সৌরজগতের কেন্দ্রে আছে সূর্য। সৌররাজ। পৃথিবীর সব জীব, এমনকি আমরা মানুষও বেঁচে আছি এই সৌরশক্তির কল্যাণে। শুধু সূর্যই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, বিষয়টা তা নয়। তবে সূর্য ছাড়া প্রাণীর বেঁচে থাকা অসম্ভব। এটা একটা চক্রের মতো করে কাজ করে। সূর্যের আলোয় আমরা আলোকিত হই। সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে গাছ সেই আলো ব্যবহার করে খাদ্য তৈরি করে। গাছের তৈরি করা খাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকি আমরা। পাশাপাশি আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণেও সূর্যের ভূমিকা অপরিসীম।
আমাদের পূর্বপুরুষরাও বুঝতে পেরেছিলেন সূর্যের গুরুত্ব। পৃথিবীর অনেক সংস্কৃতিতেই তাই সূর্যকে দেবতা মনে করা হতো। আধুনিক যুগে এসে সেই ধারণা বদলেছে। আমরা বুঝতে শিখেছি, মহাবিশ্বের কোটি কোটি নক্ষত্রের মতো সূর্যও একটি সাধারণ নক্ষত্র মাত্র।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সূর্য ও চাঁদের ওপর নির্ভর করে দিন, মাস, বছর ও ঋতু গণনা করতে শিখেছিল। অনেকেই বিশ্বাস করত, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। প্রাচীন গ্রিক পণ্ডিত টলেমি ১৫০ খ্রিস্টাপূর্বাব্দে তাঁর ভূকেন্দ্রিক মডেলটি প্রকাশ করার পরে তৎকালীন সমাজ ও সভ্যতা সেটাকে বেদবাক্যের মতো গ্রহণ করে। সেসময় দার্শনিকরা তাঁদের মন গড়া যুক্তি তৈরি করতে পারতেন, ফাঁদতে পারতেন মনোহর গল্প। সেই ভুল ধারণা ভাঙতে সময় লেগেছে বহু বছর। প্রায় ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টার্কাস বলেছিলেন, সূর্যই সৌরজগতের কেন্দ্রে আছে। প্রাচীনকালে জ্ঞানবিজ্ঞানে ভারতীয় উপমহাদেশ এগিয়ে গিয়েছিল। খ্রিস্ট্রপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ভারতীয় গণিতবিদ আর্যভট্ট বলেছিলেন, পৃথিবী তার নিজের অক্ষের ওপর ঘোরে। অনেকের দাবি, তিনি সৌরকেন্দ্রিক মডেলেরও প্রস্তাব করেছিলেন।
এরপর মধ্যযুগে জ্যোতিঃর্বিজ্ঞান নিয়ে ব্যাপক কাজ করেন আরবীয় বিজ্ঞানীরা। সেকালের বিজ্ঞানীরা সৌরকেন্দ্রিক মডেল নিয়েও কাজ শুরু করেছিলেন। এদের মধ্যে নাসির আল-ডিন আল-তুসি উল্লেখযোগ্য। তবে সেটা অন্যদের কাছে গ্রহণযোগ মনে হয়নি। আধুনিককালে অনেকে দাবী করেন, আল-তুসির সৌরকেন্দ্রিক মডেল ইউরোপীয় জ্যোতির্বিদদের প্রভাবিত করেছিল।
১৫৪৩ সালে নিকোলাস কোপার্নিকাস সৌরজগতের সৌরকেন্দ্রিক গাণিতিক মডেল বর্ণনা করেন। এরপর ১৬১০ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলি বৃহস্পতির চাঁদ আবিষ্কার করে নিশ্চিত করেন, আসলেই পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্রে নেই। কারণ তিনি দূরবীনে দেখতে পান, বৃহস্পতির উপগ্রহগুলো নিজ মাতৃগ্রহকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে, পৃথিবীকে নয়। এভাবেই তিনি প্রমাণ করলেন, পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্র নয়।
যাইহোক, সৌরজগতের সবচেয়ে বড় বস্তু সূর্য। সৌরজগতের মোট ভরের ৯৯.৮ শতাংশ সূর্য মামার দখলে। পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ১০৯ গুণ। সূর্যের মধ্যে পৃথিবীর সমান প্রায় ১০ লাখ ৩০ হাজার গ্রহ এঁটে যাবে অনায়াসে।
সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় ১০ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৫ হাজার ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু সূর্যের কোর বা কেন্দ্রের তাপমাত্রা ২ কোটি ৭০ লাখ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা প্রায় দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়েও বেশি। সাধারণত পারমাণবিক বিস্ফোরণে এ পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হতে পারে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মতে, সূর্যের কেন্দ্রের সমপরিমাণ তাপমাত্রা উৎপন্ন করতে হলে প্রতি সেকেন্ডে ১০০ বিলিয়ন টন ডিনাইমাইট বিস্ফোরণ দরকার।
প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার পৃথিবী একসঙ্গে করলে সূর্যের ভরের সমান হবে।
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে সূর্যের মতো নক্ষত্রের সংখ্যা প্রায় ১০০ বিলিয়নেরও বেশি। আমাদের সূর্য ২৫ হাজার আলোকবর্ষ দূরে থেকে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে প্রদক্ষিণ করে। একবার মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে প্রদক্ষিণ করতে সূর্যের সময় লাগে ২৫০ মিলিয়ন বছর। তবে সূর্য তুলনামূলকভাবে তরুণ নক্ষত্র। এটি ‘পপুলেশন ১’ নক্ষত্র প্রজন্মের অংশ। যেসব নক্ষত্রে ভারী মৌলিক পদার্থের পরিমাণ বেশি, সেগুলো পপুলেশন ১ নক্ষত্র প্রজন্মের অন্তর্ভূক্ত। অর্থাৎ, এ ধরনের নক্ষত্রে হিলিয়ামের চেয়ে ভারী উপাদানগুলো তুলনামূলক বেশি থাকে।
সূর্য একটি মাঝারি আকারের নক্ষত্র। এর ব্যাসার্ধ প্রায় ৪ লাখ ৩৫ হাজার মাইল বা ৭ লাখ কিলোমিটার। এর চেয়ে বড় আকারের কোটি কোটি নক্ষত্র আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই আছে। পৃথিবীর সঙ্গে সূর্যের ভরের তুলনা করা যায়। প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার পৃথিবী একসঙ্গে করলে সূর্যের ভরের সমান হবে।
পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বও কম নয়। প্রায় ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল বা ১৫ কোটি কিলোমিটার। সূর্যের পরে আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র আলফা সেন্টাউরি নক্ষত্রমণ্ডলী। তিনটি নক্ষত্র আছে এই সিস্টেমে। এর মধ্যে লাল বামন নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টাউরি পৃথিবী থেকে ৪.২৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। সূর্যের আকারের নক্ষত্র আলফা সেন্টাউরি এ ও বি পরস্পরকে ৪.৩৭ আলোকবর্ষ দূর থেকে প্রদক্ষিণ করে।
সূর্যের জন্ম হলো কীভাবে, এবারে সেটা একটু সংক্ষেপে জেনে নিই। সূর্যের জন্মের একদম সঠিক হিসাব জানা যায় না। তবে পৃথিবীতে যে পুরোনো পাথর ও উল্কাপিণ্ড পাওয়া গেছে, তার বয়স প্রায় ৪৫০ কোটি বছর। এ ছাড়া অন্যান্য গ্রহের বয়স ইত্যাদি হিসেব করে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, সূর্যের জন্ম হয়েছে এর প্রায় লাখখানেক বছর আগে। সে হিসাবে ধারণা করা যায়, সমগ্র সৌরজগতও তখনই সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলে সূর্যের বয়সও তাই ৪৬০ কোটি বছরই ধরা হয়। বেশিরভাগ বিজ্ঞানীর বিশ্বাস, সূর্য এবং সৌরজগতের বাকি বস্তুগুলো সৃষ্টি হয়েছে ঘূর্ণায়মান কোনো গ্যাসপিণ্ড থেকে, যা সৌর নীহারিকা নামে পরিচিত। মহাকর্ষ বলের প্রভাবে জমতে শুরু করে ধুলোবালি। প্রবল ঘূর্ণনের কারণে ধুলোবালি চ্যাপ্টা ডিস্কের আকার ধারণ করে। বেশিরভাগ উপাদান কেন্দ্রের দিকে জমা হয়। কোটি কোটি বছর সময় নিয়ে জন্ম হয় সূর্যের।
সূর্যের প্রতি ১০ লাখ পরমাণুর বিপরীতে ৯৮ হাজার হিলিয়াম, ৮৫০টি অক্সিজেন, ৩৬০টি কার্বন, ১২০টি নিয়ন, ১১০টি নাইট্রোজেন, ৪০টি ম্যাগনেসিয়াম, ৩৫টি আয়রন ও ৩৫টি সিলিকন থাকে। তারপরেও এই উপাদানগুলোর মধ্যে হাইড্রোজেন সবচেয়ে হালকা। সূর্যের ভরের ৭২ শতাংশই হাইড্রোজেন। হিলিয়াম আছে ২৬ শতাংশ।
সূর্যের বুকে এখনো যথেষ্ট পরিমাণ জ্বালানি আছে। এই জ্বালানি ব্যবহার করে সূর্য জ্বলতে পারবে আরও অন্তত ৫০০ কোটি বছর। এরপর আমাদের হলুদ সূর্য পরিণত হবে লাল দৈত্যে। ধীরে ধীরে সূর্যের বাইরের স্তরগুলো ঝরে পড়বে। পড়ে থাকবে শুধু কেন্দ্রের সাদা অংশটুকু। আস্তে-ধীরে তাও বিবর্ণ হয়ে যাবে। জ্বলজ্বলে সূর্য তার সব শক্তি হারিয়ে শীতল হয়ে যাবে এবং কালো বামনে পরিণত হবে।
এবার সূর্যের অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে সংক্ষেপে জানা যাক। সূর্য কয়েক স্তরে বিভক্ত। সূর্যের ভেতরের অংশ কোর বা কেন্দ্র, রেডিয়েটিভ জোন এবং কনকেভটিক জোনের সমন্বয়ে গঠিত। এছাড়া ফটোস্ফিয়ার, ক্রোমোস্ফিয়ার, ট্রানজিশন অঞ্চল ও করোনা অঞ্চল নিয়ে গঠিত সূর্যের আবহমণ্ডল। এগুলো নিয়ে পরের কোনো পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এখন বরং সূর্যের রাসায়নিক গঠন নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করা যাক।
অন্যান্য নক্ষত্রের মতো, সূর্যেরও বেশিরভাগ হাইড্রোজেন দিয়ে গঠিত। এরপরেই রয়েছে হিলিয়াম। পাশাপাশি আছে আরও প্রায় সাত ধরনের উপাদান। অক্সিজেন, কার্বন, নিয়ন, নাইট্রোজেন, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন ও সিলিকন। একটা মজার তথ্য দিই। সূর্যের প্রতি ১০ লাখ পরমাণুর বিপরীতে ৯৮ হাজার হিলিয়াম, ৮৫০টি অক্সিজেন, ৩৬০টি কার্বন, ১২০টি নিয়ন, ১১০টি নাইট্রোজেন, ৪০টি ম্যাগনেসিয়াম, ৩৫টি আয়রন ও ৩৫টি সিলিকন থাকে। তারপরেও এই উপাদানগুলোর মধ্যে হাইড্রোজেন সবচেয়ে হালকা। সূর্যের ভরের ৭২ শতাংশই হাইড্রোজেন। হিলিয়াম আছে ২৬ শতাংশ।
সূর্যের মূল জ্বালানী হাইড্রোজেন। এখন পর্যন্ত সূর্যে মূলত হাইড্রোজেন-হাইড্রোজেন ফিউশন বিক্রিয়ায় একসঙ্গে মিলে হিলিয়াম তৈরি হয়। দুটো হাইড্রেজেনের মোট ভর এবং তা থেকে সৃষ্ট হিলিয়ামের ভর তার চেয়ে কিছুটা কম। এই যে হারিয়ে যাওয়া ভর, এটিই পরিণত হয় শক্তিতে। এই শক্তিকেই আমরা দেখতে পাই আলো হিসেবে। (হ্যাঁ, কারণটা যা ভাবছেন, তা-ই। তবে আলোর পাশাপাশি রোদে গেলে যে আমাদের গরম লাগে, এর পেছনেও কিন্তু সৌরশক্তির কারিকুরি আছে! কারণ আর কিছুই নয়, তাপও শক্তির একটি রূপ। তাই সূর্যের আলোর যে অংশটা দৃশ্যমান নয়, সেটা আমরা তাপ হিসেবে অনুভব করি।)
এই হলো একনজরে সূর্য। সৌরজগতের অধিপতি। তবে সূর্যকে নিয়ে জানার আছে আরও অনেক কিছু। সেগুলো আমরা ধীরে ধীরে জানব, আগামীপর্বগুলোতে।
লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: নাসা ও স্পেস ডট কম