চাঁদের ঠিকানায় ভারত

সম্প্রতি চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নভোযান চন্দ্রযান-৩ পাঠিয়েছে ভারত। ভারতের এ চন্দ্রজয়ে অনেকে অবাক হয়েছেন। তবে চাঁদ নিয়ে দেশটি দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছে। সে গবেষণার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং চন্দ্রগামী নভোযানের সফলতা ও স্বল্প খরচের রহস্য, ভবিষ্যৎ গবেষণা…

চন্দ্রযান-৩ নভোযানের ল্যান্ডার বিক্রমছবি: সংগৃহীত

চাঁদের দিকে অনেক দেশের নজর। মহাকাশে সবচেয়ে কাছের বস্তু বলে চাঁদের প্রসঙ্গ স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে মহাকাশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। কোনো দেশ যখন কৃত্রিম উপগ্রহ বানানো এবং উৎক্ষেপণের কৌশল রপ্ত করে ফেলে, তখন স্বভাবতই তার নজর পড়ে চাঁদের ওপর। কারণ, পৃথিবীর চারপাশের অঞ্চল পেরিয়ে মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার উপযুক্ত জায়গা এই চাঁদ।

সে হিসেবে ভারতের মহাকাশ প্রযুক্তিবিদদের লক্ষ্যে চাঁদ রয়েছে দুই দশকের বেশি সময় ধরে। মনে রাখা উচিত, ১৯৫৮ সালে রাশিয়ার স্পুতনিক উৎক্ষেপণের পরপরই ভারতীয় বিজ্ঞানীরা মহাকাশ প্রযুক্তিবিদ্যায় গবেষণার কথা ভাবতে শুরু করেন। ভারতের পারমাণবিক শক্তি গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা ১৯৬১ সালে ভারত সরকারকে এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন।

ভারতের পারমাণবিক শক্তি গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা
ছবি: সংগৃহীত

১৯৬৩ সালে, অর্থাৎ ঠিক ৭০ বছর আগে নয়াদিল্লিতে মহাকাশবিজ্ঞানীদের প্রথম সভায় তিনি বলেছিলেন, এখনই এ গবেষণায় যোগ না দিলে পরে অন্য দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে ভারতকে। ১৯৬৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর ভারতের মহাকাশবিজ্ঞান গবেষণা পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বিক্রম সারাভাই। প্রথম দিকে সারাভাইয়ের লক্ষ্য ছিল মহাকাশবিজ্ঞানের মাধ্যমে ভারতের সাধারণ মানুষকে সাহায্য করা। যেমন কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহার করে কৃষিব্যবস্থার উন্নতি সাধন বা আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে লোকজনকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমেও বাণিজ্য থেকে শুরু করে অন্যান্য ক্ষেত্রে মহাকাশপ্রযুক্তির ছোঁয়া লাগতে পারে। সেই লক্ষ্যে সত্তরের দশকে রাশিয়ার সাহায্যে বানানো হয় প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘আর্যভট্ট’। সেটি রাশিয়া থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। সেই থেকে শুরু। পরে ১৯৮০ সালে ভারত প্রথম নিজের তৈরি যন্ত্র পৃথিবীর চারদিকের কক্ষপথে পাঠাতে সক্ষম হয়।

ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘আর্যভট্ট’
ছবি: সংগৃহীত

এই সহস্রাব্দের প্রথম থেকে ভারত চন্দ্রযান নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করে। ২০০৮ সালে পাঠানো হয়েছিল চন্দ্রযান-১। এ অভিযানের লক্ষ্য ছিল চাঁদের চারদিকের কক্ষপথে একটি যন্ত্র বসানো, যাতে চাঁদের পিঠের ওপর নজর রেখে কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা যায়। আসলে চাঁদে পৌঁছানো চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা।

চাঁদের খনিজ পদার্থ নিয়েও অনেক দেশের কৌতূহল রয়েছে। পানি নিয়ে তো আছেই। কারণ, ভবিষ্যতে চাঁদে স্টেশন বানিয়ে সৌরমণ্ডলের অন্য জায়গায় যাওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। চাঁদে মহাকর্ষ টান পৃথিবীর তুলনায় কম।

শুধু যে প্রযুক্তিবিদ্যায় নিজেদের দক্ষতা জাহির করার জন্য এই উদ্যোগ, তা নয়। উল্লেখ্য, ১৯৯০-এর দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্র আবার চাঁদে নভোযান পাঠাতে উঠেপড়ে লেগেছিল। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো ‘ক্লিমেন্টাইন’ প্রথম চাঁদের অবলোহিত এবং অতিবেগুনি আলোর ছবি তুলে পাঠায়। এরপর ১৯৯৮ সালে নাসা পাঠিয়েছিল ‘লুনার প্রসপেক্টর’, যাতে চাঁদে পানির সন্ধানের জন্য নিউট্রনের সাহায্যে পরীক্ষা করার যন্ত্র ছিল। এর সাহায্যে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, তাতে বিজ্ঞানীরা ইঙ্গিত পেয়েছিলেন যে চাঁদের মেরু অঞ্চলে প্রচুর বরফ থাকতে পারে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপের বিজ্ঞানীরাও ২০০৩ সালে পাঠিয়েছিলেন স্মার্ট-ওয়ান। এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মহাকাশযানে জ্বালানি ব্যবহারের কিছু নতুন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা করা। তবে যন্ত্রটি চাঁদের চারদিকে বছর দুই ঘুরে নানা রঙের ছবি তোলে। চাঁদের মাটির বিভিন্ন উপাদানের খবর পাওয়া যায় সেখান থেকে। ২০০৪ সালে জাপান ভেবেছিল, চাঁদে একটি যান পাঠাবে। তবে পরে সেই পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, চাঁদের খনিজ পদার্থ নিয়েও অনেক দেশের কৌতূহল রয়েছে। পানি নিয়ে তো আছেই। কারণ, ভবিষ্যতে চাঁদে স্টেশন বানিয়ে সৌরমণ্ডলের অন্য জায়গায় যাওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। চাঁদে মহাকর্ষ টান পৃথিবীর তুলনায় কম। তাই চাঁদ থেকে রকেট উৎক্ষেপণ অপেক্ষাকৃত সহজ। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে পানির প্রয়োজন হবে। তাই চাঁদে স্টেশন ও অন্যান্য যন্ত্র বসানো নিয়ে ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতা চরমে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম থেকে শামিল হতে না পারলে পরে স্থান পাওয়া মুশকিলই শুধু নয়, অসম্ভব বলা যেতে পারে। ইতিহাস জানায়, যখন কোনো নতুন প্রযুক্তিবিদ্যা মানুষের আয়ত্তে এসেছে, তখন প্রথম যে কটি দেশ উদ্যোগ নিয়েছে, তাদের ছাড়া অন্যদের পক্ষে সেসব পরীক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে পরে। পারমাণবিক শক্তির ক্ষেত্রে ভারত বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল সত্তরের দশকেই। তাই পরে যখন অ্যান্টার্কটিকায় কয়েকটি দেশ গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করে, তখন ছোট হলেও একটি কেন্দ্র তৈরি করার উদ্যোগ নেয় ভারত। ১৯৮১ সালে ‘দক্ষিণ গঙ্গোত্রী’ নামের একটি কেন্দ্র স্থাপন করে রাশিয়ার সাহায্যে। ফলে ১৯৯৩ সালে যখন অ্যান্টার্কটিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তখন ভারতকেও পরামর্শদাতা দেশের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দেশটিতে কিছু করতে যাওয়ার নিয়মকানুন ধার্য করার সময় ভারতের মতামত নেওয়া হয় এখন। সেই আশির দশকে সেখানে গিয়ে খুঁটি গেড়ে না এলে এখন সামান্য কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করতে গেলেও হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো ভারতকে। সেখানকার খনিজ পদার্থের ব্যাপারে মতামত পোষণ করার অধিকার তো রইলই। মোটকথা, ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতায় আগে থেকে নাম না লিখিয়ে রাখলে পরে কেউ পাত্তা দেয় না। চাঁদে যাওয়ার পরিকল্পনার এটাও আরেক উদ্দেশ্য। শুধু এটুকু বললে অবিচার করা হবে। সেই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, এ ধরনের উদ্যোগে সাফল্য দেশের শিক্ষার্থীদের মনে যে উৎসাহ জোগায়, তা হিসাবের বাইরে।

চাঁদে যাওয়ার খরচ অনেক। অন্যান্য দেশের তুলনায় এ খাতে ব্যয় করার ক্ষমতা নেই ভারতের মতো দেশের। তাই ভারতের মহাকাশ সংস্থা এক অভিনব পদ্ধতির কথা ভাবে চন্দ্রযান-১ পাঠানোর সময়। শুরুতে পৃথিবীর চারদিকে একটি কক্ষপথে পাঠানো হয়েছিল একে। কখনো পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসছিল—ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১৭০ কিলোমিটার দূরে। আবার কখনো চলে যাচ্ছিল ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরে। ধীরে ধীরে কক্ষপথটি লম্বাটে করে তোলা হয় চন্দ্রযান যখন পৃথিবীর কাছে এসে পড়ছিল, তখন একটু করে ধাক্কা দিয়ে। তাতে কক্ষপথ হয়ে পড়ছিল আরও লম্বাটে। অর্থাৎ আরও বড় হচ্ছিল তার কক্ষপথ।

বিক্রম সারাভাই
ছবি: সংগৃহীত
২০০৮ সালে পাঠানো চন্দ্রযান-১ নভোযানে বেশ কয়েকটি যন্ত্র ছিল। চাঁদের পিঠ থেকে বিচ্ছুরিত এক্স-রশ্মি বিশ্লেষণের জন্য ছিল একটি যন্ত্র। ভারত অনেক বছর ধরে মহাকাশ থেকে আসা এক্স-রশ্মি নিয়ে গবেষণা করছে।

তারপর একসময় যখন এর কক্ষপথ প্রায় চাঁদের কাছে পৌঁছে গেল, তখন সময় বুঝে ধাক্কা দিয়ে সেটাকে পৃথিবীর নাড়িবন্ধন কেটে ঠেলে দেওয়া হয় চাঁদের দিকে। তখন সেটা ঘুরতে শুরু করে চাঁদের চারদিকে। এই চক্কর খেতে খেতে যেতে সময় লাগে ঠিকই, কিন্তু জ্বালানির খরচ কমে যায় প্রচুর পরিমাণে। এর কারণ হলো, পৃথিবীর চারদিকে কক্ষপথে ঘোরার সময় তো আর জ্বালানি লাগে না! তখন নিউটনের নিয়ম মেনে আপনাআপনি চলতে থাকে মহাকাশযান। শুধু পৃথিবীর কাছে এসে পৌঁছালে থ্রাস্টার জ্বালিয়ে একে একটু ধাক্কা দিলেই হলো। অর্থাৎ বেশির ভাগ সময় পৃথিবীর মহাকর্ষকে কাজে লাগানো হয় জ্বালানি না পুড়িয়ে। ট্রাপিজের খেলায় যেমন একটু একটু করে দোলার পরিমাণ বাড়াতে থাকেন এবং একসময় লাফ দিয়ে অন্য দোলনায় গিয়ে পৌঁছান, সেভাবে চন্দ্রযান পাঠানো হয়েছিল। এতে বেঁচে গিয়েছিল খরচ। তবে এটা ঠিক যে এই পদ্ধতিতে নভোচারী পাঠানো যাবে না চাঁদে। কারণ, এত বেশি দিন লাগলে তার খরচ এবং বিপদের ঝুঁকি বেড়ে যাবে।

২০০৮ সালে পাঠানো চন্দ্রযান-১ নভোযানে বেশ কয়েকটি যন্ত্র ছিল। চাঁদের পিঠ থেকে বিচ্ছুরিত এক্স-রশ্মি বিশ্লেষণের জন্য ছিল একটি যন্ত্র। ভারত অনেক বছর ধরে মহাকাশ থেকে আসা এক্স-রশ্মি নিয়ে গবেষণা করছে। পরে ২০১৫ সালে শুধু মহাকাশের এক্স-রশ্মি গবেষণার জন্য নিজস্ব একটি দুরবিন পাঠিয়েছিল মহাকাশে। তাই এ ব্যাপারে কারও সাহায্য নিতে হয়নি। এক্স-রশ্মি বিশ্লেষণ করে চাঁদের পিঠে তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিস্তৃতি নিয়ে গবেষণা করার ইচ্ছা ছিল। এ ছাড়া মার্কিন বিজ্ঞানীরা একটি যন্ত্র বসিয়েছিলেন, যার নাম ছিল মুন মিনারোলজি ম্যাপার। এ যন্ত্রের সাহায্যে চাঁদের মেরু অঞ্চলে বরফের সন্ধান পাওয়া যায়। চাঁদ থেকে প্রতিফলিত আলো বিশ্লেষণ করে জানা যায় হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের মধ্যে রাসায়নিক বন্ধনের তথ্য। ২০০৯ সালে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয় সে গবেষণার খবর।

এর এক দশক পর ২০১৯ সালে চন্দ্রযান-২ পাঠানো হয়েছিল চাঁদে অবতরণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি। চাঁদের পিঠে অবতরণ করা সহজ নয়। কারণ, সেখানে বায়ুমণ্ডল নেই, তাই মঙ্গলে নামার মতো বেলুন ব্যবহার করা চলে না। সাইকেল চালানো শেখার সময় কে না এক-আধবার পড়ে হাত-পায়ে চোট পেয়েছে? মনে আছে নিশ্চয়ই, সাইকেলে উঠে পড়া সহজ, ব্রেক কষে সফট ল্যান্ডিং করা কঠিন। চাঁদের বুকে মহাকাশযানের ল্যান্ডিংয়ের ব্যাপারেও তা–ই। একবার ভাবা যাক, সাইকেলে ব্রেক কষে নামতে গেলে কেন পড়ে যাই আমরা? প্রথমত, আমাদের নজর আবদ্ধ থাকে আগে থেকে ভেবে রাখা একটি ছোট সীমিত জায়গার মধ্যে, অথচ সাইকেলটি বেশির ভাগ সময় তার বাইরে গিয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, ব্রেকে হাত এত শক্তভাবে ধরা থাকে যে ছোটখাটো ভুল শুধরে নেওয়ার উপায় থাকে না। তৃতীয়ত, নিজের গতিবেগ সম্বন্ধে আন্দাজ থাকে না সাইকেল-নবিশের। চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে নামাও কম কথা নয়। খুব কঠিন। সে অঞ্চলের জমি বীভৎস ধরনের এবড়োখেবড়ো। এখানে ১০ কিলোমিটার গভীর খাদ, আবার একটু দূরে সাত-আট কিলোমিটার উঁচু পাহাড়।

এবারে চন্দ্রযান-৩ নভোযানে রোবট গাড়ি ছাড়াও কয়েকটি মজার পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চাঁদের পিঠে কম্পনসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করবে একটি যন্ত্র (ILSA)। আর চাঁদের পিঠের ঠিক ওপরকার প্লাজমা অবস্থার খবর জোগাড় করবে ল্যাংমুর প্রোব যন্ত্রটি।

তাই এ বছর আবার চেষ্টা করা হয়েছে। আগেরবারের তুলনায় এবারের অবতরণযান ‘বিক্রম’ তিন দিক দিয়ে ছিল উন্নততর। চন্দ্রযান-২ নভোযানের লক্ষ্য ছিল প্রায় এক বর্গকিলোমিটারের সিকি অংশ। সে প্রায় ১০০ বিঘা পরিমাণের একটি অঞ্চল। এবার নজরদারির আওতা বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৪০ গুণ। চার কিলোমিটার গুণন আড়াই কিলোমিটার। তা ছাড়া যেসব রকেটের সাহায্যে (১০ সেকেন্ডব্যাপী) অ্যাটিচুড-হোল্ড ফেজে ব্রেক কষা হয়, সেগুলো নিয়ন্ত্রণের উপায় ছিল। আগেরবার তা ছিল না বলে ছোটখাটো ভুলও শোধরানো যায়নি। আর এবার ‘বিক্রম’-এর গতিবেগ মাপার যন্ত্র ছিল। তাই প্রতিমুহূর্তে বোঝা গেছে কতটুকু ব্রেক কষতে হবে এবং তা কোন দিকে তাক করে করতে হবে। এখানে মনে রাখা দরকার, মহাকাশযাত্রার ক্ষেত্রে এই হাঁটি হাঁটি পা পা করে শেখার ধাপগুলো কোনো বইতে লেখা নেই। প্রতিটি দেশের প্রযুক্তিবিদদের নিজেদের হাতে পরীক্ষা করে জেনে নিতে হয়। এ বিষয়ে প্রতিটি দেশ মন্ত্রগুপ্তি বজায় রাখে। তাই এতে লজ্জা নেই; বরং প্রযুক্তিবিদদের প্রশংসা করা উচিত। তাঁরা যে হাল ছেড়ে না দিয়ে নিজেদের ওপর ভরসা রেখে আবার পরীক্ষা করেছেন, সে জন্য।

এবারে চন্দ্রযান-৩ নভোযানে রোবট গাড়ি ছাড়াও কয়েকটি মজার পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চাঁদের পিঠে কম্পনসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করবে একটি যন্ত্র (ILSA)। আর চাঁদের পিঠের ঠিক ওপরকার প্লাজমা অবস্থার খবর জোগাড় করবে ল্যাংমুর প্রোব যন্ত্রটি। চাঁদে যেহেতু কোনো চৌম্বকক্ষেত্র নেই, তাই তার পিঠে শক্তিশালী সৌরঝড়ের পদার্থকণা এসে আছাড় খায়। সেই সংঘর্ষে যে চার্জযুক্ত কণার বাতাবরণ তৈরি হয়, তাতে রয়েছে প্লাজমার বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়া রয়েছে SHAPE (Spectro-polarimetry of Habitable Planet Earth), যেটি নজর রাখবে পৃথিবীর ওপর। পৃথিবী থেকে যে অবলোহিত আলো বিকিরিত হচ্ছে, তাতে প্রাণের সন্ধান খুঁজতে গেলে কোন কোন বৈশিষ্ট্যের ওপর নজর রাখা দরকার, তা নিয়ে গবেষণার জন্য এই যন্ত্র। ধরা যাক, সৌরমণ্ডলের বাইরের কোনো নক্ষত্রের চারদিকে একটি গ্রহ আবিষ্কার করা গেল। এবার সেই গ্রহ থেকে যে আলো বিকিরিত হচ্ছে, তার বিশ্লেষণ থেকে সেই গ্রহে প্রাণ আছে কি না, এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কি সম্ভব? এ গবেষণায় প্রথমে পৃথিবীকে নিয়ে গবেষণা করার কথা মনে হয়েছে বিজ্ঞানীদের। আর সেটা মহাকাশের কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে। তাই চাঁদ থেকে পৃথিবীর দিকে নজর রাখবে এই যন্ত্র, যাতে অন্য নক্ষত্রের গ্রহ নিয়ে গবেষণার সময় কাজে লাগে।

ভবিষ্যতে চাঁদে আরও কিছু গবেষণার কথা এখন থেকেই ভাবছেন ভারতের বিজ্ঞানীরা। যেমন জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণার কথাও ভাবা হচ্ছে। বিশেষ করে রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আগামী চন্দ্রাভিযানে চাঁদকে প্রদক্ষিণরত যন্ত্র বসানো যেতে পারে। এ নিয়ে আমার কয়েকজন সহকর্মী বেঙ্গালুরুর রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউটে কাজ শুরু করেছেন। রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানে এমনিতে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই সেটাকে কাজে লাগিয়ে চাঁদের পরিবেশে যন্ত্র রাখার কথা স্বাভাবিকভাবে উঠে এসেছে। চাঁদে পৃথিবীর মতো আয়নমণ্ডল নেই। কারণ, বায়ুমণ্ডল নেই সেখানে। পৃথিবীর আয়নমণ্ডলের একটি সুবিধা হলো, এতে প্রতিফলিত করে আমরা বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে খবর পাঠাই। তার জন্য এমন তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়, যার দৈর্ঘ্য বেশি। কীসের চেয়ে বেশি? আয়নমণ্ডলে ইলেকট্রনগুলো নড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। তাদের সেই দুলুনির জন্য একধরনের ঢেউ তৈরি হয়। আয়নমণ্ডলে ইলেকট্রনের দোলনের কম্পাঙ্ক বা ফ্রিকোয়েন্সি হলো প্রায় ১০ মেগাহার্জ, অর্থাৎ ১ কোটি হার্জ। আর বেতারে কিলোহার্জ (হাজার হার্জ) ফ্রিকোয়েন্সির তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়। কম্পাঙ্ক কম হওয়ার অর্থ তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি। সে জন্য পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে আসা বেতার তরঙ্গ আয়নমণ্ডলে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের কাছে ধরা দিতে পারে।

কিন্তু আয়নমণ্ডলের অসুবিধা হলো, সেটি মহাকাশ থেকে আসা কম কম্পাঙ্কের রেডিও তরঙ্গও প্রতিফলিত করে। ফলে মহাকাশের জ্যোতিষ্ক থেকে কম ফ্রিকোয়েন্সির তরঙ্গ ধরা যায় না পৃথিবীতে বসে। সেটা সম্ভব চাঁদের পরিবেশে। সেই গবেষণার জন্য আমার সহকর্মীরা উপযুক্ত যন্ত্র বানানোর নকশা নিয়ে বসেছেন। সেটি কবে চাঁদে পাঠানো সম্ভব হবে, তা কেউ জানেন না। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ ধরনের দূরদর্শী প্রকল্পগুলো এ দেশের (ভারতের) মহাকাশবিজ্ঞানের যাত্রা অপ্রতিহত রাখতে সাহায্য করবে।

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ভারত

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত