সূর্যের বয়স কত

সৌরজগতের মোট ভরের ৯৯.৮০ শতাংশই সূর্যের দখলেছবি: সংগৃহীত
সূর্যের বয়স আসলে কত? কীভাবেই-বা সূর্যের এই বয়স নির্ধারণ করলেন বিজ্ঞানীরা? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞান ও গণিতের সূত্র ধরে এগোতে হবে। তবে আমরা জটিলতার দিকে যাব না। উত্তর জেনে নেব সহজে।

সৌরজগতের প্রাণ বলা যায় সূর্যকে। এটিই সৌরজগতের সবচেয়ে বড় বস্তু। পৃথিবীর ব্যাসের তুলনায় ১০৯ গুণ বড়। সৌরজগতের মোট ভরের ৯৯.৮০ শতাংশই সূর্যের দখলে। সূর্যের বুকে এঁটে যাবে প্রায় ১৩ লাখ পৃথিবী। সৌরঅধিপতির অসীম শক্তির কারণে প্রাচীন মিসর থেকে শুরু করে মায়া সভ্যতা পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ সূর্যের পূজাও করেছে।

আমরা জানি, সূর্যের অবস্থান সৌরজগতের কেন্দ্রে। স্বাভাবিক। গোটা সৌরজগতে এর জন্মই সবার আগে। একে ঘিরেই তৈরি হয়েছে বাকি সব গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো, সূর্যের বয়স আসলে কত? কীভাবেই-বা সূর্যের এই বয়স নির্ধারণ করলেন বিজ্ঞানীরা? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞান ও গণিতের সূত্র ধরে এগোতে হবে। তবে আমরা জটিলতার দিকে যাব না। উত্তর জেনে নেব সহজে। চলুন, সেই চেষ্টা করা যাক।

দ্বিতীয় প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি। সূর্যের বয়স মাপা হয় কীভাবে। ধরুন, একটা অপরাধ হয়েছে। খেয়াল করলে দেখবেন, দুঁদে গোয়েন্দারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আশপাশটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেন। কোনো কিছু অস্বাভাবিক লাগছে কি না, মিলিয়ে দেখেন। এরপর শোনেন প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য। বিভিন্ন জায়গা থেকে নেন আঙুলের ছাপ। দরকার হলে মৃতদেহের ডিএনএও পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। তারপর ঠিক ধরে ফেলেন অপরাধীকে। অর্থাৎ, একজন গোয়েন্দা সম্ভাব্য সবরকম চেষ্টা করে তবেই অপরাধীকে ধরতে পারেন।

আরও পড়ুন
সূর্যের বয়স নির্ণয় করার একটি পদ্ধতি হলো, সৌরজগতের সবচেয়ে প্রাচীন কোনো বস্তু খুঁজে বের করা। তারপর সেই বস্তুর বয়স নির্ণয় করতে পারলেই সৌরজগতের অন্যান্য বস্তুর বয়স নির্ধারণ করা যায়। বিজ্ঞানের ভাষায়  এ পদ্ধতিকে বলে নিউক্লিওকসমোক্রোনোলজি।

সূর্যের বয়স নির্ধারণের জন্যও সম্ভাব্য নানারকম চেষ্টা করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। সবরকম চেষ্টায় ফলাফল একই হলে ধরে নিতে হয়, ফলাফল সঠিক। বিজ্ঞানীরা সূর্যের বয়স নির্ধারণ করতে গিয়ে সম্ভাব্য সব ফলাফল এক করে দেখেছেন, একই ফলাফল পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, তাদের হিসাব ঠিক আছে। কী সেই হিসাব? 

সূর্যের বয়স নির্ণয় করার একটি পদ্ধতি হলো, সৌরজগতের সবচেয়ে প্রাচীন কোনো বস্তু খুঁজে বের করা। তারপর সেই বস্তুর বয়স নির্ণয় করতে পারলেই সৌরজগতের অন্যান্য বস্তুর বয়স নির্ধারণ করা যায়। বিজ্ঞানের ভাষায়  এ পদ্ধতিকে বলে নিউক্লিওকসমোক্রোনোলজি। শব্দটির অর্থ খুঁজলে দেখবেন, এ কৌশলের সঙ্গে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা জড়িত। এ কাজ করার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমন বস্তু খোঁজেন, যা অনন্য। মানে পৃথিবীতে তৈরি করা সম্ভব নয়, এমন কিছু। এরকম একটি বস্তু হলো আয়রন-৬০। এটি লোহার একধরনের আকরিক। এর কেন্দ্রে থাকে মোট ৬০টি প্রোটন ও নিউট্রন। আয়রন-৬০ তৈরি করা অনেক কঠিন। দুঃসাধ্য। সাধারণত সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে পাওয়া যায় এই আকরিক। কয়েক লাখ বছর পরে আয়রন-৬০ বদলে গিয়ে নিকেল-৬০-এ রূপান্তরিত হয়। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এটি নিকেলের আকরিক। আরও বেশি স্থিতিশীল এবং কখনো পরিবর্তন হয় না। 

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নিকেলের আকরিকটি সৌরজগতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অবস্থায় পেয়েছেন। বিশেষ করে উল্কাপিণ্ডের ভেতরে। ওসব উল্কাপিণ্ড সৌরজগৎ সৃষ্টির সময় তৈরি হয়েছিল। এই আকরিকের বয়স হিসেব করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বের করেছেন সূর্যের বয়স। 

আরও পড়ুন
চাঁদের সাহায্যেও সূর্যের বয়স নির্ধারণ করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার কল্যাণে এখন পর্যন্ত ৬ বারে ১২ নভোচারী চাঁদের বুকে পা রেখেছেন।

সূর্যের বয়স পরিমাপের আরেকটি পদ্ধতি আছে। আমরা জানি, মহাবিশ্বে নক্ষত্রের সংখ্যা কোটি কোটি। আমরা এর কিছু সম্পর্কে জানি। সে জানাও খুব সামান্য। নক্ষত্রের জীবনকাল এত বেশি যে নক্ষত্রের সম্পূর্ণ জীবনকাল অনুসরণ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। তবে একেকটি নক্ষত্রের জীবনের একেক সময় আমরা দেখতে পারি। কারণ, সব নক্ষত্রের বয়স এক নয়, আলাদা আলাদা। কোনো কোনো নক্ষত্র হয়ত সম্প্রতি জন্মেছে, আবার কোনোটা অনেক আগেই জন্মেছে। সুতরাং আমাদের কাছে নক্ষত্রের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের ছবি আছে। সেসব ছবি নিয়ে গবেষণা করেও সূর্যের বয়স নির্ধারণ করা যায়। 

বিষয়টা আরেকটু সহজ করে বলি। ধরুন, আপনি ১০ লাখ ভিন্ন মানুষের ছবি তুললেন। ছবিগুলো তুলবেন র‍্যান্ডমলি। মানে যাকে সামনে পাবেন, তার ছবিই তুলবেন। সে হোক ছোট, বড় বা বৃদ্ধ। সব ছবি পাশাপাশি সাজালে দেখবেন, কেউ হয়তো হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে শিখেছে, কেউ হয়তো একটু একটু দাঁড়িয়ে সবে হাঁটা শুরু করেছে। আবার কেউ জীবনের মধ্য বয়সে কাজ করে ঘরে ফিরছেন। কোনো বৃদ্ধ হয়তো জীবনের শেষ সময়ে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। এখন এই ছবিগুলোর সাহায্যে আপনি মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবনের একটা ধারণা পাবেন। কিন্তু খেয়াল করুন, আপনি কিন্তু কোনো মানুষকে শৈশব থেকে বৃদ্ধ হওয়া পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেননি। তারপরেও আপনি একটি ধারণা পেয়ে যাচ্ছেন। অনেকটা একই পদ্ধতি ব্যাবহার করা হয়েছে সূর্যের বয়স নির্ণয়ে। লাখ লাখ নক্ষত্রের ছবি নিয়ে গবেষণা করে একটি মানচিত্র তৈরি করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। একটি নক্ষত্রের নির্দিষ্ট ভর ও উজ্জ্বলতা জানা থাকলে ওই নক্ষত্রের বয়স বের করা যায়। এই ম্যাপিং পদ্ধতি ব্যবহার করে নির্ণয় করা হয়েছে সূর্যের বয়স।

আরও পড়ুন

এ দুটি পদ্ধতির পাশাপাশি চাঁদের সাহায্যেও সূর্যের বয়স নির্ধারণ করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার কল্যাণে এখন পর্যন্ত ৬ বারে ১২ নভোচারী চাঁদের বুকে পা রেখেছেন। তাঁরা চাঁদের কিছু শিলা ও ধুলোবালি নিয়ে এসেছেন পৃথিবীতে। সেই নমুনা পরীক্ষা করেও সূর্যের বয়স অনুমান করেছেন বিজ্ঞানীরা। সূর্যের বয়স নির্ণয়ে চাঁদের মাটি ব্যবহার করা হয়েছে, কারণ লাখ লাখ বছর ধরে চাঁদের পৃষ্ঠে কোনো পরিবর্তন হয়নি। 

ওপরে উল্লেখিত প্রত্যেকটি পদ্ধতি আলাদা আলাদাভাবে গোয়েন্দাদের মতো করে পর্যবেক্ষণ করেছেন দুঁদে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। উত্তর পেয়েছেন একই। সূর্যের বয়স প্রায় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন বছর। মানে সাড়ে চারশো কোটি বছরেরও বেশি।

সূত্র: ডিসকভারি ডট কম ও ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস ডট কম

এই সিরিজের আরও লেখা পড়ুন