১৯৭৪ সাল। বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক ল্যারি নিভেন ‘দ্য হোল ম্যান’ নামে একটি রহস্য গল্প লেখেন। ছোট্ট কোনো ব্ল্যাকহোল দিয়ে কি মানুষকে মেরে ফেলা সম্ভব—এমন এক প্রশ্নের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে ওই গল্পে। কৌতূহলী পাঠকেরা চাইলে গল্পটা পড়ে দেখতে পারেন। এই লেখার মূল বিষয় সেই গল্প নয়, বরং গল্পের প্রশ্নটা। চলুন, সেই প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করি।
ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে আমরা এখন পর্যন্ত যা জানি, তাতে এর ঘটনা দিগন্তের মধ্যে পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা নেই। আমাদের পরিচিত এ মহাবিশ্বে বিজ্ঞানীরা যেসব ব্ল্যাকহোলের সন্ধান পেয়েছেন, তার প্রায় সবই এত বড় যে সূর্যের মতো নক্ষত্রকে সহজেই হজম করার শক্তি রাখে। সবচেয়ে ছোট ব্ল্যাকহোলটিও সূর্যের চেয়ে কয়েকগুণ ভারী। এসব ব্ল্যাকহোলের সামনে কেবল মানুষ নয়, গোটা পৃথিবীর অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে। এর প্রচণ্ড মহাকর্ষ শক্তি নিমিষেই অণু-পরমাণুতে ছিন্ন ভিন্ন করে পদার্থকে টেনে নিয়ে যাবে কেন্দ্রে। সেখানে ছোট্ট বিন্দুতে জমা হয়ে আছে বিপুল পরিমাণ ভর। এই বিন্দুকে বিজ্ঞানীরা বলেন সিঙ্গুলারিটি।
অর্থাৎ আমাদের আবিষ্কৃত ব্ল্যাকহোলে পড়লে মানুষের বাঁচার আশঙ্কা নেই। কিন্তু ছোট আকারের ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে ঘটনা কেমন ঘটবে? তার চেয়েও বড় কথা, কত ছোট ব্ল্যাকহোলের কথা আমরা বলছি?
আদি ব্ল্যাকহোলগুলোর ভর হতে পারে একটি পরমাণু থেকে কয়েকটি পৃথিবীর ভরের সমান। যদিও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখনও কোনো আদি ব্ল্যাকহোলের দেখা পাননি। সেটাই স্বাভাবিক। নির্দিষ্ট সীমার বাইরে আদি ব্ল্যাকহোলগুলোকে আমাদের দেখতে পাওয়া কথা নয়।
বিজ্ঞানীদের মতে, তাত্ত্বিকভাবে ব্ল্যাকহোল একটি পরমাণুর আকারেরও হতে পারে। এগুলোকে বলা হয় ম্যাইক্রো ব্ল্যাকহোল। আকার ছোট হলেও পাহাড়ের সমান ভর এতে পুঞ্জীভূত থাকতে পারে।
এবার মূল প্রশ্নে ফেরা যাক। সর্বনিম্ন কতটুকু আকারের ব্ল্যাকহোল মানুষের জন্য প্রাণঘাতি? সম্প্রতি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গবেষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যপক রবার্ট জে. শেরার। তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশের জন্য এআরএক্সআইভি জার্নালে জমা দেওয়া হয়েছে। গবেষণার শিরোনাম, ‘Gravitational Effects of a Small Primordial Black Hole Passing Through the Human Body’ বা মানবদেহের মধ্যে দিয়ে পার হওয়ার সময় ছোট আদি ব্ল্যাকহোলের মহাকর্ষীয় প্রভাব।
অধ্যপক শেরার তাঁর গবেষণা করেছেন আদি ব্ল্যাকহোল নিয়ে। তাত্ত্বিকভাবে মহাবিশ্বের জন্মের কিছু সময় পর এসব ব্ল্যাকহোলের তৈরি হয়েছিল। আমাদের চেনা জানা ব্ল্যাকহোলের চেয়ে এদের আকার অনেক ছোট।
আদি ব্ল্যাকহোলগুলোর ভর হতে পারে একটি পরমাণু থেকে কয়েকটি পৃথিবীর ভরের সমান। যদিও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখনও কোনো আদি ব্ল্যাকহোলের দেখা পাননি। সেটাই স্বাভাবিক। নির্দিষ্ট সীমার বাইরে আদি ব্ল্যাকহোলগুলোকে আমাদের দেখতে পাওয়া কথা নয়। পর্যবেক্ষণযোগ্য হতে হলে কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। এগুলো সেই শর্ত মানে না। যেমন, আদি ব্ল্যাকহোলের ভর যদি ১০১২ কেজির কম হয়, তাহলে বিগ ব্যাংয়ের পর থেকে এগুলো হকিং রেডিয়েশন নির্গমের মাধ্যমে উবে গেছে।
আবার ১০২০ কেজির বেশি ব্ল্যাকহোলের কারণে মহাকাশে দেখা যায় গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং প্রভাব। অর্থাৎ, এরা স্থানকে এমনভাবে বাঁকিয়ে ফেলতে পারে যেন এসব ব্ল্যাকহোলের পেছনে থাকা অনেক দূরের নক্ষত্র সহজেই দেখা যায়। আমাদের কাছেপিঠে (মানুষের ওপর ব্ল্যাকহোলের প্রভাব বুঝতে হলে, মানুষের কাছাকাছি ব্ল্যাকহোল থাকতে হবে। যেহেতু আমরা ব্ল্যাকহোলের যাইনি এখনও) এধরনের ব্ল্যাকহোল থাকলে আমাদের নিজেদের গ্যালাক্সির দূরের নক্ষত্রগুলো স্পষ্ট দেখতে পেতাম। অর্থাৎ মিল্কিওয়েতেই দেখা যেত গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিজ্ঞানীরা এমন কোনো ঘটনা এখন পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারেননি। তাই বলা যায়, এ ধরনের ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
গ্রহাণুর সমান ভরের ব্ল্যাকহোলগুলো এক মাইক্রোমিটারের চেয়েও ছোট আকারের হয়। ফলে এদের টাইডাল ফোর্সের ব্যাপ্তিও হয় খুব অল্প। এটি যদি আমাদের হাত-পা অথবা কোনো অঙ্গের মধ্যে দিয়ে চলে যায়, তাহলে কিছুটা ক্ষতি করবে আশেপাশে টিস্যুর।
কিছু তাত্ত্বিক মডেল অনুসারে, আদি ব্ল্যাকহোলগুলো ডার্ক ম্যাটারের উৎস হতে পারে। যদি সত্যিই তা হয়, তাহলে আমাদের পর্যবেক্ষণ সীমার মধ্যে থাকবে ১০১৩-১০১৯ কেজির ব্ল্যাকহোলগুলো। এই ভর গড়পড়তা একটি গ্রহাণুর সমান।
এসব যুক্তির ওপর ভিত্তি করে অধ্যাপক শেরার নিজের গবেষণায় ১০১৩ থেকে ১০১৯ কেজির ব্ল্যাকহোলগুলো আমলে নিয়েছেন। মানুষের ওপর এসব ব্ল্যাকহোলের ক্ষতির সম্ভাব্য দুটি প্রভাব বিশ্লেষণ করেছেন। একটি প্রভাব হলো, এদের চারপাশে তৈরি হওয়া শকওয়েভ, অন্যটি টাইডাল ফোর্স।
ভারী কোনো কিছুর যত কাছে যাওয়া যায়, ততই শক্তিশালী হতে থাকে এর চারপাশে তৈরি মহাকর্ষ ক্ষেত্র। ফলে কাছে যাওয়া বস্তুটি ভারী বস্তুর দিকে টান অনুভব করে। এটাকেই মূলত টাইডাল ফোর্স বলা হয়। এর মানে হলো, ব্ল্যাকহোলের যত কাছে যাওয়া যায়, টাইডাল ফোর্স ততই বাড়তে থাকে। অন্যদিকে, ব্ল্যাকহোল অন্য একটি ব্ল্যাকহোল কিংবা বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ালে সৃষ্টি হয় শক্তিশালী তরঙ্গ। (এরকম ঘটনার কারণেই আমরা ২০১৫ সালে লাইগো গবেষণাগারে প্রথমবারের মত মহাকর্ষী তরঙ্গ শনাক্ত করতে পেরেছিলাম।) যাহোক, এখন প্রশ্ন হলো, আদি ব্ল্যাকহোলের এ দুই প্রভাব কি শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ছিন্ন ভিন্ন করতে সক্ষম?
গ্রহাণুর সমান ভরের ব্ল্যাকহোলগুলো এক মাইক্রোমিটারের চেয়েও ছোট আকারের হয়। ফলে এদের টাইডাল ফোর্সের ব্যাপ্তিও হয় খুব অল্প। এটি যদি আমাদের হাত-পা অথবা কোনো অঙ্গের মধ্যে দিয়ে চলে যায়, তাহলে কিছুটা ক্ষতি করবে আশেপাশে টিস্যুর। কিন্তু সেটাকে কোনোভাবেই প্রাণঘাতি বলার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে একটা সুঁচ ঢুকে বের হয়ে গেলে যেমন ব্যথা পাবেন, তেমনটা হতে পারে।
কিন্তু ব্ল্যাকহোলটি যদি মস্তিষ্কের মধ্যে দিয়ে পার হতে চায়, তাহলে ঘটনা হবে ভিন্ন। টাইডাল ফোর্স মস্তিষ্কের কোষগুলোকে ছিড়ে ফেলতে পারে। এর ফল হতে পারে মারাত্মক। মস্তিষ্কের কোষগুলো খুবই নাজুক। ১০-১০০ মাইক্রো নিউটনের বল এদেরকে ছিন্নভিন্ন করতে পারে। আর তেমনটা হলে প্রাণরক্ষার খুব একটা সুযোগ নেই। তবে এতটা বল তৈরি করতে হলে ব্ল্যাকহোলটি ভর হতে হবে ভরসীমার শেষ পর্যায়ের।
শকওয়েভ আরও বেশি বিপজ্জনক হতে পারে। এক্ষেত্রে ব্ল্যাকহোল শরীরে ঢুকে পড়লে, ভেতরে ভারী তরঙ্গ তৈরি করবে। এ তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়বে চারপাশে। এতে শরীরের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া তাপশক্তি স্থানান্তর হবে শকওয়েভের মাধ্যমে। ফলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। ২২ ক্যালিবারের গুলি সমান শকওয়েভ তৈরি করতে ১.৪×১০১৪ কেজি ভরের ব্ল্যাকহোল যথেষ্ট। বলা বাহুল্য, এই ক্যালিবারের গুলি মানুষকে মেরে ফেলতে সক্ষম।
মোদ্দাকথা, আদি ব্ল্যাকহোল মানুষকে মেরে ফেলতে সক্ষম। তবে বাস্তবে এমনটা হওয়ার আশঙ্কা প্রায় শূন্য। সঠিকভাবে বললে, ১০ ট্রিলিয়ন বারে একবারও নয়। আসলে মহাকাশের বিশালতার তুলনায় এদের অস্তিত্ব থাকা এবং সেটা আপনার আমার শরীরের মধ্য দিয়ে পার হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। তাই ছোট্ট ব্ল্যাকহোল মানুষকে মেরে ফেলতে পারে কিনা, তা নিয়ে জমজমাট গল্প তৈরি হতেই পারে। তবে বাস্তবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।