মহাকাশ
মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগিতা
মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে আবারও। ভারত, চীন, জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা কিংবা পাকিস্তান বা আরব আমিরাতও এ প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিচ্ছে। তবে এবারের প্রতিযোগিতায় স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের মতো সক্রিয় নয় রাশিয়া। এদিকে চাঁদে ফিরতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, কলোনি বানাতে চায়। চীনও চায় চাঁদে কলোনি বানাতে। চাঁদ থেকে মঙ্গলে যেতে চায় তারা। শুধু দেশগুলোই নয়, বেসরকারি বিভিন্ন মহাকাশ প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানও পাল্লা দিচ্ছে সমানে সমানে। কে জিতবে এ প্রতিযোগিতায়?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকের কথা। জার্মানদের গবেষণাগারগুলো একে একে দখল করে নিচ্ছে মিত্রবাহিনী। মানে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ জার্মানিবিরোধী দেশগুলোর যৌথ সেনাবাহিনী। জার্মানরা রকেট বানিয়েছে। সেই রকেট ইউরোপের নানা দেশে হামলে পড়েছে। গবেষণাগারের দখল নেওয়া তাই জরুরি। শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু—এটাই ছিল মিত্রবাহিনীর বন্ধুত্বের পেছনের কথা। নিজেদের মধ্যকার প্রতিযোগিতায় কিছুটা ভাটা পড়লেও থেমে যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই সে প্রতিযোগিতা পুরোদমে মাথাচাড়া দিল। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুরু হলো স্নায়ুযুদ্ধ। এই যুদ্ধ নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের। আর এর কেন্দ্রে আছে মহাকাশ জয়।
কে আগে পৃথিবীর সীমানা পেরোতে পারবে? কার আগে পা পড়বে চাঁদে? মঙ্গল জয় করাও প্রয়োজন! এর মাধ্যমে প্রমাণিত হবে প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব। প্রতিযোগিতা শুধু মহাকাশ নিয়ে নয়, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, অস্ত্র নির্মাণ, পারমাণবিক শক্তি—প্রতিযোগিতা চলছে নানা দিকে। সব মিলেই স্নায়ুযুদ্ধ। কিন্তু কেন্দ্রে সেই মহাকাশ জয়। কারণও আছে। রুশ সেনাবাহিনী জার্মানদের গবেষণাগার দখল করে প্রযুক্তি নিয়ে গেছে। ওদিকে বিজ্ঞানীরা আত্মসমর্পণ করেছেন মার্কিনদের কাছে। কাজেই জমে উঠেছে লড়াই।
মহাকাশ জয়ের এ প্রতিযোগিতার শুরু চল্লিশের দশকের শেষ দিকে। কিন্তু আর সব প্রতিযোগিতার মতো এটি দীর্ঘ হয়নি। ষাটের দশক শেষ হতে হতে প্রতিযোগিতা শেষ। কারণ, মার্কিনরা চাঁদে পা রেখেছেন। রাশিয়া পারেনি। অথচ খরচ হয়ে গেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়ে গেছে, এখন আর প্রমাণের কিছু নেই।
নাসার কাজকর্মের পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ার্নার ভন ব্রাউন। তিনি বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, মার্কিনরা তাঁকে গ্রহণ করেছেন। জার্মান ভি-২ রকেটের উত্তরসূরি হিসেবে তিনি বানিয়েছেন ‘স্যাটার্ন’ রকেট। এই রকেট মানুষকে চাঁদে পৌঁছে দিয়েছে। তাঁর পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী। শুধু চাঁদে পা রেখে তিনি সন্তুষ্ট নন। মঙ্গলে পাড়ি জমাতে চান। কিন্তু বাজেট নেই হয়ে গেল সত্তর দশক শেষ হতে হতে। ভন ব্রাউন টের পেলেন, তাঁর আসলে আর কিছু করার নেই। নতুন নতুন রকেট ও নভোযান বানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বানাচ্ছে স্যাটেলাইটও। কিন্তু চাঁদে ছয়বার নভোচারী পাঠানোর পর আর কাউকে মহাকাশে পাঠাতে তারা আগ্রহী নয়। রোবট নভোযান পাঠালেই কাজ হচ্ছে।
তারপর প্রতিযোগিতার চেয়ে বন্ধুত্বকেই লাভজনক হিসেবে বিবেচনা করেছে দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপানসহ আরও অনেক দেশ মিলেমিশে মহাকাশ জয়ের লক্ষ্যে কাজ করছে। মানব–নির্মিত কৃত্রিম যান পেরিয়ে গেছে সৌরজগতের ঠিকানা, নেমেছে বৃহস্পতির উপগ্রহে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে রুশ নভোচারীরা (কসমোনট) মার্কিন অ্যাস্ট্রোনটদের সঙ্গে মিলে গবেষণা করছেন। দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।
কিন্তু এক মাঘে শীত ফুরোয় না। বন্ধুত্বের পাশাপাশি তাই প্রতিযোগিতা উঁকি দিয়েছে নানা সময়ে। তবে সেটা সত্যিকারের প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে বর্তমান সময়ে এসে। একদিকে চীন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়াও আছে, আছে ভারত, জাপান, কানাডা, যুক্তরাজ্য থেকে শুরু করে আরব আমিরাতও! বিশ্বরাজনীতিতে আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মহাকাশ অভিযান। প্রায় ৫০ বছর পর চাঁদে ফিরছে যুক্তরাষ্ট্র। লক্ষ্য, ২০৪০ সালের মধ্যে মঙ্গলে পাড়ি জমানো।
এই প্রতিযোগিতার নানা দিক নিয়েই এ আলোচনা। শুরুটা করা যাক ভারত থেকে।
২.
গত দশক থেকেই ভারত মহাকাশ অভিযানে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। এরই সূত্র ধরে ২০০৮ সালের অক্টোবরে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো) প্রথম ‘চন্দ্রযান–১’ উৎক্ষেপণ করে। চাঁদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় এই চন্দ্রযান। ২০১৯ সালে চন্দ্রযান–২ চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। সেই ধারাবাহিকতায় এই জুলাই মাসেই চাঁদের উদ্দেশে যাত্রা করার কথা চন্দ্রযান–৩-এর। চন্দ্রযান–২-এর যা করার কথা ছিল, এটি তা–ই করবে। চাঁদে নেমে ঘুরে বেড়াবে ও তথ্য সংগ্রহ করবে। এরপর ২০২৫ সালে লুনার পোলার এক্সপ্লোরেশন মিশন (লুপেক্স) পরিচালনা করবে ইসরো ও জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জাক্সা) যুগ্মভাবে। এই অভিযানের সবিস্তার তথ্য এখনো জানা যায়নি। তবে অভিযানটি চালানো হবে চাঁদের উল্টো পাশে। যে পাশটি পৃথিবী থেকে দেখা যায় না। যে পাশটির ব্যাপারে আমরা অতিসম্প্রতি জানতে শুরু করেছি। (এ বিষয়ে পরে আসছি)
এবার মঙ্গল অভিযানের কথা বলি। ২০১৩ সালের নভেম্বরে ভারত প্রথম মঙ্গলে অভিযান চালায়। ইউরোপ, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পর মঙ্গলযান–১-এর মাধ্যমে চতুর্থ দেশ হিসেবে মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছায় ভারত।
এবার মঙ্গল অভিযানের কথা বলি। ২০১৩ সালের নভেম্বরে ভারত প্রথম মঙ্গলে অভিযান চালায়। ইউরোপ, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পর মঙ্গলযান–১-এর মাধ্যমে চতুর্থ দেশ হিসেবে মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছায় ভারত। ২০১৪ সাল থেকে এখনো এই নভোযান ঘুরছে মঙ্গলকে ঘিরে। এই অভিযানের উল্লেখযোগ্য বিশেষত্ব হলো, নাসার প্রায় অর্ধেক খরচে মঙ্গলে পৌঁছে গেছে ভারত। মঙ্গলযান–২ যাত্রা করবে ২০২৪ সালে। এতে কোনো ল্যান্ডার থাকবে না, অর্থাৎ মঙ্গলে নামবে না ভারত। তবে এর পরের কয়েকটি অভিযানে যে ভারত মঙ্গলে নভোযান নামানোর পাশাপাশি মানুষ পাঠানোর চেষ্টাও করবে, তা বোঝা যাচ্ছে ‘হাবভাবে’। এ ছাড়া ভারত বিভিন্ন কৃত্রিম উপগ্রহ, নভোদুরবিন থেকে শুরু করে শুক্র গ্রহের কক্ষপথে শুক্রায়নসহ বেশ কিছু প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছে।
‘হাবভাবে’ মানে কী, সেটা একটু খোলাসা করা প্রয়োজন। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি গঙ্গায়ন–১-এর মাধ্যমে ভারত প্রথম মহাকাশে নভোচারী পাঠানোর সক্ষমতা পরীক্ষা করবে। এই অভিযানে অবশ্য কোনো নভোচারী থাকবেন না। শুধু পরীক্ষা করে দেখা হবে, নভোযানটি নিরাপদে নভোচারী বহনের যোগ্য কি না। এর ধারাবাহিকতায় গঙ্গায়ন–২ মহাকাশে যাবে ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে। আর পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ২০২৫ সালে গঙ্গায়ন–৩ নভোচারী নিয়ে ছুটবে। এর মাধ্যমে পৃথিবীর সীমানা পেরোনোর কথা ভাবছে ভারত। এই অভিযান সফল হলে মহাকাশে স্বতন্ত্রভাবে নভোচারী পাঠানো চতুর্থ দেশে পরিণত হবে ভারত। এত দিন শুধু যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন স্বতন্ত্রভাবে মহাকাশে নভোচারী পাঠিয়েছে। ‘হাবভাবে’ মানে, মহাকাশে নভোচারী পাঠানোর এ প্রচেষ্টা। এরই ধারাবাহিকতায় ভারতীয় নভোচারীরা যে শিগগিরই চাঁদের পানে ছুটবেন, তা আন্দাজ করতে বোধ হয় রকেট বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
ভারতের পর দক্ষিণ এশিয়ায় জাপান ও চীনের কাজই উল্লেখযোগ্য। জাপান মহাকাশ গবেষণায় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে। ২০২১ সাল থেকেই নভোচারীদের নিয়োগ দিচ্ছে তারা। উদ্দেশ্য, লুনার গেটওয়েতে নভোচারী পাঠানো। লুনার গেটওয়ে মানে, চাঁদের চারপাশে কক্ষপথে একটি স্টেশন বানাবে নাসা। সে স্টেশনে নভোচারী পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে চীন। চাঁদেও শিগগিরই জাপানি নভোচারীদের পা পড়বে—এটা শুধু আন্দাজ নয়, জাক্সার আনুষ্ঠানিক বক্তব্য। আর লুনার গেটওয়ে যে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের মঙ্গল অভিযানের সঙ্গে যুক্ত, তা আমরা দেখব একটু পরেই।
চাঁদের পাশাপাশি জাপান গ্রহাণু নিয়েও গবেষণা করছে পূর্ণোদ্যমে। হায়াবুসা ও হায়াবুসা ২ গ্রহাণুতে শুধু নামেইনি, নমুনা নিয়ে ফিরেছে পৃথিবীতে। পৃথিবীতে খনিজের সংকট দেখা যাচ্ছে। শিগগিরই হয়তো মানুষ গ্রহাণুতে খনিজ সংগ্রহে অভিযান চালাবে। এ দৌড়ে পিছিয়ে থাকতে চায় না জাপান।
জাপান বা জাক্সার যুগ্ম প্রকল্পের কথা আবার আসবে আর্টেমিস নিয়ে আলোচনায়।
ভারতের পর দক্ষিণ এশিয়ায় জাপান ও চীনের কাজই উল্লেখযোগ্য। জাপান মহাকাশ গবেষণায় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে। ২০২১ সাল থেকেই নভোচারীদের নিয়োগ দিচ্ছে তারা। উদ্দেশ্য, লুনার গেটওয়েতে নভোচারী পাঠানো। লুনার গেটওয়ে মানে, চাঁদের চারপাশে কক্ষপথে একটি স্টেশন বানাবে নাসা।
৩.
বর্তমান মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে চীন। চাঁদ জয়ের বর্তমান প্রতিযোগিতায় অনেকের ধারণা, চীন অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে। কেন? সেটা বোঝার জন্য চাঁদের উল্টো পাশের বিষয়টি একটু বোঝা প্রয়োজন।
পৃথিবীর সঙ্গে চাঁদ টাইডাল লকে আবদ্ধ; অর্থাৎ চাঁদ এমনভাবে পৃথিবীকে ঘিরে ঘোরে যে পৃথিবী থেকে এর শুধু একটি পাশই দেখা যায়। অন্য পাশটি দেখা যায় না। এত দিন চাঁদে যত ল্যান্ডার বা নভোযান নেমেছে, সবই নেমেছে চাঁদের এ পাশে। মার্কিন নভোচারীরাও চাঁদের এ পাশেই নেমেছেন। উল্টো পাশে ঠিক কী আছে, এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের উৎস ছিল অরবিটার নভোযানগুলো। যে নভোযানগুলো কোনো মহাজাগতিক বস্তুর চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, নামে না, সেগুলোকে বলে অরবিটার। আর যেগুলো নামে, ইংরেজিতে সেগুলোকে বলে ল্যান্ডার। আরও নানান নভোযান আছে, তবে আমাদের এ আলোচনায় এটুকু জানলেই চলবে।
চাঁদের উল্টো পাশে নামা, সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা ও খতিয়ে দেখা ২০১৩ সাল পর্যন্তও ছিল দূর অতীত। এতই দূর অতীত যে ২০১১ সালে চাঁদের উল্টো পাশ নিয়ে জনপ্রিয় ধারার একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে মার্কিন মুলুকে। ট্রান্সফরমারস সিরিজের তৃতীয় কিস্তি—ট্রান্সফরমারস: ডার্ক অব দ্য মুন। তবে সেখানে যেমন দেখানো হয়েছে, সে রকম কোনো গাড়িরূপী এলিয়েন যে চাঁদে লুকিয়ে নেই, সেটুকু আমরা জানি। তবু সেখানকার মাটিতে নিশ্চয়ই অনেক কিছু লুকিয়ে আছে, লুকিয়ে আছে চাঁদের অন্ধকারের খাদের গহিনে। সেগুলো জানার জন্য প্রয়োজন সেখানে ল্যান্ডার পাঠানো। আর এই কাজ সবার আগে করেছে চীন।
শাঙ-ই—চৈনিক চন্দ্রদেবী। এই দেবীর নামে চীন চাঁদ অভিযানের নাম রেখেছে শাঙ-ই। ২০০৭ ও ২০১০ সালের অক্টোবরে শাঙ-ই–১ এবং শাঙ-ই–২ চাঁদের চারপাশে ঘুরে দেখেছে। সবিস্তার তৈরি করেছে চাঁদের মানচিত্র। তারপর ২০১৩ সালে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে শাঙ-ই–৩। ২০১৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর এটি চাঁদের উল্টা পাশে নেমেছে। ২০১৮ সালে চীন শাঙ-ই–৪ নামের আরেকটি নভোযান পাঠিয়েছে চাঁদের উল্টো পাশে। শুধু তা–ই নয়, শাঙ-ই–৫ টি ১ এবং শাঙ-ই–৫ অভিযানে চাঁদের নমুনা পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে চীন। বর্তমানে তাদের বেশ কিছু রোবট নভোযান পাঠানোর পরিকল্পনা আছে। সেই সঙ্গে ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে নভোচারী পাঠানোর জোগাড়যন্তর করছে চীন।
অর্থাৎ চীন শুরু করেছে দেরিতে, কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড বেগে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যেমন মঙ্গল জয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে, চাঁদের চারপাশে স্টেশন বানাতে চাচ্ছে, চীন কি সেটা করতে পারবে?
যুক্তরাষ্ট্রের সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো চীন এ ক্ষেত্রে জুটি বেঁধেছে রাশিয়ার সঙ্গে। রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে তারা বানাতে চাইছে ইন্টারন্যাশনাল লুনার রিসার্চ স্টেশন। শুধু তা-ই নয়, অনেকগুলো দেশকে তারা সদস্য হতে প্রস্তাবও দিয়েছে। এ প্রস্তাবে ইতিমধ্যেই সাড়া দিয়েছে পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। আরব আমিরাত মানে আবুধাবি, দুবাই, শারজা, আজমান, ফুজাইরাহ, রাস আল খাইমাহ ও উম্ম আল কোয়াইন। আরব আমিরাত মানে ভালো অর্থনৈতিক সহায়তা। এ রকম একটি স্টেশন নির্মাণে এর প্রয়োজন বোধ হয় আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।
ওদিকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের কার্যক্ষমতা ফুরিয়ে আসছে। ২০৩০ সালে এটির মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। চীন ওদিকে নিজেদের জন্য মহাকাশ স্টেশন বানিয়ে নিয়েছে—তিয়াংগং। সব মিলে বেশ আটঘাট বেঁধেই নেমেছে দেশটি, বলা বাহুল্য।
এ হিসেবে রাশিয়া একরকম অকেজোই বলা যায় বর্তমানে। না, গবেষণায় পিছিয়ে নেই রাশিয়া। রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমস নিয়মিত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে। চাঁদ, মঙ্গল গ্রহ কিংবা মহাকাশবিষয়ক গবেষণাও চালিয়ে যাচ্ছে পুরোদমে। তবে নিজেদের স্বতন্ত্র মিশন, চাঁদ বা মঙ্গল জয়ের সে রকম উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো চীন এ ক্ষেত্রে জুটি বেঁধেছে রাশিয়ার সঙ্গে। রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে তারা বানাতে চাইছে ইন্টারন্যাশনাল লুনার রিসার্চ স্টেশন। শুধু তা-ই নয়, অনেকগুলো দেশকে তারা সদস্য হতে প্রস্তাবও দিয়েছে। এ প্রস্তাবে ইতিমধ্যেই সাড়া দিয়েছে পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
৪.
মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বড় করে আসবে যুক্তরাষ্ট্রের নাম। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা কাজ করছে পুরোদমে। বর্তমানে তাদের সবচেয়ে আলোচিত প্রকল্প আর্টেমিস। যে প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৫০ বছর পর মানুষ আবার চাঁদে ফিরবে। তবে এটি নাসার একক প্রকল্প নয়। নাসার সঙ্গে এ প্রকল্পে কাজ করছে ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসা, জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা জাক্সা এবং কানাডার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা—কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (সিসা)।
ইতিমধ্যেই আর্টেমিস–১ অভিযান সফল হয়েছে। নভোচারীহীন এ অভিযানে আর্টেমিসের সক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। আর্টেমিস–২-এ চার নভোচারী চাঁদের চারপাশ ঘুরেফিরে আসবেন। আর্টেমিস–৩ নভোচারীদের নিয়ে চাঁদে নামবে ২০২৫ সাল নাগাদ। এর মাধ্যমে প্রথম নারী নভোচারী চাঁদে পা রাখবেন।
আর্টেমিস প্রকল্পে যে রকেট ব্যবহৃত হবে, তার নাম এসএলএস। এটার মাথায় যে নভোযানটি থাকবে, যেটা মানুষকে লুনার গেটওয়েতে নিয়ে যাবে, মানুষবাহী সে যানটির নাম ওরিয়ন। এটা স্পেসএক্স বানিয়েছে। লুনার গেটওয়ে থেকে মানুষকে চাঁদে পৌঁছে দেবে যে ল্যান্ডার, সেটা নিয়ে নিলাম হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। চাঁদের চারপাশে বানানো হবে লুনার গেটওয়ে নামের একটি মহাকাশ স্টেশন। এতে নভোচারীরা থাকবেন, গবেষণা করবেন। যাঁরা চাঁদে নামবেন, তাঁরা প্রথমে লুনার গেটওয়েতে গিয়ে বিশ্রাম নেবেন। পরে সেখান থেকে ল্যান্ডারে করে নামবেন চাঁদে। ধীরস্থিরভাবে নাসা ও সংশ্লিষ্ট মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলো এ লক্ষ্যে এগোচ্ছে। চাঁদে একটি কলোনি গড়ে তোলার ইচ্ছা আছে তাদের, অন্তত নিয়ন্ত্রিতভাবে, সীমিত পরিসরে হলেও। তা ছাড়া চাঁদ থেকে তারা আর্টেমিস প্রকল্পের মাধ্যমেই ২০৪০ সালের মধ্যে পা রাখতে চায় মঙ্গলে। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে এই মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলো।
সংক্ষেপে লিখেছি, তবে এই আলোচনা আসলে অনেক বড়। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানা যাবে বিমান নাথের ‘চাঁদ থেকে মঙ্গলে পাড়ি’ (পৃষ্ঠা ২২-২৫) লেখাটিতে। তবু কিছু বিষয় বলা প্রয়োজন। মহাকাশ গবেষণা ও চন্দ্র জয়ের এই প্রতিযোগিতা প্রযুক্তিক্ষেত্রে এগিয়ে নিচ্ছে মানুষকে। নাসা যেমন লুনার গেটওয়ে বা সেখান থেকে চাঁদে নামার জন্য নভোযান কে তৈরি করবে, এ নিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গেও কাজ শুরু করেছে। ফলে বেসরকারি খাতেও শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। এতে শীর্ষে আছে জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন এবং ইলন মাস্কের স্পেসএক্স।
আর্টেমিস প্রকল্পে যে রকেট ব্যবহৃত হবে, তার নাম এসএলএস। এটার মাথায় যে নভোযানটি থাকবে, যেটা মানুষকে লুনার গেটওয়েতে নিয়ে যাবে, মানুষবাহী সে যানটির নাম ওরিয়ন। এটা স্পেসএক্স বানিয়েছে। লুনার গেটওয়ে থেকে মানুষকে চাঁদে পৌঁছে দেবে যে ল্যান্ডার, সেটা নিয়ে নিলাম হয়েছে। প্রতিযোগিতায় আর্টেমিস–৩ অভিযানের ল্যান্ডার বানানোর দায়িত্ব পেয়েছে স্পেসএক্স। আবার আর্টেমিস–৫-এর ল্যান্ডার বানানোর দায়িত্ব পেয়েছে ব্লু অরিজিন। চাঁদে নামার পরে সেখানে কলোনি বানানো হলে সেটারও অর্থনৈতিক প্রয়োগ এবং তা নিয়ে প্রতিযোগিতাও দেখা যাবে। তবে তার এখনো দেরি আছে।
ওদিকে স্পেসএক্স স্টারশিপ নামের একটি নভোযান বানাচ্ছে; যেটি থেকে রকেট ও নভোযানটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে না (বর্তমানে এমনটাই করা হয়)। প্রতিটি নভোযানেই রকেট ও মানুষবাহী অংশটি থাকবে। ইলন মাস্ক দাবি করছেন, এটি মানুষকে মঙ্গলে পৌঁছে দিতে পারবে সফলভাবে। আসলেই পারবে কি না, সেটা জানার জন্য অবশ্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও অনেকটা সময়।
মহাকাশ গবেষণার নানা ক্ষেত্রে, নভোদুরবিন থেকে বিভিন্ন গ্রহে অরবিটার বা ল্যান্ডার পাঠানো, এমনকি ভয়েজারের সৌরজগতের সীমানা পেরিয়ে যাওয়া—সবখানেই রয়েছে নাসার নাম। তা ছাড়া গ্রহাণুতে যদি খনিজ আহরণের কাজ শুরু হয়, এ দৌড়েও নাসা পিছিয়ে থাকবে না। সেই ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতেই নাসার ‘নিয়ার শুমেকার’ নেমেছে মঙ্গলকে ঘিরে ঘূর্ণমান গ্রহাণু ইরোসের বুকে। এরপর নাসার একাধিক নভোযান নেমেছে বিভিন্ন গ্রহাণুতে।
একসময় দেশগুলোর আকাশের সীমানা নির্দিষ্ট ছিল না। মানুষ উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেছে, তাই আকাশসীমাও নির্ধারিত হয়েছে। মহাকাশে নভোযান পাঠাতে শুরু করার পর আকাশসীমা ওপরে কতটুকু পর্যন্ত বিস্তৃত, তা নির্ধারিত হয়েছে।
এবার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের কথা বলা যাক। আগেই বলেছি, এর মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু গবেষণার জন্য এ স্টেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি ২০২৩ সংখ্যায় এ বিষয়ে বিস্তারিত উঠে এসেছে। অতি সরল করে বললে, কিছু গবেষণা মহাকাশেই করে দেখতে হয়, করার প্রয়োজন হয়। মহাকাশ অভিযানে এসব গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। এ ছাড়া পৃথিবীবিষয়ক নানা গবেষণার জন্যও এ নভো স্টেশন কাজে লাগে। ২০৩০–এর পর এ ধরনের গবেষণা চালিয়ে নিতে নতুন নভো স্টেশন বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে নাসা। এ জন্য বেসরকারি তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তারা কাজও করছে। ব্লু অরিজিন, ন্যানোর৵াকস এলএলসি এবং নরথর্প গ্রুমান সিস্টেম করপোরেশন। আশা করা হচ্ছে, ২০৩০-এর আগেই এই প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের ভালো বিকল্প নির্মাণে নাসাকে সাহায্য করতে পারবে।
মহাকাশ জয়ের এই প্রতিযোগিতায় অবধারিতভাবেই ভবিষ্যতে উঠে আসবে চাঁদের বিভিন্ন অংশের মালিকানা, বিভিন্ন গ্রহাণুতে খনিজ আহরণসহ নানা বিষয়। বর্তমানে চাঁদের কোনো অংশের মালিকানা নেই নির্দিষ্ট কোনো দেশের। চাঁদ, অন্যান্য গ্রহ ও গ্রহাণুতে সব দেশই যেকোনো কাজ করতে পারবে মানবতার কল্যাণের জন্য—১৯৬৭ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার মধ্যকার এক চুক্তিতে এ কথাই আছে। ভবিষ্যতেও কি তা থাকবে?
একসময় দেশগুলোর আকাশের সীমানা নির্দিষ্ট ছিল না। মানুষ উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেছে, তাই আকাশসীমাও নির্ধারিত হয়েছে। মহাকাশে নভোযান পাঠাতে শুরু করার পর আকাশসীমা ওপরে কতটুকু পর্যন্ত বিস্তৃত, তা নির্ধারিত হয়েছে। কারমান রেখা—সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটার ওপরের এ রেখার ওপরের মহাকাশ আজও সবার জন্য মুক্ত। ভবিষ্যতেও কি তা-ই থাকবে? এ প্রশ্নের নিশ্চিত জবাব দেওয়ার উপায় নেই। তবে ইতিহাস কী বলছে, সে কথা তো বললাম। বাকিটা বুদ্ধিমান পাঠকের ভাবনার জন্যই তোলা থাকুক।
মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের মাধ্যমে। অসুস্থ এ যুদ্ধ শেষ হতে হতে মহাকাশ জয় মানুষের কল্যাণে অবদান রাখতে শুরু করেছে। মহাকাশ অভিযানের জন্য নির্মিত অনেক প্রযুক্তি—ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট বা আইসি থেকে শুরু করে ফ্রাইপ্যান—আমাদের জীবনকে সহজ করছে প্রতিনিয়ত। আর বর্তমানের মহাকাশ জয়ের প্রচেষ্টা অনেকাংশেই সহযোগিতার। প্রতিযোগিতা আছে, তবে সুস্থ এ প্রতিযোগিতা মানুষকে এগিয়ে নিচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে, মানুষ ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে গ্রহান্তরে। জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সহজ করছে আমাদের জীবন। এটি যদি ক্ষতিকর না হয়ে ওঠে, তবে এ রকম স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা আসলে মন্দ নয়, কী বলেন?