সূর্যের দৃশ্যমান পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় ৬ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর কয়েক হাজার কিলোমিটার ওপরে অবস্থিত সূর্যের বায়ুমণ্ডল। এটি করোনা অঞ্চল নামেও পরিচিত। সেখানকার তাপমাত্রা সূর্যের পৃষ্ঠের চেয়ে কয়েকশ গুণ বেশি। প্রায় ১০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এমনটি তো হওয়ার কথা নয়। সাধারণত কোনো গরম উৎস থেকে দূরে সরে গেলে ধীরে ধীরে ঠান্ডা হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে তার বিপরীত চিত্র। এই অনিয়মের কারণ কী?
আসলে সত্যি বলতে, এই রহস্যের সমাধান খোদ বিজ্ঞানীদের কাছে নেই। তবে সূর্যের বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করতে এই শক্তিগুলো কোথা থেকে আসে, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের একটি ধারণা আছে। চলুন সেই ধারণাকে সঙ্গী করে সামনে যাওয়া যাক।
সূর্যের বায়ুমণ্ডল বেশি গরম হওয়ার কারণ সূর্যের চৌম্বকীয় ক্ষেত্র। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সূর্যের চৌম্বকীয় ক্ষেত্র সৌরপৃষ্ঠ থেকে বায়ুমণ্ডলে শক্তি নিয়ে আসে। বিষয়টি আরও একটু স্পষ্ট করা দরকার।
পৃথিবীর যেমন চৌম্বকীয় ক্ষেত্র আছে তেমনি আছে সূর্যেরও। এ চৌম্বক ক্ষেত্রের দুটি মেরু আছে। উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু। এই দুই মেরুর মধ্যে কতটা ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে সূর্যের করোনা অঞ্চলের ঠিক কোথায় দেখা যাবে সোলার স্ট্রম বা সৌরঝড়। ধাক্কাধাক্কির মাত্রা যত বেশি হবে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা তত বাড়বে।
যে কোনো চৌম্বকের চারপাশে তৈরি হয় চৌম্বক ক্ষেত্র। আর থাকে দুটি মেরু। বিপরীত মেরু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। আর সম মেরু পরস্পরকে করে বিকর্ষণ। যাহোক চৌম্বক যত শক্তিশালী হয়, তার চৌম্বক ক্ষেত্রও তত বাড়ে। এই চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যেই থাকে চৌম্বক রেখা। সেগুলোকে অবশ্য দেখা যায় না। কিন্তু চৌম্বক ক্ষেত্র কতটা শক্তিশালী এবং বিস্তৃত হবে তা আবার নির্ভর করে এই রেখাগুলোর ওপর। সূর্যের এই রেখাগুলোর জন্ম হয় সৌরপৃষ্ঠে বা ফটোস্ফিয়ারে। সাধারণত এই রেখাগুলো একসঙ্গে আবদ্ধ থাকে। অনেক চৌম্বক রেখা দেখতে আবার সরলরেখার মতো। যাহোক, এই রেখাগুলো সূর্য থেকে বেড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে সূর্যের বায়ুমণ্ডলে। অর্থাৎ, করোনা অঞ্চলে। ফলে করোনা অঞ্চল অত্যাধিক গরম হয়। মোদ্দাকথা, সূর্যের করোনা অঞ্চলকে অত্যন্ত উত্তপ্ত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করে এই চৌম্বক রেখাগুলো। আদতে চৌম্বক ক্ষেত্রগুলো।
তবে সূর্যের ক্ষেত্রগুলো অদৃশ্য হলেও এগুলো পরিমাপ করা যায়। কারণ সূর্য থেকে আসা আলো কিছুটা পরিবর্তন হয়। সূর্যের পৃষ্ঠ খুবই উজ্জ্বল। তাই সূর্যপৃষ্ঠ থেকে আসা আলোর পরিবর্তনগুলো দেখা যায়। ফলে সহজেই পরিমাপ করা যায় সূর্যের চৌম্বকীয় ক্ষেত্র। কিন্তু সূর্যের বায়ুমণ্ডল এতটাই উষ্ণ যে সেখানকার আলো দেখা যায় না। বরং সে আলো এক্স-রশ্মি তৈরি করে। এক্স-রশ্মি এমন এক ধরনের আলো, যা আমরা দেখতে পাই না।
তবে আশার কথা হচ্ছে, ২০১৮ সালে সূর্যের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয় মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পার্কার সোলার প্রোব। এটি সূর্যের কাছাকাছি থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। প্রকৃতপক্ষে এই প্রোবটি সূর্যের চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে উড়ছে। এখনো পার্কার প্রোব থেকে এ বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে আগামী তিন বছরের মধ্যে নিশ্চয়ই স্যাটেলাইটটি থেকে দারুণ সব নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যাবে। কারণ ২০২৫ সালে শেষ হবে পার্কার প্রোবের ৭ বছরের অভিযান।
সূর্যের চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের বৈশিষ্ট্যসহ সূর্যের অনেক রহস্যই আমাদের এখনো অজানা। সূর্যকে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য এ ধরনের স্যাটেলাইট সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। হয়তো ভবিষ্যতে সূর্যের উদ্দেশ্যে পাঠানো হবে আরও উন্নত প্রযুক্তি সম্পন্ন নতুন কোনো স্যাটেলাইট। চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের কারণে সূর্যের বায়ুমণ্ডল তার পৃষ্ঠের চেয়ে আসলেই গরম কি না, তা বোঝার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: স্পেস ডট কম ও আর্থ স্কাই ডট ওআরজি
এই সিরিজের অন্যান্য লেখা