সৌরপালে আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণ

মাটির পৃথিবী ছাড়িয়ে মানুষ মহাকাশে উঁকি দিতে শুরু করেছে বেশিদিন হয়নি। বর্তমানে পৃথিবীর বাইরে, মহাশূন্যে যাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে রকেট ও মহাকাশযান। এসব নভোযান পরিচালনা একদিকে যেমন ব্যয়বহুল; তেমনি জ্বালানী সীমাবদ্ধতার কারণে দূরপাল্লার মহাকাশ ভ্রমণের জন্য এই পদ্ধতি খুব একটা কার্যকর নয়। বিজ্ঞানীরা তাই দীর্ঘদিন ধরে বিকল্প কোনো উপায়ে মহাকাশভ্রমণ সম্ভব কি না, এ নিয়ে কাজ করছেন। গবেষণার মাধ্যমে মহাকাশভ্রমণের বেশ কিছু উপায় বের করেছেন অনুকল্প হিসেবে। কারিগরি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবসহ নানা কারণে এসব উপায়ে এখনই মহাকাশভ্রমণ সম্ভব হচ্ছে না। এসব অনুকল্পের মাঝে সব আশা জাগানোটি হলো সৌরপাল বা সোলার সেইলিং।

পৃথিবীতে বাতাসের গতি ব্যবহার করে পালতোলা নৌকা বা জাহাজ চালানো হয় জলপথে। পাল, অর্থাৎ কাপড়ের মাধ্যমে বাধা দেওয়া হয় বাতাসের শক্তিকে। ফলে জলযান ছুটে চলে বাতাসের গতির দিক বরাবর। সৌরপালের বিষয়টাও এরকম। পার্থক্য শুধু, এখানে বায়ুমণ্ডলীয় বাতাসের পরিবর্তে কাজে লাগানো হয় সৌরবায়ুকে।

সূর্য প্রতিমুহূর্তে শক্তিসমৃদ্ধ কণা নির্গত করছে। কণার এই স্রোতকে বলা হয় সৌরবায়ু। এসব কণার আছে ভরবেগ। ফলে, এরা বস্তুকে ধাক্কা দিতে পারে। পৃথিবীতে বাতাস যেভাবে পালের কাপড়ে ধাক্কা দেয়, অনেকটা সেভাবেই বস্তুকে ধাক্কা দিতে পারে সৌরবায়ু। তবে এক্ষেত্রে কাপড় বা অস্বচ্ছ প্রতিবন্ধক কোনো কাজে আসে না। সৌরবায়ুর গতিশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন প্রতিফলক তল। আয়নার মতো প্রতিফলক তলে সূর্য থেকে আসা আলোর কণা ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায়। অর্থাৎ আলো প্রতিফলিত হয়। একইভাবে সূর্য থেকে নির্গত অন্যান্য কণাও প্রতিফলক তলকে ধাক্কা দিয়ে ফিরে যায়। ভরবেগের সংরক্ষণশীলতার সূত্র অনুযায়ী, ধাক্কার আগে ও পরে মোট ভরবেগ সংরক্ষিত থাকে। ফলে, প্রতিফলক পৃষ্ঠে ধাক্কা খেয়ে ভরবেগসমৃদ্ধ এসব কণা যখন ফিরে আসে, তখন প্রতিফলক পৃষ্ঠও কিছুটা গতি পায়। পৃথিবীর মহাকর্ষ বল, বাতাসের চাপ ইত্যাদির কারণে আমরা সৌরবায়ু কিংবা আলো, এসবের ধাক্কা টের পাই না। কিন্তু মহাকাশে এসব সমস্যা নেই। সেখানে সৌরবায়ুকে কাজে লাগিয়ে মহাকাশযানে গতি তৈরি করা তাত্ত্বিকভাবে খুবই সম্ভব। সৌরবায়ু যেহেতু ক্রমাগত নির্গত হয়, তাই জ্বালানীর সীমাবদ্ধতা এখানে নেই।

সৌরপাল প্রযুক্তির বড় একটা সমস্যা হলো, সূর্য থেকে দূরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সৌরবায়ুর বায়ুর প্রাবল্য কমতে থাকে। ফলে সূর্য থেকে দূরে মহাকাশযানে গতি বাড়ানো সম্ভব নয়। এমনকি পৃথিবীর কক্ষপথ থেকেই সৌরবায়ু ব্যবহার করে কোনো মহাকাশযানে যথেষ্ট পরিমাণে বেগ পেতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। বলা প্রয়োজন, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার।

এ সমস্যা সমাধানের একটি উপায় হতে পারে পৃথিবীতে বিশাল আকারের কোনো লেজার তৈরি করা। লেজারের শক্তিশালী আলো সৌরপালে ফেলে নভোযান চালানো সম্ভব বর্তমানের সবচেয়ে দ্রুতগামী মহাকাশযানের চেয়েও বেশি গতিতে। বিজ্ঞানীদের হিসেব অনুযায়ী, এভাবে কোনো নভোযানকে আলোর বেগের ২০ ভাগ বেগে গতিশীল করা সম্ভব। এ গতিতে খুব সহজেই অন্য কোনো নক্ষত্রব্যবস্থায় ভ্রমণ করা যাবে। তবে সৌরপালের এ প্রযুক্তি বড় পরিসরে ব্যবহারের সুযোগ সহসাই হচ্ছে না। কারণটা আগেই বলেছি।

তবে সৌরজগতের ভেতরে সৌরপালের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। ২০১০ সালে জাপান অ্যারোস্পেস এজেন্সি (জাক্সা) মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সৌরপালবিশিষ্ট নভোযান উৎক্ষেপণ করে। ছয়মাসের মধ্যে নভোযানটি সফলভাবে পৌঁছে যায় শুক্রগ্রহের কক্ষপথে। সৌরপাল প্রযুক্তিকে কীভাবে আরও কার্যকর ও গতিশীল করে তোলা যায়, তা নিয়ে বর্তমানে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আলোর কাঁধে ভর দিয়েই মানুষ চড়ে বেড়াবে অসীম এই মহাবিশ্বজুড়ে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: ফিজ ডট ওআরজি, ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস