উল্কাঘাতে বিক্ষত বিশ্বের একমাত্র মানুষ

মহাকাশ থেকে শাঁ শাঁ করে ছুটে এল উল্কা। বাসার ছাদ ফুটো করে, ধাঁই করে এসে আঘাত করল আপনাকে। কী হবে, ভাবুন তো?

না, বানিয়ে বলছি না। এমন ঘটনা আসলেই ঘটেছে।

অ্যান হজেস নামে ৩৪ বছর বয়সী এক নারী কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁর বাড়ি যুক্তরাষ্ট্রের আলবামার সিলাকগা শহরে। দিনটা ছিল ১৯৫৪ সালের ৩০ নভেম্বর। ঘড়িতে বাজে ২টা ৪৬। এ সময় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। টের পেলেন, কিছু একটা এসে তাঁর গায়ে পড়েছে।

জিনিসটা আসলেই একটা উল্কা। ৪.৫ বিলিয়ন, মানে প্রায় ৪৫০ কোটি বছর পুরোনো এক পাথর। ছুটে এসেছে মহাশূন্যের নিঃসীম অন্ধকার চিড়ে। সাড়ে ৮ পাউন্ড বা প্রায় ৪ কেজির এই পাথরটা ভাগ্যিস সরাসরি তাঁর গায়ে পড়েনি। প্রথমে এসে পড়েছে বিছানার পাশে রাখা রেডিওতে। সেখানে ধাক্কা খেয়ে তাঁর গায়ে এসে পড়েছে। সেজন্যই সে যাত্রা বেঁচে গেলেন ভদ্রমহিলা। তবে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ও পর্যবেক্ষণে রাখা হল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বড় কোনো সমস্যা হয়নি। তবে অ্যানের বেঁচে যাওয়ার আরেকটা কারণও আছে।

১ / ২
অ্যান হজেস

পরে জানা যায়, উল্কাটি আসলে আরও বড় ছিল। দুভাগ হয়ে গেছে পথিমধ্যে কোথাও। একভাগ আঘাত করেছে হজেসকে। অন্যভাগ গিয়ে পড়েছে কয়েক মাইল দূরে। এই উল্কাখণ্ডটি এখন রাখা আছে যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান’স ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে।

বিজ্ঞানীরা পরে হিসেব করে দেখেছেন, উল্কাটি সেদিন ছুটে এসেছিল ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার বেগে। অ্যান হজেসের একাধিক প্রতিবেশী সেদিন আকাশে ‘বিশাল এক অগ্নিগোলক’ ছুটে আসতে দেখার কথা জানিয়েছেন। তবে সাধারণত উল্কা এত বড় হয় না। বেশিরভাগ উল্কাই গল্‌ফ বল থেকে হাতের মুঠির আকারের হয়। সে তুলনায় এটি একটু বড়ই ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিলাকগা’ উল্কা। তবে এটি ‘হজেস’ উল্কা নামেই বেশি জনপ্রিয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা স্টেট কলেজের জ্যোতির্বিদ মিখায়েল রেনল্ডস। তিনি এ নিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সে সময় তিনি বলেন, একসঙ্গে টর্নেডো, হারিকেন ও বজ্রপাতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বরং (এর চেয়ে) বেশি।

ইতিহাসের একমাত্র উল্কাঘাতে বিক্ষত মানুষ এই অ্যান হজেস। আর কেউ এরকম আঘাত পেয়েছে বলে জানা যায় না। তবে উল্কাপাত খুব দুর্লভ ঘটনা নয়। মানুষ না হলেও ১৯৭২ সালে ভেনিজুয়েলায় একটি গরু মারা যায় উল্কাঘাতে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরও বড় পরিসরের একটি ঘটনা ঘটে রাশিয়ার চেলইয়াবিনস্কে। একটি উল্কা তৈরি করে সনিক বুম বা শব্দ-নিনাদ। অর্থাৎ প্রচন্ড বেগে শব্দ তরঙ্গ ছুটে যায় চারদিকে। এর আঘাতে ভেঙে পড়ে জানালার কাচসহ আরও নানা কিছু। এ ঘটনায় সেবার আহত হয় প্রায় ১ হাজার মানুষ।

১ / ৩
অ্যান হজেস এ বাড়িতেই থাকতেন

তবে ক্ষতিকর উল্কা বা গ্রহাণুদের নিয়ে এখন আর দুশ্চিন্তার কিছু নেই। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এ নিয়ে সম্প্রতি ডার্ট নামে একটি অভিযান চালিয়েছে। এতে  দেখা গেছে, যেকোনো গ্রহাণুকে চাইলে বিশেষ নভোযান দিয়ে আঘাত করে এর গতিপথ বদলে দেওয়া যায়। ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর চালানো এ অভিযানে সেটাই করে নাসা। ডাইমরফোস নামের ৫৩০ ফুট ব্যাসের একটি গ্রহাণুকে আঘাত করে দিকচ্যুত করে দেয়। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আমাদের নিশ্চিত করেন, উল্কাপাত বা গ্রহাণুর আঘাত সংক্রান্ত দুর্যোগ এড়ানো সম্ভব। এজন্য আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতিও রয়েছে।

আরও পড়ুন

মজার একটা ঘটনা বলে শেষ করি। সিলাকগা উল্কার মালিকানা নিয়ে মামলা পর্যন্ত হয়েছিল মার্কিন আদালতে! কারণ, অ্যান হজেস দাবি করেছিলেন, এ উল্কার মালিকানা তাঁর। আর অ্যানের বাড়ির মালিক বার্ডি গাই দাবি করেন, এটা যেহেতু তাঁর বাড়িতে পড়েছে, তাই এর মালিকানা তাঁর! এ সময় অ্যান হজেস ছোটখাটো তারকায় পরিণত হন। তিনি ভেবেছিলেন, উল্কাটি রেখে দিলে অনেক দামে পরে বিক্রি করতে পারবেন। তাই শেষ পর্যন্ত  বার্ডিকে ৫০০ ডলার দিয়ে মীমাংসা করেন তিনি। উল্কাটি বেশ কিছুদিন তাঁর কাছে ছিল, বিক্রি হয়নি। কোনো ক্রেতা পাওয়া যায়নি। পরে এটি আলবামা মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিকে দান করে দেন অ্যান। এখনো এই উল্কাখণ্ডটি সেখানেই আছে।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা