মহাবিশ্বের দিকে তাকালে বেশিরভাগ স্থানকেই মনে হয় ফাঁকা। গ্রহ থেকে উপগ্রহের দূরত্ব কয়েক লাখ কিলোমিটার, নক্ষত্ররা তো আরও দূরে। এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি দূরত্ব নক্ষত্রদের মধ্যে। এ দূরত্বকে বলা হয় ইন্টারস্টেলার বা আন্তঃনাক্ষত্রিক দূরত্ব। এটা এত বেশি যে এখানে মিটার, কিলোমিটার একক ব্যবহার করে লাভ হয় না। দূরত্ব মাপার জন্য তাই ব্যবহার করা হয় ‘আলোকবর্ষ’ এবং জ্যোতির্বিদ্যাগত একক (ইংরেজিতে যথাক্রমে লাইটইয়ার এবং অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট) । নক্ষত্রের চেয়ে আবার গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যকার দূরত্ব অনেক গুণ বেশি। একে বলা হয় আন্তঃগ্যালাকটিক দূরত্ব। এসব দূরত্বের মধ্যবর্তী স্থানকে আমাদের কাছে ফাঁকা বা শূন্য মনে হয়। এজন্য মহাকাশের আরেক নাম মহাশূন্য। কিন্তু মহাশূন্য কি আসলেই শূন্য? উত্তর হলো, না। মহাশূন্য আসলেই শূন্য নয়।
দুটি নক্ষত্রের মধ্যকার শূন্যস্থানে খুব সামান্য মাত্রায় ছড়িয়ে আছে গ্যাস ও ধূলিকণা। ইংরেজিতে এগুলোকে বলা হয় ইন্টারেস্টেলার মিডিয়াম। বাংলায় বলতে পারি, আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যম। একইভাবে দুটি গ্যালাক্সির মধ্যবর্তী স্থানের উপাদানকে বলা হয় আন্তঃগ্যালাকটিক মাধ্যম। দুটি মাধ্যমই খুবই আয়োজনাইজড বা আয়নিত। মানে, এখানে পরমাণু থেকে ইলেকট্রন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এমনটা ঘটার জন্য প্রচুর শক্তি শোষণ করতে হয় পরমাণুকে। এই শক্তির জন্যই পরমাণু থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে ইলেকট্রন। শক্তি শোষণ করে বেরিয়ে যায় লাফ দিয়ে। প্রশ্ন হলো, গোটা মহাবিশ্বটা আয়নিত হলো কীভাবে?
প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর পর মহাবিশ্ব যথেষ্ট ঠান্ডা হয়ে এল। এ সময় সব নিউক্লিয়াসের সঙ্গে ইলেকট্রন জোড় বাঁধার কথা ছিল। তাহলেই মহাবিশ্ব আয়নিত হতো না।
এ জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৩.৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে। সে সময় অসীম ঘনত্বের এক বিন্দুতে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে জন্ম হয় মহাবিশ্বের। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় বিগ ব্যাং। এই মহাবিস্ফোরণের কিছুটা পরে শিশু মহাবিশ্বে যা কিছু ছিল, তার সব ছিল একেবারে খাঁটি শক্তি বা এনার্জি। সময়ের প্রথম সেকেন্ড পেরোতে পেরোতেই অনেক কিছু ঘটে যায় সেই শিশু মহাবিশ্বে। শক্তি ঘনীভূত হয়ে নিউট্রিনো, কোয়ার্কসহ গঠন করে নানারকম মৌলিক কণা। এর ধারাবাহিকতায় ১০-৬ সেকেন্ড থেকে ১ সেকেন্ডের মধ্যে তৈরি হয় মহাবিশ্বের প্রথম পারমাণবিক নিউক্লিয়াস—হাইড্রোজেন। সে সময় এর পাশাপাশি সামান্য পরিমাণে তৈরি হয় হিলিয়াম ও লিথিয়াম। তবে এর সব কটিই ছিল নিউক্লিয়াস, কোনোটিই পরমাণু গঠন করতে পারেনি। প্রথম প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর ধরে মহাবিশ্ব ছিল প্রচণ্ড উত্তপ্ত। এসব নিউক্লিয়াস তাই ইলেকট্রন আটকানোর সুযোগ পায়নি। ফলে পুরো মহাবিশ্ব ভরে ছিল ঘন আয়নিত গ্যাসে।
প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর পর মহাবিশ্ব যথেষ্ট ঠান্ডা হয়ে এল। এ সময় সব নিউক্লিয়াসের সঙ্গে ইলেকট্রন জোড় বাঁধার কথা ছিল। তাহলেই মহাবিশ্ব আয়নিত হতো না। কিন্তু সব নিউক্লিয়াস তা পারেনি। যদিও সে সময়ই মহাবিশ্বের প্রথম সত্যিকার পরমাণু গঠিত হয়—হাইড্রোজেন পরমাণু। এতদিন কণা স্যুপের মধ্যে আটকে পড়া ফোটন কণাগুলোর সামনে আর কোন বাধা রইল না। তাই ফোটন ছুটতে শুরু করল তার নিজস্ব গতিতে। তাতেই মহাবিশ্ব প্রথমবারের মতো আলোকিত হয়ে ওঠে। সেই আলোটাই আমাদের কাছে মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ নামে পরিচিত।
ভারী নক্ষত্র প্রচুর পরিমাণে শক্তি বিকিরণ করে। এই শক্তি গ্যাসকে করে তোলে আয়নিত। এটুকু শুনে মনে হতে পারে, মহাবিশ্ব আয়নিত হওয়ার পেছনে আসলে নক্ষত্ররাই দায়ী। কিন্তু গল্পের আরও বাকি আছে।
যাহোক, কয়েক মিলিয়ন বছরের মধ্যে মহাবিশ্বে প্রথম প্রজন্মের নক্ষত্রগুলো জন্ম নিতে শুরু করে। মহাবিশ্ব তখন ছোট ও অনেক ঘন ছিল। ফলে নক্ষত্রগুলো হয় অতি অতিভারী। নক্ষত্রের ভরের সঙ্গে বিকিরণের সম্পর্ক সমানুপাতিক। অর্থাৎ, নক্ষত্র যত ভারী হবে, তত বেশি শক্তি বিকিরণ করবে। এই শক্তিই শীতল মহাবিশ্বকে ধীরে ধীরে আবারও আয়নিত করে তোলে। প্রায় ১০০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বে এরকম প্রচুর নক্ষত্র ছিল। এসব নক্ষত্র থেকে নির্গত শক্তি মহাবিশ্বের অনেকটা অঞ্চলকে আয়নিত করে ফেলে। এই সময়টাকে বিজ্ঞানীরা ‘পুনঃআয়নায়ন কাল’ বা ‘রিআইয়োনাইজড এরা’ বলেন।
ভারী নক্ষত্র প্রচুর পরিমাণে শক্তি বিকিরণ করে। এই শক্তি গ্যাসকে করে তোলে আয়নিত। এটুকু শুনে মনে হতে পারে, মহাবিশ্ব আয়নিত হওয়ার পেছনে আসলে নক্ষত্ররাই দায়ী। কিন্তু গল্পের আরও বাকি আছে। প্রচুর পর্যবেক্ষণ এবং হিসাব-নিকাশের পর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, শুধু নক্ষত্র গোটা মহাবিশ্বটাকে আয়নিত করে ফেলতে পারে না। এজন্য নিশ্চিতভাবেই শক্তি বিকিরণের অন্য কোনো উৎস দায়ী। এই অন্য উৎসটি গামা-রে বার্স্ট বা জিবিআর, অর্থাৎ গামা-রশ্মির বিস্ফোরণ হতে পারে।
ভারী নক্ষত্রের জীবনকালের শেষে নক্ষত্র নিজের ভরের মহাকর্ষীয় টানে চুপসে যায় নিজের ওপরেই। এ সময় প্রচুর পরিমাণ গামা-রশ্মি বিকিরণ করে মুমূর্ষু নক্ষত্রটি। এই ঘটনাকেই বলা হয় গামা-রশ্মি বিস্ফোরণ বা জিআরবি। গামা-রশ্মি বিকিরণের মধ্যে থাকে প্রচুর শক্তি। ফলে এ রশ্মি খুব সহজেই পরমাণুকে আয়নিত করতে পারে। তবে নক্ষত্রের শক্তি বিকিরণের সঙ্গে জিআরবির শক্তি যোগ করলেও সেখান থেকে গোটা মহাবিশ্বের আয়নিত হওয়ার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
তাই ব্ল্যাকহোল, নিউট্রন নক্ষত্র, কোয়াসারের মতো অন্যান্য বস্তু থেকেও শক্তি আসতে পারে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখনও এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। বের করতে পারেননি এর পেছনের সব কারণ।
প্রযুক্তি এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে উন্নত। মহাবিশ্বকে এখন আরও নিখুঁতভাবে দেখতে পায় মানুষ। পর্যবেক্ষণ করতে পারে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে, করতে পারে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ফলে প্রতিদিনই উন্মোচিত হচ্ছে অজানা অনেক রহস্য, খুলছে রহস্যের জট। তাই মহাবিশ্ব ঠিক কী কী কারণে আয়নিত হয়েছে, তা হয়তো জানা যাবে অদূর ভবিষ্যতেই। হয়তো সে কারণ আবিষ্কার করবেন এ লেখারই কোনো পাঠক—আমাদের ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরা।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: ওয়ান্ডারপোলিস, উইকিপিডিয়া, অ্যাস্ট্রোনমি ডট কম