সৌরজগৎ
পৃথিবী ঘুরছে কিন্তু বুঝতে পারি না কেন
পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘন্টায় প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার কিলোমিটার বেগে ঘুরছে। আবার নিজের অক্ষের চারপাশে প্রতি ২৪ ঘন্টায় একবার ঘোরে। কিন্তু তারপরেও আমরা কেন বুঝতে পারি না, পৃথিবী ঘুরছে?
পৃথিবী একই সঙ্গে সূর্যের চারপাশে এবং নিজের অক্ষের ওপর ঘোরে, এটা আমরা সবাই জানি। এই ঘুর্ণনের গতিও কম নয়। ঘন্টায় প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার কিলোমিটার বেগে সূর্যের চারপাশে ঘোরে। আর নিজের অক্ষের চারপাশে ঘোরে ঘন্টায় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার বেগে। কিন্তু আমরা তা বুঝতেই পারি না। কেন পারি না?
সে উত্তরে যাওয়ার আগে ভাবুন, আপনি একটা নাগরদোলায় উঠেছেন। এটি আপনাকে কয়েক পাক ঘোরাবে। ঘোরানোর কাজটা করবে কোনো মানুষ বা মেশিন। তবে যেভাবেই ঘোরানো হোক, গতি খুব বেশি থাকে না। প্রায় একই রাখা হয়। পৃথিবীর ঘোরার গতি নাগরদোলার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু তারপরেও নাগরদোলায় উঠলে অনেকের পিলে চমকে যায়। এই সামান্য গতির ঘূর্ণনে অনেকে বমিও করে ফেলে। তাহলে পৃথিবী যে এর চেয়ে হাজার গুণ বেশি গতিতে সাগর, পাহাড়-পর্বত সব কিছু নিয়ে ঘুরছে, আমরা তা বুঝতে পারি না কেন?
এর প্রধান কারণ হলো, পৃথিবীর ঘুর্ণন ধ্রুবক; মানে একই গতিতে ঘোরে। আসলে নাগরদোলাও একই গতিতে ঘোরে, অর্থাৎ ধ্রুবক। কেন আমরা বুঝতে পারি না এর প্রধান কারণ হলো পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ, ওটা না থাকলে আমরা উড়ে যেতাম। আর আমরা এটা মনে না বুঝলেও আমাদের শরীর ঠিকই বোঝে। এই ঘূর্ণনের ফলে যে কেন্দ্রাতিগ বলের সৃষ্টি হয়, তা আমাদের ওজনকে কমিয়ে দেয়। সুমেরুতে একজনের ভর ১০০ কেজি (১০০০ নিউটন ওজন), ঢাকা শহরে তার মনে হবে ২০০ গ্রাম ভর কমেছে (যদিও ভর অপরিবর্তিত থাকবে, এটা তার মনে হবে), অর্থাৎ ওজন কমবে ২ নিউটন।
বিষয়টা আরও একটু স্পষ্ট করি। চলুন, কল্পনার জগৎ থেকে ঘুরে আসি। ধরুন, আপনি বাসে চড়ে বসলেন। সোজা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। জ্যামের ঝামেলাও নেই। ধরা যাক, ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটার গতিতে বাসটি চলছে। সিটে আরাম করে বসে মাথাটা হেলিয়ে দিয়েছেন পেছনে। চোখ বন্ধ করলেন। গাড়ি চলার শব্দ আসছে কানে। এ অবস্থায় আপনি বুঝতেই পারবেন না, বাসে আছেন নাকি বাড়িতে আরাম করে শুয়েছেন? কিন্তু হঠাৎ গাড়িতে ব্রেক কষতে হলো। গতি নেমে এলো ২০ কিলোমিটারে। আবার বাড়তে বাড়তে ৪০ হলো। সামনে স্পিড ব্রেকার দেখা যাচ্ছে। গতি কমে এলো ৫ কিলোমিটারে। এবার কিন্তু আপনার বিরক্ত লাগবে। আপনি যে বাসে চড়েছেন তা বুঝতে পারবেন। এখন কেন বুঝতে পারবেন? কারণ বাসের গতি বাড়ছে-কমছে। আগের মতো একই গতিতে চলছে না।
বিমানে চা বা কফি খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এসব যাত্রীবাহী বিমানের গতি ঘন্টায় প্রায় ৭০০-৮০০ কিলমিটার। কিন্তু এই গতিতে থেকেও আপনি অনায়াসে মগে কফি ঢেলে খেতে পারবেন।
একই কারণে পৃথিবীর ঘোরার গতি বোঝা যায় না। পৃথিবী যদি ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গতি একটু গতি কমিয়ে দেয়, তাহলে আপনি টের পাবেন। শুধু টেরই পাবেন না, প্রাণটাই চলে যাবে। এক সেকেন্ডের জন্যও পৃথিবীর গতি একটু কমলে গ্রহটাই ধ্বংস হয়ে যেত। সেটা ভিন্ন বিষয়, পরের কোনো লেখায় বিস্তারিত লিখব।
তাহলে বুঝলাম, পৃথিবী একই বেগে মানে সর্বদা ঘন্টায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার বেগে চলে বলেই আমরা তা টের পাই না। যারা বিমানে চড়েছেন, তারা হয়তো বিষয়টা আরও একটু ভালো বুঝবেন। বিমানে চা বা কফি খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এসব যাত্রীবাহী বিমানের গতি ঘন্টায় প্রায় ৭০০-৮০০ কিলমিটার। কিন্তু এই গতিতে থেকেও আপনি অনায়াসে মগে কফি ঢেলে খেতে পারবেন। কারণ বিমান একই গতিতে এগিয়ে যায়।
আরেকটি বিষয় হলো, পরম গতি বলে কিছু নেই, সব গতি আপেক্ষিক। এ বিষয়টা গ্যালেলিও গ্যালেলি, আইজ্যাক নিউটন এবং আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীরা তুলে ধরেছিলেন। গ্যালেলিও একটা জাহাজের কথা কল্পনা করতে বলেছেন। ধরুন, আপনি একটা জাহাজের কোথাও দাঁড়িয়ে আছেন। জাহাজ চলার শব্দ না শুনলে বুঝতেই পারবেন না, জাহাজটি এখনো চলছে নাকি ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে জাহাজ চলছে কি না, তা বোঝার জন্য আপনাকে পানির দিকে তাকাতে হবে। অর্থাৎ একটা প্রসঙ্গ কাঠামো লাগবে। সেই প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে বস্তুটি চলমান নাকি স্থির, তা বোঝা যায়। এখানে পানি কাজ করে প্রসঙ্গ কাঠামো হিসেবে।
আরও সহজ একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। আপনি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখলেন বন্ধু বাসে চড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আপনি বন্ধুকে দেখছেন গতিশীল, কিন্তু আপনি নিজে স্থির। আবার আপনার বন্ধুও বাস থেকে আপনাকে পেছনের দিকে সরে যেতে দেখছে, কিন্তু সে নিজে স্থির। মানে আপনি যখন বন্ধুকে দেখছেন, তখন কার সাপেক্ষে বন্ধুকে গতিশীল দেখছেন? আপনার নিজের সাপেক্ষে। আপনিই এখানে প্রসঙ্গ কাঠামো এবং স্থির। একই কথা আপনার বন্ধুর জন্যও খাটে। অর্থাৎ প্রসঙ্গ কাঠামো না থাকলে আপনি বন্ধুকে গতিশীল দেখতেন না।
পৃথিবীর ঘূর্ণন দেখার জন্য এই প্রসঙ্গ কাঠামো নেই। মানে পৃথিবী যে ঘুরছে, সেটা আপনি কার সাপেক্ষে দেখবেন? এটা দেখার জন্য কোনো স্থির বস্তু নেই। বিষয়টা আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য আবার জাহাজের উদাহরণে ফেরা যাক। পানির (প্রসঙ্গ কাঠামো) দিকে না তাকানো পর্যন্ত আপনি বুঝতে পারছেন না, জাহাজ চলমান নাকি স্থির। এই একই জাহাজে যদি আপনার বন্ধু থাকে, সেও পানির দিকে না তাকিয়ে শুধু আপনাকে দেখে বুঝতে পারবে না, জাহাজটি চলছে কি না। এমনকি আপনি জাহাজে থাকা অন্যান্য বস্তুর দিকে তাকালেও বুঝবেন না। এটা বুঝতে হলে জাহাজের বাইরের কোনো বস্তুর দিকে তাকাতে হবে।
এখন সম্পূর্ণ পৃথিবীটাকে ওই জাহাজ কল্পনা করুন। আর জাহাজে থাকা অন্যান্য বস্তুগুলোকে ভাবুন পৃথিবীর বিভিন্ন বস্তু। জাহাজের মানুষগুলো পৃথিবীর সব মানুষ। এখন জাহাজের কোনো মানুষ বা বস্তু দেখে কি বুঝতে পারবেন, জাহাজ চলছে নাকি স্থির? আসলে বুঝতে পারবেন না। কারণ পানির দিকে বা জাহাজের বাইরের কোনো বস্তুর দিকে না তাহালে জাহাজের সব বস্তুই আপনার কাছে স্থির মনে হবে। পৃথিবীর ব্যাপারটাও এমন। আমরা শুধু পৃথিবীর পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, ঘর-বাড়ি দেখছি, যা সবই পৃথিবীর ভেতরে। পৃথিবীর বাইরের কিছু আমরা প্রসঙ্গ কাঠামো হিসেবে দেখতে পাচ্ছি না। তাই পৃথিবীর নিজের অক্ষের ওপর ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার গতিতে ঘুরলেও আমরা তা টের পাই না।