মঙ্গল গ্রহে গিয়ে পর্যটকরা কী দেখবেন

লাল গ্রহ মঙ্গল—আমাদের সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ। এ গ্রহে রয়েছে বিশাল আগ্নেয়গিরি, গভীর গিরিখাত, লাল মাটি। সম্প্রতি এ গ্রহে পানির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সব মিলিয়ে বলা যায়, বর্তমানে বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মঙ্গল। কেন এত আগ্রহ মঙ্গল নিয়ে? কারণ, চাঁদের পর মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। ইলন মাস্কের স্পেসএক্স দীর্ঘদিন ধরেই এ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

কখনো ভেবেছেন, একদিন হয়তো আমরা মঙ্গলে ঘুরতে যেতে পারব? বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গল গ্রহ ভবিষ্যতে আমাদের জন্য হয়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় গন্তব্য। মানুষ হয়তো কলোনি তৈরি করতে পারে, আবার ঘুরতেও যেতে পারেন অনেকে। যদিও মঙ্গলে মানুষ পাঠানো এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ভবিষ্যতে এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে পারে। শিগগিরই। কিংবা হয়তো অপেক্ষা করতে হতে পারে আরও বেশ কয়েক বছর বা যুগ। কিন্তু যদি সত্যিই মঙ্গলে ঘোরার সুযোগ মেলে, কোথায় যাবেন ঘুরতে?

বাস্তবে এখুনি যেতে না পারলে কী হবে, চলুন কল্পরথে চড়ে বসি। জেনে আসি, মঙ্গলের আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো কী হতে পারে।

অলিম্পাস মনস

অলিম্পাস মনস দেখতে বিশাল ঢালের মতো। লাভা ধীরে ধীরে এর ঢাল বেয়ে নেমে এসে এই বিশাল পর্বত গঠন করেছে

পৃথিবীতে আগ্নেয়গিরি দেখতে কৌতূহল বোধ করেন অনেক পর্যটক। আপনিও যদি তাদের একজন হয়ে থাকেন, তাহলে সুখবর আছে আপনার জন্য। মঙ্গলের অলিম্পাস মনস গোটা সৌরজগতেরই সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি। থারসিস আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে অবস্থিত বিশাল এটি। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার তথ্য অনুযায়ী, আগ্নেয়গিরিটির আকার যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা রাজ্যের প্রায় সমান। উচ্চতায় প্রায় ২৫ কিলোমিটার। কত বড়, সেটা হয়তো এটুকু পড়ে বোঝা যায় না। এটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট এভারেস্টের প্রায় তিন গুণ!

অলিম্পাস মনস দেখতে বিশাল ঢালের মতো। লাভা ধীরে ধীরে এর ঢাল বেয়ে নেমে এসে এই বিশাল পর্বত গঠন করেছে। এ কারণেই এই পর্বতের ঢাল খুব বেশি খাড়া নয়। মাত্র ৫ শতাংশ খাড়া। ফলে ভবিষ্যতে কোনো অভিযাত্রী যদি এই পর্বত আরোহণ করতে চান, তাহলে তাঁদের জন্য কাজটি তুলনামূলক সহজই হবে। তা ছাড়া মঙ্গলের মহাকর্ষ পৃথিবীর মহাকর্ষের এক-তৃতীয়াংশ মতন। ফলে উঠতে এমনিতেও কষ্ট কমই হবে পৃথিবীর তুলনায়।

অলিম্পাস মনসের চূড়ায় প্রায় ৮৫ কিলোমিটার চওড়া একটি বিশাল গর্ত রয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, গর্তটি আগ্নেয়গিরির অভ্যন্তরে থাকা ম্যাগমা চেম্বার ধসে পড়ার ফলে তৈরি হয়েছে। যখন ম্যাগমা বের হয়ে যায়, তখন খালি জায়গাটি ধসে পড়ে, সেখান থেকে এ ধরনের গর্ত তৈরি হয়।

থারসিস আগ্নেয়গিরি

ছবিটি পূর্ব থারসিস অঞ্চলের। যা ১৯৮০ সালে ভাইকিং ১ মহাকাশযান দ্বারা তোলা ছবির মতো

অলিম্পাস মনস আরোহণ করার সময় চারপাশে তাকালে আপনি থারসিস অঞ্চলের অন্যান্য বিশাল আগ্নেয়গিরি দেখতে পাবেন। নাসার তথ্য অনুযায়ী, এই অঞ্চলে প্রায় ১২টি বিশাল আগ্নেয়গিরি রয়েছে। এটি প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। মঙ্গল গ্রহের কম মহাকর্ষের কারণে এই আগ্নেয়গিরিগুলো পৃথিবীর আগ্নেয়গিরির তুলনায় অনেক বড় হয়ে থাকে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এই আগ্নেয়গিরিগুলো মঙ্গল গ্রহের ইতিহাসের প্রায় অর্ধেক সময় ধরে অর্থাৎ প্রায় দুই বিলিয়ন বছর ধরে সক্রিয় ছিল।

উপরের ছবিটি পূর্ব থারসিস অঞ্চলের। যা ১৯৮০ সালে ভাইকিং ১ মহাকাশযান দ্বারা তোলা ছবির মতো। ছবির বাম দিকে, উপর থেকে নিচে, দেখা যাচ্ছে তিনটি বিশাল ঢাল আগ্নেয়গিরি। এদের নাম অ্যাসক্রেয়াস মনস, পাভোনিস মনস এবং আরসিয়া মনস। এই আগ্নেয়গিরিগুলো প্রায় ২৫ কিলোমিটার উঁচু। এগুলো মঙ্গল গ্রহের থারসিস অঞ্চলের একটি চমৎকার দৃশ্য উপস্থাপন করে। ছবির উপরের ডান দিকে থারসিস থোলাস নামে আরেকটি ঢাল আগ্নেয়গিরিও দেখা যায়।

ভ্যালিস মেরিনারিস

ভ্যালিস মেরিনারিস কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ে গবেষকরা এখনও একমত নন

মঙ্গল গ্রহে যে শুধু সৌরজগতের বৃহত্তম আগ্নেয়গিরিটি রয়েছে, তা নয়। সেখানে সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গিরিখাতও রয়েছে। এর নাম ভ্যালিস মেরিনারিস। এটি প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ—পৃথিবীর গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়ে প্রায় চার গুণ বড়।

ভ্যালিস মেরিনারিস কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ে গবেষকরা এখনও একমত নন। এর গঠন সম্পর্কে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব রয়েছে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, মঙ্গল গ্রহের থারসিস অঞ্চলের গঠন এই বিশাল গিরিখাত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যখন থারসিস অঞ্চলে আগ্নেয়গিরিগুলোর অসংখ্য অগ্নুৎপাত হয়েছিল, তখন তা আশপাশের ভূত্বক ওপরে ঠেলে দিয়েছিল। ফলে ভূত্বকে ফাটল ধরে। এ থেকেই সৃষ্টি হয় ভ্যালিস মেরিনারিসের মতো বিশাল গিরিখাত।

উত্তর ও দক্ষিণ মেরু

বরফের বাষ্পীভবন ও জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া মঙ্গল গ্রহের জলবায়ুকে প্রভাবিত করে

মঙ্গল গ্রহের উত্তর ও দক্ষিণ মেরু বরফের বিশাল চাদরে ঢাকা। উত্তর মেরুতে ২০০৮ সালে ফিনিক্স ল্যান্ডার নামে একটি মহাকাশযান অবতরণ করে। সেখানকার বরফের গঠন নিয়ে গবেষণা করে ল্যান্ডারটি। আর দক্ষিণ মেরুর বরফ সম্পর্কে তথ্য মেলে মঙ্গলের কক্ষপথ থেকে তোলা ছবির মাধ্যমে। নাসার তথ্য মতে, শীতকালে দুটি মেরুতেই তাপমাত্রা এত কমে যায় যে বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিণত হয় বরফে।

গ্রীষ্মকালে পরিস্থিতি উল্টে যায়। তখন মেরুতে জমে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইডের বরফ বাষ্পীভূত হয়ে ফিরে যায় বায়ুমণ্ডলে। উত্তর মেরুর কার্বন ডাই-অক্সাইডের বরফ প্রায় পুরোপুরি বাষ্পীভূত হয়ে যায়। শুধু পানিজ বরফের চাদর অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু দক্ষিণ মেরুর কিছু কার্বন ডাই-অক্সাইড বরফ রয়ে যায়। এই বরফের বাষ্পীভবন ও জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া মঙ্গল গ্রহের জলবায়ুকে প্রভাবিত করে, যা বায়ু ও অন্যান্য প্রবাহ সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখে চলেছে।

গেইল খাদ ও শার্প পর্বত (এওলিস মনস)

কিউরিওসিটি রোভার এই গর্তে প্রায় ৩৫০ কোটি বছর পুরাতন পাথরে জটিল জৈব অণু আবিষ্কার করে

গেইল ক্রেটার বা খাদের নাম রাখা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ান শখের জ্যোতির্বিদ ওয়াল্টার এফ গেইলের নামে। ২০১২ সালে নাসার কিউরিওসিটি রোভার অবতরণ করে এই খাদে। তখন থেকে এটি সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। কিউরিওসিটি মঙ্গল গ্রহের অতীত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে এই স্থান থেকে। এই রোভারের পাঠানো তথ্য থেকে জানা যায়, এ গর্তের তলদেশে এককালে পানির অস্তিত্ব ছিল।

এরপর কিউরিওসিটি রোভার ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে মাউন্ট শার্প (শার্প পর্বত) নামে একটি আগ্নেয়গিরির উদ্দেশে যাত্রা করে। এটি অবশ্য গেইল খাদ অঞ্চলেই অবস্থিত। বর্তমানে রোভারটি এই পর্বতের ঢাল বেয়ে উঠেই চলেছে। এই পর্বতের বিভিন্ন স্তর পর্যবেক্ষণ করে মঙ্গল গ্রহের জলবায়ু ও ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস সম্পর্কে আরও জানাই এর উদ্দেশ্য। মাউন্ট শার্প মঙ্গল গ্রহের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিজ্ঞানীদের আশা, এখানে পাওয়া তথ্য মঙ্গল গ্রহে জীবনের অস্তিত্বের সম্ভাবনা সম্পর্কে আরও জানতে সাহায্য করবে তাঁদের।

কিউরিওসিটি রোভার এই গর্তে প্রায় ৩৫০ কোটি বছর পুরাতন পাথরে জটিল জৈব অণু আবিষ্কার করে। জৈব অণু মানে, জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় কার্বনযুক্ত যৌগ। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র থেকে এ তথ্য জানা যায়। এ ছাড়াও রোভারটি মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের পরিমাণে ঋতুভিত্তিক পরিবর্তন লক্ষ করেছে। মিথেন গ্যাস সাধারণত জীবজন্তুর কারণে বা ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ফলে তৈরি হতে পারে। গেইল খাদে ঘুরতে গেলে এই পাথরটি হয়তো আপনি নিজ চোখেই দেখে আসতে পারবেন।

মেডুসাই ফোসি

৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি বছর ধরে শত শত বার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে গঠিত হতে পারে এই স্থান

মেডুসাই ফোসি মঙ্গল গ্রহের সবচেয়ে অদ্ভুত স্থানগুলোর একটি। অঞ্চলটির অদ্ভুত ভূ-প্রাকৃতিক গঠনের জন্য অনেকে এটিকে ইউএফও ধ্বংসের স্থান বলেও মনে করেন। মেডুসাই ফোসি বিশাল এক আগ্নেয়গিরির অংশ, যার আকার যুক্তরাষ্ট্রের এক-পঞ্চমাংশের সমান। সময়ের সঙ্গে বাতাস আগ্নেয়গিরির শিলাগুলোকে এই সুন্দর গঠনে রূপান্তরিত করেছে। কিন্তু এই আগ্নেয়গিরিগুলো কীভাবে মেডুসাই ফোসি তৈরি করেছিল, তা জানতে এখনও গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা।

২০১৮ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই কাঠামো গঠনের পেছনে রয়েছে অগ্ন্যুৎপাত।বিজ্ঞানীদের ধারণা, ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি বছর ধরে শত শত বার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে গঠিত হতে পারে এই স্থান।এই অগ্ন্যুৎপাতগুলো লাল গ্রহের জলবায়ুকে উষ্ণ করে তুলেছিল।এ থেকে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছিল গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে।উষ্ণতার কারণে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলো বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে।এর ফলেই আজকের এই অদ্ভুত রূপ ধারণ করেছে স্থানটি।

হেলি ক্রেটার

হেলি ক্রেটারের ছবি থেকে বিজ্ঞানীদের ধারণা হয়েছে, এই দাগগুলোতে পানির অণু থাকতে পারে

মঙ্গলপৃষ্ঠের অনেক জায়গায় একধরনের অদ্ভুত দাগ দেখা যায়। এগুলোকে ‘রিকারিং স্লোপ লাইন’ বলা হয়। এই দাগগুলো সাধারণত উষ্ণ আবহাওয়ায় খাড়া ঢালে তৈরি হয়। স্লোপ মানে ঢাল, আর রিকারিং মানে পুনরাবৃত্তি। নামকরণের কারণটা তো বুঝতেই পারছেন!

এই দাগগুলো কীভাবে তৈরি হয়, বিজ্ঞানীরা তা অনেকদিন ধরেই বুঝতে চেষ্টা করছেন। হেলি ক্রেটারের ছবি থেকে বিজ্ঞানীদের ধারণা হয়েছে, এই দাগগুলোতে পানির অণু থাকতে পারে। আগে তাঁরা মনে করতেন, দাগগুলো পানির প্রবাহের কারণে তৈরি হয়েছে। কিন্তু পরে দেখা গেছে,এই দাগগুলো বায়ুমণ্ডলীয় পানি বা শুষ্ক বালু প্রবাহের কারণেও তৈরি হতে পারে। ২০১৫ সালে এই তথ্য প্রকাশ করে নাসা।

মঙ্গল গ্রহের এই রহস্যময় দাগগুলোর রহস্য উন্মোচনের জন্য আমাদের হয়তো সশরীরে মঙ্গলে যেতে হবে। কিন্তু যদি এই দাগগুলোতে কোনো ধরনের মহাজাগতিক জীবের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে আমাদের সেখানে যাওয়ার ফলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে ওগুলো। দুইয়ে মিলে এই রহস্যের সমাধান খুঁজে বের করা সত্যিকারের এক চ্যালেঞ্জ। হয়তো ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা এই রহস্যের উত্তর বের করতে পারব।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: নাসা ও স্পেস ডটকম

আরও পড়ুন