালগুলো’? সেখান থেকে যে চাঞ্চল্যকর অনেক কিছু, আমরা আশা করেছিলাম।

যত কাছে আসতে থাকি মঙ্গলের ‘মূল রহস্যগুলো’ ততই অল্প অল্প করে আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে আসতে থাকে। মঙ্গলে বিস্তর ধূলোবালি। আমাদের পৃথিবীতে যেমন, তেমনি ওখানেও ধূলোবালি খালি পাথরের চাঁইয়ের তুলনায় উজ্জ্বল।

মঙ্গলে বাতাসের খুব জোর। গ্রহের যে সমস্ত জায়গা উঠে আছে প্রবল বাতাস সেখান থেকে ধুলো উড়িয়ে নিয়ে যায়। অর্থাৎ পাহাড় থেকে খুলো যায় নাবাল জমিতে। পাহাড় সব সময় বাতাসের ফুঁয়ে পরিষ্কার। এই জন্য কালো দেখায়। কিন্তু তার পাদদেশে যে সমভূমি সেখানে সব সময় ঝেঁটিয়ে রাজ্যের ধূলোবালি এসে জমছে। তাই সেইখানটা উজ্জল। বসন্তকালে মেরুতে বরফ গলে। সেখান থেকে ভিজে বাতাস বইতে থাকে। সেই বাতাসে গ্রহ ‘ধোয়ামোছা’ হয়ে যায়। এর পর পাহাড়-পর্বত খানিকটা ‘সতেজ হওয়ার’ ফলে আরও কালো দেখায়। গোটা ব্যাপারটা খুবই সহজ। বনের সঙ্গে এর কোন রকম সম্পর্ক নেই।

তা না হয় হলো, কিন্তু ‘খাল’? এটা সম্ভবত দৃষ্টিবিভ্রম। খাত, গহর ইত্যাদি ‘বড়োখেবড়ো জায়গাগুলো’ মঙ্গলে পুরোপুরি বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোথাও ঘন, কোথাও বিরল। তবে কোথাও হয়ত দৈবাৎ তিনটে কি চারটে গহর সার বেধে আছে। কোথাও হয়ত দৈবাৎ প্রায় সরল রেখায় চলে গেছে পর্বতশ্রেণী। কোথাও বা দৈবাৎ মরুভূমির বুক চিরে তীরের মতো সোজা চলে গেছে বিশাল বিশাল খাত। সবগুলো জায়গা দূর কালো কালো টানা ফালি বলে আমাদের মনে হয়।

কিন্তু এখন পর্যন্ত বুদ্ধিমান মঙ্গলবাসীদের নির্মাণকলার কোনো পরিচয় পাওয়া গেল না। বরং দেখেশুনে মনে হয় সে রকম কোনো প্রাণী ওখানে নেই।

তবু মঙ্গলকে চাঁদ, বুধ বা শুক্রের মতো প্রাণহীন গ্রহ বলে আমাদের মনে হয় না। ঐ গ্রহগুলো চুল্লীতে ঝাঁই পোড়া পাথরের মতো যা তা রকমের শুকনো। জল ছাড়া তো আর কোনো রকমের জীবন সম্ভব নয়! কিন্তু মঙ্গল আর যাই হোক, একটু ‘ভিজ-ভিজে’।

গোটা কয়েক সোভিয়েত ও মার্কিন স্বয়ংক্রিয় স্টেশন মঙ্গলের দিকে যায়। সেগুলো গ্রহের চারধারে ঘুরে ঘুরে যন্ত্রপাতির সাহায্যে তার ওপর অনুসন্ধান চালায়, চতুর্দিক থেকে তার আলোকচিত্র গ্রহণ করে। এ থেকে কৌতূহলজনক অনেক কিছু জানা গেছে।

জানা গেছে মঙ্গলের দুই মেরুর ঐ যে সাদা টোপর ওগুলো প্রধানত গড়ে উঠেছে ‘শুকনো বরফে’, যে শুকনো বরফ পৃথিবীতে আমরা আইসক্রীমের বাক্সে রাখি। এছাড়াও অবশ্য আছে আমাদের সাধারণ তুষার ঠান্ডায় জমা জল। বসন্তে সেই তুষার গলে বাষ্প হয়ে যায়। আর্দ্রতা বায়ুতে সঞ্চারিত হয়, বায়ুপ্রবাহে তাড়িত হয়ে চলে যায় গ্রহের উষ্ণ অংশগুলোতে; সেখানে রাতের পর রাত সাদা হিমকণা হয়ে ঝরে পড়তে থাকে ঠান্ডায় জমাট জমির ওপর। প্রভাতী সূর্যের কিরণে হিমকণা গলে যায়, ফলে কয়েক মিনিটের জন্য মাটি ভিজে যায়। উদ্ভিদ অথবা কীটপতঙ্গের মতো চেতন পদার্থ এই সময়ের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে জল পেতে পারে।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই যে মঙ্গলকে কাছ থেকে নিরীক্ষণ করার পর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রগুলো সেখানে মজা নদীর খাত দেখতে পায় এবং তার আলোকচিত্রও গ্রহণ করে। তার মানে, এই কিছুকাল আগেও মঙ্গলে প্রবল জলধারা ছুটে চলত? পরে তাহলে সমস্ত জলপ্রবাহ গেল কোথায়? তাহলে কি মাটি সেগুলো শুষে নিয়েছে আর সেখানেই জমাট হয়ে গেছে? মঙ্গলে ত আবার ঠান্ডাও বটে।

আমাদের এই পৃথিবীতে প্রাণীরা বাস করে গ্রহের পিঠে। সেটাই তাদের পক্ষে বেশি সুবিধাজনক। উষ্ণতা আর জল দুইই যথেষ্ট পরিমাণে আছে। কিন্তু মঙ্গলে সম্ভবত মাটির তলায় গর্ত খুঁড়ে বাস করা বেশি সুবিধার।
আরও পড়ুন

কিন্তু স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহায্যে আবার ‘চুল্লিও’ দেখতে পাওয়া গেছে’—সেগুলো মাটির তলায় জমাট জল গলানোর ক্ষমতা রাখে। মঙ্গলে আগ্নেয়গিরির সন্ধান পাওয়া গেছে। ঐ সমস্ত আগ্নেয়গিরি এখন অবশ্য আর অগ্ন্যুদ্গীরণ করে না, নিভে গেছে। কিন্তু তা হলেও তাদের চারপাশে, নীচ থেকে, গ্রহের গভীর তলদেশ থেকে উত্তাপ যায়। এর ফলে জমাট মাটি গলতে পারে। আর কোনো আগ্নেয়গিরি থেকে যদি অগ্ন্যুদ্গীরণ শুরু হয়, সেখান থেকে গনগনে লাভাস্রোত বেরিয়ে আসে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের সব কিছু গরম হয়ে উঠবে, তখন শতধারে উপছে পড়বে।

এ সমস্তর অর্থ হলো এই যে মঙ্গলে জীবিত প্রাণীর পক্ষে ওপরের বায়ু থেকে এবং নীচের মাটি থেকে জল সংগ্রহ করার পথে কোন বাধা নেই।

এই কারণেই আমাদের মনে হয় মঙ্গলে ‘কেউ না কেউ’ অন্তত বাস করে। কিন্তু কে?

অবশ্য সেখানে যে ‘মানুষ’ আছে এমন মনে করার খুব একটা কারণ আমরা দেখি না। কিন্তু এই ধর, গাছগাছড়া, ছোটখাটো প্রাণী—এরা ত থাকতেই পারে।

ওখানে কোথায় তারা বাস করতে পারে? কোথায় তাদের খোঁজ করা যায়?

আমাদের এই পৃথিবীতে প্রাণীরা বাস করে গ্রহের পিঠে। সেটাই তাদের পক্ষে বেশি সুবিধাজনক। উষ্ণতা আর জল দুইই যথেষ্ট পরিমাণে আছে। কিন্তু মঙ্গলে সম্ভবত মাটির তলায় গর্ত খুঁড়ে বাস করা বেশি সুবিধার। যদি মাটির ওপরে উঠতেই হয় তো কেবল আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে, যেখানে বেশ উষ্ণতা আছে, আর আর্দ্রতাও বেশি আছে। এবারে সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা বলি। মঙ্গলের পাহাড়-পর্বত ও প্রান্তরের ওপর দিয়ে ওড়ার সময় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র অনেকগুলো রঙিন ছবি তোলে। সেই সব ছবিতে দেখা গেছে কিছু কিছু গহরের তলদেশে সবুজ-সবুজ! বলা যায় না, এটাই হয়ত মঙ্গলগ্রহে ‘প্রাণের চিহ্ন’? হয়ত বা আমরা এখনই দেখতে পার মঙ্গলের ‘কল্পনাতীত’, আশ্চর্য কোনো গাছগাছড়ার সবুজ পাতার গালিচা, যার মধ্যে গিজগিজ করছে আমাদের অজানা, অলৌকিক সমস্ত খুদে খুদে জন্তুজানোয়ার?

১৯৭৬ সালে ‘ভাইকিং-১’ ও ‘ভাইকিং-২’ নামে দুটি মার্কিন স্বয়ংক্রিয় স্টেশন মঙ্গলে নামে। মঙ্গলে সত্যি সত্যিই প্রাণ আছে না নেই, পুরোপুরি জানার ভার তাদের ওপর দেওয়া হয়েছিল।

‘ভাইকিং’ স্টেশনদুটো তাদের ধাতব মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে রেডিওর সাহায্যে মঙ্গলের চারপাশের এলাকার সুন্দর সুন্দর আলোকচিত্র পৃথিবীতে পাঠায়। আলোকচিত্রে দেখা গেল সীমাহীন বালির মরুভূমি, তার ওপর পড়ে আছে অর্ধেক বালিতে ঢাকা সব পাথর।

আলোকচিত্রে জীবনের সামান্যতম লক্ষণও দেখা গেল না। এরপর ভাইকিং স্টেশনদুটো তাদের কাছাকাছি জায়গায় মাটি খুঁড়ে সেই মাটি ‘গিলে’ ভেতরে নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে লাগল তার মধ্যে অন্তত অতি ক্ষুদ্র আকারের এমন কোনো জীবন্ত ব্যাক্টেরিয়া আছে কিনা যাদের খালি চোখে দেখা যায় না। পৃথিবীতে কিন্তু তারা সর্বত্র আছে এমনকি মরুভূমির বালুতেও।

স্টেশনদুটোর কাজের মধ্যে কোনো ফাঁকি ছিল না। তারা শেষ পর্যন্ত জানাল: ‘দেখেশুনে মনে হচ্ছে মঙ্গলে জীবন্ত কিছুই নেই। আবার একেবারেই যে কিছু নেই এমন কথাও হলফ করে বলা যায় না।’

বোঝ কাণ্ড! এর অর্থ কী? মানুষ তাই আজ পর্যন্ত জানতে পারেনি মঙ্গলে প্রাণ আছে কি নেই।

কিন্তু প্রাণ নিঃসন্দেহে সেখানে থাকা সম্ভব। তাই আগের মতোই আমরা আশা করতে পারি যে আজ হোক কাল হোক। একদিন আমরা ওখানে প্রাণের খোঁজ পাব।

যাই হোক, আমরা মঙ্গলের কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম। একটা সমতলমতো জায়গা বেছে নিয়ে মহাকাশযান নামালাম।

আকাশ নির্মেঘ, গাঢ় বেগুনী রঙের যেমন আমরা দেখেছি বুধে। বুধের আকাশের মতো এখানেও উজ্জল আলো থেকে নিজেকে আড়াল করলে দিনের বেলায় তারা দেখা যায়।

এই ছোট্ট জানলার ভেতর দিয়ে যখন সে পৃথিবীর সমুদ্র দেখতে পাবে তখন হয়তো ঈর্ষায় তার চোখ ফেটে জল আসবে। মিঠাইয়ের পাহাড় আর ক্ষীরের নদী দেখলে আমাদের যে অবস্থা হবে তারও অবস্থা হবে সেই রকম। মঙ্গলে জল সম্ভবত মহামূল্যবান বস্তুর মতো বোতলে করে বিক্রি হয়।
আলোক টেলিস্কোপে মঙ্গলগ্রহ
নাসা
আরও পড়ুন

চারদিকে তাকিয়ে দেখি। একদিকে আদিগন্ত বিস্তৃত নয়নাভিরাম বালির ঢিবি। অন্য দিকে, সামান্য দূরে দেখা যাচ্ছে মনোরম শিলাময় পাহাড়ের শ্রেণি। পায়ে হেটে রওনা দিই এই পাহাড়ের দিকে।

আমাদের পরনে অবশ্য স্পেস স্যুট আছে। নিশ্বাস নিতে হচ্ছে সিলিন্ডার থেকে, আমাদের পৃথিবীর বাতাসের সাহায্যে। এখানকার বাতাসের যা গঠন তাতে আমাদের পোষাবে না। তাছাড়া এ বাতাস আমাদের বাতাসের চেয়ে একশ গুণ বেশি হালকা।

এই রকম পাতলা হাওয়ায় কোনো পাখি বা কীটপতঙ্গ ভেসে থাকতে পারে না। মঙ্গলে কেবল বুকে হাঁটা যায়, দৌড়ানো ও লাফানো যায়।

মঙ্গলবাসী বলে যদি কোন প্রাণী থাকে ত পাখাওয়ালা তারা কোন রকমেই হতে পারে না।

মঙ্গলবাসী! তাদের সম্পর্কে মানুষের কতই না জল্পনা- কল্পনা!

কেউ কেউ মনে করে তারা সম্ভবত খুবই ছোট—পিপড়ের সমান।

কেউ কেউ তাদের শাড়ওয়ালা আটপেয়ে জীব বলে কল্পনা করে।

কারও কারও ধারণায় তারা সম্ভবত মানুষেরই মতন। আচ্ছা সত্যিই যদি তাই হয়?

যে রকমই তারা হোক না কেন, পৃথিবী সম্পর্কে সম্ভবত তাদের খুব কৌতূহল। তাদের যদি আমরা দেখা পাই তাহলে একজন মঙ্গলবাসীকে অন্তত আমরা সঙ্গে নিয়ে যাব। তাকে দেখাব আমাদের গ্রহ।

অবশ্য এটা ঠিক যে আমাদের এই পৃথিবীর আবহাওয়ার সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার দফা-রফা হয়ে যাবে। তাকে একটা জানলাসমেত ছোটখাটো ফ্রিজের ভেতরে বসিয়ে পৃথিবী ঘোরাতে হবে।

এই ছোট্ট জানলার ভেতর দিয়ে যখন সে পৃথিবীর সমুদ্র দেখতে পাবে তখন হয়তো ঈর্ষায় তার চোখ ফেটে জল আসবে। মিঠাইয়ের পাহাড় আর ক্ষীরের নদী দেখলে আমাদের যে অবস্থা হবে তারও অবস্থা হবে সেই রকম। মঙ্গলে জল সম্ভবত মহামূল্যবান বস্তুর মতো বোতলে করে বিক্রি হয়। কিন্তু পৃথিবীতে মহাসাগর ভরতি জল আর জল—সে জলের কানাকড়ি দাম নেই।

আমাদের এই খুদে মঙ্গলবাসীটি সম্ভবত সারা দিন মুগ্ধ হয়ে দেখত পৃথিবীর মেঘ। তাদের ওখানে এরকম যে কিছুই নেই! আমাদের মেঘ কতই না সুন্দর হয়ে থাকে বিশেষত সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়!

আমাদের এই খুদে মঙ্গলবাসীটি সম্ভবত সারা দিন মুগ্ধ হয়ে দেখত পৃথিবীর মেঘ। তাদের ওখানে এরকম যে কিছুই নেই! আমাদের মেঘ কতই না সুন্দর হয়ে থাকে বিশেষত সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়!

পাহাড়ের দিকে যেমন চলছিলাম সেই রকম চলা যাক। বেশ দূরের পথ। ঝুরঝুরে বালিতে পা ডুবে যায়। পাহাড়ের ঢালে ইতিমধ্যে সবুজ আভা দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হয় যেন শিলাখণ্ডের ওপর জায়গায় জায়গায় শেওলার পোঁচ পড়েছে।

শৈলমালা এবারে একেবারে কাছে। দূর থেকে আমরা যাকে শেওলা বলে ভেবেছিলাম এখন তাকে নিচু নিচু ঝোপঝাড়ের মতো দেখাচ্ছে।

এমন সময়!.. এই ঝোপঝাড়ের নীচেই কী যেন নড়েচড়ে উঠল! জীবন্ত কেউ একটা লাফিয়ে আমাদের দিকে এলো, ফের মিলিয়ে গেল ঝোপঝাড়ের নীচে!.. আরে, ‘ওরা’ যে দেখছি সংখ্যায় অনেক!.. ওরা আমাদের দেখতে পেয়েছে!.. আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।...

ওরা কারা?

না, আমাদের এই গল্পকথা আর বাড়াব না। তোমরা বুঝতে পারছ, মঙ্গলে আসলে এখনও কেউ যেতে পারেনি। তাই এই গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে তোমরা নিজেরাই আরও ভালো করে কল্পনাবিলাস করতে পার। যার যেমন খুশি। এতে আরও মজা পাবে। বড় হয়ে তোমরা নিজেরাই মঙ্গলে গিয়ে দেখে এসো কার কথা সত্যি।

(চলবে...)

মূল: পাভেল ক্লুশান্‌ৎসেভ

অনুবাদ: অরুণ সোম

'টেলিস্কোপ ও আকাশ' বই থেকে আরও পড়ুন