মহান জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপার্নিকাস

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর সম্পর্ক। পৃথিবী ও আকাশ নামের এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…

কোপার্নিকাস যখন এই মহান আবিষ্কার করেন, তখন তাঁর বয়স প্রায় চল্লিশ।

কলম্বাস, ম্যাগেলান ও অন্যান্য নাবিকদের মহান সমুদ্রযাত্রার ফলে বদলে গেল পৃথিবীর মানচিত্র।

লোকে সবিস্ময়ে দেখল নতুন নানা দেশ; বাইবেলে উল্লেখ পর্যন্ত নেই—এমন সব বিস্তৃত ভূখণ্ড। আর ঠিক একালে বিশ্বজগতের গঠন নিয়ে একটি নতুন তত্ত্ব উত্থাপন করেন নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)। পোলিশ শহর টরুনের লোক তিনি। কোপার্নিকাস ছিলেন যাজক, গির্জা পরিষদের সভ্য।

পৃথিবীর সৃষ্টি বিষয়ে চার্চের আপ্তবাক্যের বিরোধিতা করার সাহস কী করে হলো একটি যাজকের?

নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)

আগের দিনে চার্চের সেবকরা ছিলেন বিশেষ একটি সমাজ বা শ্রেণি। যাজকসমাজ বলে তাঁদের অভিহিত করা হতো, বাকি সবাই হলো অনিত্য বা পার্থিব সমাজের লোক। সে সব দিনে যাঁরা যাজকবৃত্তির জন্য তৈরি হতেন, শুধু তাঁরাই শিক্ষা পেতেন।

প্রার্থনার বই অনুসারে ধর্মোপাসনা গির্জায় চালাতে হবে, তাই তারা পড়তে শিখতেন। গির্জার ব্যাপার নিয়ে যাজক ও বিশপদের পত্র বিনিময় করতে হয়, তাই তাঁরা লিখতে শিখতেন; ছাপাখানা আবিষ্কার হওয়ার আগে সন্ন্যাসীরা ধর্মগ্রন্থ হাতে নকল (মানে, কপি) করতেন।

পার্থিববৃত্তি যাঁদের, তাদের মধ্যে শুধু অল্প কজন লেখাপড়া জানতেন। রাজা বা সম্রাট কোনোক্রমে হিজিবিজি করে নাম সই করেন, পড়ালেখার বালাই নেই, এ ব্যাপারটা খুব দুর্লভ ছিল না। তাঁদের বিষয়কর্ম চালাতেন যাজকেরা।

আরও পড়ুন

সে জন্য বিজ্ঞানে মন দেওয়ার ইচ্ছে থাকলে পেশাদার যাজক হতে হতো। রুটিওয়ালার সন্তান নিকোলাস কোপার্নিকাস ঠিক তা-ই করেন। তিনি মানুষ হন কাকার কাছে, কাকা ছিলেন ক্যাথলিক বিশপ, তিনি তাঁকে এমন কি ইতালিতে পাঠান দীর্ঘকাল অধ্যয়নের জন্য। ধর্মতত্ত্ব ছাড়া কোপার্নিকাস চিকিৎসাশাস্ত্র ও টেকনোলজি (প্রযুক্তি) অধ্যয়ন করেন। তিনি ভালো চিকিৎসক ও সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ার (প্রকৌশলী) ছিলেন।

মহান পোলিশ দেশপ্রেমিক ছিলেন কোপার্নিকাস। চার্চের যাজক হলেও তিনি জার্মানদের বিরুদ্ধে নানা যুদ্ধে যোগ দেন। সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ার তিনি, নিজেই দুর্গগুলোকে সুরক্ষিত করে দুর্গরক্ষাকারী সৈন্যদের পরিচালনা করেন।

পর্যবেক্ষণগুলোর ফলে তাঁর দৃঢ় ধারণা হলো, টলেমীয় দর্শন ভ্রান্ত। এ দর্শনে একটি মাত্র সঠিক কথা তিনি পান—চাঁদ সত্যি সত্যি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। বুধ, শুক্র, মঙ্গল এবং অন্যান্য গ্রহ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, পৃথিবীকে নয়।

চার্চের কাজকর্মে তাঁর অনেক সময় ও প্রচেষ্টা যেত। তা ছাড়া গরিব অসুস্থ লোকেদের চিকিৎসায় অনেকখানি সময় দিতেন, চিকিৎসা করতেন বিনা পয়সায়।

সন্ধ্যেবেলা আর রাতে কাজ থাকত না, সে সময়টা তিনি দিতেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বিজ্ঞানে, জ্যোতির্বিজ্ঞানে।

কয়েক শ বছর আগে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাজ আজকের থেকে একেবারে অন্য রকম ছিল। আজ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে অনায়াসে তারা দেখতে পারেন। আকাশের যেকোনো অংশের ছবি তোলা যায়, দূরবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা এবং অদেখা অনেক তারা সে ছবিতে ধরা পড়ে। কোপার্নিকাসের কালে দূরবীক্ষণ যন্ত্র ছিল না, খালি চোখে শুধু তারাদের অধ্যয়ন করতে হতো।

গ্রহ-নক্ষত্রকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য আকাশে তাদের অবস্থান নির্ণয় করার ক্ষমতা রাখতে হতো জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের, পৃথিবীর মানচিত্রে কোনো শহরের অবস্থান যেভাবে বের করতে হয়, ঠিক সেভাবে। আকাশের মানচিত্রে রেখার একটা বুনট ডিগ্রি মেপে আঁকতে হতো তাঁদের, সে রেখাগুলো দেখতে আমাদের মানচিত্রে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা রেখার মতো।

আরও পড়ুন

আগের দিনের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত সহজ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতেন, অনেকটা দুই হাতওয়ালা বিরাট কাঠের কোণমাপা যন্ত্রের মতো। একটা হাত সে যন্ত্রে লাগানো থাকত, আর এ হাত হতো দিগন্তমুখী। অন্য সচল হাতটা থাকত তারাদের দিকে মুখ করে। দুটোর মাঝের কোণ থেকে বোঝা যেত দিগন্ত থেকে তারাটি কত উঁচুতে। সে সব দিনে মিনিট বা সেকেন্ড মাপার জন্য ঘড়ি পর্যন্ত ছিল না। পানি আর বালিঘড়ির সাহায্যে লোকে মোটামুটি সময় বিচার করত।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কাজ। ১৫২০ সালে আঁকা।

এ ধরনের বেঠিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে কঠিন বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ চালানোর জন্য লাগত অসীম কৌশল আর ধৈর্য, আর বিজ্ঞানের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ।

বছরের পর বছর, রাতের পর রাত, গরমে বা তুহিন আবহাওয়ায় কোপার্নিকাস যেতেন ফ্রমবোর্ক ক্যাথিড্রালের দেয়ালের একটি গম্বুজের ছাদে। সুদীর্ঘ অনেক বছর পরিশ্রমের ফলে গ্রহ-নক্ষত্রের অসংখ্য পর্যবেক্ষণ তিনি করেন।

পর্যবেক্ষণগুলোর ফলে তাঁর দৃঢ় ধারণা হলো, টলেমীয় দর্শন ভ্রান্ত। এ দর্শনে একটি মাত্র সঠিক কথা তিনি পান—চাঁদ সত্যি সত্যি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। বুধ, শুক্র, মঙ্গল এবং অন্যান্য গ্রহ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, পৃথিবীকে নয়। আর স্বয়ং পৃথিবীর ব্যাপারটা কী? পৃথিবীটা কি একটা ব্যতিক্রম, অন্য গ্রহ থেকে আলাদা? অবশ্যই নয়। অন্যদের মতোই পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে সূর্যকে।

কোপের্নিকাসের মতে, বিশ্বজগতের স্থিরকেন্দ্র হিসেবে পৃথিবীকে ধরা চলে না, পৃথিবী এমন একটা কেন্দ্র নয় যার জন্য অন্য সব গ্রহ-নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়েছে।

পৃথিবীকে নক্ষত্রগুলোর প্রদক্ষিণের মূলে আছে নিজের মেরুরেখাতে দিনে একবার পৃথিবীর আবর্তন। পৃথিবীর এই আবর্তনের জন্য মনে হয় সূর্য ও গ্রহগুলো পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে।

কোপার্নিকাস যখন এই মহান আবিষ্কার করেন, তখন তাঁর বয়স প্রায় চল্লিশ। বহু বছর নির্যাতনের ভয়ে তিনি আবিষ্কারের কথা চেপে যান, কয়েকটি অন্তরঙ্গ বন্ধু ছাড়া আর কাউকে বলেননি।

গ্রহ-নক্ষত্রকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য আকাশে তাদের অবস্থান নির্ণয় করার ক্ষমতা রাখতে হতো জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের, পৃথিবীর মানচিত্রে কোনো শহরের অবস্থান যেভাবে বের করতে হয়, ঠিক সেভাবে।
আরও পড়ুন

জীবনের শেষ দিকে কোপার্নিকাস শুধু বন্ধুদের নির্বন্ধে তাঁর রচনা ছাপাবার অনুমতি দেন। তাঁর বই প্রকাশিত হয় ১৫৪৩ সালে। লোকে বলে, বইটির প্রথম কপি কোপার্নিকাসের কাছে আনা হয় তাঁর মৃত্যুশয্যায়।

চার্চের কর্তৃপক্ষরা বইটির গুরুত্ব সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারেননি। মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এত কঠিন ভাষায় বইটি লেখেন যে অজ্ঞ মঠবাসীদের মগজে ঢোকেনি।

কোপেনিকীয় দর্শন। গ্রহগুলোর নাম লাটিন ভাষায় লিখিত, সে কালে এ ভাষাতেই সমস্ত বৈজ্ঞানিক রচনা লেখা হতো।

অনেক দিন কোপার্নিকাসের বইকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, বিনা বাধায় লোকে পড়ে। আর তাই অলক্ষিতে সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে কোপার্নিকাসের নবতত্ত্ব।

কিন্তু অবশেষে বিশ্বজগতের এই নতুন দর্শনের আসল তাৎপর্য ধর্মগুরুদের কাছে ধরা পড়ায় তাঁরা কোমর বাঁধলেন নতুন তত্ত্বের বিরুদ্ধে। এ তত্ত্ব তো খৃষ্টধর্মের খাস বুনিয়াদের শত্রু: বাইবেল মতে, বিশ্বজগতের কেন্দ্র হলো পৃথিবী, পৃথিবীতে মানুষের বাস; সূর্য, চাঁদ আর তারাদের সৃষ্টি করা হয় বিশেষভাবে মানুষের খাতিরে।

আর হঠাৎ কিনা ভোল বদলে গেল পৃথিবী বিশ্বজগতের কেন্দ্র নয়, অন্যান্য গ্রহদের মতো সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা ছোট্ট একটা গ্রহ মাত্র, এমনকি বাচ্চাদের লাটিমের মতো নিজের মেরুরেখায় ঘোরে?

এর সঙ্গে আবার বলা হয়েছে যে বুধ, শুক্র এবং অন্য গ্রহগুলো আকাশের স্ফটিক পাত্রে আলোর অতিক্ষুদ্র কণা নয়, তারাও স্বতন্ত্র জগৎ, তাদেরও আছে নিজ নিজ আকাশ ও পাতাল। অন্য গ্রহগুলোর প্রকৃতি বিষয়ে সে সময়ে কোনো ধারণা ছিল না জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। তাঁরা ভাবতেন, আমাদের পৃথিবীতে যেমন, তেমন ওগুলোতেও প্রাণ আছে। অন্য জগতের লোকেরা বাইবেল-কথিত ভগবানসৃষ্ট প্রথম পুরুষ ও নারী, আদম ও ইভের বংশপ্রসূত তো হতে পারে না।

ভীষণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন ধর্মগুরুরা: কোপার্নিকাসের কথা নিয়ে ভাবতে শুরু করলেই লোকে অবিশ্বাসী হয়ে পড়বে, বাইবেলের নানা উপকথা যে আজগুবি, তারা সেটা বুঝতে আরম্ভ করলে তাদের ওপর চার্চের ক্ষমতা ও প্রভাব নষ্ট হয়ে যাবে।

(চলবে…)

মূল: আলেকজান্ডার ভলকভ, অনুবাদ: সমর সেন

* পাঠকের সুবিধার্থে বইয়ের মূলভাব ঠিক রেখে বানানরীতির কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।

'পৃথিবী ও আকাশ' বই থেকে আরও পড়ুন