মঙ্গলপৃষ্ঠের নিচে পাওয়া গেছে বিশাল সমুদ্র, থাকতে পারে প্রাণও

আলোক টেলিস্কোপে মঙ্গলগ্রহনাসা

ভূতাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা সম্প্রতি মঙ্গলপৃষ্ঠের নিচে বিশাল এক সমুদ্র আবিষ্কার করেছেন। তাঁদের দাবি, এ সমুদ্রে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে। গবেষণাটি গত ১২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস (পিএনএএস) জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

বিশাল এই ভূগর্ভস্থ জলাধারের সন্ধান পাওয়া গেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ইনসাইট ল্যান্ডারের সংগৃহীত সিসমিক ডেটা তথা ভূকম্পন-সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে। জানা গেছে, এতে এত বিপুল পরিমাণ পানি আছে যে গ্রহটির পুরোটাজুড়ে এই পানি ছড়িয়ে পড়লেও এর উচ্চতা হবে প্রায় ১ মাইল বা প্রায় দেড় কিলোমিটারের সমান। তবে এই সমুদ্র মাটির এত গভীরে যে জানা কোনো পদ্ধতি বা প্রযুক্তির মাধ্যমে এতে পৌঁছানো বর্তমানে সম্ভব নয়।

লাইভ সায়েন্স-এর তথ্য বলছে, লাল গ্রহের বহিঃত্বকের নিচে একটি ফাটা পাথরের স্তর রয়েছে। এই স্তর সাড়ে ১১ থেকে ২০ কিলোমিটার গভীর। এর মধ্যেই বদ্ধ এই পানির স্তর। এতে পৌঁছাতে যে ধরনের ড্রিলিং অপারেশন চালাতে হবে, সেরকম কিছু আজও পৃথিবীতে করা যায়নি (পৃথিবীতে খোঁড়া সবচেয়ে গভীর গর্ত হলো রাশিয়ার কোলা সুপারডিপ বোরহোল, যার গভীরতা প্রায় ১২ কিলোমিটার)। তবে গবেষকেরা বলছেন, কোনোভাবে ওতে পৌঁছানো সম্ভব হলে পাওয়া যেতে পারে প্রাণের সন্ধান।

আরও পড়ুন
এককালে মঙ্গলের পৃষ্ঠে যথেষ্ট পানি ছিল। অথচ মঙ্গল আজ খটখটে শুকনো মরু। এই ঘটনাটা ঘটেছে প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন বা ৩৫০ কোটি বছর আগে। কোনো কারণে মঙ্গলের জলবায়ুতে সে সময় হঠাৎ পরিবর্তন এসেছে, ফলে সব পানি কর্পুরের মতো উবে গেছে রাতারাতি।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউসি বার্কলির পৃথিবী ও গ্রহবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাইকেল মাঙ্গা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমাদের পরিচিত প্রাণের জন্য পানি যে জরুরি, তা আমরা জানি। কাজেই এই ভূগর্ভস্থ জলাধার কেন প্রাণের জন্য বাসযোগ্য হবে না, তার কোনো কারণ দেখছি না। পৃথিবীতে এ ধরনের জলাধারে প্রাণের দেখা মেলে—সমুদ্রের অতল বা খনির গহিনেও দেখা যায় প্রাণ।’

মাঙ্গা আরও বলেন, ‘মঙ্গলে আজতক প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে তাত্ত্বিকভাবে প্রাণ থাকতে পারে, এমন একটি জায়গা অন্তত শনাক্ত করা গেল।’

এর আগে অবশ্য বহু শুকনো নদী, বদ্বীপ ও শুকিয়ে যাওয়া হ্রদের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এ থেকে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন, এককালে মঙ্গলের পৃষ্ঠে যথেষ্ট পানি ছিল। অথচ মঙ্গল আজ খটখটে শুকনো মরু। এই ঘটনাটা ঘটেছে প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন বা ৩৫০ কোটি বছর আগে। কোনো কারণে মঙ্গলের জলবায়ুতে সে সময় হঠাৎ পরিবর্তন এসেছে, ফলে সব পানি কর্পুরের মতো উবে গেছে রাতারাতি। এর পেছনের কারণ কী, তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, মঙ্গলের চৌম্বকক্ষেত্র হারিয়ে যাওয়া, কোনো উল্কাপিণ্ডের আঘাত বা প্রাচীন কোনো অণুজীবের হামলায় জলবায়ুর এ ধরনের পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু ঠিক কেন হয়েছে এবং এত পানি কোথায় গেল, তা আজও রহস্য হয়েই রয়েছে বিজ্ঞানীদের কাছে।

এই রহস্য সমাধানের সূত্র সন্ধান করতে গিয়েই গবেষকেরা নাসার ইনসাইট ল্যান্ডারের তথ্য নিয়ে কাজ করেছেন। এই রোবোটিক সিসমোলজি ল্যাব, অর্থাৎ ভূকম্পনবিষয়ক গবেষণা রোবট ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মঙ্গলের ভেতরের গঠন ও সংশ্লিষ্ট নানা তথ্য সংগ্রহ করেছে। এটির সেন্সর ৫ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প শনাক্ত করতে পারে—উল্কার আঘাত বা আগ্নেয়গিরি সক্রিয় হয়ে উঠলে এ ধরনের ভূমিকম্পের চিহ্ন পাওয়া যেতে পারে মঙ্গল-অভ্যন্তরে।

আরও পড়ুন
লাইভ সায়েন্স-এর তথ্য বলছে, লাল গ্রহের বহিঃত্বকের নিচে একটি ফাটা পাথরের স্তর রয়েছে। এই স্তর সাড়ে ১১ থেকে ২০ কিলোমিটার গভীর। এর মধ্যেই বদ্ধ এই পানির স্তর।

মাঙ্গার ভাষ্যে জানা যাচ্ছে, এই তথ্য পৃথিবীতে অ্যাকুইফার বা পানিযুক্ত ভূগর্ভস্থ শিলাস্তর ও তেলের মজুত খুঁজতে ব্যবহৃত হয়, এমন একটি গাণিতিক মডেলে ইনপুট দেওয়া হয়েছে। এভাবে মঙ্গলের ভেতরে কোথায় ভূত্বক কত পুরু, কোরের পুরুত্ব ও গভীরতা, এর গাঠনিক উপাদানসহ আরও নানা বিষয় জানা গেছে। ম্যান্টলের ভেতরের তাপমাত্রা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া গেছে খানিকটা।

আরও পড়ুন

গভীর ভূত্বক নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ফাটল ধরা আগ্নেয়শিলার ভেতরে যথেষ্ট পরিমাণ তরল পানি রয়েছে। মঙ্গলের সমুদ্র ভরা থাকার কথা এ পানিতে। সে ক্ষেত্রে হতে পারে, প্রায় ৩৫০ কোটি বছর আগে মঙ্গলের পানি হয়তো উবে বা হারিয়ে যায়নি, বরং ঢুকে পড়েছে গ্রহটির গহিনে। তবে আপাতত সেই সমুদ্রে গিয়ে অনুসন্ধান বা গবেষণা করার যে উপায় নেই, সে কথা তো আগেই বলেছি।

নাসার পার্সিভিয়ারেন্স রোভার এরকম বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছে মঙ্গলের জেযেরো খাদ থেকে

এ ছাড়াও অবশ্য মঙ্গলের ধুলোসহ বিভিন্ন নমুনায় প্রাণের সন্ধান করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। নাসার পার্সিভিয়ারেন্স রোভার এরকম বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছে মঙ্গলের জেযেরো খাদ থেকে। ২০২১ সাল থেকে রোভারটি নমুনা সংগ্রহ করে চলেছে, এখনও পর্যন্ত চলমান রয়েছে এর কাজ। তবে সেই নমুনা পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার কথা ছিল প্রাথমিকভাবে ২০২৬ সালে। এখন অবশ্য বাজেট সংকটের ফলে সময় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে ২০৪০ সালের আগে ওসব নমুনা পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা বর্তমানে খুবই কম। অবশ্য প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর সহায়তায় এ কাজে অগ্রগতির চেষ্টা করে চলেছে নাসা।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন